হিমালয়ের পথে তৃতীয় কেদার তুঙ্গনাথ
শান্তনু মজুমদার
২০১২ সালে সেপ্টেম্বর মাসের শেষে কেদারনাথ ধাম দর্শন করার পর আমাদের ইচ্ছে ছিল তৃতীয় কেদার তুঙ্গনাথ দর্শনে।অবশ্য তা সম্ভব হয় প্রকৃতিদেবীর সহায়তায়। সেসময় যমুনোত্রী ও গঙ্গোত্রীতে ধস নেমেছিল বলে অনেক যাত্রী তাদের যাত্রাসূচী পালটে অন্যপথে যায়।যারা ভুক্তভোগী তারা জানেন যে পাহাড়ে কোন পরিকল্পনা খাটে না। কখন কোথায় ধস নামবে, রাস্তাঘাট দুর্গম হবে আগের থেকে কেউ পূর্বাভাস করতে পারে না। আমাদের আশঙ্কা ছিল ভারী বৃষ্টিপাতে পথচলায় বিঘ্ন না ঘটে। মেঘলা আকাশ মুখ ভার করে আছে দুপুর থেকে।কেদার দর্শন করে দুপুর তিনটে গৌরীকুন্ডে ফিরেছি।আমাদের দলে আছেন সমাদ্দারদা,তাঁর এক শ্যালক সুবলদা ও সুবলদার ভায়রাভাই শম্ভুদা,আমার ভ্রাতৃপ্রতিম দেবদূত,পঙ্কজদা ও আমি।সমাদ্দারদা বয়সে বড়,প্রায় ৬৭ বছর বয়স কিন্তু মনের দিক থেকে নবীন,তুলনায় শম্ভুদা একটু চুপচাপ,শিক্ষক।সুবলদা চাকরী ও ব্যবসা করেন,অনেকজায়গায় ঘোরার অভিজ্ঞতা আছে,তার সারাংশ আমরা শুনি মাঝেমধ্যে। দেবদূত রেলে কাজ করে,আমাদের টিম লিডার।কম পয়সায় কি ভাবে ঘোরা যায়, দেবদূত ভাল জানে।পঙ্কজদা ব্যবসা করে, এইপ্রথম বাংলার বাইরে ঘুরতে এল।তাই তার উৎসাহ খুব।মাঝে মাঝে উৎসাহের চোটে বাঙাল ভাষায় কথা বলে । পঙ্কজদা পাড়ায় মামা নামে পরিচিতি ও সেই সুবাদে দেবদূত পঙ্কজদাকে মামা বলে। মামা ডাকটা এমনই ছোঁয়াচে যে সুবলদা,মায় সমাদ্দারদার মতন প্রবীণ লোকও মামা ডাকা শুরু করলেন।পঙ্কজদার তাতে কোন আপত্তি নেই।সফর সঙ্গীদের একটু পরিচয় দিয়ে রাখলাম এইকারণে যে পাঠকদের বুঝতে অসুবিধা না হয়।গৌরীকুন্ডে নামার পর দেরী না করে চেপে বসলাম বোলেরো গাড়ীতে। পৌঁছতে হবে উখীমঠে। গৌরীকুন্ড থেকে উখীমঠ ৬০ কিমি দূরত্ব।মোটামুটি ঘন্টা তিনেক লাগবে।টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়া শুরু হল গুপ্তকাশী যাওয়ার পর।আশ্বিন মাসেও পাহাড়ে বৃষ্টির রেশ থাকে প্রায়ই। বৃষ্টি শুরু হলে ভয় লাগে। কখন কি ঘটবে কে জানে!আমার মনের কথা গাড়ীর চালক বিক্রম জেনে গেল কি ভাবে জানি না।ঘন কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল,”বাদল ফাট যানে সে বহুত মুসিবত হোগা ৷ ” সবাই একটু শঙ্কিত হলাম তার কথা শুনে।পাহাড়ি লোকেদের অভিজ্ঞতাকে তুচ্ছ করা যায় না।হঠাৎ পঙ্কজদা বলে উঠলো ,”বিক্রমভাইয়া,বাদল কেইসে ফাট্টা হ্যায়?” বিক্রম একটু অন্যমনস্ক ছিল।পঙ্কজদার প্রশ্নে কোন উত্তর দিল না। দেবদূত বললো,”আরে মামা,মেঘভাঙা বৃষ্টি বোঝ? তোমাদের বরিশালে কি বলে?” শম্ভুদা বললেন , “আমাদের এখানে বলে মুষলধারে বৃষ্টি পড়া।”পঙ্কজদা ,”হ,ঠিক কইছেন।আমাগোর দেশেও মুষলধ্যারে বিষ্টি পড়তাছে কয়।” সমাদ্দারদা দুম করে প্রশ্ন করে বসলেন,”দেবদূত, মুষলধারা কেন বলে?” দেবদূত -“জোরে বৃষ্টি পড়লে মুষলধারা বলে।” সমাদ্দারদা খুশী হলেন না উত্তর শুনে বুঝলাম। সুবলদা -“মুষল মানে গদা,মহাভারতে মুষলপর্বে যাদবকুল ধ্বংস হলেন নিজেদের মধ্যে লাঠালাঠি করে।কিন্তু গদার সঙ্গে বৃষ্টির তুলনা কেন বুঝতে পারছি না।” আমি গাড়ির সামনে বসেছিলাম।পিছনের কথা কানে আসছিল কিন্তু মন পড়ে ছিল আকাশ পানে।ঘন কাল মেঘ ছেয়ে আছে। যে কোন সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে দামাল ছেলের মতন।বিক্রম গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে দিল।আলো কমে এসেছে।পিছনদিকে ফিরে বললাম, “মুষল শব্দটি অনেক অর্থ,ঢেকির মোনাকেও মুষল বলে।দুফুটের গোল কাঠ ঢেকির সামনের দিকে থাকে।ধান ভাঙা হয় এই মোনা দিয়ে।ঢেকিতে ধান ভাঙার সময় দুপদুপ্ করে শব্দ হয়।আগে গ্রাম বাংলায় ঢেকির দুপদাপ শব্দ ছড়িয়ে যেত প্রতি ঘরে।সেজন্য ভারী বৃষ্টিপাতের তুলনা টানা হয়েছে ঢেকি ভাঙার সঙ্গে।” আমার কথা শেষ না হতেই চড়বড় করে তুমুল বৃষ্টি পড়া শুরু হল।