Shadow

জ্যোতিরলিঙ্গ মহাকালেশ্বর – বিজিত কুমার রায়

জ্যোতিরলিঙ্গ মহাকালেশ্বর

বিজিত কুমার রায়

মহাকাল জ্যোতিরলিঙ্গের মন্দির উজ্জয়িনী বা অবন্তিকাতে। আমার চাকরির সূত্রে ভুপাল থাকার সময় এই পুণ্যক্ষেত্র দর্শনের অভিজ্ঞতা একাধিকবার হয়েছে। ১৯৯৪ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে। তবে স্মরণীয় হয়ে আছে ২০০৫ সালে এসে দুই দিন থাকার স্মৃতি।
এই উজ্জয়িনীর কত নাম। অবন্তিকা, অমরাবতী, কুশস্থলী, ভোগবতী, হিরণ্যবতী, কনকশৃঙ্গা, কুমুদবতী, বিশালা ইত্যাদি। কথিত আছে স্বয়ং মহাদেব এখানে ত্রিপুরাসুরকে বধ করার জন্য দেবী রক্তদন্তিকা চন্ডীর আরাধনা করে পাশুপত অস্ত্র লাভ করেন। প্রবল শত্রুকে ‘উজ্জিত’ অর্থাৎ পরাজিত করার জন্য এই স্থানের নাম হয় উজ্জয়িনী ।
ভোপাল থেকে গাড়িতে করে আমরা এসে পৌঁছাই এই তীর্থে ও বৈকালবেলা মহাকাল দর্শনে আসি। ভিড়ের জন্য লাইন দিয়ে ধীরে ধীরে মন্দিরে প্রবেশ করে মন্দির চত্বর পেরিয়ে মুলমন্দিরের সিঁড়ির কাছে দাঁড়ালাম। তারপর সিঁড়ি বেয়ে ভুগৰ্ভস্থ মন্দিরে প্রবেশ। শ্বেতপাথরের সিঁড়ি, চারিদিক শ্বেতপাথরে বাঁধানো। নেমেই সামনে মহাকালের দর্শন হয়। সামনে ছোট নন্দীমূর্তি।
মহাকাল বেশ বড় কালোপাথরের দক্ষিণমুখি স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ। তান্ত্রিকদের সাধনক্ষেত্র এটি, তাই শিব এখানে দক্ষিণামূর্তি। গৌরিপট্ট বিশাল রুপা দিয়ে বাঁধানো। তারও বাইরে রূপার সুন্দর জালিকাটা একহাত উঁচু নকশা করা রেলিং। লিঙ্গের পূর্বপ্রান্তে রুপোর বিশাল ত্রিশূল ও ডমরু। মন্দিরের উত্তর দিকের দেওয়ালে কুলুঙ্গিতে ছোট শ্বেতপাথরের পার্বতী, পশ্চিমের দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে সিদ্ধিদাতা গণেশ, পূর্ব দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে কার্তিকেয়ের মূর্তি। শিবের একপাশে দুটি অখন্ড জ্যোতি প্রদীপ জ্বলছে দিবারাত্র। একটি তেলের অন্যটি ঘিয়ের। পাশে রুপোর সাপের বিরাট ফনা। দর্শন করে প্রানভরে পূজা করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। এছাড়াও মন্দিরের চত্বরের মধ্যে বিভিন্ন দেবতার মূর্তি দর্শন করলাম ও শহরের বাইরে বিখ্যাত হরসিদ্ধি মন্দির, বড়ো গণেশ, সন্দীপনী মুনির আশ্রম ও কালভৈরব দর্শন করে হোটেলে ফেরা হলো আজকের মতো। ওখানকার এক ব্যক্তির পরামর্শে কাল অতি প্রত্যুষে ভস্মারতির স্পেশাল টিকিট কেটে নেওয়া হলো। কাউন্টারেই বলে দিলো যে, কোনো ক্যামেরা আনবেন না ভিতরে আর যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি আসবেন। কিন্তু কোনো জামাকাপড়ের বিধিনিষেধ ছিলো বলে মনে নেই। পরদিন অতি প্রত্যুষে অর্থাৎ সকাল ৩.৩০টায় বিধিমত স্নান সেরে পরিষ্কার হয়ে মন্দিরে হাজির। প্রবেশের অনুমতি পেলাম গতকাল ব্যবস্থা করে রাখা বিশেষ টিকিটের জোরে। মন্দিরে গর্ভগৃহে একেবারে দেওয়ালের ধার ঘেঁষে আমাদের মতো আরো কয়েকজনের বসার ব্যবস্থা হলো। প্রথমে পূজারীরা সবাই সমস্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রী গুছিয়ে নিয়ে এবং প্রধান পুরোহিত সহ সবাই একত্রিত হলে মহাকালের মহাস্নান শুরু হলো।
পঞ্চামৃতে আলাদা আলাদা করে স্নান করানো হলো বৈদিক মন্ত্রে। তারপর গঙ্গা ও শিপ্রা নদীর জলে স্নান ও তারপর চন্দনাদি সুগন্ধি লেপন। এরপর হলুদ, বিভূতি ও কুমকুম দিয়ে শিবের দক্ষিন গাত্রে খুব সুন্দর করে এক পূজারি চোখ, মুখ ও গোঁফ আঁকলেন। তারপর লিঙ্গের মাথায় বিরাট রৌপ্য নির্মিত সাপের ফনা বসিয়ে দেওয়া হলো। পাশে রাখা হলো রুপার ত্রিশূল ও ডমরু। এরপর শুরু হলো আরতি। বাইরে ঘন্টা, ঝাঁজ ইত্যাদি বাজা শুরু হলো। ভেতরে ডমরুর সুগম্ভীর আওয়াজ ও পূজারীদের বোম বোম গালবাদ্য। সাথে সমস্বরে মন্ত্রপাঠ। পঞ্চপ্রদীপ, পঞ্চকর্পূর, দীপ, শঙ্খ, বস্ত্র, পুষ্প ও চামর দিয়ে দিয়ে প্রায় এক ঘন্টা চললো সেই আরতি। অকল্পনীয় সে দৃশ্য আমাদের চোখে। এর কিছুপরে গর্ভমন্দিরের সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হলো। এবার এলেন এক নবীন সন্ন্যাসী। এটাই উষা আরতির প্রধান অঙ্গ। তাঁর হাতে রক্তবস্ত্রের পুঁটুলি। সেই পুঁটুলি টি তিনি দুই হাতে ধরে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে তিনি শিবলিঙ্গের চারপাশে ঘোরাতে লাগলেন। আর শিবের সর্বাঙ্গ ঢেকে যেতে লাগলো ভস্মে। এটি নিকটবর্তী শ্মশানের চিতাভস্ম। এই আরতির নামই ভস্মারতি। একমাত্র তন্ত্রসিদ্ধপীঠ মহাকালেই শেষরাতে এই ভস্মারতি হয়। শেষ হতে আবার আলো জ্বলে উঠলো আর আমরা এক ঘোরের মধ্যে বাইরে বেরিয়ে এলাম সারাজীবন মনে রাখার মতো অনুভূতি নিয়ে।
অকালমৃত্যু সো মরে, যো কার্য করে চণ্ডালকা।
কাল উসকা ক্যা করে যো ভকত  হো মহাকাল কা।।
***********************************************

বিজিত কুমার রায় পরিচিতি
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে।
রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ – পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!