সম্পর্ক
দেবলীনা দে
দিনের শুরুটা জয়িতার রোজ প্রায় একই রকম। কাকভোরে উঠে সারা বাড়ি পরিষ্কার করে স্নান সেরে পুজো। ছেলে মেয়ের ঘুম ভাঙানো, নাতনিকে স্কুলের জন্য তৈরী করা ,তারপর রান্না ঘরে যুদ্ধ। কখনও চায়ের পাতা, কখনও পরোটার আটা তার কোমল হাতের স্পর্শে যেন স্নাত হয়। আর পাঁচটা মানুষের মত ভুলও হয়। চায়ে চিনি বেশি বা তরকারিতে নুন কম। তার জেরে বাড়িতে অশান্তি হয়না বললে ভুল হবে। দোতলা বাড়ি হলেও জীবনের পরিধি যেন এই একতলার মধ্যে সীমিত তার। কিন্তু আজ সেই সীমিত জীবনের চেনা গণ্ডি পার করে জীবন যেন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। কাপড়ে রক্তের দাগ তার মাতৃত্বকে নানা প্রশ্ন করছে। আর সামনে শুয়ে আছে তার বছর পনেরোর নাতনি তিতলি।
নাতনির হাত তিনি শক্ত করে ধরে আছেন আর গলা থেকে হালকা সুরে ভেসে আসছে ঠাকুর নাম। ভগবানের কাছে প্রার্থনা একটাই,’আমার জীবন কেড়ে নিলে নাও,আমার তিতলির যেন কিছু না হয়।’ মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে ভাবতে,এই আঁতের টান কি এতটাই শক্ত যে একটা মানুষ তার নিজের জীবন বিসর্জন করতেও পিছুপা হয় না!!
তিতলির ওই চাঁদপানা মুখ তখন রক্তে রাঙা। নিজের আঁচল দিয়ে জয়িতা তখন কপাল থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত কোনো ক্রমে আটকে আছে। অ্যাম্বুলেন্স ছুটছে দ্রুতগতিতে। পিছনের যেন ফেলে যাচ্ছে তিতলির হাসি মুখ আর জয়িতার স্নেহ।
হসপিটালে পৌঁছতেই ডাক্তাররা তিতলিকে নিয়ে চলে গেলেন ও. টি তে। সাদা দরজার ব্যবধানে নাতনি আর দিদুন তখন জীবনের দুই সীমান্তে দাঁড়িয়ে। জয়িতা তিতলির সাথে থাকতে চাইছেন,ছুঁতে চাইছেন তাকে। কারণ বাইরের এই বেঞ্চে একাকী বসে তার মন শুধু ফিরে যাচ্ছে সেই বাড়ির একতলার সিঁড়িতে।
‘তিতলি,ও তিতলি কি খাবি বল মা। আমার অনেক কাজ পরে আছে।’
তিতলি তখন নিজের প্রিয় কার্টুনে মগ্ন। স্কুল থেকে ফিরেই ঝাঁপ দিয়েছে সেই জগতে।
‘তুমি দাওনা একটু চাউমিন করে।’
‘রোজ রোজ এই ফাস্টফুড কেন খেতে চাও তুমি। মাম্মাম কিন্তু আজও বকবে।’
তিতলি বসার ঘর থেকে দৌড়ে এলো রান্না ঘরে। নিজের নরম হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো প্রিয় দিদুনকে। সেই ভালোবাসার স্পর্শে জয়িতার সারা জীবন যেন ভরে গেলো।
‘তুমি তাহলে আজও মাম্মামকে বলো না। বলো বলো তুমি বলবে না।’
নাতনির আবদার পৃথিবীর কোন দিদুন কবে আর ফেলতে পেরেছে। দিদা নাতনির আলাদা পৃথিবী থাকে, সেখানে সবাই আসতে পারে না। আর সব কথা সবাই জানতেও পারে না।
তিতলি যখন খাচ্ছে, জয়িতা পাশে বসে তার মাথায় স্নেহের হাত বোলাচ্ছেন। তিতলির মুখের দিকে তাকিয়ে তার বার বার নিজের মেয়ে অদ্রিজার কথা মনে পড়ছে। সেও কি কম জেদী ছিল। সেই ছোটবেলা থেকে। বড়ো হয়েও হেরফের হয়নি। জয়িতার এখনও মনে আছে সমরেশের কথা। অদ্রিজার হঠাৎ করে একদিন বলে ওঠা সে সমরেশকে বিয়ে করতে চায়। এই নিয়ে বাবা আর মেয়ের মধ্যে কি কম অশান্তি। কেউ নিজের কথা থেকে সরবে না। কিন্তু জয়িতা চিরকাল ছেলে মেয়েকে সাপোর্ট করে এসেছে। তার বিশ্বাস আছে তার শিক্ষা কখনও মিথ্যে হবে না। মেয়ের পছন্দে তার পূর্ণ সহমত। বিয়ের পরে অদ্রিজা যখন বললো সে ডিভোর্স নিতে চায়,তখনও সমাজের সব কুকথা আর সন্দেহের নজর থেকে জয়িতা তাকে আগলে রেখেছিল, মেয়েকে নিজের আঁচলের ছায়ায় রেখেছিল। মেয়ে যখন দিশেহারা তিতলিকে একা কি করে মানুষ করবে, জয়িতা তখন মেয়ের হাত শক্ত করে ধরলো। সেই বাঁধন আজও একটুও আলগা হয়নি।
তিতলি যখন প্রিয় খাবার ও কার্টুনে মগ্ন, সারাদিনের ক্লান্তি একটু দূরে রেখে জয়িতা তখন তার ফোনটা হাতে নিয়ে কি যেন খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। হঠাৎ সে বুঝতে পারে নাতনি খাওয়া ছেড়ে তার সাথেই যোগ দিয়েছে।
দিদুন সাধের নাতনিকে স্নেহ চুম্বনে ভরিয়ে দিলেন।
‘জানো,ভারী মজার জিনিস এই ফেসবুক।’
‘তোমার কোনো বন্ধু হলো?’
