উরাল নদীর কাশফুল
মোতাজিদ খুররম
যাচ্ছি উরাল নদী দিয়ে কাস্পিয়ান সাগরের দিকে। নদীটা কাজাখস্তানে এঁকেবেঁকে গিয়ে পড়েছে কাস্পিয়ান সাগরে। সাগরে গালিয়া নামে একটা জাহাজ আছে। জাহাজটা তেল অনুসন্ধানের কাজ করছে। ঐ জাহাজটাই এবার আমার গন্তব্য।
বারো-তেরো বছর ধরে আমি একটা অ্যামেরিকান এক্সপ্লোরেশন কোম্পানিতে কাজ করছি। কোম্পানির নাম ভেরিতাস জিওফিজিক্যাল। আমাদের সাইসমিক ক্রু পৃথিবীর নানা দেশে যায়,মাটির নিচে কোথায় তেলের খনি আছে খুঁজে বের করে। আমিও ঘুরে ঘুরে সেইসব দেশে গিয়ে কাজ করি। এই মুহূর্তে কাস্পিয়ান সাগরে কাজ করছে একটা দল। আমি সেখানে যাচ্ছি মাস দুয়েকের জন্য। কাজ শেষে দেশে ফিরে যাবো ছুটি কাটাতে। তারপর আবার অন্য কোথাও পাঠাবে কোম্পানি আমাকে অন্য কোনো দেশের জঙ্গলে,পাহাড়ে কিংবা মরুভূমিতে।
এবারে কাস্পিয়ান যাত্রায় সঙ্গে আছে সেরিক। সে আমার কাজাখ ফ্রেন্ড,ফিলসফার এবংগাইড। একটু সকাল সকাল রওনা দেবো ভেবেছিলাম। ক্যাপ্টেন রাখমাতের জন্য সেটা আর হলো না। সে আমাদের ইয়টের ক্যাপ্টেন। সাদা ধবধবে দোতলা ইয়ট ‘নুরিয়া’ আমাদের নিয়ে যাবে কাস্পিয়ানে। আমি আর সেরিক ছ’টার সময় এসে দেখি রাখমাত ঘুম থেকেই ওঠেনি। যাত্রার কোনো প্রস্তুতিও নেয়নি। চোখ ডলতে ডলতে সে জানালো ইয়টে খাবার,পানি কিছুই নেই।
আমি আর সেরিক গেলাম সেসব কিনতে। প্রথম দোকানে খেলাম কুকুরের ধাওয়া। জায়গাটা ছোট্ট একটা ঘুমন্ত গ্রামের মতো, নাম আতরিয়াউ। দোকানের গায়ে লাগানো বাড়ি। বাড়ির পাঁচিলে টিনের দরজা। এত সকালে কেউ জাগেনি। দোকানটা বন্ধ দেখে দরজা ঠেলে ‘হ্যালো কেউ আছেন’ বলতে বলতে আমরা ঢুকেছিলাম বাড়ির উঠোনে। অমনি ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এলো একটা কুকুর। ভীষণ দর্শন কালো কুকুর!
