শ্বেতকালী রাজবল্লভী ও ইতিহাসের রাজবলহাট
ড: স্বয়ংদীপ্ত বাগ
বাংলার লোক সংস্কৃতির ইতিহাস অনেকটাই সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলার নানা দেবদেবীর মন্দির ও তাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠান সহ নানান ধর্মী সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে। পশ্চিমবঙ্গে হুগলী জেলার রাজবলহাটে রয়েছে প্রায় আটশো বছরের পুরনো এমনই এক বিখ্যাত মন্দির। শ্বেতকালী রাজবল্লভী মাতার মন্দির। যাকে কেন্দ্র করে একসময় বিকাশ হয়েছিল রাজবলহাটের মতো একটি সমৃদ্ধ জনপদের। দুর্ভাগ্যক্রমে একের পর এক সংস্কার ও পরিবর্তনের কারণে মন্দিরের কোথাও আজ আর সেই প্রাচীনত্বের ছোঁয়া পাওয়া যায় না। কিন্তু ইতিহাসের পথ ধরে, লোককথার পথ ধরে এর গৌরবোজ্জ্বল অতীতে ফিরে যাওয়া যায় খুব সহজেই…।
আনুমানিক ১২৪২ খ্রীষ্টাব্দে, ‘রাজপুর’এ (বর্তমানে হুগলী জেলার রাজবলহাটে) শ্রীশ্রী রাজবল্লভী মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রাজা সদানন্দ রায়। অবশ্য মতান্তরে, ষোড়শ শতকে ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ, রাজা রুদ্রনারায়ণ রায় এই মন্দির নির্মাণ করেন। দেবী রাজবল্লভী শ্বেত বা সাদা কালী নামে পরিচিতা। আদতে দুর্গা, কালী ও সরস্বতীর এক মিশ্র রূপ এই রাজবল্লভীর। ত্রিনেত্রা, মাথায় বিরাট মুকুট, নানা অলংকারে ভূষিতা, প্রসন্নবদনা দেবী। সাদা রঙের ব্যতিক্রমী কালী মূর্ত্তিটি মাটির তৈরী। বাম পায়ে বসে বিরুপাক্ষ শিবের উপর এবং ডান পা বিশ্রাম নিচ্ছে মহাকাল ভৈরবের বুকে। বাম হাতের তালুতে আছে একটি সিঁদুরের পাত্র আর ডান হাতে দেখা যাচ্ছে ছুরিকা। কোমরে ছোট ছোট কাটা হাতের মালা। গলায় ঘন্টা মালা। ছ ফুট উঁচু বিশাল দেবী মূর্তি দেখে প্রথম দর্শনেই সম্ভ্রম জাগে। প্রত্যেক ১৩ বা ১৪ বছর অন্তর গঙ্গা জল ও গঙ্গা মাটি দিয়ে নতুন বিগ্রহ তৈরী করে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে দেবীর প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হয়।
আদি মন্দিরের সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও ভক্তরা পরবর্তীকালে নতুন করে তৈরী করেছেন মন্দির, নাটমন্দির, নহবতখানা, দিঘির ঘাট, মন্দির সংলগ্ন শ্রী ত্র্যম্বকেশ্বর, শ্রীসোমেশ্বর সহ চারটি শিবমন্দির ও রান্নাঘর। একটু বিস্তারিত ভাবে বলতে গেলে, বাংলা ১৩৪০ সালে শ্রী ফকির চন্দ্র, মন্মথ নাথ ও জহরলাল ভড় বহু ব্যয়ে মন্দিরের সংস্কার করেন। এরপর ১৩৪৬ সালে তাঁরা নাট মন্দির, নহবতখানা, দিঘির ঘাট ইত্যাদি তৈরি করেন।
