ইউরোপ ভ্রমণ (ষষ্ঠ পর্ব) : লুসর্ন হয়ে জার্মানি এক রাত্রি তারপর অস্ট্রিয়া
বিজিত কুমার রায়
প্রথম ভাগ
সকাল সকাল তৈরি হয়ে, ব্যাগ সুটকেস গুছিয়ে ব্রেকফাস্ট হলে। তারপর ব্রেকফাস্ট সেরে বাসে। সকাল ৭.৩০ মিনিটে বাস ছাড়লো লুসর্নের দিকে। সকাল ১০টার সময়ে পৌঁছালাম একটি সুন্দর লেকে যার চারদিকে বরফে ঢাকা পাহাড়।
সুইজারল্যান্ড তার আশ্চর্যজনক হ্রদের জন্য বিখ্যাত। বিশেষ গৌরব হ’ল লুসর্ন হ্রদ, যা প্রায়শই দেশের ভিজিটিং কার্ড নামে পরিচিত। লুসর্ন হ্রদকে অন্যথায় Firvaldstetsky বলা হয়। এটি সুইজারল্যান্ডের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। ঐতিহাসিকভাবে, এই জলাশয়ের তীরে চারটি সেনানিবাস ছিল: লুসর্ন, উরি, শোয়েজ এবং আনটারওয়াল্ডেন।
এই পুকুরটি প্রায়শই সুইজারল্যান্ডের ভিজিটিং কার্ড নামে পরিচিত কারণ হ্রদটি খুব মনোরম জায়গায় রয়েছে। চারদিক থেকে, লুসর্ন হ্রদ, সুন্দর বন এবং তুষারে ঢাকা পর্বতশৃঙ্গ দ্বারা বেষ্টিত।
লেক লুসর্নের জল বিশ্বখ্যাত বিখ্যাত জেনেভা লেকের চেয়ে অনেক বেশি শীতল। যাইহোক, এটি বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের ফিরাওয়াল্ডস্ট্যাট জলাশয়ের পরিষ্কার জলে সাঁতার কাটা থেকে বিরত রাখে না। লেক লুসর্নে, জলের তাপমাত্রা 20-23 ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা অর্জন করতে পারে। হ্রদের জলের এই তাপমাত্রাটি অবাক করার মতো নয়, কারণ এই পুকুরটি প্রবাহিত হচ্ছে।
রাইন নদী এক আশ্চর্য হ্রদের জলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। জলবায়ু সমিচীন। গরমে পর্যটক ক্লান্ত হয় না।
লুসর্ন হ্রদে চারটি প্রধান অববাহিকা রয়েছে, যা সংকীর্ণ স্ট্রেস দ্বারা সংযুক্ত। বিজ্ঞানীরা মনে করেন হিমবাহের পর্বতশৃঙ্গ থেকে নেমে যাওয়ার পরে এই হ্রদের বেসিনটি তৈরি হয়েছিল। হ্রদের জলের রঙে একটি নীল বর্ণ রয়েছে। পাইলেটাস, টাইটলিস এবং রিগা এর মনোরম পর্বতশৃঙ্গগুলি লুসর্ন হ্রদের উপকূলে অবস্থিত। লেক লুসর্নের তীরে সর্বাধিক বিখ্যাত রিসর্টগুলি উইটসনাউ এবং ওয়েগিস হিসাবে বিবেচিত হয়। এই শহরগুলিতে,পর্যটকদের বাইরের কাজের জন্য সমস্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। রেস্তোঁরা এবং হোটেল চেইনগুলি খুশিতে তাদের দরজা দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করবে। শহরগুলির মধ্যে একটি বার্তা রয়েছে। আপনি নৌকায় করে এক রিসর্ট থেকে অন্য রিসর্টে লেকে উঠতে পারেন।
এটিকে শপার্স প্যারাডাইস ও বলা হয় কারণ এখানে সুইজারল্যান্ডের ঘড়ি, চকোলেট ইত্যাদি প্রচুর পাওয়া যায়। আমরাও উইন্ডো শপিং করলাম আর লেকের চারধারে ঘুরে এলাম।