‘ওরে বাবারে’ বলে দরজার কাছে ঠেলাঠেলি শুরু করে দিলাম আমি আর সেরিক। দু’জনেই এপাশে চলে আসার চেষ্টা করছি,আমি ছিলাম পিছনে। চলে এসেছি প্রায়,ডান পা’টা তখনো ভেতরে ছিল,গোড়ালি লক্ষ্য করে কামড় দিল কুকুর। পা সরিয়ে নিলাম ঠিকই,কিন্তু কুকুরের দাঁতে আটকে গেল জিন্সের নিচের অংশ। মানুষে-কুকুরে টানাটানি চলছে,টানাটানিতে ফরফর করে ছিঁড়ে গেল জিন্স। নীল কাপড়ের টুকরোটা থেকে গেল পাজি কুকুরের মুখে। টিনের দরজাটা কোনোমতে ওর মুখের উপর বন্ধ করে দিলাম। জোর বাঁচা বেঁচে গেছি- গোড়ালিতে কামড়টা লাগেনি। আমার ছেঁড়া প্যান্ট আর দুর্দশা দেখে সেরিক হেসেই খুন।
দূরের একটা দোকান থেকে সবকিছু কিনে ফিরলাম ইয়টে। উরাল নদী দিয়ে রাজহাঁসের মতো সাঁতার কেটে পশ্চিমের দিকে চললো নুরিয়া। নদী তেমন চওড়া নয়। বড় জোর ঢাকার ধানমন্ডি লেকের দ্বিগুণ হবে। দু’পাশে জেলেরা জাল ফেলেছে। নিয়ম হচ্ছে খুব ধীরে যেতে হবে,যাতে জেলেদের অসুবিধা না হয়। সেভাবেই ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ইয়ট,একটা স্ক্রিনে নদীর গভীরতা দেখা যাচ্ছে। পাঁচ-ছয় মিটার গভীর এখানে উরাল নদী। সাবধানে যেতে যেতে রাখমাত জানালো পানি তিন মিটারের কম হলে নুরিয়া আটকে যাবে।
গতরাতে সেরিকের ভাতিজার বিয়ে ছিল। কাজাখ বিয়ে এক মজার অভিজ্ঞতা। প্রচুর পানাহার হয়েছে সেখানে। ইভেন্ট ম্যানেজ করছিল সুদর্শন একটা ছেলে। অতিথিদের সঙ্গে সে নিজেও ভাসছিল ভদকার জোয়ারে। একসময় সে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল এই বলে- ‘আজকে আমাদের সঙ্গে একজন ইন্দুস গেষ্ট আছেন। তার নাম মিশা।’ আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘আমি ইন্ডিয়ান না,বাংলাদেশের। আমার নাম মিশা না…।’ কে শোনে কার কথা!
বর-কনের বিয়ের পোশাক ইউরোপিয়ান স্টাইলের-বরের গায়ে স্যুট-কোট,কনের সাদা ড্রেস। কনে প্রবেশ করলো ধীরে ধীরে,তাকে ঘিরে স্বচ্ছ সাদা কাপড়ের একটা ঘেরাটোপ। চারপাশ থেকে কিশোরী মেয়েরা সেটা ধরে আছে। ঘেরাটোপ সরে গেলে দেখা গেল কনের মুখে নেকাব। কনেপক্ষের সঙ্গে আছে একজন বালালাইকা বাদক। সে এগিয়ে এসে গান গেয়ে কনেকে অনুরোধ করলো তার নেকাব সরাতে। কনে নেকাব সরালে তার সুন্দর মুখটা দেখা গেল,করতালি দিয়ে গেষ্টরা তাকে অভিনন্দন জানালো। বর এতক্ষণ কনের পাশে পাশেই ছিল। এবার বরের বাবা-মা এগিয়ে গিয়ে বধূ বরণ করে নিলেন।
নেহারির মতো একরকম স্যুপ দিয়ে খাওয়া-দাওয়া শুরু হলো। নানারকম আইটেমের পর শেষ হলো ভেড়ার মাংস দিয়ে। আস্ত ভেড়ার রোস্ট রাখা আছে সামনে। সেখান থেকে গেষ্টরা কেটে কেটে নিয়ে আসছে যার যত বড় টুকরো দরকার। এতক্ষণ ছুরি-কাঁটা দিয়ে খাওয়া চলছিল। কিন্তু কাজাখ ট্র্যাডিশন অনুযায়ী ভেড়ার মাংস খেতে হয় হাতের পাঁচ আঙুল ব্যবহার করে। খাওয়ার পর গিফট দেওয়ার পালা। নিচু একটা টুলের উপর কারুকাজ করা সুন্দর একটা কাঠের বাক্স রাখা আছে।