গাড়ির সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।গাড়ির ওয়াইপার কোন কাজে লাগছে না । বিক্রম তারমাঝেই গাড়ি চালাচ্ছে। সমাদ্দারদা বৃষ্টির তোড় দেখে বিক্রমকে গাড়ি থামাতে বললেন।বিক্রম জানাল মাইল দুয়েক যাবার পর দেখা যাবে কারণ যে জায়গার পাশ দিয়ে গাড়ি চলছে তা ধস প্রবণ এলাকা।অজানা আশঙ্কায় আমরা ছয়জন চুপ করে প্রকৃতির রোষ প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম।এইরকম দুর্যোগ আমি আগে দেখিনি পাহাড়ি পথে।বিক্রমের ভরসায় রাত আটটা নাগাদ উখীমঠে পৌঁছলাম।তখনও অঝোরধারায় বৃষ্টি পড়ে চলেছে তবে আগের মতন জোরালো নয়।লাল মেটে রঙের ভারতসেবাশ্রমের বাড়ি রাস্তার বাঁ পাশে।আমরা দাঁড়িয়ে আছি ডানদিকে।রাস্তার উপরেই একটা হোটেল।মালিক কাম কেয়ারটেকার আমাদের ডাকছে।কাচের জানালা খুলে কথা বলার উপায় নেই।জল ঢুকে যাবে।দেবদূত কোনরকমে গাড়ি থেকে নেমে দৌঁড় দিল বটে কিন্তু জামা, প্যান্ট ভিজে গেল সামান্য সময়ে।জনশূন্য হোটেল।সিজন শুরু হবে দিনদুয়েক পরে।তাছাড়া এদিকে যাত্রীসংখ্যা কম।দেবদূত ইশারায় জানাল নামতে।দারুণ ঘর।গিজার,কমোড সব আছে।পরিষ্কার বিছানা,মোটা লেপ ও কম্বল দেখে সুখ পেলাম।মাত্র ৬০০ টাকায় দুটো রুমে তিন বেডের ঘর পাওয়া গেল।চার পাঁচদিন পরে এলে দিতে হত প্রতি রুম পিছু ৯০০টাকা।গরম জলে স্নান করে রুটি,তরকারী খেয়ে লেপের তলায় শুয়ে পড়লাম।ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙলো সকাল ৬টায় বাচ্চাদের কলকলানি শুনে।বেরিয়ে এসে দেখি ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে।তাদের গালগুলি আপেলের মতন লাল।হাসিখুশি প্রাণবন্ত চেহারা।শান্ত জায়গাটা যেন প্রাণ ফিরে পেল তাদের আওয়াজে।বৃষ্টি নেই,আকাশ পরিষ্কার। গাছের পাতায় এখন ভোরের আলো পড়ে মরকতের দ্যুতি ফুটে বেরচ্ছে।চারিদিকে সবুজের তরতাজা ভাব।সঙ্গীরা সবাই স্নান করে প্রস্তুত,একমাত্র আমি ছাড়া।তৈরী হয়ে নিলাম মিনিট দশেকের ভিতর।দেবদূত জানিয়ে দিয়েছিল সকাল আটটায় রওয়ানা দেওয়া হবে।গরম চা একগ্লাস চুমুক দিতেই পঙ্কজদা বলে উঠলো ‘আহা,কি দেখিলাম!জন্মজন্মান্তরে ইহা ভুলিব না!’দেবদূত ফুট কাটলো-“মামা,তুমিও নবকুমার হইয়া গেলে।নুতন কিছু স্টক থাকলে ছাড়।” পঙ্কজদা মুচকি হাসে।আমায় জিজ্ঞেস করলো ,”দুখীমঠ যাইবেন না?” হেসে বললাম-“আমরা উখীমঠে আছি।এই নামের পিছনে একটি সুন্দর গল্প আছে।” গল্পের কথা শুনে সবাই নড়েচড়ে বসল।বলীরাজের ছেলে বাণাসুর ছিলেন শিবভক্ত।তাঁর নামেই বাণলিঙ্গ,তিনি মহাপ্রতাপশালী ছিলেন।তাঁর একটি সুন্দরী কন্যা ছিল,নাম ঊষা।কৃষ্ণ-রুক্মিণীর ছেলে প্রদ্যুম্ন ছিলেন মহাধনুর্ধর।দ্বারকা রক্ষার ভার তাঁর উপর থাকতো যখন কৃষ্ণ,বলরাম থাকতেন না।তাঁর ছেলে ছিল অনিরুদ্ধ, তিনিও ছিলেন মহাযোদ্ধা। গোপনে সাক্ষাৎ হয় ঊষার সঙ্গে। দুজনেই পরস্পরের প্রতি প্রেমে পড়েন।কিন্তু ঊষা জানতেন পিতার সম্মতি পাবেন না।যদুবংশের ঘরে বিবাহ দেবেন না।বিবাহ হবে কোন শিবভক্ত রাজপুরুষের সঙ্গে। অনিরুদ্ধ ও ঊষা পালিয়ে চলে আসেন এখানে।বাণাসুর জানতে পেরে অনিরুদ্ধ ও ঊষাকে বন্দী করেন।কৃষ্ণের কাছে খবর যায়।কৃষ্ণ ও প্রদ্যুম্ন আসেন অনিরুদ্ধকে মুক্ত করার জন্য।বাণাসুরকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন ও বাণাসুর সম্মত হন ঊষার সঙ্গে অনিরুদ্ধর বিবাহ দিতে ৷
