পপামাসীর গোয়েন্দাগিরিঃ- দ্বিতীয় অভিযান
যখন পিঁপড়ে পথ দেখায়
প্র ত্যু ষ সে ন গু প্ত
।। এক।।
দোর্জে শব্দের অর্থ জানিস?
সকাল বেলায় পপামাসী ল্যাপটপে চোখ রেখে আমাকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল।আমি আড়চোখে দেখলাম ওর মেক মাই ট্রিপের ফ্লাইট পেজ খোলা! পপা মাসী কোনও জায়গায় ঘুরতে যাবার আগে সেখানকার ইতিহাস ভূগোল সব নিয়ে পড়াশোনা করে নেয়! এবার বুঝলাম মাসী কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করছে। ছুটি জমে আছে,না নিলে নষ্ট হয়ে যাবে বলে বলছিলো। এদিকে আমারও পরীক্ষা শেষ।
“তুমি কোথায় যাবার প্ল্যান করছ মাসী? আমাকে নেবে তো”?
মাসী বললো,“ আমার প্রশ্নের উত্তর কই”?
“দর্জি মানে তো টেলর মাস্টার। জামা কাপড় তৈরি করেন”।
-দর্জি নয়,দোর্জে। অর্থ বলতে পারলে তোকে সঙ্গে নেব! আমি বললাম,আমি জানি তুমি আমাকে নেবেই। নেটে তুমি ফ্লাইটের টিকিট কাটছিলে তাতে আমার নামও দেখেছি! বলে দাওনা উত্তর টা?
-পাকামো হচ্ছে? শোন,এটি একটি তিব্বতি শব্দ। বজ্রদন্ডকে দোর্জে বলা হয়।আর…,বলতো কোথায় যাচ্ছি?
– একটু ক্লু দাওনা? আমার আর্তি!
– বেশ।যেখানে যাবো,সেই জায়গাটা সমুদ্র পিঠ থেকে ছ’হাজার সাতশো ফুট উঁচুতে! আর ক্লু দিতে পারবোনা। পপা মাসীর সোজা জবাব!
।।দুই।।
দমদম এয়ারপোর্টের দু নম্বর টার্মিনাল থেকে এস জে ২২৩৬ কাঁটায় কাঁটায় সকাল সাড়ে ছ’টায় টেক অফ করলো। আমাদের সীট ই-উনিশ-কুড়ি। ফিফথ্ রো। বাঁদিকে। ডানার পরেই। আমি জানালায়। পপামাসী বাঁদিকের সীট বেছেছে। যাবার সময় বাঁ আর ফিরতি পথে ডান দিকে। এদিক দিয়ে শিবালিক রেঞ্জের গোটা পর্বতমালা নাকি খুব সুন্দর দেখা যায়। হিমালয়ের এই অংশকে শিবালিক রেঞ্জ বলে,এটা পপামাসী বলছিলো। মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ। চা আর স্ন্যাক্স খেলাম দুজনে। মেঘের অনেক উপর দিয়ে চলেছি। নীচে খুব ছোট একটা ধূসর রেখা আর চারপাশ সবুজময়। মাসী বললো রেখাটা গঙ্গা নদী। বাঁদিকে সোজা তাকিয়ে আছি। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে নীল রঙা হিমালয় পর্বতমালা। সাদা সাদা কিছু পাহাড় চূড়া।হঠাৎ যেন কাছে চলে এলো। অপূর্ব দৃশ্য। কাঞ্চনজঙ্ঘা, এভারেস্ট আর অগুন্তি ছোট্ট ছোট্ট বরফের পাহাড়। যেন রূপো দিয়ে মোড়া! মাঝে মাঝে সূর্যের আলোয় রঙ পাল্টাচ্ছে। কখনো কমলা,কখনো গোলাপী রং ঠিকরে উঠছে! হীরায় সূর্যের আলো পড়লে যেমন ঝকমক করে,তেমনি সাত রং যেন ঝলসে উঠছে।ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে যাচ্ছে তার বর্ণচ্ছ্বটা।তার ওপর তুলোর মতন মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। সবুজ রং যেন চকচক করছে।আমি আর থাকতে পারলাম না,আপনিই মুখ দিয়ে চলে এলো “বৃষ্টি পড়ে এখানে বারো মাস,এখানে মেঘ গাভীর মত চরে। পরান্মুখ সবুজ নালী ঘাস…”। এস এল আরে ছবি তুলছিল মাসী। বললো,শক্তির অবণী বাড়ি আছো আওড়াচ্ছিস না? আমি হেসে ফেললাম। পাক খেয়ে আমাদের প্লেনটা নীচে নামছিলো। এখন গাছ,পাহাড়ের গায়ে সাপের মতন রাস্তা,ঘরবাড়ি সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পপামাসী দেখিয়ে দিলো কার্শিয়াং টিভি টাওয়ার। মহানন্দা নদী,তিস্তা। তখনি সীট বেল্ট বাঁধতে হলো। পাইলটের ঘোষণা ল্যান্ডিং প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
।।তিন।।
দাশ স্টুডিওর ভিতর ঢুকলে মনে হয় পৃথিবীর যাবতীয় দেশের ঘর সাজানোর জিনিসপত্র একছাদের নীচে এমনটা বোধহয় কোত্থাও নেই। চোখ ধাঁধিয়ে যাবার মতন ব্যাপার। ইলেকট্রনিকস,শো পিস্,বাদ্য যন্ত্র,মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টস,শুধু অ্যাকোয়াস্টিক গীটারই রয়েছে হাজার রকমের। ক্যামেরা,ছবি তোলার সরঞ্জাম,গার্মেন্টস,চশমা,অলঙ্কার, কী নেই? বলে শেষ করা যাবে না। কয়েক হাজার স্কোয়ার ফিটের এই অত্যাধুনিক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের অন্যতম দেখার বিষয় হলো প্রচুর ছবির সংগ্রহ। বিভিন্ন আকারের,বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে তোলা জীবন্ত পর্বতচিত্র। খুব সুন্দর একটা তিব্বতি তৈলচিত্র আর রডোডেনড্রনের (স্থানীয় লোকেরা আদর করে আট হাজার ফুট উঁচুর এই ফুলকে বলে লালিগুরাস মাসী বলল) বিরাট ক্লোজআপের প্রিন্ট কিনলো পপামাসী। ওরা বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। আমার জন্য একটা আধখাওয়া আপেলের লোগো দেওয়া বারো ইঞ্চি ট্যাবলেট কিনলো। এটা নাকি এইচ এস আর জয়েন্টে খুব ভালো রেজাল্টের জন্য।দোর্জে শব্দের অর্থ আগে বলেছে,এবার বললো পুরো শব্দটা হলো দোর্জে লিং। লিং মানে দেশ বা স্থান।এর পুরো অর্থ হলো বজ্রের দেশ।দার্জিলিং।বেলা একটা নাগাদ আমরা দাশ স্টুডিও থেকে বেরলাম।বাঁদিকে ম্যাল।ডান দিকে ল্যাডেনলা রোডের ঢালু পথ মেহতাব চাঁদ রোড হয়ে অনেক নীচে হিলকার্ট রোডে গিয়ে মিশেছে।আমরা যাব হোটেল উইন্ডমেয়ার।এখানে সত্যজিৎ রায় কাঞ্চনজঙ্ঘার শ্যুটিং করেছিলেন! আমরা বাঁদিক ঘুরে,ম্যালের ডান দিকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।বেশ ঠান্ডা লাগছে, এই জুন মাসেও। জ্যাকেট টুপিতেও শীত মানাচ্ছে না। পপা মাসীর সাদা চুড়িদারের উপর শ্যাওলা পুলওভার। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। কপালে দুই ভুরুর মাঝে ছোট্ট একটা খয়েরি টিপ। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে এগোচ্ছি। জায়গাটা বেশ নির্জন। স্যাঁতসেতে আর ঠান্ডা। বাঁদিকে খাড়া পাহাড়। ডানদিকে রেলিং ঘেরা। নীচে অনেক দূরে একটা মাঠের মতন কিছু। মেঘ না কুয়াশায় খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। পপামাসী বললো ওটা লেবং রেসকোর্স। ঠিক তখনই ঘটলো ব্যাপারটা।
।।চার।।
তিনটে ছেলে! একটা বেশ গাঁট্টা গোট্টা। কালো জ্যাকেট। কুস্তিগীরের মতন চেহারা। অন্যদের একজন সিড়িঙ্গে,লম্বা,চোখ ঢুলুঢুলু। পরে মাসী বলেছিল ড্রাগ অ্যাডিক্ট। তৃতীয় জন মাঝারি হাইট। নাক চোখ মুখে মঙ্গোলীয় ধাঁচ। মাথায় লম্বাচুল,পিছনে ক্লিপ করা। লাল কলার তোলা গেঞ্জি আর নীল জিনস। আমার দিকে অসভ্যের মতন তাকাচ্ছে। লাল দাঁত বের করে হাসছে। জানেনা আমি কারাটের ব্ল্যাক বেল্ট,সদ্য ইন্টারস্কুল চ্যাম্পিয়ন। পপামাসী ও কারাটের ব্ল্যাকবেল্ট। সম্প্রতি তাইকোন্ডুর কোর্সও করেছে। অল ইন্ডিয়া আইপিএস চ্যাম্পিয়নও হয়েছে। মাসীর হাতে দুটো ঢাউস ব্যাগ। একটায় আমাদের নতুন কেনা দুটো জ্যাকেট। সানগ্লাস। দুটো হাতঘড়ি,রোলেক্স ক্রোমা আর রেনে রিচার্ডসের একটা লিমিটেড এডিশন। প্রথমটা মাসীর,পরেরটা আামার। আমার হাতের ব্যাগে নতুন কেনা ট্যাবলেট। একটা ক্যামেরা। ওদের চোখ আমাদের হাতের ব্যাগের দিকে। নিমেষে কুস্তিগীর মাসীর হাতের ব্যাগ ধরে টান দিল। স্তম্ভিত হয়ে আমি দেখলাম,অসাধারণ রিফ্লেক্সে বিদ্যুত গতিতে অদ্ভুত ভাবে হরাইজন্টালি মাসী শরীরটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলো,মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে ডান পা টা সোজা কুস্তিগীরের বাঁদিকের চোয়াল আর কানের গোড়ায় সজোরে আঘাত করলো। ঠক করে শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাটা কলাগাছের মতন কুস্তিগীর মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। আমি দেখলাম,মাসীর ছয় ইঞ্চি পেন্সিল হীল তীব্র গতিতে আছড়ে পড়েছে পালোয়ানের কানের গোড়ায়।মঙ্গোলীয় আমার ব্যাগের দিকে হাত বাড়াতেই মাসী বললো “চার্জ”। মুহূর্তে আমি সোজা ওর থুতনি বরাবর ঘুঁসি চালালাম। কিছু বোঝার আগেই ও আঁক্ শব্দ করে ছিটকে পড়লো। দুটো ব্যাপারই ঘটলো সেকেন্ডের মধ্যে। এর মধ্যে দেখি সিড়িঙ্গের হাতে উঠে এসেছে কুচকুচে কালো একটা পিস্তল! সোজা আমাদের দিকে তাক করা!