ইভেন্ট ম্যানেজার যাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে,সে উঠে মঞ্চে বসে থাকা বর-কনের উদ্দেশ্যে দু’একটা শুভেচ্ছার কথা বলছে। তারপর ঝুড়িতে টাকা রাখছে। আমার পালা এলে ছেলেটা বললো,‘এই যে ইন্দুস ভদ্রলোক,মিশা…!’ শুধরে দিতে দিতে আমি তখন হাল ছেড়ে দিয়েছি। উঠে দাঁড়িয়ে বর-কনের শুভকামনা করলাম, সুখী জীবনের প্রার্থনা জানালাম,তারপর ঝুড়িতে গিফট রাখলাম। প্রত্যেক গেষ্টকে একটা করে উপহার দেওয়া হচ্ছে,কাউকে কারুকাজ করা ঝলমলে জ্যাকেট,রঙিন চাদর,অথবা অন্য কিছু। আমি পেলাম সুন্দর একটা টুপি। কাজাখ শিকারীরা এরকম ফারের টুপি মাথায় দিয়ে শিকার করতে যায়,ছবিতে দেখেছি। টুপিটা এত বড় আমার চোখ-মুখ প্রায় ঢাকা পড়ে গেল।
আমাদের বিয়েতে গায়ে-হলুদের সময় নাচ-গান আনন্দ হয়,এখানে বিয়ের অনুষ্ঠানেই নাচ-গান হলো। সবুজ ড্রেস পরা একদল মেয়ে একটা ইন্ডিয়ান নাচ করলো। সেরিক আমাকে ফিসফিস করে বললো তোমার অনারে ইন্ডিয়ান নাচ নাচছে ওরা। তুমি ওদের কিছু গিফট দিয়ো নাচের শেষে। আমি ওদের একজনের হাতে গিফট দিলাম। আনুষ্ঠানিক নাচ-গান শেষ হলো। বেশ রাত হয়েছে। হোটেলে ফেরার জন্য উশখুশ করছি মনে মনে- আগামীকাল খুব ভোরে আমার যাত্রা শুরু। দেখি বর-কনের আত্মীয়-স্বজনরা এবার ফ্লোরে এসে মাইক্রোফোন হাতে গান ধরলেন। ঘরোয়া অধিবেশন শুরু হলো। এই অধিবেশনের শিল্পী বর-কনের চাচা-মামা-মাসি ও পিসিরা। গেষ্টরা কেউ কেউ তাদেরও গিফট দিলেন গান শোনানোর জন্য। বুঝলাম ধন্যবাদ জানানোর কাজাখ রীতি এটা। টাকা বা গিফট এখানে বড় কথা না, যিনি গান গাইছেন তাকে সম্মান আর ভালোবাসা জানানো হচ্ছে এভাবে।বাঙালিদের মতো কাজাখদেরও ‘আরেকটু খান’ ‘আরেকটু থাকেন’ এসব বলে বলে গেস্টকে আন্তরিকতা দেখানোর রীতি আছে। সেসব সেরে হোটেলে ফিরেছি অনেক রাতে। এখন ঘুম পাচ্ছে। তাই দু’তীরের দৃশ্য দেখা বাদ দিয়ে কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘন্টা দুয়েক পর যখন উঠলাম ইয়ট পৌঁছে গেছে সাগরের মুখে। বাঁ দিকের তীর ঘেঁষে যাচ্ছি আমরা। তীরে একটা চেকপোস্ট, কালাসনিকভ হাতে পাহারা দিচ্ছে কাজাখ সৈন্য। আমাদের ক্যাপ্টেন ভোঁ বাজিয়ে স্যালুট দিলো। কাস্পিয়ানে নামলো ইয়ট। ছুটলো এবার তীব্র গতিতে।
তারপর শুধু পানি-কূল নাই কিনারা নাই,শুধু পানি আর অথৈ পানি। একটা বই খুলে বসলাম। হঠাৎ পাখির ডাকে তাকিয়ে দেখি একটু দূরে মাস্তুলের উপর বসে আছে একটা পাখি। দেখতে চড়ুইয়ের মতো,তবে চড়ুই থেকে একটু বড়ো। অবাক হলাম এ আবার কখন এলো! খুশিও হলাম। সেরিক ওর কেবিনে ঘুমাচ্ছে,ক্যাপ্টেন আর তার সহকারী ইয়ট চালাচ্ছে, আমি এখানে একা। একটা সঙ্গী অন্তত পেয়ে গেলাম। পাখিকে জিজ্ঞেস করি-কীরে তুই কোথা থেকে এলি? পাখি জবাব দেয় চিঁউ চিঁউ! একটু পরপর সে কোথায় উড়ে যায়,আমি পড়ায় মন দিই,তারপর আবার চিঁউ চিঁউ শব্দে তাকিয়ে দেখি ফিরে এসে বসেছে মাস্তুলের উপর।