ওঁমকারেশ্বরে ঐ পাহাড়ে যুদ্ধশেষে ঘর্মাক্ত-ক্লান্ত অবস্থায় কৃষ্ণ যুদ্ধের পোশাক খুলে বিশ্রাম নিয়েছিলেন বলে রণছোড়জী নামে পরিচিত হন।এখনও সেখানে পূজা হয়।ঊষার নামে এইজায়গার নাম হয় ঊষীমঠ।নামের পরিবর্তন হয় কালের নিয়মে।ঊষীমঠ থেকে ওখীমঠ এবং পরে উখীমঠ।পঙ্কজদা হেসে বলল,”কার নাতি দ্যাখতে হইব।এমন জায়গায় ঊষারে লইয়া পালাইয়া আইছে যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দুঁদে গোয়েন্দারাও খুইজ্যা পাইতো না।তবে বাণাসুরের নেটওয়ার্ক ভালই ছিল বোঝা যাইতাছে।” আমরা সবাই মুচকি হাসলাম।বললাম,”এখানে ঊষা মন্দির ছাড়াও অনিরুদ্ধ, নবদূর্গার মন্দির আছে।তবে ওঁমকারেশ্বর মন্দির সবথেকে জনপ্রিয়। শীতকালে দীপাবলির পর কেদারনাথ ও মদমহেশ্বর মন্দির বন্ধ হয়ে যাবার পর তাঁদের প্রতিভূকে নামিয়ে আনা হয় এখানে।পূজো চলে অক্ষয়তৃতীয়া পর্যন্ত।তুঙ্গনাথ দেখে আসার পর সময় থাকলে দর্শন করা যাবে।” দেবদূত যেভাবে ঘড়ির দিকে বারবার দেখছিল,মনে হয় আটটা বাজে।সবাই রওনা দিলাম চোপতার উদ্দেশে।চোপতা এখান থেকে ৩০কিমিদূরে।চোপতা থেকেই তুঙ্গনাথ যেতে হয়।জহরলাল নেহেরু চোপতার সৌন্দর্য দেখে বলেছিলেন মিনি সুইজারল্যান্ড। সকাল নটায় পৌঁছে গেলাম চোপতা।জায়গাটা বেশ মনোরম। পাইন গাছে মোড়া চারদিক।শান্তি বিরাজ করছে এখানে।তিন চারটে খাবারের দোকান দেখলাম।আমাদেরকে দেখতে পেয়ে হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল।কয়েকটি লোমশ কুকুর শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিল। গাড়ি থামতেই লেজ নাড়তে শুরু করলে, যেন কতদিনের চেনা সম্পর্ক।দেবদূতকে বললাম ব্রেকফাস্ট সেরে নিতে।খালি পেটে পাহাড়ে চড়া ঠিক নয়।যারা মনে করেন উপোস করে পূজো দেওয়া ভক্তির লক্ষণ,তাদের বলা ভাল খালিপেটে তুঙ্গনাথ দর্শন করতে চাইলে হিতে বিপরীত হবে।হিমালয়ে দেবদর্শন কদাপি খালিপেটে নয়।বিশেষ করে যেখানে ৪কিমি খাঁড়া উচ্চতায় পায়ে হেঁটে যেতে চাইলে।
চোপতা সমুদ্র তল থেকে প্রায় নয় হাজার ফিট উচ্চতায় অবস্থিত। রাস্তার একটা বড় তোরণ আছে।জানা গেল এই তোরণ ২০০২ সালের পর হয়েছে। হিন্দীতে লেখা শ্রী তুঙ্গনাথ মন্দির।তুঙ্গনাথ যাওয়ার রাস্তা এই পথ ধরেই।চোপতা থেকে তুঙ্গনাথ ৩.১ মাইল(৫কিমি)।তুঙ্গনাথের উচ্চতা ১২০০০ফিট।পঞ্চ কেদারের মধ্যে সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থান বলে তাঁর নাম তুঙ্গনাথ।পঞ্চকেদারের প্রথম কেদারনাথ, দ্বিতীয় মদমহেশ্বর, তৃতীয় তুঙ্গনাথ, চতুর্থ রুদ্রনাথ ও পঞ্চম হলেন কল্পেশ্বর।হিমালয়ের পাঁচটি পাহাড়ে পাঁচজন অবস্থান করছেন।পঞ্চকেদার দেখার ভাল সময় এপ্রিল,মে ও জুন।সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ভাল কিন্তু শীতের প্রকোপ বেশি।
তুঙ্গনাথ যাওয়ার পথ প্রথম থেকেই চড়াই ।ঘন্টা তিনেক সময় লাগে হেঁটে গেলে,ঘোড়ায় লাগে ঘন্টা দেড়েক। সূর্যোদয় দেখতে গেলে ভোর সাড়ে তিনটে রওনা দেওয়া উচিত এবং সেক্ষত্রে সরাসরি চোপতায় রাত কাটান ভাল।আমি দ্বিতীয়বার তুঙ্গনাথ দর্শন করেছিলাম ২০১৬ সালে ও রাত কাটিয়েছিলাম চোপতায়। সেবার সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।আকাশ পরিষ্কার থাকে এবং প্রতিটি শৃঙ্গের চূড়ায় যখন সূর্যের আলো স্পর্শ করে তখন তার সৌন্দর্য মুখে বলা যায় না।যার এই সৌভাগ্য হয় তিনি ভাগ্যবান।প্রকৃতি সুপ্রসন্ন থাকলেই সেই অনির্বচনীয় সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।এমন হয়েছে তেরো বার তুঙ্গনাথ দেখতে এসে একবার শুধু প্রকৃতি তার প্রতি সুপ্রসন্ন হয়েছিলেন।পাগলকরা রূপ,যে দেখে সে ভুলে যায় অন্য সব কিছু।বারেবারে তাকে হাতছানি দেয় তুঙ্গনাথ দর্শনে।সবকিছু ফেলে নিশিরডাকের মতন সে ছুটে যায় অপরূপকে ধরার জন্য।কিন্তু হায়,চঞ্চলা বালিকার মতন সে পুরোপুরি ধরা না দিয়ে লুকিয়ে পড়ে মেঘের আড়ালে।
আমরা ঠিক করলাম ঘোড়ায় যাব।ঘোড়া যদিও নয়,এগুলি আসলে খচ্চর।খচ্চর পিছু ২০০টাকা ধার্য হল একপিঠের।নাম রাখা হয়েছে হীরা,রেখা,মতি,বিবি,পান্না ও জুহি।আমার খচ্চরের নাম হীরা,চেহারা একটু বড়।আমার শরীরের সঙ্গে মানানসই। পঙ্কজদা চেপেছেন রেখার উপর।বেচারির উপর পঙ্কজদা বসতেই আওয়াজ দিয়ে জানান দিল পছন্দ নয় আরোহীকে।দেবদূত হেসে বললো,”মামা তোমারে পছন্দ নয় রেখার।তুমি বরং হেঁটে যাও।”পঙ্কজদা বাঙাল ভাষায় খিস্তি দিতেই রেখা চলতে শুরু করল।
দেওধর, পাইন বনের মাঝে পাথরের পথ চলেছে এঁকেবেঁকে চড়াইএর পানে।চওড়া চারফুটের বেশী নয় এই পথ।এই রাস্তাতৈরী হয় সম্ভবত ১৯১৯ সালে।এক প্রকৃতিপ্রেমী ইংরেজসাহেবের সহযোগিতায় রাস্তা তৈরী হয়েছিল।তিনি ছিলেন জরিপবিভাগের এক উচ্চপদস্থ অফিসার। এই তীর্থ ছিল আগে দুর্গম। পাহাড়ি চিতা ছিল মৃত্যুদূত।বিপদকে মাথায় নিয়ে তীর্থযাত্রীরা আসতেন দেবদর্শনে।কি কষ্টই না করতে হত সেইসময়ে।আমরা ভাগ্যবান,আজ খচ্চরে পিঠে চড়ে তুঙ্গনাথ দর্শন করতে যাব অনায়াসে। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছি চড়াইএর পথে।কিছুদূর যেতেই দেওধর, পাইন গাছ দেখা গেল ।পাহাড়ের ঢাল ধাপে ধাপে নেমে গেছে সবুজ ঘাসের আস্তরণে। সবুজ মখমল গালিচা যেন বিছিয়ে দিয়েছে কেউ।একে বুগিয়াল বলে।বাংলায় বলে চারণভূমি। গড়াগড়ি খেতে মন খুব চাইছিল।কিন্তু হীরা আমার মনের কথা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলতে লাগলো। এবারে কিছুদূর এগিয়ে চলার পর নজরে এল থাক থাক রডোডেনড্রন গাছ।কালচে সবুজ পাতা।ফুল ফোটে এপ্রিল মাসের শেষে।লাল,গোলাপি,কমলা,সাদা নানা রঙের ফুল হয় রডোডেনড্রন গাছে। এপ্রিলের শেষে এলে দেখা যায় রডোডেনড্রন গাছে থোকা থোকা নানা রঙের ফুল বিশেষ করে লাল,কমলা রঙের ফুল যখন হাওয়ায় দুলতে থাকে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে তখন চোখে ধাঁধা লাগে।দূর থেকে মনে হয় আগুনের শিখা। পাহাড়ে যেন আগুন লেগেছে। সে এক অপরূপ দৃশ্য।অন্য সময়ে এলে এই চিত্তাকর্ষক দৃশ্য দেখা যায় না।তাই তুঙ্গনাথের রূপ পরিবর্তন হয় বিভিন্ন সময়ে,যার জন্য প্রকৃতিপ্রেমীরা বারেবারে আসেন সেই সুধারস পান করতে। রবির কথায়-
ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে–
ডালে ডালে ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় রে
আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে॥
রঙে রঙে রঙিল আকাশ, গানে গানে নিখিল উদাস–
যেন চল-চঞ্চল নব পল্লবদল মর্মরে মোর মনে মনে।
পথ ক্রমশ চড়াই হচ্ছে।ঘোড়াদের কষ্ট হচ্ছে আমাদের ভার নিয়ে চলা।মাঝে মাঝে হাঁফিয়ে যায় তারা।কিন্তু সে আর কতক্ষণ, তাদের চালকদের লাঠির তাড়নায় সামনের দিকে চলতে হচ্ছে।রেখা সবার আগে, পঙ্কজদা খুব খুশি। পঙ্কজদা ঘোড়ার চালকের সঙ্গে হিন্দীতে কথা বলছে।আমি পিছন থেকে শুনতে পাই পঙ্কজদার হিন্দী,”ভাইয়া,আগে যো কুত্তা যাতা হায়,ইয়ে আপলোককা হায়?” চালক মাথা নেড়ে ,” নেহি জি।”নজরে এল একটি পাহাড়ি কুকুর,দেখতে অবিকল এ্যালসেশিয়ান,সকলের সামনে চলছে।আমাদের যেন পথ দেখাচ্ছে।কিছুদূর অন্তর হিসি করছে।দেবদূত হিন্দী ভাল বলে।জিজ্ঞেস করলো , ‘ক্যায়া আপলোক্ বোল্ নহি সেকতে ইয়ে কুত্তা কাহাঁসে আ গয়ি?”নহী জি,ইয়ে খুদ আয়ে হ্যা।যব উহ চাহে তব উতার যায়েগা।” মনে পড়ে গেল মহাভারতের কথা।স্বর্গারোহণের সময় যুধিষ্ঠিরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছিল একটি কুকুর।পাহাড়ে কুকুরই মানুষের পথপ্রদর্শক। পাহাড়িরা কুকুর পোষে ভেড়া পালনের জন্য। কুকুরের গলায় থাকে কাঁটাযুক্ত লোহার কলার যাতে চিতা গলার টুঁটি ধরতে না পারে।চিতার হাত থেকে তারা ভেড়ার পালকে রক্ষা করে।রাত্রে তারা পাহারা দেয়।চিতার গন্ধ পেলেই তারা মনিবদের সজাগ করে দেয়।অনেক উপর থেকে দেখতে পেলাম বুগিয়ালে বেশ কয়েকটি ভেড়া ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে।তিনটি লোমশ কুকুর তাদের সাথে আছে।কোন রাখাল নজরে এল না।আমি বললাম-,”আমাদের সাথের কুকুরটি ঐ বুগিয়াল থেকে আসেনি তো?” পঙ্কজদা বললেন,”-না,ওটি প্রথম থেকেই ছিল।পথের মাঝখান থেকে আমাদের সঙ্গে যোগদান করে নি।” পথের একপাশে খাদ।খচ্চরগুলি রাস্তার যে পাশে খাদ সেদিকে মুখ বাড়ায় কচি ঘাস খাওয়ার লোভে কিন্তু আরোহীর অবস্থা যে আত্মারাম খাঁচা।