।।পাঁচ।।
একটু দূরে দেখলাম বেশ ভীড় জমেছে। সামনে আর পিছনে,দুদিকেই। সেকেন্ডের ভগ্নাংশেরও কম সময়ে চোখের পলকে মাসী পিস্তল চালালো,কিন্ত দুটি গুলির শব্দ শুনলাম! সিড়িঙ্গের হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে পড়লো একদম আমার সামনে। সিড়িঙ্গে বাঁ হাত দিয়ে ডানহাত চেপে বসে পড়লো। রক্ত গড়াচ্ছে। কিন্ত দ্বিতীয় গুলিটা কে করলো? ভুল ভাঙতে দেরি হলোনা। দুই উর্দিধারী আকাশ থেকে যেন এসে সিড়িঙ্গেকেও পাকড়াও করলো। একজনের হাতে খোলা পিস্তল। মুহূর্তেই দেখি কুস্তিগীর আর লম্বাচুলের হাতেও হ্যান্ডকাফ বাঁধা হয়ে গেছে। পালোয়ান এখনো অচৈতন্য। মাসী বললো ও এখনো বারো চোদ্দ ঘন্টা ঘুমাবে। এরমধ্যে কখন যে নিঃশব্দে পিছনে একটা পুলিশের জীপ এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি।
-প্লীজ সারেন্ডার অ্যান্ড গিভ ইওর গান বলতে বলতে যে স্মার্ট অফিসারটি জীপ থেকে নামলেন ওর কাঁধে আই পি এস লেখাটি দেখলাম চকচক করছে। মাসীর কাছে এসে বলে উঠলেন,মাই গড্,বিশোয়াস্ না? এর পর সংক্ষেপে বলা যায়,দার্জিলিংয়ের এ এস পি অপারেশন মিস্টার পান্ডে মাসীর ব্যাচ মেট। আমরা সদর থানায় গিয়ে এফ আই আর করলাম। চকবাজারে বেশ সাজানো গোছানো থানা। অনেক লোক বসে আছে। সব জিডি করবে। একজন মাত্র ব্যতিক্রম। ফেডেড জিন্সের উপর কালো টিশার্ট। কালো ব্র্যান্ডেড সানগ্লাস। হাতে টিসোট ঘড়ি। আইসির সঙ্গে কথা বলছিল। চোখ ঘুরছিল চারদিক। এদিকে তিন জনকেই অ্যারেস্ট করা হয়েছে। এদের মধ্যে লম্বাচুল আর সিড়িঙ্গেকে পুলিশ খুঁজছিল অনেকগুলো কেসে। গরম চা খেলাম। মাসীকে আবার এস পি সাহেব চেম্বারে ডাকলেন। কয়েক মিনিট পর মাসী বেরিয়ে এলো। চোখ মুখ উজ্বল। থানা থেকেই স্কর্পিও করে হোটেলে পৌঁছুলাম। এ এস পি পান্ডে মাসীকে বললেন,টুমরো অ্যাট টেন থার্টি ওকে? হোটেলে ঢুকে রুম সারভিস কে লাঞ্চ দিতে বললো মাসী।পাঁচ মিনিটে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসতেই চেয়ার টেনে মাসী বললো,ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে,এমন একটা কথা আছে,জানিস?
।।ছয়।।
সকাল বেলাটা এত মনোরম,কী আর বলব। আমি এই প্রথম বার দার্জিলিং এসেছি। এখন বুঝতে পারছি কেন একে পাহাড়ের রাণী বলা হয়। হোটেলের ছাদটা খুব পরিপাটি করে সাজানো। এটা বেশ উঁচুতে। একদিকে নীচে লেবং কার্ট রোড। চক বাজার থেকে লেবং চলে গেছে। রাস্তার ওপারে ঘন সবুজ বন। মাসী বললো বোটানিক্যাল গার্ডেন। সোজাসুজি নীচ দিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ।
উপরে দূরে একটা বিশাল বাংলো বাড়ি। লোহার গেট। বেশ কিছু গাড়ি ঢুকছে,বেরোচ্ছে।বাড়িটার মাথায় একটা নীল অর্ধগোলক।মনে পড়লো,ঠিক এমনই একটা নীল অর্ধগোলক বসানো একটা প্রাসাদের মত বাড়ি দার্জিলিং ঢুকতে বাঁদিকে নীচে চোখে পড়েছে। মাসী বললো সামনেরটা গভর্নর হাউস। আর আগেরটা বর্ধমান রাজবাড়ি। মাসী বললো,১৮৭৯ সালে এর পুরনো ভবনটি তৈরি করেছিলেন তখনকার লেঃগভর্ণর স্যার অ্যাশলে এডেন। ১৯৩৪ সালের ৫ মে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ভবনটি পুরোপুরি ধূলিসাৎ হয়ে গেলে স্যার জন অ্যান্ডারসন দুবছরের মধ্যে এই ভবনটি তৈরি করেন। তখন বর্ধমানের জমিদার মেহতাব চাঁদ দার্জিলিংয়ে একটা রাজভবন তৈরির চিন্তাভাবনা করছিলেন। তাঁর পরিকল্পিত ভবনের প্ল্যানেই গভর্নর হাউস তৈরি হয়। লিম্বুবস্তির বর্ধমান রাজবাড়ি অবশ্য এখন আংশিক ভাবে অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে,মাসী জানালো। এই শহরের ইতিহাস কি? মাসী বললো,সে অনেক কাল আগের কথা। সিকিমের চোগিয়াল রাজ ডেনজোঙ্গপা উপজাতিদের জন্য দোরজে-লিঙ নামে এক বৌদ্ধ গুম্ফা তৈরি করেন। সেখান থেকেই দার্জিলিং নামের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। ১৮১৫ সালে সিকিম রাজের সঙ্গে তখনকার ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সুগৌলি চুক্তির পর দার্জিলিংয়ের কাগজকলমে পত্তন হয়! স্যানাটোরিয়াম,সামরিক ঘাঁটি,চাকাগান তৈরি হয় একেএকে। স্বাধীনতার পর দার্জিলিং বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়। নীচ থেকে গাড়ির হর্ন শুনে মাসী বললো এসে গেছে।
।।সাত।।
ডি আইজি র অফিসটা ছবির মত সাজানো। কাঠের দোতলা বাংলো। হালকা সবুজ রঙ। ঢুকতে অনেকটা রাস্তা। দুপাশে কেয়ারি করা ফুল গাছ। ফার্ণ। সবুজ বাড়ির উপর উঠে গেছে পাহাড়ি লতানো গোলাপ। সবুজের উপর গোলাপি রঙের থোকাথোকা গোলাপফুল ফুটে রয়েছে। ফুলগুলো খুব ছোটো-ছোটো। বেলি ফুলের অর্ধেক সাইজ। পপামাসীকে একটা নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে গোপনে একাজ করতে হবে। ডিআইজি নিজে রিকোয়েস্ট করেছেন। আমি তো ঘুরতে এসেছি,মাসী আবার এখানে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে ঘোরাঘুরি মাথায় উঠবে। মাসী চব্বিশ ঘন্টা কাজে ব্যস্ত থাকলে আমি কি করবো এনিয়ে চিন্তায় ছিলাম। ডিআইজি সাহেব মাসীর সঙ্গে আমাকে থাকার পারমিশন দিয়েছেন। ফাঁক পেলেই ঘোরাঘুরি করা যাবে। ইচ্ছে হলে একাও ঘুরতে পারি। আলাদা গাড়ি এবং দুজন গাইড ও থাকবে। মাসীকে কালো রঙের একটি জাইলো দেওয়া হয়েছে। হোটেল থেকে বার্চহিলের পুলিশ গেস্ট হাউসে থাকার অনুরোধ করা হয়েছে। মাসী যাবেনা।
আমাকে একটা ঢাউস প্লেটে বাটার টোস্ট,ডিম সেদ্ধ,বিস্কুট,কাজু কিসমিস,কলা আর একটা খুব সুন্দর কাঁচের গ্লাসের একগ্লাস কমলার রস দিয়ে গেল।একটি ছোট্ট বাটিতে সাদা কিছু রয়েছে দইয়ের মতন। আরেকটি বাটিতে চিনি। সঙ্গে একজন মাসীর বয়সী মহিলা অফিসার,উনি পাশে বসে আমাকে পরম স্নেহে খেয়ে নিতে বললেন। আমি সকালে এত খাইনা। “হামি তিমরো দিদি যস্ত হই। বইনি,বিস্তারি বিস্তারি খাউনু হোস,ল?”
কাঁটা দিয়ে ডিম ভেঙে আমাকে খাইয়ে দিলেন,বাটি থেকে সাদা জিনিসটা মুখে দিলে বুঝতে পারলাম,ঘন দুধের সর! আমি বললাম,আমি এবার কলেজে ভর্তি হব তো! ছোট নই!
অনসূয়া দিদি হাসতে হাসতে যা বললেন,তার অর্থ মা,পপামাসী আগে বহুবার বলেছেন,যতই বড় হও না কেন,আমার কাছে চিরকাল ছোটই থাকবে। এর মধ্যে একজন পাঁচ ছ’টা খবরের কাগজ,তিনটে ইংরেজি আর দুটো বাংলা ম্যাগাজিন দিয়ে গেল। পরে হোটেলেও এই কাগজ গুলো দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। খেতে খেতে কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলাম। চোখ আটকে গেল একটি খবরে। প্রথম পাতায় একদম নীচে চার কলমের অ্যাঙ্কর নিউজ। লিখেছে পাহাড়ে পুলিশ প্রশাসন বলে কিচ্ছু নেই। চার দিন হলো,গাড়ি নিয়ে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে পাহাড়ের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী যুবক পুত্র সহ নিখোঁজ। ওঁর সেক্রেটারি,ড্রাইভার সহ গাড়িটা যেন হাওয়ায় উবে গেছে। সংবাদে প্রকাশ………..
।। আট।।
দুটো হাত মুঠো করে পিছন দিকে নিয়ে গোড়ালী ঠুকে মাসীকে সেলাম জানিয়ে অফিসার মাসীর হাতে গোটা পাঁচেক ফাইল তুলে আবার ওরকম দুহাত পিছনে নিয়ে পা ঠুকে চলে গেল।
এট কেমন হলো? মাসীকে বলতেই মাসী বললো,এটাকে বলে মুফতি তে পে রেসপেক্ট। বুঝলি না তো? ফোর্সে সুপিরিয়র অফিসারকে স্যালুট করতে দেখেছিস তো? অ্যাটেনশন হয়ে ডান হাত কনুই থেকে ভাঁজ করে তালুর উল্টো দিকটা ডান চোখের ভুরুর উপর রেখে পা ঠোকা? – – – দেখেছি। কিন্তু?
এটা সাদা পোশাকের স্যালুট বলতে পারিস।মুফতি মানে প্লেন ক্লোথড্…। সিভিল ড্রেসে থাকলে এভাবে স্যালুট করতে হয়। হলুদ ফাইলের উপরে অশোকস্তম্ভ। বেঁকিয়ে লেখা দার্জিলিং পুলিশ। তারপর দেখলাম গোটা গোটা অক্ষরে ছাপানো মাসীর নাম “পমপম বিশ্বাস,আই পি এস ..”। দিদার কাছে শুনেছি,পপা মাসীর ডাক নাম পম্পা আর আমি পম্পা উচ্চারণ করতে পারতাম না। বলতাম “পপা”,সেই থেকে..
আজ রবিবার। ছুটির মধ্যে ছুটি। সকালে একটু হাঁটতে বেরিয়ে ছিলাম। দেখলাম হোটেলে গেটের সামনে বন্দুকধারী দুজন পুলিশ। পাশে একটা জীপ দাঁড়ানো। ভিতরে একজন। আলফা স্পিকিং বিটা…ওভার অ্যান্ড আউট ইত্যাদি শব্দ কানে এলো। মাসীকে দেখে দুজনে অদ্ভুত আওয়াজ করে স্যালুট দিলো। পপামাসী বললো,হোটেলে হাউস গার্ড পোস্টিং করেছে উইথ টোয়েন্টি ফোর আওয়ার্স ওয়্যারলেস মোবাইল। আমার আর ছুটিটা ছুটি থাকলো না রে! লাউঞ্জে দুজন গাঁট্টাগোট্টা লোক বসেছিল। মাসীকে দেখে স্যালুট করে কি সব বললো। আমরা হাঁটতে বেরোলে দেখলাম ওরা পিছন পিছন আসছে। মাসী বললো,আমার বডিগার্ড !
।।নয়।।
সি আর পি সির ১৫৫ ধারায় পুলিশ একটি কগনিজিবল মামলা রুজু করেছে। কোনও ব্যক্তি নিখোঁজ হলে এই ধারায় মামলা হয়। মামলাটি বিচার্য হলে তাকে কগনিজিবল বলা হয়। পরে যদি দেখা যায় নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তিটিকে কিডন্যাপ করা হয়েছে,সেক্ষেত্রে অন্য ধারা যুক্ত করা হবে। এই বলে পপা মাসী থামলো। আজ জুন মাসের দশ তারিখ। গত চার তারিখ থেকে শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী অর্জুন বশিষ্ঠ (৫৬),পুত্র আদিত্য বশিষ্ঠ(২৪),সেক্রেটারি বিনয় ছেত্রী (৪০) ও ড্রাইভার পদম লামা(৩২) নিখোঁজ। নিজস্ব কালো রঙের টয়োটো ফর্চুনারে শিলিগুড়ি যাচ্ছিলেন ওঁরা। সঙ্গে হার্ড ক্যাশ ছিলো ত্রিশ থেকে চল্লিশ লাখ টাকা বা তার বেশি (পরে পুলিশ জেনেছে),সকাল আটটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন। শিলিগুড়িতে একটু কাজ সেরে তিনটের দিল্লির ফ্লাইট ধরবেন। এমন প্রায়ই ঘটে। বিনয় আর পদম গাড়ি নিয়ে ফিরে আসে। সেদিন দার্জিলিং থেকে রওনা দিয়ে জোড়বাংলোয় পেট্রোল পাম্প থেকে তেল ভরেছিলেন। তারপর থেকে আর কোনও খোঁজ নেই। গাড়ি সহ চারটি মানুষ যেন উবে গেছে। মিলিয়ে গেছে হাওয়ায়।
পমপমের মনে হলো,সূত্র একটা পাবেই। আগে খুঁজে বের করতে হবে ওদের। করতেই হবে। তেরোটি চা বাগান নিয়ে বশিষ্ঠ টি ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকের গাড়ির খবর মিলবেই। প্রথমে সব থানার ওসিদের নির্দেশ দিলো দুদিকের সব কটা চাবাগানে খোঁজ নিতে,সেদিন গাড়িটির বা মালিকের গতিবিধি সম্পর্কে যদি কোনও খবর মেলে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে তিনটে খবর পাওয়া গেল। পেট্রোল পাম্প থেকেই একজন ওই গাড়িতে ওঠে। দ্বিতীয়তঃ সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ওই গাড়িটি কার্শিয়াং থেকে ডানদিকে পাঙ্খাবাড়ির পথ ধরে ছিলো কিন্তু মকাইবাড়ি চা বাগানের সামনে দশ চাকার একটি ট্রলার উল্টে গেলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তখন ওরা পুরনো হিলকার্ট রোড ধরে ফেরে। তৃতীয় খবর,গয়াবাড়ি রেল স্টেশন পেরিয়ে গিদ্দা পাহাড়ে রাস্তার ধারে ফর্চুনারটি নাকি দুপুর থেকে দাঁড়িয়ে ছিলো। পরের স্টেশন তিনধারিয়া। রংটং,শুকনা পর্যন্ত পথের দুপাশে সরকারি ও ব্যক্তিগত যত সিসি ক্যামেরা আছে,থানাগুলিকে বললো ঘটনার দিন থেকে আপডেটের সব ছবি গুলো ওকে সাবমিট করতে। ইমিডিয়েটলি। জোড়বাংলো পেট্রোল পাম্প থেকে পাওয়া গেল পঞ্চম ব্যক্তির ছবি। এই ছেলেটির নাম সুমন রাই। কিছুদিন বশিষ্ঠদের ড্রাইভারি করেছিলো। ত্রিশ বত্রিশের বিশ্বস্ত ছেলে।
।।দশ।।
এমনিতে পাহাড়ে রাতে গাড়ি কম চলে। যেগুলো চলে,বেশীর ভাগই হাফ টন ট্রাক। সমতল থেকে মালপত্র আনার কাজ করে। ফুটেজ খতিয়ে দেখা গেল সে রাতে দশটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত মোট তেত্রিশটা গাড়ি কার্শিয়াং থেকে নেমেছে। পমপম গুনে দেখলো রংটং পর্যন্ত চৌত্রিশটা গাড়ি,আবার শুকনা ফরেস্ট অফিসের সিসি ক্যামেরায় গাড়ির সংখ্যা তেত্রিশ,শুকনা স্টেশন,রাস্তার ধারে একজনের বাড়ির ক্যামেরাতেও তেত্রিশ। তাহলে চৌত্রিশ নম্বর গাড়িটা কোন গাড়ি! গয়াবাড়ি থেকে রংটং পর্যন্ত এই গাড়ি চলেছে, তা’হলে কি…? এবার বোধহয় কিছু একটা খুঁজে পাওয়া যাবে। পমপম,অজয় বশিষ্ঠের ফোন গুলিতে গত তিনমাসের রিসিভড ফোন কলের কললিস্ট চেয়েছিল। মেইল চেক করে দেখলো সার্ভিস প্রোভাইডার পাঠিয়ে দিয়েছে। কাল অডিও গুলো পেলে সুবিধা হবে। সুমন রাই আদতে কালচিনির ছেলে। গত বছর ও দার্জিলিং এসে বশিষ্টদের কোম্পানীতে ড্রাইভারের কাজ নেয়। ওর কাজের দক্ষতা এবং ব্যবহারে মাস তিনেকের মধ্যেই বাড়ির লোকের মন জয় করে ফেলে। খোদ মালিকের খাস ড্রাইভার হয়ে যায়। মাস তিনেক আগে দেশের বাড়ি যাবে বলে ছুটি নিয়ে আর ফেরেনি। কালচিনি থানায় ওর নামে দুটো কেস রয়েছে। একটা কাঠ পাচার,আরেকটা ছিনতাই। পমপম তাড়াতাড়ি সব কাগজপত্র গুছিয়ে নিলো। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে। রংটং থেকে তল্লাসি শুরু করবে। চোখ ভর্তি ঘুম নিয়ে পমপম শুতে গেলো।
