জ্যোতিরলিঙ্গ দেওঘর
বিজিত কুমার রায়
ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগনা জেলার দেবগৃহ অর্থাৎ দেবতার ঘর আজ হয়েছে দেওঘর। বৈদ্যনাথ ধাম নামেও সমধিক খ্যাত। রেল স্টেশনও বৈদ্যনাথ ধাম। দেব লিঙ্গের শিবের পাঁচ আঙুলের ছাপে জড়িয়ে রয়েছে পুরাণ কাহিনি। ৭২ ফুট উঁচু মন্দিরে দেবতা কামনা লিঙ্গ এখানে বৈদ্যনাথ নামে খ্যাত। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম বৈদ্যনাথ বা ভগবান শিবের মন্দিরটি এক গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু তীর্থ। ১৫৯৬ সালে এই মন্দির গড়েন রাজা পূরণমল। চকবন্দি, গোলাকার মন্দিরে পুষ্পমাল্যে ভূষিতদেবতার স্বরূপ দর্শন মেলে সন্ধ্যায় স্নান অভিষেক কালে। বিপরীতে ৯ অনাদি শিব ছাড়াও নানান দেবদেবী আছেন মন্দিরে। তেমনই আছে মন্দিরের উত্তরে ১৫০ সিঁড়ির ক্ষীরগঙ্গা দিঘি। ৬ কিমি দূরে গঙ্গা। ৫১ পীঠের এক পীঠ এই বৈদ্যনাথ ধাম, বিশ্বাস অনুযায়ী সতীর হৃদয় পড়েছিল এখানে।
শিবপুরাণের কাহিনি অনুসারে, ত্রেতাযুগে লঙ্কা অধিপতি রাবণ চেয়েছিলেন যে তার রাজধানী হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সকল শত্রুর থেকে মুক্ত। তার মনে হয়েছিল, যদি শিব সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু না করেন, তবে তা হওয়া সম্ভব নয়। তিনি শিবের তপস্যা শুরু করেন। শিব সন্তুষ্ট হয়ে তাকে একটি শিবলিঙ্গ লঙ্কায় প্রতিষ্ঠার জন্য দান করেন। শিব বলেছিলেন, লিঙ্গটি অন্য কোথাও যেন স্থাপন না করা হয় এবং অন্য কারোর হাতে না দেওয়া হয়। এমনকি লঙ্কায় যাত্রাপথেও কোথাও যেন না থামা নয়। রাবণ যদি অন্য কোথাও পৃথিবীতে এই লিঙ্গটি স্থাপন করেন, তবে সেটি সেখানেই চিরতরে থেকে যাবে। রাবণ খুশি হয়ে লিঙ্গটি নিয়ে লঙ্কার পথে যাত্রা করেন।
অন্যান্য দেবতারা এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করলেন। শিব যদি রাবণের সঙ্গে লঙ্কায় যান, তবে রাবণ অজেয় হবেন। তখন তিনি পৃথিবীর উপর অকথ্য অত্যাচার চালাবেন। তাই তারা রাবণকে ছলনা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। দেবতারা জলদেবতা বরুণকে রাবণের উদরে প্রবেশ করতে অনুরোধ করলেন। তখন কৈলাস পর্বত থেকে ফেরার পথে রাবণের মুত্রের বেগ পেল। তখন তিনি এমন কাউকে খুঁজতে লাগলেন, যাকে খানিকক্ষণের জন্য লিঙ্গটি ধরতে দেওয়া যায়। বিষ্ণু তখন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে রাবণের কাছে এলেন। রাবণ তার হাতেই লিঙ্গটি দিয়ে মুত্র ত্যাগ করতে বসলেন। কিন্তু মুত্র ত্যাগ করতে রাবণের অনেক সময় লাগল। এদিকে ব্রাহ্মণবেশী বিষ্ণু লিঙ্গটি মাটিতে স্থাপন করলেন। এই স্থানেই এখন বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ অবস্থিত। রাবণ লিঙ্গটি মাটি থেকে তোলার অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি একচুলও সেটি নড়াতে অসমর্থ হলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তিনি জোরে লিঙ্গটি নড়ানোর চেষ্টা শুরু করলেন। কিন্তু বুড়ো আঙুলের আঘাতে লিঙ্গের একটুকরো অংশ ভেঙে ফেলা ছাড়া আর কিছু করতে তিনি অসমর্থ হলেন। পরে অনুতপ্ত হয়ে তিনি কৃতকর্মের জন্য শিবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এদিকে রাবণ যে শিবলিঙ্গটি লঙ্কায় নিয়ে যেতে পারলেন না, তা দেখে দেবতারা আনন্দিত হলেন। রাবণ লঙ্কায় ফিরে গেলেন। কিন্তু তিনি রোজ এসে সেই লিঙ্গটি পূজা করে যেতেন। এমনভাবেই তিনি সারাজীবন বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের পূজা করেছিলেন। যেখানে রাবণ পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন সেটি বৈদ্যনাথ থেকে চার মাইল দূরে হরিলাজোরি নামে একটি জায়গা বলে লোকে বিশ্বাস করে। লিঙ্গটি মাটিতে রাখা হয়েছিল অধুনা দেওঘর শহরে। লিঙ্গটির নাম বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ।
