Shadow

অভিশপ্ত রাগিনী (তৃতীয় পর্ব) – রামানুজ দাশগুপ্ত

রামানুজ অভিশপ্ত রাগিনী ছবি

অভিশপ্ত রাগিনী (তৃতীয় পর্ব)

রামানুজ দাশগুপ্ত

ভীমানি একটা সাইনিং মানি তাদের হাতে দেয়,তারা যেন হাতের কাছে চাঁদ পেয়ে যায়৷ টাকার বান্ডিলটা নিয়ে বড়দার কাছে আসে,”দাদা এই টাকাটা আজ একটা নতুন কাজের জন্য পেলাম৷ তুমি এটা রাখো৷” কিন্তু বড়দা টাকাটা এক নিমেষে গুনে নিয়ে বলে,”ছ্যা ছ্যা এই টাকায় তো বাড়ির একটা বাথরুম ও হবে না রে!” “আমি জানি দাদা,ভগবান চাইলে আমি আরো টাকা এনে দেবোI” “রাখ তোর ভগবান,তোদের মতো অকাজের মানুষের জন্য ভগবান নেই,আমি তোকে তিন মাস সময় দিলাম৷ না হলে নিজের পথ দেখে নিবি৷ “দিব্য বাবার দেওয়া সাধের গাড়িটা বেচে দিল,সামান্য টাকায়,কিছু দিনের জন্য তো হাত খরচা চালাতে পারবে৷ কাজও শুরু করে,দুখানা গানের রেকর্ডিংও হয়ে যায়৷ নতুন একটা ছেলেকে দিয়ে গান গাওয়ানো হলো,ভীমানি তাকে প্রথম ব্রেক দিল৷ যদিও ওরা তার গাওয়াতে খুব একটা খুশী হলো না,রঙ্গনাথকে ওরা খুব মিস করছে যে শুধু তাই নয়,রেকর্ডিং এ রবি কে ডেকেছিল বাজানোর জন্য,রবি যথারীতি গম্ভীরভাবে এলো,বাজালো,আর যাবার সময় যা বলে গেল তাতে দুজনেই খুব ভেঙ্গে পড়লো৷ রঙ্গনাথ পাগল হয়ে মুম্বাই থেকে ফিরেছে,তাকে জুহুর সি বিচে মৃতপ্রায় অবস্থায় পুলিশ আবিস্কার করে৷ ঘটনায় জানা যায় প্রসিদ্ধ সঙ্গীত পরিচালক য়শপাল সিং তাকে দিয়ে দু খানা গান গাইয়েছিলেন তার মধ্যে একটা গান খুব হিট করে সারা ভারতে৷ সমসাময়িক আরেকজন উঠতি গায়ক ষড়যন্ত্র করে ড্রিংকসের সাথে বিষ দেয়,কোনমতে প্রাণ বাঁচলেও গলাটা একদম নষ্ট হয়ে যায় ও একদম উন্মাদ হয়ে যায়৷
বাবা খবর পেয়ে গিয়ে ছেলেকে নিয়ে আসেন,তারপর এই অ্যাসাইলামে৷ পরদিন ওরা দুজন যায় তাকে দেখতে,রঙ্গনাথ হয়তো ওদের চিনতে পেরেছিল,ওদের দেখে বলে,”আমার কাছে বোসের সাউন্ড সিস্টেম আছে দেওয়ালে ফিট করা,আমার নতুন গান শোনাই তোদের আয়৷ “দিব্যর চোখে দুফোঁটা জল,ফিরে আসে ওরা৷
ভীমানির ফরমাস মতো আরো দুটো গান রেকর্ড হবে,তারপর হয়তো আরো কিছু টাকা পাওয়া যাবে৷ ভীমানি তার অফিসে একটা ঘর দিয়েছিল,সেখানে বসেই ওরা কাজ করতো৷ সেদিনও তারা দুজন বসেছে,অনিরুদ্ধও ঠিক মতো লিখতে পারছে না আর দিব্যর মাথায় তো কোন সুরই আসছে না৷ এরমধ্যে দিব্যর শরীরটা খারাপ হয়ে উঠলো,গা টা গুলিয়ে বমি এল,অনিরুদ্ধ বলল,”চল,বাড়ি ফিরে যাই,একটু বিশ্রাম দরকার৷”
অনিরুদ্ধ সাধারণত রাত দশটার আগে বাড়ি ফেরে না৷ সেদিন চারটের মধ্যে ফিরে এল,কিন্তু বাড়ি এসে যা দেখল এক মুহুর্তে সমস্ত ছবিটা তার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল৷ বুঝল কেন এই হাই বাজেটের ছবি এক কথায় ভীমানি তাদের দিয়েছিল৷ ভেতর থেকে দরজা লক করা ছিল না,চাবি ঘুরিয়ে ল্যাচ টা খুলতেই দেখে স্বাতী ভীমানির সাথে অতি অন্তরঙ্গ অবস্থায়,অনিরুদ্ধের হঠাৎ এসে পড়ায় ওরাও হতচকিত৷ অনিরুদ্ধের মুখে কোনও কথা নেই,বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে আর দুজনকে দেখে যাচ্ছে,কয়েক সেকেন্ড পর ভীমানি বলে,”তুমি কিছু দেখনি অনিরুদ্ধ, কিছুই হয়নি, সব ভুলে যাও,কালই তোমার নতুন গাড়ি এসে যাবে আর ছবি শেষ হলেই একটা নিজস্ব ফ্ল্যাট,আর তোমার বন্ধুর প্রবলেমও সলভ্ড| “অনিরুদ্ধ আরো জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে,হঠাৎ করে নজর পড়ে স্বাতীর গলার দামি নেকলেসটার ওপর,ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর,স্বাতী টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়,মাথাটা জোরে ধাক্কা খায় একটা লোহার টেবিলে,সাথে সাথেই প্রবল রক্তপাত সাথে অজ্ঞান| অনিরুদ্ধ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ ভীমানি বাইরে বেরিয়ে যায়,অনিরুদ্ধ আস্তে আস্তে নীচু হয়ে স্বাতীকে ডাকে কিন্তু কোন সাড়া পায় না৷ দশ মিনিটে ভীমানি ফেরে,সাথে ডাক্তার,ডাক্তার বলে সব শেষ৷ অনিরুদ্ধ একই ভাবে স্বাতীর পাশে বসে থাকে,এত অল্প সময়ের মধ্যে কি যে ঘটে গেল বুঝে উঠতে পারে না৷ আরো ঘন্টা খানেকের মধ্যে বাইরের লক খুলে ভীমানি ঘরে ঢোকে,সাথে পুলিশ| হাত কড়া পরিয়ে অনিরুদ্ধকে ভ্যানে তোলা হল,আর আরেকটা গাড়িতে স্বাতীর ডেড বডি।