।।এগারো।।
ফাঁকা রাস্তায় বেশ জোরে ছুটছিলো কালো রঙের নতুন জাইলো। খুব ভোরে বৃষ্টি হয়েছিলো। ঠান্ডাটা বাড়লেও ঝকঝকে রোদ উঠেছে। দুপাশের গাছপালা,পাহাড়,দূরের নীল সবুজ পর্বত শিখর মনে হচ্ছে সদ্যস্নাত। গাড়ির কাঁচ তোলা। বাইরের বাতাস যেন হুল ফুটিয়ে দেবে। খুব হাল্কা করে হিটার চলছে। সোনাদা পেরোতে দেখি রাস্তার পাশে প্রচুর মুলো নিয়ে বসেছে মেয়েরা। পাশে ঢাই করা গোল গোল মতন সবুজ কোনও ফল বা সবজি। দার্জিলিং বাজারেও এমনটা দেখেছি। এটা কোন ফল? আম? আমি জিজ্ঞেস করতেই মাসী বললো,এটাকে স্কোয়াশ বলে। লতানে গাছে এই সবজি হয়,প্রচুর ফলে। এপ্রিল -মে থেকে আগস্ট -সেপ্টেম্বর ,স্কোয়াশ ফলে।এটা দরিদ্র মানুষের খিদে মেটায় অনেকটা।এর গাছের পাতা,ডগার খুব স্বাদ।দুর্গম এলাকার মানুষ এই স্কোয়াশ ও তার শাক শুকিয়ে রাখে,প্রচন্ড শীতে খাওয়ার জন্য। স্থানীয় উচ্চারণে এটা বলে স্কুস্।
কার্শিয়াং এ গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা রাস্তার পাশে অমরজিৎ হোটেল অ্যান্ড রেস্টোর্যান্টে ঢুকলাম। সকালে ব্রেকফাস্ট করেছি, এখন আবার কেন? মাসী বললো,চল দেখবি। আগের থেকে কেউ খবর দিয়েছে কিনা জানিনা,হোটেল মালিক,তাঁদের সব কর্মচারী যেন তটস্থ হয়ে উঠলো। বেশ বড় বড় দুটো করে গরম সিঙাড়া নেওয়া হলো দুপ্লেট।সঙ্গে লালচে বাদামি চাটনি।মুখে দিতেই মনে হলো অমৃত। চাটনিটার তো তুলনা নেই। সঙ্গে দার্জিলিং টি! চা খেতে খেতে দেখলাম সাদা একটা স্কর্পিও থেকে লম্বা স্মার্ট একজন নেমে সোজা হোটেলের দিকে হাঁটা দিলেন।নীল জিনস,লাল হাফশার্টের উপর পাতলা সোয়েটার,পিছনে কয়েকজন পুলিশ! নীল জিনস সোজা মাসীকে এসে নমস্কার জানালেন। সুবীর অবস্থি। অ্যাডিশনাল এস পি কার্শিয়াং। সঙ্গে নীল শাড়িতে মিসেস। আমাদের পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন বাংলোয় যাওয়ার জন্য।পরে স্থির হলো,তাড়াতাড়ি কাজ মিটলে লাঞ্চ করা যাবে। বাইরে বেড়িয়ে অপূর্ব দৃশ্য। ডান দিকে একটু উপরে কার্শিয়াং টিভি টাওয়ার। রাস্তার পাশে নীচে অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ যেন।মাঝখানে একটা ধূসর শাড়ি যেন মাঠে মেলে দিয়েছে কেউ,শুকানোর জন্য। মাসী বললো ওটা বাগডোগরা এয়ারপোর্টের রানওয়ে !
।।বারো।।
কাঁটায় কাঁটায় সকাল দশটায় রংটং আউটপোস্টে হাজির সি আর পি কম্যান্ডান্ট কুমুদ পান্ডে সঙ্গে ফোর্স।আমরা আগেই পৌঁছে গেছিলাম। বিশেষ অনুরোধে কম্বিং অপারেশনে সহায়তা করবে সিআরপি। সঙ্গে পুলিশ ও বনবিভাগ। আধঘন্টার মধ্যে ওরা সার্চ অপারেশন শুরু করলো। আমি আর মাসী রইলাম একাজে নেওয়া একটি সেফ হাউসে। পাশের ঘরে ডি এস পি কার্শিয়াং ও তাঁর দলবল।রংটং এ শিলিগুড়ি মুখী রাস্তার ডানদিকে ঢালু হয়ে কয়েকশো ফুট নেমে গেছে। জায়গাটা যেন ঘন বন।পাহাড়টা ইউ আকৃতি নিয়ে ঘুরে গেছে। প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ওপারে নীলচে পাহাড়ের গায়ে সুতোর মতন রাস্তা দেখা যাচ্ছে। সার্চ অপারেশনের লোকগুলোকে দেখলাম নীচে নামছে,এক সময় বনের আড়ালে মিলিয়ে গেল। বশিষ্ঠ বাবুর কাছে আসা তিন মাসের ইনকামিং কল পরীক্ষা করে দেখা গেছে গত তিন মাস ধরে কোনও এক মোহন দু কোটি টাকা দাবি করেছে। নয়তো প্রাণে মারার হুমকি। ফোন গুলি এসেছে মূলতঃ হিন্দি ও কিছু ইংরেজিতে। সাইবার সেলের ইন্সপেক্টর চট্টরাজ আরও জানালো মোট উনিশটা কলের শেষটা এসেছিলো তিন তারিখ রাত ন’টা দশে।নিখোঁজ হওয়ার আগের রাতে। প্রতি বারই মিঃবশিষ্ঠ প্রত্যাখ্যান করেছেন। উনিশটা কলের দুটো এসেছিলো দিল্লি থেকে। বারোটা শিলিগুড়ি -জলপাইগুড়ি থেকে। তিনটে দার্জিলিং, একটা সিকিম আর একটা ডুয়ার্স থেকে।পমপম ,চট্টরাজকে অডিও পাঠাতে বললো,এক্ষুনি। ল্যাপটপ থেকে ব্লুটুথ হেড ফোনে দ্রুত ফোনালাপ গুলো শুনে পমপম দুটি বিষয় মার্ক করলো।এক, হিন্দিতে লোকটি লেকিন শব্দটি বাক্যের মধ্যে খুব ব্যবহার করে। আর ইংরেজিতে অ্যান্ড কে বলে অ্যান্ডা! ওকে কে বলে ওক্কে আর কথার শেষে বলে আই থিংক সো….l সূত্র বলতে এটুকুই, তাই সই। পমপম চিন্তা করতে লাগলো,কোথায় যেন এমন শুনেছে,কিন্ত কোথায়? হঠাৎ মনে পড়লো।এক ঝলক। কন্ঠস্বরের মালিককেও মনে পড়লো। পমপমের এত ভুল হয়না। ডি এস পি ক্রাইমকে ফোন করে বললো ওই লোকটার গত তিনমাসের যাবতীয় মুভমেন্ট,ফোন কলসের ডিটেইলস পাঠাতে।খুব জরুরি।
।।তেরো।।
দীপক জাভেরিকে মধ্য তিরিশের ঝকঝকে, প্রাণবন্ত,স্মার্ট, সুদর্শন যুবক বললে ভুল হবেনা। দার্জিলিংয়ে ওর দুটি স্টার রেটেড গেস্ট হাউস আছে। সিকিমে ও শিলিগুড়িতে একটা করে। মোট চল্লিশটা গাড়ি ওর এই শহরে ভাড়া খাটে। অত্যন্ত মিশুকে, নিপাট ভদ্রলোক বললে কম বলা হবে না।জেলা প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে দীপকের ওঠাবসা।নানাভাবে সাহায্য করার জন্য এই সরকারি মহলে ওর বেশ প্রতিপত্তি। সকাল দশটা নাগাদ ম্যাল রোডে নিজের বাড়ি থেকে ওর কালচে নীল বি এম ডব্লু নিয়ে বেরোলো।ক্যাসলটনের দু’কেজি অটাম টি,দুটো দামী ভূটানী চাদর,দুটো ফারের কোট,একটা বুদ্ধমূর্তি পৌঁছে দিতে হবে অবস্থি সাহেবের বাংলোয় আজ বিকেলের মধ্যে। গাড়ির ভিতর থেকেই মোবাইলে দোকানগুলোকে বলে দিলো জিনিষগুলো খুব সুন্দর ভাবে প্যাক করে রাখতে,ও নিতে আসছে। একটা ফোন পেয়ে দীপকের প্রোগ্রাম পাল্টে গেল। বিকেলে নয় সন্ধ্যায় মাল গুলো নিয়ে এক হোটেলের স্যুইটে পৌঁছে দিতে হবে। সাহেবের ফোন পেলেই যেন চলে আসে। গাড়ি ঘুরিয়ে পুলবাজারের রাস্তা ধরলো দীপক। সামনের সপ্তাহে দিল্লিতে হাত বদল হবে পুল টি গার্ডেনের। কুড়ি একরের এই বাগান দিয়ে ওর চা ব্যবসায় প্রবেশ ঘটতে চলেছে।এই বাগানের ইল্ড খুব ভালো।একটু ঢালে টেবিলটার গড় বারো ইঞ্চি। (চা বাগানের প্ল্যান্টেশনে চা গাছ গুলো সমানকরে ছেঁটে দেওয়া হয়। দূর থেকে মনে হয় সবুজ চাদর পাতা! একে টেবিল বলে)। মনে মনে দীপক দেখতে পেলো ফাঁকে ফাঁকে শিরিষের শেড ট্রির মাঝে সবুজ বাগান যেন ওকে ডাকছে! গীয়ার পাল্টে আলতো চাপ দিলো অ্যাক্সেলেটরে।
।।চোদ্দ।।
সার দিয়ে পিঁপড়ের দল চলেছে। ছ’ইঞ্চির মতন ছড়ানো কালো একটা লাইন মনে হয় দূর থেকে। আমরাও চলতে থাকলাম।একটু দূরে ডানদিকের ঢাল বেয়ে আর একটা সারি,একটু এগিয়ে আরো একটা সারি। তারপর আরো একটা। সবার গন্তব্য একদিকে। জবরজং ধরাচুড়ো পরে স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারছিলাম না। গরম লাগছে। হাঁটু পর্যন্ত হান্টিং শ্যু। বিশেষ কাপড় দিয়ে তৈরি প্যান্ট এবং জামা। মুখ ঢাকা কাপড়ের তৈরি হেলমেটে। মাসীও। উদ্ভট রকম। মহাকাশচারী আর বোম স্কোয়াডের পোষাকের মিশেল যেন। সি আর পি,পুলিশ আর বনবিভাগ তাঁদের নিজস্ব ইউনিফর্মে। যত এগিয়ে যাচ্ছি, একটার পর একটা নতুন নতুন পিঁপড়ের লাইন যোগ হচ্ছে। এখানে অসমতল ঢালু জমি। চার পাঁচ ফুট পর পর বিভিন্ন গাছ। অশোক,নিম যেমন আছে তেমনি পাইন গাছও রয়েছে।তবে বেশীরভাগ গাছই অচেনা। মাসী হয়তো জানতে পারে। পায়ের নীচে ঘাস কোথাও একহাত আবার কোথাও ইঞ্চি খানেক লম্বা।কিছু প্রজাপতি এবং অনেক রকমের পাখি। হলুদ লাল মেশানো ছোটো ছোটো ফুল গাছের ঝোপ। মাসী বললো ল্যান্টানা ক্যামেরা।এতক্ষণ ঢাল দিয়ে এগোচ্ছিলাম। এখন সূর্য একটু পশ্চিমে সরেছে। হঠাৎ করে বৃষ্টি এলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার আর মাসীর মাথায় ছাতা ধরলো একজন। দূরে উল্টো দিকের ঢাল নজরে এলো। সরু কালো কালো দাগ দেখা যাচ্ছে। পিঁপড়ের সারি ! হঠাৎ সামনে একটা ফাঁকা জমি ! নানা দিক থেকে পিঁপড়ের সারি এসে ওখানে ঢুকছে!
।।পনেরো।।
মাটি খুঁড়তেই মনে হলো একটা কালো চাদর পাতা। কোটি কোটি পিঁপড়ের চাদর। সরাতেই পাওয়া গেল তিনটে ব্যাগে মোড়া চারটে লাশ। প্রত্যেকের মাথায় একটি করে গুলি। লাশ গুলো পোস্টমর্টেমে পাঠানো হয়েছে। তেমন বিকৃত হয়নি। তবে চোখ নাক কান পিঁপড়ে খুবলে খেয়েছে। সারা শরীরে পিঁপড়ে। অগুণতি পিঁপড়েতে ঢাকা পড়েছিল মাটি চাপা লাশগুলো। আগেই স্প্রে করে পিঁপড়ের দলকে নিস্তেজ করা হলো। ব্যাগের মুখ খুলতেই একটা লাশের নাক মুখ দিয়ে স্রোতের মতন পিঁপড়ে বেরোতে দেখে আমার গা গুলিয়ে উঠলো। বীভৎস দৃশ্য।
অ্যাডিশনাল এস পির বাংলোয় আর যাওয়া হয়নি। হোটেলে যখন ফিরে এলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। স্নান করে খাওয়াদাওয়া সেরে বেশ ক্লান্ত লাগছে। পপামাসী কিন্তু একদম ফিট। যেন কিছুই হয়নি। মাসীর বেশ ফুরফুরে মেজাজ। আমায় বললো,খুনীর খোঁজও পেয়ে গেছিরে। কেসটা মনে হয় সলভড হতে যাচ্ছে শিগগিরই। আমার দুচোখে ঘুম নেমে এলো। গাড়িটা পাওয়া গেছে তিস্তা বাজারের কাছে রাস্তার দুশো ফুট নীচে। দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছেতাই খারাপ অবস্থা। এর অর্থ,গাড়িটাকে ঘুরিয়ে তাকদা’র পথ ধরে ওদিকে নিয়ে যাওয়া হয়। গত তিন মাসে বাগডোগরার কলকাতা দিল্লির ফ্লাইট গুলির প্যাসেঞ্জার লিস্ট এসে গেছে।পমপম দেখতে যাবে, এমন সময় পান্ডের ফোন। স্যুইটের দোর গোড়ায়! দরজা খুলতেই সস্ত্রীক পান্ডে। পিছনে এক সুদর্শন যুবক, হাতে চারটি ঢাউস প্যাকেট। নামিয়েই চলে গেল।পমপমকেও গুডনাইট জানালো। ওর কথাগুলি যেন মরমে পশিয়া গেল।এক তীব্র আনন্দে পমপম ভাসতে লাগলো। পান্ডে সাহেব,তাঁর স্ত্রী অনেক কথা বলতে থাকলেন।অর্ধেক কথা কানে গেলনা।ওঁরা চা স্ন্যাক্স খেয়ে বিদায় নেবার পরে পমপম মুনকে প্রশ্ন করলো,মেঘ না চাইতেই জল না বৃষ্টি, কোনটা হবে রে?
।।ষোল।।
আজ একটু দেরি তে উঠলাম দুজনে। পপামাসী কেসটা সলভ্ করে ফেলেছে। মি.বশিষ্ঠ দাবি মত অর্থ না দেওয়ায় সপুত্র খুন হলেন। সঙ্গে সেক্রেটারি ও ড্রাইভার। সুমনকে সিকিম পুলিশ ঋষি খোলার এক হোম স্টে থেকে অ্যারেস্ট করেছে দু’জন সাকরেদ সহ। সঙ্গে রিভলবারটি এবং কুড়ি লাখ নগদ। প্যাসেঞ্জার লিস্টে জাভেরির নাম মিলেছে। যেদিন যেদিন বশিষ্ঠকে হুমকি ও টাকা চেয়ে দিল্লি থেকে ফোন আসে,সেদিন ওর দিল্লি থাকার প্রমাণ মিলেছে। জাভেরি উত্তর প্রদেশের সোনপুর গ্যাংয়ের হয়ে কাজ করত। এদের কাজ ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাকমেল করে মোটা অর্থ তোলা। ও-ই সুমনকে বশিষ্ঠ টি কোম্পানিতে ঢুকিয়ে ছিলো চরবৃত্তি করতে। ডেডবডির পোস্টমর্টেম,ফরেন্সিক রিপোর্ট এলে জেলা পুলিশের তদন্ত এগোবে। পপামাসীর কাজ শেষ।
পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজি পার্কের অন্যতম সুন্দর দিক হলো,পাহাড়ের গা বেয়ে চারদিক তারের জাল দিয়ে ঘেরা রাস্তা। নীচে বনের মধ্যে বাঘমামা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গাছের গুঁড়ি আঁচড়াচ্ছেন। সাদাকালো পান্ডা গুলো যেন পুতুল। বাঁশপাতা চিবোচ্ছে। সন্ধ্যায় ডি আইজি সাহেবের পার্টিতে দারুণ খাওয়া দাওয়া।সমস্ত আলো যেন পপামাসীর দিকে। আমার এই মাসীটা আমার গর্ব। সকলের অনুরোধে পপামাসী গাইলো দুটি গান। তার মধ্যে অবশ্যই একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত । আমার এ পথ ….. প্রচুর হাততালি আর উপহার পেলো মাসী। কাল দশটায় ফ্লাইট। এবার ছুটিটা অন্যরকম কাটলো!
হোটেলে ফেরার পথে মাসী বললো
-আই পি এস হবি?
– না।
– কেন?
– আমি তোমার মত হতে পারবোনা ।
একটা মানুষের মধ্যে এত কিছু গুণ একসঙ্গে কীভাবে থাকে। ইংরেজি গান(Gun)আর বাংলা গান কিভাবে এভাবে মিলে যায়? মাসী বললো,আর একটা কথা বললে গাঁট্টা মারব কিন্তু !
।।শেষ।।
*****************************************************
প্রত্যুষ সেনগুপ্ত পরিচিতিঃ
সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে নানা রকম চাকরী করে এখন বেলাশেষে কলম ধরেছেন। প্রথম চাকরী এক ওষুধ কোম্পানীতে। তারপর চা বাগানে। এরপর দু’দুটি খবরের কাগজে সাব এডিটর। শেষ পর্বে গোপনীয়তায় ভরা সরকারী চাকরী। দীর্ঘ চাকরী জীবনে কাজ করেছেন পশ্চিম বঙ্গের অধিকাংশ জেলায়! অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রচুর। এই শেষ বেলায় ওই অভিজ্ঞতায় নির্ভর করে আবার কলম ধরেছেন।