পিঠ থেকে বাঁপাশে গড়িয়ে পড়লে বাঁচবার কোন উপায় নেই।তাই সব রাগ গিয়ে পড়ে চালকদের উপর।আমি ও দেবদূত ছাড়া বাকিরা ভয়ে ভয়ে চলেছে।প্রকৃতির সৌন্দর্য ভুলে বেশী মনোযোগ দিতে হয় খচ্চরের দিকে।এদিকে আমি লক্ষ্য করলাম মেঘ জড়ো হচ্ছে উত্তর -পূর্ব দিকে।দূরের পাহাড় অস্পষ্ট। ক্যামেরা এক হাতে ধরা,অন্যহাতে লাগাম।কিন্তু সূর্য দেবকে জব্দ করার জন্য মেঘমালারা দলে দলে জড়ো হচ্ছে।হঠাৎ কয়েকটি বরফে ঢাকা উজ্জ্বল শৃঙ্গ কয়েকমিনিটের জন্য মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল।ক্যামেরা ঠিক করার আগেই চলে গেল অন্তরালে। ২০১৬ সালে আবার এলাম। সেবার কিন্তু তুঙ্গনাথ আমাকে নিরাশ করেন নি।ভোরবেলা সূর্য উদয়ের আগেই পৌঁছে গেছিলাম তুঙ্গনাথে।আকাশ পরিষ্কার।তুঙ্গনাথ থেকে ২৭০°প্রসারিত গিরিরাজ হিমালয়ের অধীন তাঁর পনেরহাজারি,বিশহাজারি,পচিশহাজারি মনসবদারদের দেখতে পেয়েছিলাম। একেবারে পশ্চিমে শিবলিং-বন্দরপুঞ্জ,শতোপন্থ,গঙ্গোত্রী,চৌখাম্বা এবং তার ডানদিকে কেদারনাথ, কেদারডোম, নীলকন্ঠ এবং আরো ডাইনে নীলগিরি। কামেট,হাতিপর্বত,ঘোড়িপর্বত,দুনাগিরি,সুমেরু,নন্দাদেবী,নন্দাঘুন্টি,ত্রিশূল,পঞ্চচুলি এরকম অজস্র তুষারশৃঙ্গ আছে।শৃঙ্গ চিনতে না পারলে কিছু যায় আসে না।উপভোগ করি প্রকৃতির সুকুমার সৌন্দর্য যা কখনই তুলির আঁচড়ে পরিপূর্ণ রূপ দেওয়া সম্ভবপর নয়।এমনকি কোন উন্নত ক্যামেরা ত্রিমাত্রিক অপরূপ দৃশ্য কে বন্দী করতে পারে না,এ আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি।অরুণ আলোর স্পর্শে যখন একএকটি বরফশৃঙ্গ তরল সোনায় রূপান্তরিত হয়ে পরবর্তী সময়ে রজতশুভ্র উজ্জ্বলতায় ফিরে আসে তখন সে এক মনোরম দৃশ্য। ২৭০° ছড়ান হিমালয়ের পর্বতমালা তার সুউচ্চ শৃঙ্গ নিয়ে দীপ্তভাবে যখন প্রকাশমান হয় তখন নয়নভরে তার সুধারস পান করতে হয়। লেখার বাঁধনে তাকে প্রকাশ করতে যাওয়া মুর্খামি।
ফিরে আসি আগের কথায়।প্রায় ১১০০০ফিট উচ্চতায় চলে এসেছি এক ঘন্টায়।পথে কুকুর চলেছে আগে আগে এবং হিসি করে চলেছে কিছুদূর অন্তর। পঙ্কজদা তাই দেখে বলেই ফেলে, “কুত্তার মতন পেছাব করলে ভাল হত।”চালকরা বলল সামনেই চটি।মিনিট পাঁচেক পরেই একটা ছোট চটির সামনে উপস্থিত হলাম।ঘোড়াগুলো কাবু হয়ে পড়েছে।তাদেরকে ছোলা চানা গুড় খেতে দেওয়া হল।কুকুরটিকে বিস্কুট দেওয়া হল কিন্তু অবাক হয়েছিলাম কুকুরটি কিছুই মুখে তুললো না।এদিকে সুবলদা নতুন কেনা ভিডিও ক্যামেরায় ছবি তুলে যাচ্ছেন।সমাদ্দারদা চায়ে চুমুক দিতে দিতে নিচু গলায় বললেন,”সুবলের হাত কাঁপে।কি ছবি উঠবে কে জানে!”হেসে বললাম,”ধ্যাৎ,ছবি ভাল না তুললে কেউ কি শখে দামী ক্যামেরা কিনে?” সমাদ্দারদা-“ভাল ছবি হবে না।আগেও ছবি তুলেছে বলেই আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে।দেখুন কুয়াশায় চারিদিক ঢেকে গেছে।এরমধ্যে ছবি কি করে ভাল আসবে?দেখবেন,কুকুরের লেজ,খচ্চরের লেজ এইসব ক্যামেরায় বন্দী হবে।” আমি সমাদ্দারদার কথায় বাইরে তাকিয়ে দেখি মেঘ এসে ঘন কুয়াশার মতন ঢেকে ফেলেছে চারদিক।পাঁচ হাত দূরে কিছুই দেখা যায় না।শঙ্কা হল ঘন মেঘের আস্তরণ ভেদ করে আরও হাজার ফুট উপরে যাব কি করে?তবে কি তুঙ্গনাথ দর্শন হবে না?বাকি সহযাত্রীদের তেমন কোন অস্থিরতা নেই।শম্ভুদা কুকুরটাকে আদর করে পঙ্কজদাকে বললেন-“বেচারা আমাদের সঙ্গে এত উপরে এল,কিন্তু জল ছাড়া কিছু খেল না।” পঙ্কজদা -“হক কথা।কিন্তু বারেবারে মুত্ ছিল ক্যান? ” সুবলদা শুনে বললেন-” জন্তু জানোয়াররা পেচ্ছাব করে বিভিন্ন কারণে।একটি হল পথ চিনে ফিরে যাওয়া।আমরা পথ ভুল করতে পারি জলে জঙ্গলে, পাহাড় -পর্বতে।কিন্তু কুকুর ঠিক পথ চিনে যায় তার গন্ধ ক্ষমতা মাধ্যমে।” পঙ্কজদা-“আমার মনে হয় ব্যাটার সুগার হইছে।বেবাক খাইট্যা (পরিশ্রম) উপরে আইল কিন্ত মিষ্টি বিস্কুট খাইল না।