দিব্যকে শেষ পর্যন্ত বাড়ি ছাড়তে হল,গিয়ে উঠল একখানা বস্তির ঘরে| যাবার আগে অনিরুদ্ধর বাড়ি এসেছিল, এসে দেখে তালা বন্ধ,পাশের ফ্ল্যাটের লোকের কাছে সব ঘটনা জানলো,মাথাটায় হাত দিয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে আস্তে রাস্তায় নামল,দু দিন দু রাত রাস্তায় উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘোরা ঘুরি করছিল,এক কাঁধে একটা ব্যাগ অন্য কাঁধে গিটার৷ মাঝরাতে পুলিশে ধরল,কেন জানি না পুলিশ পাহারাদার তার কথা একটু খানি শুনে কি মনে করল,এক বস্তির একটি ঘরে অস্থায়ী থাকার বন্দোবস্ত করে দিল৷
কোর্টের শুনানির দ্বিতীয় দিনেই বোঝা গেল অনিরুদ্ধ পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে,সুতরাং মামলা সেখানেই স্থগিত এবং যেহেতু তার কাছের কোন মানুষের সন্ধান সেভাবে পাওয়া গেল না,তাকে স্থানান্তরিত করা হোল সেই অ্যাসাইলামে যেখানে রঙ্গনাথ বোধহয় তার পথ চেয়ে বসে ছিল৷ দুজনেই বোধহয় দুজনকে চিনতে পারলো,একে অন্যকে জড়িয়ে সে কি অট্টহাসি,রবি ছুটে এসে কিছুক্ষণ সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে সেও সেই হাসির আসরের সামিল হয়ে গেল৷ যে মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে রবি কাটাচ্ছিল তাতে মনের মাঝে বানের জল প্রায় বাঁধ ভাঙতে যাচ্ছিল,এবার পুরোপুরি ভেঙে গেল,রবি ওয়ার্ড বয় থেকে পেশেন্ট হয়ে গেল। দিব্য প্রায় সারাদিনই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত,নাওয়া খাওয়ার পাট প্রায় চুকেই গিয়েছিল৷ কখনও হয়তো মুড়ি বাদাম খেয়ে কোথাও থেকে জল খেয়ে নিতো৷ একদিন সন্ধ্যাবেলা বর্নালী সিনেমা হলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখে নতুন ছবির রিলিজ “নতুন যুগের আইকন”৷ চমকে উঠল,আরে! এই ছবিতেই তো অনিরুদ্ধ আর সে কাজ করছিল৷ ওই তো লেখা ডিরেক্টর প্রডিউসার রমেশ ভীমানি,ছবি শুরু হতে দেরি,পকেটে যা টাকা ছিল তা দিয়ে একটা টিকিট কিনল৷ ছবি শুরু হল৷ টাইটেলে গীতিকারের নাম এল শরৎ ঘোষ এর আর সঙ্গীত পরিচালনায় বুবাই পাল৷ কিছুক্ষণ বাদে যখন সেই আইটেম সং টা এলো “এ যুগের আইকন লোড করো মগজে”। অনিরুদ্ধের লেখা আর তার সুর,জনতা হাততালি আর সিটি বাজাতে লাগলো,মনে হল তাদের হৈ চৈ তে বোধহয় হলের ছাদটা উড়ে  যাবে৷ দিব্য নিজেকে আর সামলাতে পারলো না৷ “শুয়ারের বাচ্চা! চোর! আমাদের পেটে লাথি মেরে রুবাবি দেখাচ্চ”,প্রচন্ড জোরে আরো গালি,আরো কিছু বলতে লাগলো,স্বাভাবিক ভাবে জনতা গেল ক্ষেপে,কেউ তার আসল কথা শোনে না,কয়েক জন মিলে এলোপাথাড়ি মার দিয়ে ধাক্কা মেরে হলের বাইরে ফেলে দিল,কাঁধের গিটারটা ভেঙেচুরে রাস্তায পড়ে রইল,সেই অবস্থাতেই গালি দিতে দিতে এক সময় জ্ঞান হারালো। কয়েক দিন বাদে এক সমাজ সেবী সংঘের কয়েক জন যখন তাকে আবিস্কার করল,তখন সে হা হা করে হাসছে,ভাঙা গিটারের একখানা টুকরো বুকে আগলিয়ে ধরে আছে৷
ঘটনাক্রমে তারও সেই একই জায়গায় স্থান হল,চার বন্ধু আবার একসাথে৷ এখন আর তাদের আর কোনও দুঃখ বা অভিযোগ কিচ্ছু নেই৷ ওরা আবার নিজেদের মধ্যে সৃজনশীল জগৎ তৈরি করে নিত্যি নতুন গান বাঁধে৷ রঙ্গনাথ ভাঙা গলায় কাল্পনিক মাইকের সামনে গায়,রবি হাতের সামনে যা পায় তার মধ্যেই তালের তরঙ্গ তোলে৷ ওরা এখন খুব ভাল আছে৷ ডঃ মিশ্র মাঝে মাঝে এসে শ্রোতার স্থান নিয়ে বসেন৷
********************************************