সকাল সাতটায় মন্দিরের দরজা খোলে দশনার্থীদের জন্য। বেলা এগারোটায় পূজো শুরু হয়ে মাকে ভোগ নিবেদন করা হয় দুপুর দুটোয়। বিভিন্ন সবজি ও মাছ দিয়ে তৈরী ‘ঘাঁটা’বা ঘন্ট। এখানকার প্রসাদের অন্যতম বিশেষত্ব। ভোগ খাওয়ার জন্য কুপন কাটতে হয়। সকাল আটটা থেকে বেলা দশটা পর্যন্ত কুপন পাওয়া যায়। দশনার্থীদের ভোগ খাওয়ানো শুরু হয় দুপুর দুটোয়। সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হয় সন্ধ্যারতি। আরতি শেষে দেবীকে নিবেদন করা হয় লুচি, সন্দেশ ও ছানা। রাত আটটায় বন্ধ হয় মন্দিরের দরজা।
‘দেবী রাজবল্লভী’ চন্ডীরই রূপান্তর বলে মনে করা হয়। ‘‘পীঠনির্ণয়’’ গ্রন্থে রাজবলহাটকে শক্তিপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং পীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে ‘‘চন্ডী’’ বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত চন্ডী প্রাচীনকালে অনার্য দেবী ছিলেন। পরে আর্য ও অনার্যের দীর্ঘ সংঘাতের মধ্য দিয়ে কালক্রমে তিনি লোকসমাজের পূজ্যা হয়েছেন। যাই হোক্, দেবী রাজবল্লভীর বর্ণনা পাওয়া যায় নানা জায়গায়। যেমন, কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডী কাব্যে লেখা হয়েছে :
রাজ বোল বন্দি রাজবল্লভীর চরণ।
ইতিপুরে রঙ্গিনী বন্দো হয়ে একমন।
আবার রাজবল্লভী মাহাত্ম্য বইটিতে বলা হয়েছে :
মন্দিরে শোভিছে মাতা শ্রী রাজবল্লভী
শরৎ জ্যোৎস্না প্রভা বিশাল ভৈরবী।
বিল্বমালা গলে ছুরি ধরে ডান হাতে
প্রসারিত বাম হস্তে পাত্র শোভে তাতে।
রণরঙ্গিনীর মূর্তি ভীমা সুনয়না
বরাভয় প্রদায়িনী, প্রসন্ন আননা।
উজ্জ্বল মুকুট শিরে ত্রিলোক জননী।
রাজবলহাটে দেবীর আবির্ভাব বিষয়ে এক কিংবদন্তীর কথা শোনা যায়। একবার রাজবলহাট গ্রামে কোনো এক বৃদ্ধ মালাকারের ঘরে এক নাম গোত্রহীনা, সুন্দরী বালিকা এসে হাজির হয়। বৃদ্ধ মালাকার বালিকাটির মা বাবার কোনো সন্ধান করতে না পেরে মায়াবশতঃ তাকে নিজের বাড়িতেই লালন পালন করতে থাকেন। একদিন নিকটবর্তী নদী দিয়ে কোনো এক ধনী সওদাগর সপ্তডিঙা সাজিয়ে নাচ, গান ও নানারকম আমোদ আহ্লাদ করতে করতে যাচ্ছিলেন। ওদিকে মালাকার বাড়িতে পালিতা বালিকাটি এইসব নাচ গানে আকৃষ্ট হয়ে মাঝিদের নৌকো থামাতে বলে। কিন্তু ওই সওদাগর, বালিকাটির রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে অপহরণের উদ্দেশ্যে নৌকায় তুলতে ইশারা করে। আশ্চর্যের বিষয়, বালিকাটি একের পর এক দুটি নৌকোয় পদস্পর্শ করা মাত্র নৌকাগুলি নদীতে ডুবে যায়। এরপর সপ্তম নৌকোটিতে জোর করে বালিকাটিকে তোলবার সময় এক দৈববাণী হয়। সওদাগর জানতে পারে, এই বালিকা স্বয়ং ভগবতী। তখন সওদাগরটি তার কৃতকর্মের জন্য দেবীর কাছে কাতরভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। দেবী তার প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে এই জায়গায় দেবীর মন্দির নির্মাণ করে পুজোর ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়ে অন্তর্হিতা হয়ে যান। সওদাগরের ডুবে যাওয়া ছয়টি নৌকো দেবীর কৃপায় আবার জলে ভেসে ওঠে। আর সওদাগর দেব আদেশ অনুসারে রাজবল্লভী দেবীর পুজোর যথাযথ বন্দোবস্ত করে। সেই থেকে নাকি আজও নবমী দিন মন্দিরের বিশাল দিঘিতে সাতটি ছোটো ছোটো নৌকা তৈরী করে ছাড়া হয়।
‘মহাবিদ্যা আদ্যাশক্তি পরমেশ্বরী কালিকা’…ভক্তদের অচল বিশ্বাস ও ভক্তি, আকুল প্রার্থনা হয়ে যেন ঝরে পড়ে শ্বেতকালী, দেবী রাজবল্লভীর শ্রীচরণে। মানত পূরণে শয়ে শয়ে পুণ্যার্থী প্রত্যেকদিন মন্দিরে আসে। মন্দিরকে কেন্দ্র করে স্পন্দিত হয় রাজবলহাটের জনজীবন… বছরের বিভিন্ন সময়ে মেতে ওঠে নানা উৎসবে। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে মহা ধূমধামে ‘বুড়ো শিবের গাজন ও ঝাঁপ’ হলেও বছরের প্রধান উৎসবটি কিন্তু হয় দুর্গাপূজোর সময়। রাজবলহাট সংলগ্ন এলাকার দেবী দুর্গা, রাজবল্লভী দেবী রূপে পূজিতা হন…। আসলে রাজবলহাটের এই মন্দির ও স্থানীয় জনজীবন পরস্পর যেন সম্পৃক্ত হয়ে গেছে সেই দূর ইতিহাসের সময়কাল থেকেই। প্রাচীন বাংলার রাঢ় অঞ্চলের দক্ষিণভাগে একটি উল্লেখযোগ্য রাজ্য ছিল ভূরিশ্রেষ্ঠ বা ভুরশুট। আজকের পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া ও হুগলী জেলা নিয়ে গঠিত একটি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় রাজ্য ছিল ভুরশুট। ধনী বণিক সম্প্রদায় ভূরিশ্রেষ্ঠীদের বাস ছিল বলে এই রাজ্যটির নাম ছিল ভূরিশ্রেষ্ঠ। রাজবলহাট ছিল একটি বিখ্যাত ছোটো বন্দর এবং এই ঐতিহাসিক রাজ্যের রাজধানী। একসময় ভূরশুট রাজ্যে তিনটি গড় বা দূর্গ ছিল। এগুলি হল গড়ভবানীপুর, পান্ডুয়া ও রাজবলহাট। যদিও এখন এগুলির আর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কালের গর্ভে মিলিয়ে গেছে রাজবংশ ও রাজপ্রাসাদও। তবে রাজবলহাটের কাছে দামোদর নদের তীরে ডিহিভুরশুট বলে একটি জায়গা কিন্তু এখনও আছে। আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায়, সুলে-ই-মানাবাদ সরকারের অধীনস্থ ৩৩ মহলের মধ্যে বসুন্ধরী পরগণার পরেই ভূরশুট পরগণা থেকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হত। এই সমৃদ্ধির পথ ধরে দেবী রাজবল্লভী মন্দিরের সেবার ৫০০ বিঘা জমিকে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসাবে দান করেছিলেন ভূরশুট রাজারা। একদিকে ঐশ্বর্য্য, অন্যদিকে দান-ধ্যান… দারুণ ছিল সে সময়…। এক সময় রাজবলহাট সোনার কাজ ও তাঁতের কাপড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। সেই সময়ে এখানে জলপথই ছিল প্রধান। এই জলপথেই ধান, পাট, তুলো এবং ভুরশুটের বিখ্যাত তামাক নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ত। এখন সে সবের প্রায় কিছুই আর নেই। শুধু রয়ে গেছে রাজবলাটের বিখ্যাত তাঁতের শাড়ি। রাজবল্লভী দেবী তাই এখনও তন্তুবায়ীদের বোনা শাড়ি পরেন। তামাকের আদি ব্যবসা তাই রাত্রে শয়নে যাওয়ার আগে দেবীর জন্য তামাক সেজে দেওয়া হয়। গড়গড়ার নলটি মুখের কাছে দেওয়া হয় দেবীর। তা সেবন করে নিদ্রা যান দেবী…!
“চার চক, চৌদ্দ পাড়া, তিন ঘাট এই নিয়ে হয় রাজবলহাট”। এই বিখ্যাত প্রাচীন প্রবাদটি খুব চালু দেবীর স্থান রাজবলহাটে। এর অর্থ হলো, চার চক বলতে দফর চক, সুখর চক, বৃন্দাবন চক আর বাদুর চক অর্থাৎ চারটি ক্রসিং; চৌদ্দ পাড়া বলতে নন্দীপাড়া, দে পাড়া, মনসাতলা, শীলবাটি, ভড়পাড়া, উত্তরপাড়া, দিঘির ঘাট, কুমোর পাড়া, বাঁড়ুজ্যে পাড়া, দাস পাড়া, কুঁড় পাড়া, নস্করও ডাঙা, সানা পাড়া ও পান পাড়া অর্থাৎ চৌদ্দটি স্থানীয় অঞ্চল। তিন ঘাট বলতে দিঘির ঘাট, মায়ের ঘাট ও বাবুর ঘাট অর্থাৎ তিনটি স্নানের অঞ্চল। একসময় দামোদর নদ ও নদীঘেরা গ্রাম ছিল রাজবলহাট। শোনা যায়, ত্রয়োদশ শতকে সদানন্দ রায় এই নদী বিধৌত জঙ্গলাকীর্ণ এলাকার বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে রাজপুরের উত্থান ঘটান এবং গড়ে তোলেন এক বিশাল হাট। তিনি রাজবল্লভীর স্বপ্নাদেশে মন্দিরও তৈরী করেন। এই ইতিহাস অবশ্য সেই কিংবদন্তীর থেকে আলাদা। যেখানে নৌকা ডুবে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাই হোক, দেবী রাজবল্লভীর নাম এবং তার সঙ্গে এই হাট যুক্ত হয়ে কালক্রমে হয় রাজবল্লভী হাট… সময়ান্তরে তাও বদলে হয় আজকের রাজবলহাট। সুতরাং রাজবলহাট নামটি এসেছে শ্রীশ্রী রাজবল্লভী দেবীর নাম অনুসারেই। একটি মন্দিরকে কেন্দ্র করে একসময় কিভাবে একটি জনপদ ক্রমশ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, এ যেন সেই উজ্জ্বল ইতিহাসেরই এক অংশ। প্রসঙ্গত, ‘সুদূর অতীতে এখানে চন্ডাল রাজা রাজত্ব করতেন’ বলে কথিত আছে।
যাইহোক, রাজবলহাটে মা অধিষ্ঠিতা শ্বেতকালী রূপে আর পূজিতা হন দুর্গারূপে। আজও শাড়ি পরিহিতা দেবীর নাম নিয়ে দিন শুরু করেন এই অঞ্চলের বহু মানুষ। বিশ্বাস করেন অত্যন্ত জাগ্রতা এই দেবী তাঁদের সব প্রার্থনা শোনেন। দূর দূরান্ত থেকে আসা পুন্যার্থীদের সুবিধার কথা ভেবে রাজ্য সরকার, রাজবল্লভী মন্দিরের সংস্কারের জন্য সম্প্রতি ৪৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে। এই টাকায় মন্দির প্রাঙ্গনে সাত হাজার বর্গফুট জায়গায় পাথর বসানো, শৌচালয়, ঘাট নির্মাণ, মহিলাদের পোশাক পরিবর্তনের জন্য ঘর, শিশু উদ্যান ও প্রসাদ গ্রহণ কক্ষ তৈরী করা হবে। আশা করা যায় রাজবল্লভী মন্দিরকে কেন্দ্র করে তীর্থ পর্যটন আরো সমৃদ্ধ হবে আগামী দিনে।