মাংস খাইতে দিলে, দেখতেন গপাগপ খাইতো ।” সবাই হেসে ফেললাম পঙ্কজদার কথা শুনে।আমাদের পরিহাস শুনে মেঘবালারা লজ্জা পেয়ে সরে গেল।আমাদের পথ চলাও শুরু হল।মিনিট কুড়ির পর তুঙ্গনাথে পৌঁছে গেলাম।শুনশান চারপাশে। কোন তীর্থযাত্রী নেই।কয়েকটি ঘরবাড়ি আছে কিন্তু অযত্নে অব্যবহারে থাকার উপযুক্ত নয়।পুরোহিত ও সেবাইতদের থাকার জায়গা ভাল।দোকান কাম চটি দেখে এগিয়ে গেলাম।পূজোর উপকরণ কেনা যায় সেখানে। মন্দিরের পূজারীর সঙ্গে আলাপ হল।বললেন-দীপাবলিতে মন্দির বন্ধ হয়।তখন তারা তুঙ্গনাথজীর প্রতীকমূর্তি ১৯ কিমি দূরে মক্কু গ্রামে নিয়ে যান।তারা মৈথিলী ব্রাহ্মণ। তিনি কথায় কথায় জানালেন তাঁর বাবা ও নানা উমাপ্রসাদ মুখার্জিকে চিনতেন।বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখার্জির ছোট ছেলে উমাপ্রসাদের সঙ্গে হিমালয়ের আত্মিক সম্পর্ক।বাঙালিকে হিমালয় চেনান তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে। তাঁকে চেনে গাড়োয়াল ও কুমায়ূনের বহু পুরোন লোকেরা।বাঙালি জানলে তারা অযাচিত ভাবে সাহায্য করে।অনেক ভ্রমণপিপাসু বাঙালি জানে না এই রহস্য।আমাদের মধ্যে প্রায় অনেকেই তাদেরকে সামান্যটুকু ভালবাসা ও প্রীতি দেখানো প্রয়োজন বোধ করেন না।পূজারী পূজোর ডালি নিয়ে মন্দিরে আসতে বললেন।পুঞ্জিভূত মেঘ সারা আকাশ জুড়ে। দুএক ফোঁটা বৃষ্টি পড়া শুরু হল।কুকুরটি একটু চঞ্চল হল,মুখে কিছু না বললেও তার চোখ দিয়ে বোঝাতে চাইল ফিরে যাবে নিচে।বললাম একটু অপেক্ষা কর,পূজো দেবার পর আমাদের সঙ্গে ফিরে যাবি।বড্ড মায়া পড়েছে ওর উপর।আমরা সবাই দেবদূতকে বললাম নিচে গিয়ে ভাল করে খাওয়াতে হবে।দেবদূত মাথা ঝাঁকাল।আমরা পূজোর ডালি নিয়ে মন্দিরে এগোলাম। বিশ ধাপ সিড়ি পেরিয়ে মন্দিরে যেতে হবে।হাঁফ ধরে গেল,দাঁড়িয়ে গেলাম অক্সিজেনের অভাবে।ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল।মন্দির প্রাঙ্গণে ঢোকার মুখে খিলান আকৃতির তোড়ন সিমেন্টে তৈরি ।বেশি দিনকার বলে মনে হল না । আকারে কেদার মন্দিরের ছোট সংস্করণ তুঙ্গনাথ মন্দির। উত্তর ভারত ও উড়িষ্যা মন্দিরের ছাপ পাওয়া যায় মন্দির নির্মাণে।বাস্তুতন্ত্র নিয়ম অনুযায়ী হিন্দু মন্দিরগুলি নির্মাণ হয়।স্বাভাবিকভাবে রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া মন্দির নির্মাণ অসম্ভব।তুঙ্গনাথ মন্দিরের নির্মাণ কাল হাজার বছরের পুরনো বলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলেন।মন্দিরের গর্ভগৃহ ও মণ্ডপ ।গর্ভগৃহ উড়িষ্যার শিল্পরীতিঅনুসারে শিখর ও মণ্ডপ দোচালা স্টাইলে তৈরী।মন্দিরের উঁচুতে কাঠের খিলান বসান হয়েছে।খিলানের উপরে হিন্দু রীতি অনুযায়ী পিতলের ছোট তিনটি কলস পরপর বসান আছে। মন্দিরের পূর্বদিকে অবস্থিত পাহাড় অনেকটা কেটে নেওয়া।নিকটের পাহাড় কেটে ব্লক পাথর তৈরী করে মন্দির তৈরী হয়েছে বলে আমার অনুমান।স্থান নির্বাচন অবশ্যই প্রশংসনীয় । যদি ধরে নেওয়া হয় আদি শঙ্করাচার্য ধ্যানযোগে লুপ্তদেবস্থান উদ্ধার করার ফলশ্রুতিতে তৎকালীন রাজন্যবর্গ দেবমন্দির স্থাপনে উদ্যোগ নিয়েছিলেন,তাহলেও তাঁদেরকে ধন্যবাদ জানাতেই হবে এই অসাধ্য কাজ করার জন্য।বাস্তুকারদের মন্দির নির্মাণের সময়ে চিন্তা করতে হয়েছে দিক,উচ্চতা,শক্ত ভিত, বরফও বৃষ্টিপাতের প্রভাব ।এতসব চিন্তা করেছেন বলেই না আমরা আজকে তুঙ্গনাথ মন্দির দেখতে পাচ্ছি।মন্দির ক্রমশ জীর্ণ হচ্ছে কিন্তু সংস্কার কোথায়?নুতন মন্দির তৈরী হচ্ছে প্রচুর কিন্তু জীর্ণ মন্দিরের সংস্কার করার কোন উৎসাহ দেখতে পাই না কেন!তাকিয়ে দেখলাম মন্দিরের প্রবেশ পথে নন্দী তাকিয়ে আছেন মহাদেবের পানে।প্রবেশপথের ডানপাশে গনেশ ও তার পাশে পার্বতীর ছোট মন্দির। পূজারী আমাদের সবাইকে ভিতরে আসতে বললেন।বৃষ্টি শুরু হয়েছে।গর্ভঘরে তিনজন কোনরকমে দাঁড়িয়ে পড়েছি।বাকিরা মন্ডপে।প্রদীপের অল্প আলো ও ধূপের গন্ধ মিলে এক অদ্ভুত অনুভূতি আমার হল।