এরপর বর্ডার পার করে ঢুকলাম জার্মানিতে। এখানে প্রথমে এলাম শেলফেনহাউসেন বলে একটি জায়গাতে যেখানে রাইন নদী গর্জে পড়ছে একটা জলপ্রপাত হয়ে। টুরিস্টদের জন্য সুন্দর সাজানো ব্যবস্থা। রেলিং দিয়ে দেখার ব্যবস্থা।
এরপর আমরা ঢুকলাম জার্মানির বিখ্যাত ব্ল্যাক ফরেস্টে যেখানে পাতা এতো গাঢ় সবুজ যে দূর থেকে কালো মনে হয়।
এই ব্ল্যাক ফরেস্টের সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে অনেকটা যাওয়ার পর এলাম দ্রুব্বা বলে একটি স্থানে যেটি জগৎ প্রসিদ্ধ কাক্কু ক্লকের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও রয়েছে নানারকম পুতুল। কাক্কু ঘড়ি আছে ২০০০০ থেকে দুই তিন লাখ অবধি দামের। আমাদের দুই একজন ছোট সাইজের কাক্কু ঘড়ি কিনলেন। ওরা প্রপার প্যাকিং করে আপনার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে।
জার্মানিতে অবস্থিত এ বনটির নাম ‘ব্ল্যাক ফরেস্ট’। সবুজ বন না রেখে এ বনের নাম ব্ল্যাক ফরেস্ট কেন রাখা হল? এ প্রশ্ন অনেকের মনে হতে পারে। হয়ত বা ভাবতে পারেন এ বনে খারাপ কিছু আছে যে কারণে বনের নাম করা হয়েছে কালো বন। আসলে তা নয়। জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত পর্বতময় এই বনভূমির নাম ব্ল্যাক ফরেস্ট বা কালো বন রাখা হয়েছে এই বনের অপরূপ সৌন্দর্যের কারণে।
এত ঘন সবুজ এই পাতা যে পাহাড় ও বন একসাথে মিশে এখানে তৈরি করেছে এক অনাবিল পরিবেশ। লম্বা লম্বা ঘন সবুজ গাছ আর উঁচু উঁচু পাহাড়ের কারণে এই বনটি ব্ল্যাক ফরেস্ট নামে পরিচিতি লাভ করেছে। ব্ল্যাক ফরেস্টের রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। শেষ বরফ যুগের সময় বর্তমান ব্ল্যাক ফরেস্ট তুষার আচ্ছাদিত ছিল। পরে এই বরফ হিমবাহ আকারে নেমে এসে তৈরি করেছে অপরূপ সৌন্দর্যের কয়েকটি নদী। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম দানিয়ুব, দি ইনজ, দি কিনজিগ, দি মুরগ, দি নেগোল্ড, রেন্চ। এই বনের মূল বৃক্ষগুলোর মধ্যে রয়েছে পাইন ও দেবদারু জাতীয় গাছ। এ বনের গাছগুলোর ডালপালা কম এবং পাতা সরু সুচালো। ব্ল্যাক ফরেস্ট আফ্রিকার বনের মতো ঘন ও নিবিড় নয়। গাছগুলো একটু সাজানোগুছানো ও পরিপাটি।
এই সুন্দর বনটি বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। এক সময় মানুষের নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বনটিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আকাশ থেকে এসিড বৃষ্টি বর্ষিত হবার কারণে। বনটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ১৯৯৯ সালে এ এলাকায় সংঘটিত ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে। এই ঝড়ে অন্তত ১০০ একর বনভূমি চুরমার হয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে মজার বিষয় হল এই বনে কোনও হিংস্র প্রাণী নেই। এ বনের বন্যজীবের মধ্যে রয়েছে গরু, উট, ছাগল, ভেড়া, ঈগল, পেঁচা, অস্ট্রিচ পাখি ইত্যাদি। এ বনে খুব বড় আকারের কেঁচো ও শিয়াল দেখতে পাওয়া যায়। শিয়ালগুলো এতই বড় আকৃতির যে সেগুলো ঘোড়ার সমান বড়। অতীতে এই এলাকার লোকেরা এই শিয়াল দিয়ে বোঝা বহন করাত। ব্ল্যাক ফরেস্ট এলাকায় রয়েছে একটি বিশেষ ছুটির দিন। এদিন সবাই দলবেঁধে রাস্তায় নেমে আসে এবং আদিবাসীদের মুখোশ পরে আনন্দ উল্লাস করে। আকর্ষণের বিষয় হচ্ছে, এই বনে প্রায় ২৩ হাজার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তৈরি করা হয়েছে পর্যটন নেটওয়ার্ক-যা পর্যটকদের বনের মধ্যে সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদান করে। এই পর্যটন নেটওয়ার্ক পরিচালনার জন্য সেখানে রয়েছে প্রচুর লোকবল ও পর্যটন ব্ল্যাক ফরেস্ট সোসাইটি নামের একটি সংগঠন। এ বনে আছে অনেক সুন্দর সুন্দর লেক ও মনোরম ঝরনা। লেকগুলোতে দেখতে পাবেন সবুজের মাঝে স্নিগ্ধ জলের উপর পাথর ছড়িয়ে থাকার অপরূপ সৌন্দর্য। পাহাড়ের চূড়া থেকে গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনার দৃশ্য দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হয়ে যাবেন। বনের মধ্যে সবুজ বেষ্টনীর মাঝে তৈরি করা হয়েছে নয়নাভিরাম বিভিন্ন কটেজ। যেখানে পর্যটকরা অবস্থান করতে পারেন। এই বনে আছে সুন্দর কয়েকটি জলপ্রপাত। যার মধ্যে একটি অন্যতম জলপ্রপাতের নাম ট্রিবার্গ। জলপ্রপাতটি খুব উঁচু না হলেও এটি জার্মানির একটি বিখ্যাত জলপ্রপাত। জলপ্রপাতটি পর্যটকদের দারুণভাবে মুগ্ধ করে। ব্ল্যাক ফরেস্টের মধ্যে আছে একটি জাদুঘর, যেখানে দেখানো হয়েছে ১৬ ও ১৭ শতকের জার্মান কৃষকদের জীবন। ঘড়ির ইতিহাস নিয়ে ব্ল্যাক ফরেস্টে আছে একটি ঘড়ি জাদুঘর।
এরপর ওখানকার ক্যান্টিনে ওদেশী লাঞ্চ হলো যার মধ্যে বিখ্যাত ব্ল্যাক ফরেস্ট চেরি কেক ও ছিল।
ঠিক বিকেল চারটার সময়ে আমরা জড়ো হলাম বাইরে রাখা দুই তলা উঁচু কাক্কু ক্লক এর সামনে। চারটের সময়ে ঘড়ির ওপরের দরজা খুলে প্রায় তিন চার ফুট উঁচু পুতুল বেরিয়ে এসে ঘন্টা বাজালো আর সাথে সাথে একদল পুতুল তালে তালে নাচলো। পরে আবার লাইন করে ভেতরে ঢুকে গেলো।
দ্বিতীয় ভাগ
এরপর তিন ঘন্টা জার্নি করে যাওয়া হলো হেইডেলবার্গ শহরে যেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একদম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পরে আবার তৈরি হয়েছে। পায়ে হেঁটে ঘোরা হলো সুন্দর বাড়িগুলি (পুরানো স্টাইলে তৈরি) দেখতে।
হাইডেলবার্গ জার্মানির প্রাচীনতম শহর। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। জার্মানির তৃতীয় বৃহত্তম প্রদেশ ব্যাডেম-ভার্টেমবার্গে অবস্থিত। ছবির মতো সাজানো-গোছানো শহর বললেও কম বলা হবে। আমার মনে হয়েছিল আমি যেন ক্যালেণ্ডারের মাঝে দাঁড়িয়ে। শহরের যে-কোন অংশ দিয়ে ক্যালেণ্ডার-নির্মাতারা ছবি করতে পারে। শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে নেকার নদী। চারিদিকে অনুচ্চ পাহাড়। মাঝে নেকার নদী তিরতির করে বয়ে চলেছে। দুপারের মধ্যে অনেক সংযোগকারী সেতু আছে। সবচেয়ে পুরাতন সেতুটি বারশ চুরাশি সালে তৈরি হয়েছিল। সেতুটির কার্ল থিওডর সেতু নামে খ্যাত। কাঠের সেতু ছিল সেটি। বারবার ভেঙে যেত বলে সতেরশ আটাশি সালে সেটিকে ইট-পাথরে পুনর্নিমিত করা হয়েছে। সেতুর দুপারে সুদৃশ্য ফটক আছে যার নির্মানশৈলী বেশ দৃষ্টিনন্দন। অন্যান্য সেতুগুলিও অপেক্ষাকৃত আধুনিক হলেও দেখার মতো। ফটকের একদিকে বানরের এক স্টিলমূর্তি আছে। পাহাড়ের উপর ক্যাসল বা দুর্গ আছে। এই দুর্গটির নির্মানকার্য তেরশ আটানব্বই সালে আরম্ভ ও চৌদ্দশ দশ সালে সমাপ্ত।
রাস্তাতে ৮টার সময়ে ভারতীয় রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে পৌঁছালাম হাপপেনহাইম শহরে একটি হোটেলে। চেক ইন করে রুমে। কাল সকালে উঠে, যাওয়া হবে অস্ট্রিয়াতে। গুটে নাকট।
সকাল সকাল উঠে তৈরি হয়ে, প্যাক করে আর ব্রেকফাস্ট সেরে রওয়ানা হলাম অস্ট্রিয়ার উদ্দেশ্যে।
সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য আর সাজানো গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রায় ৫ ঘন্টার বাস জার্নি। মাঝে একটি গ্যাস স্টেশনে নেমে প্যাকড লাঞ্চ হলো। এরপর আমরা পৌছালাম স্বরভস্কি বলে একটি সংগ্রহালয়ে।
এটি পৃথিবী বিখ্যাত ক্রিস্টাল তৈরির কারখানা সংগ্রহালয়। অপূর্ব ও নয়নমনোহারি সংগ্রহ এবং দামও আকাশ ছোঁয়া।
এরপর রওয়ানা দিলাম অস্ট্রিয়ার ইন্সব্রুকের দিকে। ইন্সব্রুক একটি ছোট শহর ইন্স নদীর ধারে আর অস্ট্রিয়ান আল্পসের কোলে। শহরটি পায়ে হেঁটে দেখা হলো।
প্যালেস চার্চ সুন্দর রাস্তার ধারে ক্যাফে ইত্যাদি দ্রষ্টব্য।
এরপর অস্ট্রিয়ান আল্পসের একটি স্কি রিসোর্টে যাওয়া হলো। সেখানেই রাত্রিবাস। ভ্যালির থেকে চারিদিকে অপূর্ব সুন্দর পাহাড়ের দৃশ্য।
পরিষ্কার হয়ে রুম থেকে যাওয়া হলো ওদের বিশাল কনফারেন্স কাম ডাইনিং রুমে যেখানে কক্স এন্ড কিংসের সাতটা গ্রূপের একসাথে ককটেল ডিনার হলো। দারুন ভালো কন্টিনেন্টাল খাবার আর সাথে যথেচ্ছ ড্রিংকস। এছাড়া হৈ হৈ করে নাচা গানা। সুন্দর কাটলো সন্ধ্যাবেলা।
ঘরে ফিরে সোজা বিছানা কারণ কাল লম্বা জার্নি ভেনিসের দিকে।
**********************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতি
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে। রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ-পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।