দ্বাদশ জ্যোতিরলিঙ্গের (দ্বিতীয় পর্ব)
জ্যোতিরলিঙ্গ বিশ্বনাথ
বিজিত কুমার রায়
বিশ্বেশম মাধবং ঢুন্ডিং দণ্ডপানিঞ্চ ভৈরবম।
বন্দে কাশী, গুহাম গঙ্গাম, ভবানী মনিকর্নিকাম
এই বন্দনা করে কাশী ধাম ঢোকার প্রচলন। আয়ু বংশের মহারাজা কাশের নাম থেকে হয় কাশী। বরুনা আর অসি এই দুই সঙ্গমে বলে বারাণসী। কথিত কাশী মহাদেবের ত্রিশূলের ওপর স্থিত বলে কোনো ধ্বংস প্রাপ্ত না হয়ে পৃথিবীর প্রাচীনতম নগরী।
দশাশ্বমেধ রোড ধরে পশ্চিম দিকে গিয়ে উত্তর দিকে বিশ্বনাথ গলি। মন্দির এই গলিতেই। প্রসঙ্গত আমাদের থাকাও এই গলিতেই। এই গলিতে ঢুকলেই দুধ জ্বাল দেওয়ার, ধূপের, ফুলমালার, পান মশলার, আতরের ও গোবরের মিশ্রিত গন্ধ পাওয়া যায়। আওয়াজ পাওয়া যায় যাত্রীদের হর হর কাশী বিশ্বনাথ অন্নপূর্ণা ডাকের। আর অবশ্যই সাবধান থাকতে হয় সরু গলিতে মহাদেবের বাহনের স্পর্শ এড়াতে।
প্রথমে পড়ে অষ্টমবর্ষীয় শঙ্করাচার্যের শ্বেত পাথরের মূর্তি। তারপর কোটিশ্বর আড়াই ফুট উঁচু কালপাথরের শিবলিঙ্গ। আরো এগিয়ে লাল সিঁদুর মাখানো চতুর্ভূজ সাক্ষী বিনায়কের মূর্তি। বিশ্বনাথ দর্শনের আগে ও পরে এনাকে প্রণাম করার রীতি।
এরপর বাঁশ ফটকের গলি পেরিয়ে ঢুন্দি রাজ গণেশের মূর্তিকে প্রণাম করে লাল পাথরের মন্দির কাশীপুর অধিশ্বরী মা অন্নপূর্ণার। এর পরেই আমরা এলাম বহু আকাঙ্খিত বিশ্বনাথের মন্দিরে। দক্ষিণ দ্বারী বিশাল রুপার কপাট দিয়ে মোড়া ও নকশা করা দরজা পেরিয়ে ঢুকতে হয় এই মন্দিরে।
অবশ্য পুরো রাস্তা জুড়ে পুলিশ ও মিলিটারির চেকিং ও ঢোকার আগে সচিত্র আইডেন্টিটি কার্ড দেখাতে হবে। এছাড়া রয়েছে আরতি দেখার আলাদা টিকিটের কাউন্টার।
এর পরেই আমরা প্রবেশ করলাম আমাদের দীর্ঘ আকাঙ্খিত বিশ্বনাথের মন্দিরে। ভিতরে চারপাশে অনেক ছোট ছোট মন্দির আছে সেগুলির বর্ণনা পরে দেব। আমরা ছোট চবুতারা পেরিয়ে আরেকটি দরজা দিয়ে মূল গর্ভগৃহে প্রবেশ করলাম। ভিড় কোনো কারণে একদমই ছিল না। ছোট গর্ভ মন্দির সাদা কালো মার্বেল পাথরে বাঁধানো, আয়তনে ১০ * ১০ ফুট। চারদিকে চারটি দরজা। উত্তরপূর্ব কোনে একটি হাত দেড়েক গভীর রুপার কুন্ড, হাত দুয়েক লম্বা ও চওড়া, রুপার রেলিং দিয়ে ঘেরা। তারই মধ্যেই আছেন এক হাত উঁচু কালো কষ্টিপাথরের জ্যোতিরলিঙ্গ কাশী বিশ্বেস্বর। তাঁর গৌরপট্টটি সোনা দিয়ে বাঁধানো। তার ওপর একটি সোনার সাপের মূর্তি খোদাই করা। লিঙ্গ ঠিক গোলাকৃতি নয়, নিচের দিকে থেকে ওপরের দিকে সামান্য সরু আর মাথায় সুক্ষ ফাটলের চিহ্ন। এর উত্তর পূর্ব কোনে একটি কুলুঙ্গিতে অখণ্ড জ্যোতিপ্রদীপ জ্বলছে। লিঙ্গের মাথার ওপর শিকলে ঝোলানো একটি রুপার স্বছিদ্র কলস। গঙ্গাজল দেওয়া থাকে, ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ছে বাবার মাথায়।
উত্তরে একটি ফোকরে এক মহারাজ বসে আছেন ফুল মালা যা সদা সর্বদা ভক্তেরা প্রানের আনন্দে জড়িয়ে দিচ্ছে তা পরিষ্কারের জন্যে। বাবাকে স্পর্শ করার কোনো মানা নেই। তবে ভিড়ের ওপর নির্ভর করে কতটা সময় পাবেন। আমরা খালি থাকাতে ও এক ট্রাস্টি সঙ্গে থাকাতে মনের আশ মিটিয়ে পূজা করতে পেরেছিলাম।