কিন্তু শ্বেতকালী কি রয়েছেন শুধু রাজবলহাটেই? সম্ভবত না। কারণ, আরও অন্তত দিন জায়গায় শ্বেতকালীর উল্লেখ দেখতে পাচ্ছি। বীরভূমের অজয়পুর গ্রামে ময়ুরাক্ষী নদীর পাড়ে অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে শ্বেতকালীর পূজো হয়। জনৈক সাধু নাকি এই পূজোর সূচনা করেন। শোনা যায় রাত্রের অন্ধকারে অমাবস্যায় প্রদীপের আলোতে ঠিকভাবে পূজো করা যেত না, তাই তিনি পূর্ণিমা তিথিতে এই শ্বেতকালীর পূজো শুরু করেন। বীরভূম ছাড়া, নেপালের কাঠমান্ডুতে শ্বেতকালীর মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া বিখ্যাত ক্যাংড়া শৈলীর শিল্পকলায়, গাঢ় রঙের আঁকা শিবের উপর শ্বেতকালীর দন্ডায়মান চিত্র দর্শকদের নজর কাড়ে…। ২০১০ সালে কলকাতার শেক্সপিয়র সরণী এলাকার একটি সর্বজনীন কালীপূজা মন্ডপেও একবার শ্বেতকালীর আরাধনা হয় বলে জানা যায়। আসলে, কালো নয়, নীল নয়, সাদা রঙের কালীর রূপ তো সত্যিই একটু ব্যতিক্রমী। যদিও শাস্ত্রমতে মা কালীর রূপ শত সহস্র…! কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের বিখ্যাত শ্যামাসঙ্গীতে রয়েছে,- শ্যামা কখনো শ্বেত, কখনো পীত, কখনো নীললোহিত হে। আবার ভক্তমনও কখনো গেয়ে ওঠে, ‘লোকে বলে কালী কালো/আমার মন তো বলে না কালো রে’…।
যাইহোক্, দেবী রাজবল্লভী অত্যন্ত জাগ্রত। এই বিশ্বাসে এই ঐতিহ্যবাহী মন্দিরে বছরভোর সমাগম ঘটে অসংখ্য দর্শনার্থীর। শোনা যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কলকাতা থেকে মেদিনীপুরের নিজের বাড়ী যাওয়ার পথে একরাত রাজবলহাটের পুণ্যভূমিতে থাকতেন এবং শিক্ষার প্রসারে তিনি এখানে একটি বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ভূদেব ভট্টাচার্য্য, কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি কৃতি মানুষের স্মৃতিধন্য রাজবলহাট। এখানে রয়েছে ‘অমূল্য প্রত্নশালা’ নামে একটি মিউজিয়াম ও ভারত সেবাশ্রম সংঘের একটি কেন্দ্রও। মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ, সারদা মা, স্বামী বিবেকানন্দ ও স্বামী প্রেমানন্দের স্মৃতিধন্য আঁটপুর। টেরাকোটার দুর্দান্ত কাজের নিদর্শন রয়েছে। শ্রীরাধাগোবিন্দ জীউর মন্দির সহ এলাকার বিভিন্ন মন্দিরে। কলকাতা থেকে তারকেশ্বরের তীর্থযাত্রীরা, নিজস্ব গাড়ী বা ভাড়া করা গাড়িতে তারকেশ্বরের সঙ্গে রাজবলহাট ও আঁটপুর একদিনে ঘুরে আসতে পারেন। কোলকাতা বা হাওড়া থেকে আরামবাগগামী বাসে গজার মোড়ে নেমে সেখান থেকে ১০ নম্বর বাস বা ট্রেকারে চড়েও রাজবলহাট যাওয়া যায়। হাওড়া থেকে তারকেশ্বর বা আরামবাগগামী ট্রেনে হরিপাল বা তারকেশ্বরে পৌঁছে সেখান থেকে গজার মোড় হয়েও একইভাবে পৌঁছানো যায় রাজবলহাটে। তবে শুধু পুণ্যার্থীরাই নন, নিছক গ্রাম ভালোবাসলেও একদিন আসতে পারেন। এই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলিতে ঘুরতে ঘুরতে হয়তো ছুঁয়ে ফেলতে পারেন প্রায় মুছে আসা এক গরিমার ইতিহাসকেও…!
তথ্যসূত্রঃ-
১) রাজবল্লভী মাহাত্ম্য,
২) হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ সুধীর কুমার মিশ্র,
৩) হুগলী জেলার সেকাল ও একাল কমল চৌধুরী,
৪) রায়বাঘিনী ও ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজকাহিনী বিধুভূষণ ভট্টাচার্য্য,
৫) হুগলী জেলার পুরাকীর্তি নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য,
৬) পশ্চিমবঙ্গে পূজাপার্বণ ও মেলা অশোক মিত্র সম্পাদিত,
৭) রাজবলহাট : একটি বিখ্যাত আধা নগর অরিন্দম গায়েন।
৮) Bartamanpatrika.com/detailNews.php?cld=12&nld=252194&p=1,
৯) www.bongodorshon.com/home/story_detail/history-of-rajbalhat-village,
১০) www.eimuhurte.com/state/the-unique-deity-of-swet-kali-of-hooghly-zilla-loves-to-go-sleep-taking-hukka-15707/,
১১) dailyhunt.in
১২) https://birbhum.org/sklesk41217/,
১৩) https://www.mymandir.com/p/IPBggc
১৪) http://photographyakc.blogspot.com/2018/06/rajbalhat-and-rajballavi-temple.html,
১৫)www.facebook.com/476325529221314/photos/g.716989671821564/719318654921999/?type=1&theater….ইত্যাদি।
উক্ত নির্বাচিত তথ্যসূত্র ছাড়াও সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তথ্য জ্ঞাপনকারী ব্যক্তি ও সংস্থার প্রতি কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ স্থানীয় বিশিষ্ট শিক্ষক, শ্রী প্রবীর কুমার দের কাছে যিনি রাজবলহাটকে নতুন করে চেনালেন। সীমাবদ্ধতার জন্য প্রত্যেকের নামে আলাদা করে ঋণ স্বীকার করা সম্ভব হলো না।
*****************************************************
ডঃ স্বয়ংদীপ্ত বাগ
ভূগোল নিয়ে গবেষণা, পেশায় শিক্ষক। কিন্তু প্যাশন ভ্রমণ ,সাহিত্য ও সংগীত চর্চায় (সেতার)। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও পত্রিকায় নিয়মিত লেখক। লেখালেখির প্রয়াস সীমাবদ্ধ মূলতঃ প্রবন্ধ ও কবিতায়। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুই। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আকাশবাণী, দূরদর্শন সহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ।।
প্রণাম মা রাজবল্লভী। মা রাজবল্লভী সম্পর্কে ডক্টর সয়ংদীপ্ত বাগ যে তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন তা রাজবলহাটবাসী হিসাবে আমি বলতে পারি এক কথায় অপূর্ব। এই তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন রাজবলহাট এর আপামর জনসাধারণের কাছে এক অমূল্য তথ্য হিসাবে স্বীকৃত হবে বলে আমার ধারণা।
আমি একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক কাজে এবং ঠাকুর দেবতার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি।
গত 24 শে মে, 2022 তারিখ মঙ্গলবার রাজবলহাট বাজার এর কাছে অবস্থিত আছে”খটীর বাস্তুকালীমাতা ও মনসামাতার বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পূজা উপলক্ষে সকালে আঁটপুরের মহারাজ ও সমাজের বিশিষ্ট গুণীজনদের সম্বর্ধনা দেয়া হয় ও প্রায় একশত জন দুস্থ ও অবহেলিত মানুষকে বস্ত্র দান করা হয়। সন্ধ্যায় প্রায় 5000 নরনারায়ণকে খিচুড়ি ভোগ দিয়ে সেবা করা হয়।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই দুই ঠাকুরের প্রামাণ্য ইতিহাস সাধারণ মানুষের অজানা। বর্তমানে আমার বয়স 76 বছর। মন্দিরের পাশেই আমার বাড়ি । জানতে ইচ্ছা হয় মন্দিরের ইতিহাস। যদি আপনার জানা থাকে তাহলে আমাকে আমার হোয়াটসঅ্যাপ অথবা ফেসবুক মারফত জানালে চির কৃতজ্ঞ থাকবো।
নিবেদক—
অজিত কুমার লাহা
মন্দির কমিটির প্রধান উপদেষ্টা,
(M.No.) 9064024047