‘হয়েছে বৈকি। অনেক বন্ধু হয়েছে ৷’
নাতনি আজ শিক্ষিকা আর ছাত্রী দিদুন। দিদুন সারাদিন একা একা থাকে দেখে সে তাকে ফেসবুকে একখানা একাউন্ট খুলে দিয়েছে। জয়িতার চেনা পৃথিবীর সাথে সাথে এই এক অচেনা পৃথিবী আজ তার কাছে বেশ মধুর।
সে যেন এক অদ্ভুত মুক্তির স্বাদ পায়। পাখির মতো খোলা আকাশে উড়তে পারে সে। তার জীবনে এক নতুন রং যোগ হয়েছে। সারাদিনের ব্যস্ততার মধ্যেও দিনের কোন এক সময় সে এই নতুন জগতে পা রাখে, ভালোবেসে, আনন্দে। বাড়ির কাজ আর একটু গাছের দেখাশোনা ছাড়া তার জীবনে আর তেমন কিছু নেই। কিন্তু আজ এই অভ্যাসই কাল হলো। অচেনা এই গণ্ডি তাকে এক দুর্বিষহ পথে টেনে আনলো।
জয়িতার অজান্তেই তিতলি ছুট দিয়েছিল দোতলায়। এক দমকা আওয়াজে জয়িতা যখন ফোন থেকে মুখ ফেরায় তিতলি তখন রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে।
জয়িতা কোন মতে বর্তমানে ফিরে এসে, চোখের জল মুছে খবর টুকু পৌঁছে দিল ছেলে,মেয়ে ও স্বামীর কাছে। এখন তার কাছে অপেক্ষা ও আক্ষেপ ছাড়া কিছুই নেই।
ফোন পেতেই হসপিটালে তড়িঘড়ি করে ছুটে এসেছে তিতলির মা,মামা ও দাদু। জয়িতার মুখে সব কথা শুনতেই,সব দায়িত্ব গিয়ে পড়লো তার নিজের ঘাড়ে।
“এই জন্যই বারবার করে বারণ করতাম এই ফেসবুক,ফোন এই সব ছাড়ো। আমার কথা না শোনার ফল দেখলে তো?”,ছেলে সপ্তম কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো।
লজ্জায় জয়িতা যখন মাথা নিচু করে আছে,তখন হঠাৎ অদ্রিজা বলে উঠলো,’কি হলো মা? এই নিলে তুমি তোমার নাতনির ভার, এই তোমার দায়িত্ব? সারাদিন তোমার ভরসায় আমি ওকে রেখে যাই। আর তুমি ওর দিকে একটু নজর টুকু দিতে পারোনা?’
‘নজর দেবে কি করে? ফেসবুকে ছবির পোস্ট করা থেকে সময় পেলে তবে তো।’ ছেলে অর্ণব গায়ের জোরে মায়ের হাত ধরে বলে উঠলো,’একবার, একবার ভেবে দেখেছো যে ছবির গুলো তুমি পোস্ট করো সেইগুলো আমাদের কাছে কতটা embarrassing কতটা লজ্জায় ফেলে তোমার ওই ছবি।’
কাঁপা গলায় জয়িতা বিস্ময়ের সাথে বললো, ‘আমার কাছে সম্বল বলতে তোদের ছোটবেলা। সেই ছবি তোদের লজ্জা দেয়?’
‘বাঃ! আবার শুরু হলো তোমার এই ইমোশনাল ড্রামা। অনেক হয়েছে মা। এবার বন্ধ করো।’,এই বলে অদ্রিজা বেরিয়ে গেলো,সাথে গেল অর্ণব ও।
অগ্নিভ বাবু নীরব দর্শক হয়ে সবটুকু শুনলেন। ছেলে মেয়ে চলে যাবার পর জয়িতার পাশে গিয়ে বসলেন।
‘আমার অস্তিত্ব আমার ছেলে মেয়ের কাছে লজ্জার কারণ। আমি ওদের কতটা কষ্ট দি! ঠিকই তো। দোষ আমার। তিতলি কে আমার চোখে চোখে রাখা উচিত ছিল। আমার আধুনিক হতে চাওয়ার দাম আজ আমার আদরের দিদিভাইকে দিতে হলো। হায় রে। এই পাপ আমার কোনকালে যাবে না।’
জয়িতা এই চরম পাপবোধের মাঝেই হাতে এক আলতো ছোঁয়া অনুভব করে আর হঠাৎ ই ভেসে আসে অগ্নিভবাবুর সান্ত্বনা বাক্য।
‘দোষ কি সব তোমার জয়িতা? দোষ তো আমারও আছে। চাকরি করাকালীন কোনদিন সংসারের দিকে আমি তাকাইনি। যা করেছ তুমি নিজে। ছেলে মেয়ের পড়াশোনা,ওদের বড় করা,রোগ বিপদ সব ঝড় তুমি একা হাতে সামলেছো। আমি শুধু টাকা রোজগার করেছি মাত্র।’ বলতে বলতে অগ্নিভবাবুর গলা ভারী হয়ে আসে।
জয়িতা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বিয়ের এতগুলো বছর পার করে আজ যেন সে এক নতুন অগ্নিভ কে দেখছে। কই,আগে কখনও তো এমন কথা সে শোনেনি।
‘দোষ কাল ও আমারই ছিল আর আজও আমার। ওরা তোমাকে এতগুলো কথা বলে চলে গেলো। আর আমি…আমি চুপ করে থাকলাম। হয়তো আমিই ওদের কখনও শেখাতে পারিনি যে তোমাকে কিভাবে সম্মান দিতে হয়। তোমারও যে একটা জীবন আছে,একটা নিজস্বতা আছে তা আমিই ওদের বোঝাতে পারিনি। রিটায়ারমেন্ট এর পর আমি তো চলে গেলাম ক্লাব বন্ধু এই সব নিয়ে। কোনদিন ভেবে দেখিনি তোমার তো রিটায়ারমেন্ট ও নেই। তিতলির আজ যা অবস্থা তার জন্য তুমি না,আমি দায়ী জয়িতা। তিতলির দায়িত্ব যতটা তোমার ততটা তো আমারও। তুমি আজ সফল জয়িতা কিন্তু আমি কোনোদিনই তোমার যোগ্য হয়ে উঠতে পারলাম না।’
জয়িতা তখন চোখের জল মুছে অগ্নিভবাবুর হাতটা আরো শক্ত করে ধরলো। ইতিমধ্যেই,অদ্রিজা ও অর্ণবের সাথে সাথে ডাক্তারবাবু এসেছেন।
‘She is out of danger now. কিন্তু একটু খেয়াল রাখতে হবে। Complete bed rest.’
শুনে অদ্রিজা ডাক্তারবাবুকে কিছু একটা বলতে যাবে,কিন্তু অগ্নিভ বাবু তাকে থামিয়ে নিজে বলে উঠলেন,‘আপনি চিন্তা করবেন না। ওর দিদুন আছে তো। যে সমাজের সব আঘাত থেকে ডিভোর্সড মেয়েকে রক্ষা করতে পারে,ছেলের সব স্বপ্ন পূরণ করতে নিজের সব কিছু বিসর্জন দিতে পারে সে তার নাতনিকে তো যত্নে রাখবেই। আসলের থেকে সুদ সব সময়ই বেশি মিষ্টি। ‘And it’s all just an accident’,ডাক্তারবাবু হয়তো সবটা পুরোপুরি ভাবে না বুঝেই বললেন, ‘Oh yes absolutely. And accident happens.’
অদ্রিজা ও অর্ণব তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। জয়িতা ও অগ্নিভ বাবু নাতনির কেবিনের দিকে পা বাড়ালেন।
***********************************************
লেখিকা পরিচিতিঃ জন্ম কলকাতা শহরে কিন্তু বড় হয়ে ওঠা হুগলী জেলার এক গ্রামে। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজি সাহিত্যে এম এ। কল্পনার জগতে গল্পের মালা গাঁথা, অবসর সময়ের শখ ও ভালবাসা দুইই। পড়াশোনার পাশাপাশি সুরের ভক্ত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও রবীন্দ্র সঙ্গীত নিয়ে চর্চা বেশ কয়েক বছরের।
ভালো লাগলো। শুভকামনা রইলো।
ভালো লাগলো। পরবর্তী তে আরো ভালো লেখার অপেক্ষায় রইলাম।