লাল রডোডেনড্রন
দিলীপ কুমার সিংহ
প্রমথ বাবু রোজ সকালে হাসপাতালে ভর্তি নিজের স্ত্রীকে দেখতে আসেন। হাসপাতালের গেট পার হলেই তাঁর বুকটা দুরদুর করতে থাকে। ওয়ার্ডে পৌঁছতেই প্রায় দিন সিস্টার তাঁকে একটা কাগজ ধরিয়ে বলে,”যান এই ওষুধগুলো তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন| ডাক্তার বাবু লিখে গেছেন ৷”
আজকেও,দূর থেকে দেখলেন তাঁর স্ত্রীর হাতে একটা বড় মত কাগজ আছে | বুঝলেন আজকের দাবিটা বেশ বড় কিছু হবে | ভয় লাগলেও কোন উপায় নেই, সামনে গিয়ে দাঁড়াতে তো হবেই |
রোজকার অভ্যাস মত স্ত্রীর হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন,”কেমন আছ?” মলয়া এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে,কাঁপা গলায় বললেন,”সিস্টার এসেছিলেন,বলে গেলেন এক ইউনিট রক্ত আজই দিতে হবে,তবেই কাল অপারেশন হতে পারে| তুমি কি করবে এবার?”
–“আরে ডাক্তার বলেছে রক্ত দিতে হবে,তো দিতে হবে| এছাড়া তো কোন উপায় নেই ৷ চিন্তা করছো কেন? আমি দেখছি কি করা যায় !”
রক্ত দেবার ফর্ম আর ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে বেরিয়ে এলেন ঠিকই,তবে পয়সা দিয়ে তো রক্ত পাওয়া যাবে না,কাউকে না কাউকে রক্ত তো দিতে হবে| কিন্তু কে দেবে? কাউকে এমন ভাবে চেনেন না যে তাকে সোজা বলবেন যে,চলুন,আমার স্ত্রীর জন্যে রক্ত দিতে| তাহলে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তাঁর মনে হল যে তিনি নিজেও তো রক্ত দিতে পারেন| কি হবে ? যদিও তাঁর বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই করছে| এখনো বেশ শক্ত সমর্থ তো ৷ মলয়ার বিছানা ধরার আগের বছর পর্যন্ত,তাঁর জন্মদিন,বিবাহ বার্ষিকী,ভেলেনন্টাইন ডে,সবই সেলিব্রেট করেছেন এবং ভালো ভাবে করেছেন| এক সাথে কিছুটা ঘুরে এসেছেন,নিজে রান্না করে খাইয়েছেন,গিফট দিয়েছেন| গিফট বলতে মনে পড়ে গেল যে মলয়া লাল রডোডেনড্রন ফুল ভীষণ ভালবাসত| প্রতি বছর যেখান থেকে হোক খুঁজে এনে লাল রডোডেনড্রন ফুল গিফট দিতেন| মলয়া ফ্লাওয়ার ভাসে সুন্দর ভাবে রাখত, রোজ জল বদলাত,জলে একটু নুন দিত,ফুল শুকিয়ে গেলেও আরো কিছুদিন সাজিয়ে রাখত| কিন্তু মলয়ার শরীর খারাপ হওয়াতে এই বছরই কোনো গিফট দেওয়া হয় নি| বিয়ের পাঁচ বছর আগে থেকে বিয়ের ছত্রিশ বছর পর্যন্ত,দীর্ঘ একচল্লিশ বছর,গিফট দিয়ে এসেছেন,কিন্তু বিয়াল্লিশ বছরের লাল রডোডেনড্রন ফুল দেওয়াটা হয়ত আর হবে না|
এই সব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হল যে,ডোনার আর না খুঁজে,নিজে মলয়াকে রক্ত ডোনেট করতে পারলে সেটা তো বিয়াল্লিশ বছরের গিফট হতে পারে|
গিফট এর কথা মনে আসতেই, বেশ চাঙ্গা হয়ে,গট গট করে হেঁটে ব্লাড ব্যাঙ্কএ ঢুকলেন| ফর্ম ভরলেন,ডাক্তারের দস্তখত করা রিকুইজিশান স্লিপ দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,”আমার স্ত্রীর জন্যে এক ইউনিট রক্ত চাই, আমার সঙ্গে গ্রুপ মেলে,দয়া করে আমার ব্লাড নিন|” ব্লাড ব্যাঙ্ক এর ডাক্তার ওঁনার দিকে তাকিয়ে বললেন,”আপনি রক্ত দেবেন? কত বয়েস আপনার?”
বললেন,”আটান্ন বছর|”
–“কিন্তু দেখলে ত মনে হয় না| বার্থ সার্টিফিকেট আছে?”
–“না নেই| মা তো জন্ম দিয়ে মরে গিয়েছিল| পরের বাড়িতে মানুষ হয়েছি| বার্থ সার্টিফিকেট কে করাবে?”
–“তাহলে আপনার ঠিক বয়েস আপনি জানলেন কি ভাবে ?”
–“আমার স্ত্রী বলেছে|”
–“কিন্তু আপনার স্ত্রী কি ভাবে জানবে কবে আপনার জন্ম হয়েছিল ?”
–“কেন স্যার,স্ত্রীরাই তো ভালো করে বুঝতে পারে কখন আমরা বেঁচেও মরে আছি আর কখন মরেও বেঁচে আছি,স্ত্রীরাই তো সবই বোঝে| তাই স্যার,আমার স্ত্রী কেন বলতে পারবে না,যে আমার বয়স কত? তাছাড়া আমার স্ত্রীর ওভারিয়ান ক্যানসার,ফোর্থ স্টেজ,ফিরে আসার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে | তাই স্যার…..প্লীজ |”
কিছুটা বুঝতে পেরে হয়ত,ব্লাড ব্যাঙ্ক এর ডাক্তার টেকনিশিয়ানকে বললেন,”দুজনের রক্তের ক্রস ম্যাচ হলে রক্ত নিয়ে নিন|”
যাক,তাহলে মলয়াকে হয়ত,তাঁর জীবনের শেষ বছরে,তাঁর বিয়াল্লিশতম গিফট দিতে পারছেন এই ভেবে প্রমথ বাবু খুব খুশী মনে রক্ত দেবার টেবিলে শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই,এক গুচ্ছ রডোডেনড্রন ছড়িয়ে পড়ল মনের আনাচে কানাচে|
********************************************
ডাঃ দিলীপ কুমার সিংহ পরিচিতিঃ
বর্ষীয়ান অস্থি শল্য চিকিৎসক। বাংলাদেশ স্বাধীনতার সাক্ষী ভারতীয় স্থল সেনার আধিকারিক পদে থাকাকালিন। বর্তমানে পটনা মেডিকেল কলেজের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রফেসর। বিহার বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন এর বর্তমান সভাপতি। বিহার রাজ্য বাংলা একাডেমির প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং বিহার রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের প্রাক্তন ভাইস চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। সর্বভারতীয় বাংলা ভাষা মঞ্চ, কলকাতার সভাপতি পদে অধিষ্ঠাধিন। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়,পশ্চিমবঙ্গ দ্বারা বিদ্যাসাগর সম্মানে ভূষিত। অবসর সময়ে ছোট গল্প লিখতে পছন্দ করেন।