অন্য একটি কাহিনি অনুসারে, রাবণের মৃত্যুর পর বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গটি অযত্নে পড়েছিল। বৈজু নামে এক উদ্ধত ব্যাধ এটিকে দেখতে পান এবং তার দেবতা বলে গ্রহণ করে রোজ পূজা শুরু করেন। তিনি এটিকে বৈজুনাথ বা বৈদ্যনাথ নাম দেন।
সারা ভারত থেকে তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে দেওঘরে আসেন পর্যটক, স্বাস্থ্যান্বেষীরা। স্টেশন রোড থেকে একটু দূরেই ক্লক টাওয়ার। দেওঘরের প্রাণকেন্দ্র ক্লক টাওয়ারকে ঘিরে জমে উঠেছে বাজারহাট। ক্লক টাওয়ার থেকে ১২ কিমি দূরে শহরের উপকণ্ঠে তপোবন। এ ছাড়া রয়েছে নওলাক্ষি মন্দির, বীর হনুমানের মূর্তি, কুণ্ডেশ্বরী নবগ্রহ মন্দির। তপোবনের ছোট্ট ভজন গুহায় বালানন্দ ব্রহ্মচারী মহারাজ তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেন বলে কথিত। জনশ্রুতি এখানে বাল্মিকী এসেছে, কুণ্ডে স্নান করেছেন সীতাও। দেওঘরে রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমও। যে কোনও দিন সকালে দেওঘর থেকে ২০ কিমি দূরে ত্রিকূট পাহাড় থকেও ঘুরে আসা যায়। পাহাড় চড়ার রোমাঞ্চ যেমন আছে, তেমনই পাহাড় চূড়ায় রয়েছে রোপওয়ে। গিরিশৃঙ্খল আর অরণ্যের যুগলবন্দি বারবার টানে পর্যটকদের। নানান জীবজন্তুরও দেখা মেলে। মন্দিরের পাশাপাশি নৈসর্গিক দৃশ্যের আবেদনও অসামান্য। পাশাপাশি ক্লক টাওয়ার থেকে ৪ কিমি দূরে অনুচ্চ নন্দন পাহাড়ও দেখে নেওয়া যায়। নন্দনের শিরে রয়েছে চিত্ত বিনোদনের জন্য মনোরঞ্জন পার্ক। এ ছাড়াও রয়েছে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আশ্রম সৎসঙ্গ নগর। ভক্তেরা আসেন দিনভর। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই আশ্রমের মূল কেন্দ্রও দেওঘরে।
ছবি ও তথ্যসূত্র সৌজন্যে অন্তর্জাল।
প্রায় এই একই নামে (বৈজনাথ) হিমাচলের কাংরা তে আছে। আবার মহারাষ্ট্রের পারলিতেও বৈজনাথ আছেন তাই জ্যোতিরলিঙ্গ নিয়ে দ্বিমত আছে। তবে বৈদ্যনাথ বেশি জনপ্রিয়।
আমরা পাঁচটি বন্ধু পরিবার এসেছিলাম ৪ দিনের বায়ু পরিবর্তন করতে মধুপুরে শেঠ ভিলাতে। এই নিরবিচ্ছিন্ন আড্ডার মধ্যে একদিন সকালে বেটার হাফেদের অনুরোধে তারা পাঁচ জন ও আমরা দুই দেহরক্ষী দেওঘর দর্শনে যাই। মন্দিরে পৌঁছে ভিড় ও তার পাশবিক ব্যবস্থাপনা দেখে স্তম্ভিত হই। তবুও ভোলে বাবার দর্শন অভিলাষে কোনোরকমে মহিলাদের নিয়ে ভিতরে পৌঁছাই। পূজা করা তো দুরস্থান, দাঁড়িয়ে থাকাও কষ্টকর। কোনো রকমে মহিলাদের দর্শন করিয়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে বেরিয়ে আসি।
এইরকম মন্তব্য করা হয়তো উচিত নয় দেবস্থান সম্পর্কে তবে আমার দেখা যতগুলি জ্যোতিরলিঙ্গ আছে তারমধ্যে সবচেয়ে খারাপ মন্দির ম্যানেজমেন্ট এখানে। ধাক্কাধাক্কি ও অনেক খারাপ ব্যাপার হয় পূজা দেওয়ার নাম করে। আমার দুই বারের অভিজ্ঞতাই খুব খারাপ। শিবজি আমার মাথায় থাকুন কিন্তু পাণ্ডাদের নোংরামির শিকার আমি হতে দিতে চাইনা আমার বোনেদের ও মেয়েদের।
**************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতি
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে। রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ-পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।