পূজার পর চাইলে পরে পান্ডাজিরা ফুল মালা হাতে দিচ্ছেন ও কপালে বিশ্বনাথের প্রসাদি চন্দন মাখিয়ে দিচ্ছেন।
ঐ দিব্য পরিবেশে মন চলে যায় এক অন্য জগতে।
সানন্দমানন্দবনে বসন্তোমানন্দকনদং হৃতপাপ বৃন্দম।
বারাণসী নাথমনাথনাথং শ্রীবিশ্বনাথং শরনং প্রপদ্যে।।
বাবার দর্শন ও পূজা শেষ করে পশ্চিম দ্বার দিয়ে বেরিয়ে এলাম। সামনে ছোট নাটমন্দিরের ঠিক মাঝখানে রুপোর গৌরিপট্ট সমেত মধুবর্ণের শিবলিঙ্গ। ইনি বৈকুন্ঠেশ্বর। আমরা দেখলাম কয়েকজন ভক্ত মহিলা সমবেত স্তোত্র পাঠ করে চলেছেন।
এর আগে আরো দুই শিবলিঙ্গ আছেন দণ্ডপানীশ্বর ও মহাকালেশ্বর। এই মন্দিরে ঢোকার পথে মাটির গহ্বরে আরো দুই শিবলিঙ্গ আছেন কপিলেশ্বর ও নিকুম্ভেশ্বর। না জানা থাকলে ওপরের তার জালির ওপর দিয়ে লোকে চলে বেড়ায়।
এছাড়া মন্দির থেকে বেরিয়ে আছেন অবিমুক্তেশ্বর ও শিবের কাছারি। আছে জ্ঞানবাপী যা স্বয়ং বাবার ত্রিশূলের আঁচড়ে তৈরি বলে কথিত।
মন্দির চত্বরে ঘোরাঘুরির পর আমরা হাজির হলাম আরতি দেখতে। যাদের টিকিট আছে তারা ছাড়া বাকিদের বাইরে যাওয়ার পর শুরু হলো গর্ভগৃহ ও কুন্ড পরিষ্কারের কাজ ।
সমস্ত ভক্তেরা চারদিক ঘিরে পাতা বেঞ্চি ও চেয়ারে বসলেন। আমরা ট্রাস্টি মহাশয়ের সৌজন্যে বসলাম গর্ভগৃহে ঢোকার মুখে একদিকের দরজার ধাপে। যথেষ্টই চওড়া আমাদের চার জনের পক্ষে।
পুরোহিত মহাশয়েরা ব্যস্ত আরতির ও শৃঙ্গারের সামগ্রী গোছাতে। বাবার স্নান হলো পঞ্চামৃত ও সুগন্ধী গঙ্গাজলে। তারপর চন্দন ও বিভিন্ন অনুলেপ দেওয়া হলো। মালা ও বিল্লপত্র দিয়ে সুন্দর করে শৃঙ্গার হলো। সবশেষে জড়ানো হলো রুপার তৈরি সর্প।
পঞ্চ ব্রাহ্মণ প্রধান পুরোহিত সহযোগে আরতি শুরু করলেন কুন্ডের চারধারে বসে। ভেতরে সমবেত মন্ত্রপাঠ ও বাইরে ঝাঁজ ও ঘন্টা ধ্বনি ও সমবেত ভক্তদের জয়ধ্বনি এক স্বর্গীয় পরিবেশের সৃষ্টি করলো। প্রায় দেড় ঘন্টা লাগে পুরো অনুষ্ঠানটিতে।
আরতির পরে বিশেষ অনুমতিতে লিঙ্গ স্পর্শ করে প্রণাম করে ধন্য হলাম। অকল্পনীয় অনুভূতি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
বাবার কৃপাতে এক অপূর্ব দর্শন ও আরতির স্মৃতি নিয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এলাম।
ভিতরে ছবি তোলা একদম বারণ। ছবিগুলি ট্রাষ্টি মহাশয়ের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
#########
পুণ্য-লোভে কোথায় ছোটো, মন যে উচাটন,
ঘরেই কোনেই আছে তোমার কাশী বৃন্দাবন !
অশ্রু মুছাও আজ তাহাদের নেইকো যাদের নাথ,
দেখবে আপন হৃদয়-মাঝেই আছেন বিশ্বনাথ !
কাছের মানুষ জানতে হবে দূরে ছুটে নয়,
আপন-হৃদয় গহন কোণই সর্বতীর্থময় !
**************************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতিঃ
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে।
রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ – পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।
কাশী ধামের বিস্তারিত বিবরণ পড়েই ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে, খুব সমৃদ্ধ প্রতিবেদন…জয় বাবা বিশ্বনাথ 🙏