মেঝে জলের ধারায় পিছল।পাথরের কোন ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির জল পড়ে এমন হয়েছে।সম্মুখে একফুট লম্বা পাথরকে দেখিয়ে পূজারী বললেন তুঙ্গনাথজীকে ভাল করে দেখুন।ইনি স্বয়ম্ভু।মহিষের সামনের বাহু হলেন তুঙ্গনাথ।কেদারে আমরা দেখেছিলাম মহিষের পিঠ।পঞ্চকেদারে মহিষের খন্ডরূপ দেখতে পাই।পান্ডবদের কাহিনী শুনেছিলাম কেদারে। পূজারী সেই কাহিনী পুনরাবৃত্তি করলেন।কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষে যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের রাজা হলেন।মনে শান্তি নেই।ভ্রাতৃহত্যা,আত্মীয়বিয়োগের ব্যথা, পিতামহ ও আচার্যের মৃত্যুর কারণে তীব্র শোক ও অনুশোচনা হয়।মহর্ষি বেদব্যাস পরামর্শ দিলেন মহাদেবের আশীর্বাদ পেলেই শোক প্রশমন হবে।মহাদেবের খোঁজে পঞ্চপান্ডব ঘুরতে ঘুরতে কেদারে এলেন।মহাদেব সহজে ধরা দিতে রাজী নন।তিনি মহিষের ছদ্মরূপ নিলেন।অনেক মহিষদলের মধ্যে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করলেন।ভীম বুঝতে পারলেন।তিনি একটি বলশালী মহিষ দেখতে পেলেন যূথের মধ্যে। ভীম তাড়া করলেন।তখন মহাদেব পাতালে প্রবেশ করতে যেতেই ভীম মহিষের পিঠ জাপটিয়ে ধরতেই সেই অংশ পাথরে রূপান্তর হল। মহাদেব পান্ডবদের তপস্যায় সন্তুষ্ট হলেন এবং তাদেরকে আশীর্বাদ করলেন। পঞ্চকেদারে মহিষের পাঁচ অংশ ফুটে বেরিয়েছে।মদমহেশ্বরে মহিষের নাভি,তুঙ্গনাথে সামনের বাহু,রুদ্রনাথে মুখ ও কল্পেশ্বরে জটা।কথিত পঞ্চপান্ডব এই পাঁচ জায়গায় এসে মন্দির তৈরী করেছিলেন।কালের বিবর্তনে মন্দির ধ্বংস হয় এবং পরে ভূগর্ভে চলে যায়।কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই মহাভারতে এই গল্পটি আমি পাইনি।রাজশেখর বসু,কালীপ্রসন্ন সিংহ,কাশীরাম দাসের মহাভারত ও হরিদাসসিদ্ধান্ত বাগীশ, মহামহোপাধ্যায়ের মূল সংস্কৃত মহাভারত থেকে অনূদিত বাংলা পড়েই বলছি এটি পুরোটাই পান্ডাদের বানানো।কুরুযুদ্ধের শেষে পান্ডবেরা এখানে আসেন নি।বনপর্বে লেখা আছে যুধিষ্ঠির এসেছিলেন বদরীকাশ্রমে এবং অন্যান্য তীর্থ পরিক্রমা করেছিলেন ঋষিপুরুষদের অনুরোধে। কিন্তু যুদ্ধের শেষে কখনই যান নি কেদারে।আদি শঙ্করাচার্য লুপ্ত তীর্থস্থান উদ্ধার করেছিলেন এটা যেমন সত্য,তেমনি তিনি এই কথাটি বলে যান নি যে এই স্বয়ম্ভু লিঙ্গ পান্ডবদের পূজিত।
পূজারী তুঙ্গনাথ শিলার পিছনে ব্যাসদেব ও আদি শঙ্করাচার্যের মূর্তি দেখালেন।প্রদীপের সামান্য আলোয় তুঙ্গনাথের রূপ বুঝতে কষ্ট হল।টর্চ নিয়ে এলে ভাল করে রূপটা বুঝতে পারতাম।তুঙ্গনাথজী আমার মনের খেদ জানতে পেরে হঠাৎ মেঘ হটিয়ে দিয়ে আলোর রেখা আসতে দিলেন প্রবেশপথ ধরে। অল্প সময়ের জন্য আলো স্পর্শ করলো শিলাটিকে।আমরা তিনজন মহিষের সামনের বাহুর ছাপ স্পষ্ট দেখলাম।তুঙ্গনাথজীর অশেষ কৃপা।বর্ষণসিক্ত পরিবেশে সামান্য সময়ের জন্য আলোর ব্যবস্থা করে দিলেন।ফটো তোলার অনুমতি চাইতে পূজারী নিষেধ করলেন।বললেন-আশুতোষের দর্শন লাভ তারাই পান যারা কষ্ট করে এখানে আসতে পারেন।ঘরে বসে ছবি দেখে যারা খুশী হতে চান তাদের জন্য তিনি অধরা থাকেন।তিনি আরও জানালেন-বংশ পরম্পরায় ওরা তুঙ্গনাথজীর পূজা করে আসছেন।শীতকালে দীপাবলির পরের দিন গর্ভঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে তুঙ্গনাথজীর প্রতীকী নিয়ে মক্কুগ্রামে চলে আসেন।অক্ষয়তৃতীয়ার দিন তারা এসে মন্দিরের দরজা খুলে দেখেন তখনও প্রদীপ দীপ্যমান। বাবুমশাইরা,আপনারা আধুনিক যুগের লোক,বিশ্বাস করা বা না করা আপনাদের বিষয়।কিন্তু পরীক্ষা করে দেখতে দোষ কি?শীতকালে এখানে কেউ থাকে না। চারিদিকে বরফে ঢাকা থাকে।মন্দিরের দরজা বরফে ঢেকে যায়।শীতের সময় ঋষিপুরুষেরা তুঙ্গনাথজীর পূজা করেন।সেইসময় মানুষের পূজা করার অধিকার নেই।তাঁরাই জ্বালিয়ে রাখেন প্রদীপের আলো।