Shadow

বাংলা ভাষায় শিক্ষার সূচনাপর্ব এবং বিদ্যাসাগর (দ্বিতীয় ভাগ) – রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

বাংলা ভাষায় শিক্ষার সূচনাপর্ব এবং বিদ্যাসাগর
(দ্বিতীয় ভাগ)
রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

বিদ্যাসাগরের শিক্ষা বিস্তারের নীতিতে নারী সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বেথুন ও বিদ্যাসাগরের মিলিত প্রচেষ্টায় ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু ফিমেল স্কুল (পরবর্তীকালে বেথুন স্কুল) স্থাপিত হয়। বাংলায় তখনও স্ত্রীশিক্ষা সমাজের অনুমোদন পায় নি। কিন্তু অভিজাত ও ভদ্রঘরের মেয়েরা বিদ্যালয়ে না এলে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের মূল উদ্দেশ্য সফল হবে না। এই অবস্থায় বিদ্যাসাগর শাস্ত্রবাক্য উদ্ধার করে রক্ষণশীলতার প্রাচীর ভাঙলেন। বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কারের চেষ্টায় ঐ বিদ্যালয়ে মদনমোহনের দুই কন্যা ছাড়াও রামগোপাল ঘোষ, ঈশানচন্দ্র বসু, শম্ভুনাথ পণ্ডিত, তারানাথ তর্কবাচস্পতি, নীলকমল বন্দোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কন্যারাও যোগ দিয়েছিল। ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে বেথুনের মৃত্যুর পর বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় সরকার ঐ বিদ্যালয়ের ভার গ্রহণ করে। স্কুলকে আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি চেষ্টার কোনও ত্রুটি করেন নি। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে স্কুলটি সরকারি পরিচালনায় চলে যাওয়ার পর নতুন কমিটিতে তিনিই অবৈতনিক সম্পাদক হন। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সম্পাদক হিসাবে বেথুন স্কুলের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বেথুন স্কুলকে কেন্দ্র করে কলকাতা ও কাছাকাছি শহরগুলিতে নারী শিক্ষার ব্যবস্থাকে গড়ে তুলবেন। কিন্তু তাঁর সেই আকাঙ্খা পূর্ণ হয় নি। সরকারী নীতির সঙ্গে তাঁর উদ্দেশ্য ও নীতির মিলন ঘটেনি বলে বেথুন স্কুল থেকে তাঁকে সরে যেতে হয়েছিল।
বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন সমাজকে সংস্কার ও দেশাচার থেকে মুক্ত করতে হলে নারী সমাজকেও সংস্কারমুক্ত করতে হবে। শিক্ষার প্রসার না ঘটালে নারী চেতনাকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলা সম্ভব নয়। একথা বুঝেছিলেন বলেই তিনি নারী সমাজেও শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। উড্ সাহেবের শিক্ষাসম্পর্কিত নির্দেশনামায় স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের নির্দেশ ছিল। একাজে গভর্ণর হ্যালিডে বিদ্যসাগরকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তাঁর কাছ থেকে মৌখিক অনুমোদন পেয়ে বিদ্যাসাগর কাজ শুরু করেছিলেন এবং হুগলী, মেদিনীপুর, বর্ধমান ও নদীয়া জেলায় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন। অসম্ভব কর্মতৎপরতায় ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসের মধ্যে তিনি ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বাংলার গভর্ণর হ্যালিডে তাঁর ১৯.১১.১৮৫৮ তারিখের নোটে বিদ্যাসাগরের এই অসামান্য সাফল্যকে স্বীকার করেছিলেন।
এতকাল বিদ্যাসাগর সরকারী দপ্তর থেকে শিক্ষানীতির রূপায়ণে সব থেকে বেশী সহায়তা পেয়ে আসছিলেন। কিন্তু এবার তিনি সেখান থেকেই বাধা পেলেন। শিক্ষা অধিকর্তা গর্ডন ইয়ং তাঁকে কাজে বিশেষ স্বাধীনতা দিতে চাইলেন না। তাছাড়া প্রশাসনিক প্রয়োজনে সংস্কৃত কলেজের গুরুত্বকেও খর্ব করা হল। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে আগষ্ট মাসে ইংরেজ সৈন্যদলের ভলান্টিয়ার বাহিনীকে থাকতে দেওয়ার জন্য তাঁকে কলেজ ভবন ছেড়ে দিতে হয়। এবিষয়ে তিনি গর্ডন ইয়ংকে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ আগষ্ট ও ২ সেপ্টেম্বর তারিখে দুটি পত্র লিখেছিলেন। ঐ বছরের ৩১ আগষ্ট তারিখে তিনি গভর্ণর হ্যালিডেকে যে চিঠি লিখেছিলেন তাতে এটা স্পষ্ট যে সরকারী দপ্তরের লালফিতের ফাঁস যেমন তাঁর পছন্দ ছিল না তেমনই বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান সম্পর্কিত ব্যবস্থাকেও তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। এই চিঠি লেখার এক বছর পরে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে তিনি হ্যালিডেকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন বর্তমান ব্যবস্থার অধীনে কাজ করা তাঁর পক্ষে নিতান্ত অপ্রীতিকর ও ক্লেশদায়ক হইয়া উঠেছে, বিশেষতঃ বহু অর্থব্যয় করে যে প্রণালীতে বাংলা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছিল সে পদ্ধতির প্রতি তাঁর কোনো প্রকার সহানুভূতি ছিল না।
বিদ্যাসাগর বুঝতে পেরেছিলেন বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও বাংলা ভাষায় শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্য যে পথে তিনি এগোতে চাইছেন সরকারী নীতি তার প্রতিবন্ধক। ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ সেপ্টেম্বর তারিখে স্কুল পরিদর্শক হেনরী উড্রো শিক্ষা অধিকর্তা গর্ডন ইয়ংকে রিপোর্ট দিয়েছিলেন – “. . .  Pundit Iswar Chunder Bidyasagar opened forty female schools, secured an attendance of more than 1300 girls of good caste, and soon found himself liable for between three and four thousand rupees.” ভারত সরকার তখন ব্যয়সঙ্কোচ নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য দিতে অস্বীকার করেছিলেন। বিদ্যাসাগর ইতিমধ্যেই যে টাকা খরচ করেছিলেন শুধু সেটুকুই মঞ্জুর হল, কিন্তু তাঁর স্থাপন করা ৪০টি বিদ্যালয়ের খরচ বহন করতে সরকার রাজি হলেন না। শিক্ষা অধিকর্তা ইয়ং-এর নোট থেকে তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে –“Special aid solicited to a number of female schools by Pandit Iswar Chander Sarma. Aid refused by Supreme Government . . .”। এর ফলে বিদ্যাসাগরের পক্ষে শিক্ষাবিষয়ক নীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে আর কিছু করার থাকল না। ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিনি চাকরী থেকে বিদায় নিলেন।
শিক্ষার প্রসারে (বিশেষত স্ত্রীশিক্ষার সম্প্রসারণে) সরকারী নীতির কার্পণ্য বিদ্যাসাগরকে ব্যথিত করেছিল, কিন্তু তিনি হতোদ্যম হন নি। তাঁর প্রতিষ্ঠা করা বালিকা বিদ্যালয়গুলির পরিচালনার দায়িত্ব তিনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। নারীশিক্ষার জন্য তিনি একটি আলাদা অর্থভাণ্ডার খুলেছিলেন। বিভিন্ন ব্যক্তি মাসিক চাঁদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কয়েক মাস পরে সকলেই পিছিয়ে গিয়েছেন। সেসিল বিডন বা রাজকুমার সর্বাধিকারী প্রমুখ কয়েকজন কিছু কিছু চাঁদা দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ব্যয়ভারের বিপুল অংশ তিনি নিজেই বহন করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলির সাফল্যের জন্য তিনি নিরলস পরিশ্রম করেছেন। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ অক্টোবর তারিখে স্যার বাটল ফ্রিয়ারকে লেখা তাঁর একটি চিঠির কিছুটা উদ্ধৃত করছি –“You will no doubt be glad to hear that Mufussil Female Schools, to the support of which you so kindly contributed, are progressing satisfactorily. Female education has begun to be gradually appreciated by the people of districts contiguous to Calcutta and schools are being opened from time to time.”
১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে লণ্ডন থেকে শিক্ষাব্রতী মিস কার্পেন্টার এদেশে এসেছিলেন নারীশিক্ষার অবস্থা দেখতে। তিনি প্রথমেই বিদ্যাসাগরের সঙ্গে পরিচিত হতে চাইলেন। শিক্ষাবিভাগের অধিকর্তা অ্যাটকিনসন বিদ্যাসাগরকে লেখা একটি চিঠিতে এই বিদূষী মহিলার সