জ্যোতিরলিঙ্গ ভীমাশঙ্কর
বিজিত কুমার রায়
জ্যোতিরলিঙ্গ ভীমাশঙ্কর মন্দির পুনে থেকে ১২৭ কিমি দূরে সহ্যাদ্রী পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত, যা ভীমা নদীর উৎসস্থল। এই ভীমা নদী দক্ষিণপূর্ব দিকে গিয়ে রাইচুরের কাছে কৃষ্ণা নদীতে মিলেছে।
২০০৯ অথবা ২০১০ সালে পুনেতে আমার মেয়ের বাড়ীতে থাকার সময় আমরা ভীমাশঙ্কর দর্শনে যাই। সকাল বেলা ৫টার সময়ে রওয়ানা হয়ে যাওয়া হয় গাড়ীতে। সহ্যাদ্রি পাহাড়ের অপূর্ব সুন্দর রাস্তা। বর্ষাকাল বলে চারিদিক সবুজ। পুনে থেকে প্রায় ১২৭ কিমি দূরে সমুদ্রতল থেকে ৩৫০০ ফুট উঁচুতে, চারিদিকে পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে বহু প্রাচীন গ্রানাইট পাথরের মন্দির। ওপর থেকে কিছুটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে মন্দির প্রাঙ্গন। গর্ভমন্দিরে প্রবেশের আগে নন্দিশ্বরের মূর্তিকে প্রণাম জানিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরটা আলো আঁধারী। প্রদীপের আলোতে বিগ্রহ দর্শন। সামনে বেশ বড় গৌরীপট্টর মধ্যে মূল ভীমাশঙ্কর লিঙ্গ। এক হাতেরও কম উঁচু। লিঙ্গের মাথায় মাঝখানে সামান্য একটু ফাটলের মতো দেখা যায়। সেই ফাটলের মধ্যে দিয়ে খুব ক্ষীণ ধারায় জল উপচে উঠছে। পুরোহিতরা বলেন ওই লিঙ্গের একধারে মহাদেব আর অন্যধারে পার্বতী। মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে আসছে ভীমা নদী। এই নদী পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্ণা হয়ে পড়ে সমতলে কৃষ্ণা নদীতে মিশে যায়। পূজা সেরে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। প্রাকৃতিক পরিবেশ অপূর্ব। মন ভরে যায়।
ভীমাশঙ্করায় রুদ্ররূপায় মহাদেবায় নমো নমঃ।
বহুকাল আগে ডাকিনি নামে গভীর জঙ্গলে সহ্যাদ্রি পাহাড়ের উপর ভীমা নামে এক অসুরের বাস তার মা কর্কটির সাথে। দেবতা মানব সকলেই ছিল তাদের ভয়ে কম্পিত। কিন্তু তার জীবনের উদয় কোথা থেকে এই প্রশ্ন তাকে সদা সর্বদা জর্জরিত করতো। সে তার মাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করতো এই ব্যাপারে। শেষে আর না সহ্য করতে পেরে মা ভীমা কে জানায়, যে, সে লংকাধিপতি রাবনের ছোট ভাই কুম্ভকর্ণের পুত্র ও সে (কুম্ভকর্ণ) জঙ্গলে মা ও ছেলে কে পরিত্যাগ করে চলে যায়। কুম্ভকর্ণ কালাতিক্রমে বিষ্ণুর অবতার শ্ৰী রামের হাতে নিহত হয়। এই ক্রোধে, প্রতিশোধ স্পৃহাতে, ভীমা ব্রহ্মদেবের তপস্যায় মগ্ন হয়। তার তপস্যায় সন্তুষ্ট প্রজাপতি ব্রহ্মা তাকে প্রভূত শক্তির বরদান করেন। এই অসুরের অত্যাচারে ত্রিভুবনে ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে। এই অসুরের পরাক্রমে দেবরাজ ইন্দ্র পরাজিত হন। দেবাদিদেব শিবের এক অতি প্রিয় শিষ্য কামরূপেশ্বর কেও সে পরাজিত করে বন্দি করে। এরপর ঋষি ও সাধুরা প্রজাপতি ব্রহ্মাকে সঙ্গে নিয়ে পশুপতির শরণাপন্ন হন।
এই সময় কামরূপেশ্বর তার আরাধ্য দেবতা শিবের পূজায় মগ্ন হন। কিন্তু অসুরের নির্দেশ হয় তাকে পূজা করার ও অসুর শিব লিঙ্গ ধংসে উদ্যত হয়। এইখানেই শিবের আবির্ভাব হয় ও বহুকাল যুদ্ধ হয়। পরে দেবর্ষি নারদের পরামর্শে শিব তাকে তেজবলে ভস্মে পরিণত করেন। এই পরিত্রানের পর দেবতা মুনী ঋষিরা তাঁকে (শিবকে) অর্চনা করেন ও প্রার্থনা করেন এই স্থানকে তাঁর বিশেষ পূজাস্থল করার। এইভাবে সৃষ্টি হয় জ্যোতিরলিঙ্গ ভীমাশঙ্কর। আরো কথিত আছে যে এই যুদ্ধের সময় দেবাদিদেব মহাদেবের যে স্বেদ প্রবাহিত হয় তাই থেকে জন্ম হয় ভীমা নদীর। এইস্থানে মহাদেব ত্রিপুরাসুর কেও বধ করেন।
*****************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতি
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে। রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ – পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।