লক্ষ্য করলাম প্রদীপদানিটি এমন কিছু বড় নয়।বড়জোর ঘন্টা চারেক জ্বলতে পারে।জানি না আজকের বিজ্ঞান কি ব্যাখ্যা দেবে।অঘটন আজও ঘটে।বুদ্ধি দিয়ে যার ব্যাখ্যা চলে না।অবিশ্বাসীরা পরখ করে দেখে নিতে পারেন ঘটনাটি যা বললাম।পূজারী পূজোর তোড়জোড় শুরু করলেন।কোন তীর্থযাত্রী নেই,ফলে কোন তাড়া নেই।অনেকক্ষণ ধরে পূজা হল।পূজারীর কন্ঠ হতে উচ্চারিত বৈদিক মন্ত্র গর্ভঘরে এক অভূতপূর্ব অনুরণন সৃষ্টি হল।সকলের মনে ভক্তি মিশ্রিত আবেগ সঞ্চার হল।জনে জনে পঞ্চপ্রদীপ দিয়ে তুঙ্গনাথজীকে আরতি করলাম পূজারীর মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে –
সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়ণী নমোস্তুতে।
সৃষ্টি -স্থিতি -বিনাশনম্,শক্তি -ভূতে-সনাতনি
গুণাশ্রয়ে গুণময়ী নারায়ণী নমোস্তুতে।
শরণাগত দীনার্ত পরিত্রাণা পরায়নে
সর্ব্বস্যার্তি হরে দেবী নারায়ণী নমোস্তুতে।।
ওঁ ত্র্যম্বকম্ যজামহে সুগন্ধিম্ পুষ্টিবর্দ্ধনম্
ঊর্বারুকমিব বন্ধনাৎ মৃত্যোর্মুক্ষিয় মা অমৃতাত্।।
ওঁ নম শিবায়।
পূজার শেষে মন্দিরের বাইরে এলাম।ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরেই চলেছে।পূজারী আমাদের ভৈরবনাথের কাছে পূজো দেওয়ালেন।কুয়াশার মতন মেঘ চারিদিকে। পার্বতী মন্দিরের ডানদিকে পাঁচটি চারফুটের সাইজের ছোট মন্দির। এগুলি পঞ্চকেদারের প্রতীক।এবার বিদায় নেবার পালা।পূজারীর আশীর্বাদ নিয়ে নিচে নামতে লাগলাম।তুঙ্গনাথ থেকে এক কিমি উপরে চন্দ্রশিলা।কথিত যে রামচন্দ্র রাবণবধের কারণে ব্রহ্মশাপ থেকে মুক্তি কামনায় চন্দ্রশিলায় তপস্যা করেছিলেন।চন্দ্রশিলা যেতে হলে রাত্রিকাল কাটাতে হবে তুঙ্গনাথেএবং রাতভোরে রওনা দিয়ে সোয়া একঘন্টায় পৌছে যান চন্দ্রশিলায়।৩৬০° বিস্তৃত হিমালয়ের বিভিন্ন শৃঙ্গ দেখার সৌভাগ্য ও তার সাথে সূর্য উদয়ের অকল্পনীয় সৌন্দর্য দেখার সাক্ষী হবেন যা সারাজীবন স্মৃতিতে অক্ষয়,অমর হয়ে থাকবে।তবে সবই নির্ভর করছে প্রকৃতির বরাভয়ের উপর।আমাদের ইচ্ছে ছিল থাকার কিন্তু প্রকৃতির দুর্যোগ পূর্ণ আবহাওয়া দেখে রাজী হলাম না।পূজারী বলেছিলেন তুঙ্গনাথে একবার এলে সম্পূর্ণ হয় না,দ্বিতীয়বার আসতে হয়।কে জানতো তার কথা সত্বর ফলে যাবে। চারবছরের মাথায় আবার এলাম তুঙ্গনাথ দর্শনে, তবে অন্য দলের সঙ্গে। সেবার খুব ভাল প্রকৃতির সাহায্য পেয়েছিলাম কিন্তু চন্দ্রশিলা অধরাই ছিল। সেবার আবহাওয়া দুপুর তিনটের পর থেকে খারাপ হতে থাকায় নীচে নেমে এসেছিলাম।ইচ্ছে হয় আবার যাই শরীর সুস্থ থাকা কালীন। চন্দ্রশীলা দর্শন করলেই সমাপ্ত হয় সম্পূর্ণ তুঙ্গনাথ দর্শন। আসতে পারবো কিনা জানিনা।কিন্তু অন্তরে যে ছবি আঁকা হল সেকি কখন ভোলা যায়!স্মৃতির মণিকোঠায় জমে থাকা অভিজ্ঞতা জীবনের শেষপ্রান্তে এসে নির্জনে বসে যখন রোমন্থন করব,তাই হবে সুখপ্রদ ও আশীর্বাদপ্রাপ্তি।জীবনে সব দেখা সম্ভব নয় কিন্তু যতটুকু পেয়েছি তাই বা কম কি!যতটুকু পেয়েছি,দেখেছি,নিঙড়িয়ে তার স্বাদ নিয়েছি দুহাতভরে।যুক্তকরে বলি-
‘হে নিস্তব্ধ গিরিরাজ, অভ্রভেদী তোমার সঙ্গীত
তরঙ্গিয়া চলিয়াছে অনুদাত্ত উদাত্ত স্বরিত,
প্রভাতের দ্বার হতে সন্ধ্যার পশ্চিমনীড়-পানে
দুর্গম দুরূহ পথে কী জানি বাণীর সন্ধানে!’
****************************************************
শান্তনু মজুমদার পরিচিতিঃ
সুরমা নদীর তীরে শ্রীহট্টে,অধুনা বাংলাদেশে জন্ম।বাল্যকাল কাটে শিলং এ ও পরে হুগলী জেলার ভদ্রেশ্বরে স্থায়ী বাসিন্দা। বইপড়া নেশা বাবা-মা এর কাছ থেকে পাওয়া। বিত্ত মন্ত্রণালয়ের রেভিনিউ বিভাগে সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ছুটি পেলেই ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়তেন। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন ও নর্মদার তীর ধরে মধ্য প্রদেশ থেকে গুজরাত পর্যন্ত ছুটে বেড়িয়েছেন।