রামানুজ দাশগুপ্ত পরিচিতি
শ্রী রামানুজ দাশগুপ্ত একজন বিশিষ্ট গায়ক,সুরকার ও বহুমুখী সঙ্গীত প্রতিভার অধিকারী। শাস্ত্রীয় সংগীত, ভজন, গজল,  রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, শ্যামা সংগীত থেকে আধুনিক গানের মাধ্যমে তাঁর প্রতিভা প্রকাশিত হয়। তিনি দীর্ঘদিন মুম্বাইতে প্রবাসী ছিলেন। দূরদর্শন কলকাতায় মিউজিক ডাইরেক্টরের পদ সামলেছেন। পরবর্তীকালে মুম্বাইয়ের ফিল্ম ডিভিশন অফ ইন্ডিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। এছাড়াও প্রখ্যাত মিউজিক ডাইরেক্টর আর ডি বর্মন, স্বপন চক্রবর্ত্তী, শ্রীধর ফার্কে, রঘুনাথ শেঠ এর পরিচালনায় গান গেয়েছেন। রামানুজ মহাশয় এর সংগীত পরিচালনায় মহম্মদ রফি সাহেব, হৈমন্তী শুক্লা, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, অনুপ জালোটা, অনুরাধা পড়োয়াল, সুরেশ ওয়াডকর, রুনা লায়লা, কবিতা কৃষ্ণমূর্তির মতো স্বনামধন্য গায়ক-গায়িকারা গান গেয়েছেন। আমেরিকার নিউ জার্সির মেয়র শ্রী দাসগুপ্তকে ২০০০ সালে “THE CITATION” উপাধিতে ভূষিত করেন এবং ২০১৫ সালে নজরুল একাডেমী তাঁকে “নজরুল পুরস্কার” প্রদান করে।

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!