এদিকে গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে নুরিয়া। ক্যাপ্টেনের কাছে গেলাম। ওয়ারলেসে গালিয়াকে খুঁজছে ক্যাপ্টেন,‘গালিয়া! গালিয়া! কোথায় তুমি…?’ ইয়টের ইঞ্জিন বন্ধ,দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়,দুলছে ঢেউয়ের দোলায়। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি হলো গালিয়ার সাড়াশব্দ নাই। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো ক্যাপ্টেন। এদিক-ওদিক ইয়ট চালিয়ে আরও কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি হলো।
বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে খুঁজছে ক্যাপ্টেন। হঠাৎ সে চমকে উঠলো,বিড়বিড় করে বললো সর্বনাশ! আমি পাশেই ছিলাম,আমাকে বললো দেখো। বাইনোকুলারে দেখলাম দূরে একটা যুদ্ধজাহাজ দেখা যাচ্ছে। কাস্পিয়ান সাগরের চারপাশে আজারবাইজান,জর্জিয়া,তুর্কমেনিস্তান…এরকম অনেক দেশ। আমরা হয়তো ভুলে অন্য দেশের জলসীমানায় চলে এসেছি। যদি ধরে নিয়ে যায়,তাহলে খবর আছে। রাখমাত দ্রুত ইয়ট ঘুরিয়ে নিয়ে সরে যাচ্ছে।
অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। জানা গেল আমরা ভুল জায়গায় চলে এসেছি। যেখানে যাওয়া দরকার তার ঠিক উল্টো দিকে এসে পড়েছে ইয়ট। ‘কোঅর্ডিনেট ভুল ছিল।’ বললো রাখমাত। ‘এখন কী করি?’
‘গালিয়ার নতুন কোঅর্ডিনেটে যাওয়ার মতো তেল আছে তোমার কাছে?’ সেরিক জিজ্ঞেস করলো।
‘তা আছে’, ক্যাপ্টেন জবাব দিলো। ‘কিন্তু সেখানে গিয়েও যদি গালিয়াকে না পাই, তখন কী করবো? তখন আর ফেরার উপায় থাকবে না। মাঝ দরিয়ায় ভেসে বেড়াতে হবে,যতক্ষণ না কেউ এসে উদ্ধার করে।’
সেরিক আমার সঙ্গে পরামর্শ করলো। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম ফিরে যাওয়াই ভালো হবে। ফিরে চললো নুরিয়া। আবার গার্ডপোস্ট,আবার উরাল নদী…।
এবার উরালের চেহারা অন্যরকম। সূর্য ডুবছে,উরালের জলে সোনালী আলো। ধীরে ধীরে এগোচ্ছে নুরিয়া,গভীরতা মেপে মেপে। ইয়টের পিছনে ঘূর্ণি,জলে তোলপাড়,তার মধ্যে লাফিয়ে উঠছে বড় বড় মাছ। ইয়টের পিছে আসছে গাঙচিলের ঝাঁক-ডাইভ মারছে একের পর এক। নখে মাছ গেঁথে উঠে এলো একটা গাঙচিল। মাছের ভারে তার গতি কমে গেছে, প্রাণপণে ডানা ঝাপ্টে উঠে আসছে সে। তাকে ধাওয়া করলো আরও দু’টো গাঙচিল। কাড়াকাড়িতে মাছটা ঝপাস করে পড়ে গেল জলে। উরালের মাছ ফিরে গেল উরালে। চলতে থাকলো প্রকৃতিতে শিকারী-শিকার খেলা।
এইসময় আমার চোখে পড়লো কাশফুল। নদীর ডান পাড় দিয়ে ফিরছি আমরা,উল্টো পাড়ে দু’মানুষ সমান উঁচু সাদা কাশফুলের ঝোপ। চকিতে আমার মনে পড়ে গেল ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমার অপূর্ব দৃশ্য,কাশবনে অপূ-দুর্গার লুকোচুরি খেলা। সেই কাশফুল। নিজের শৈশবের কথা আমার মনে এলো-ফুলার রোডে ঘুড়ি উড়ানো শৈশব আমার!
স্মৃতিকাতর চোখে আমি তাকিয়ে থাকলাম উরাল নদীর কাশফুলের দিকে।
*******************************************
মোতাজিদ খুররম – জিও ফিজিসিস্ট,বাংলাদেশ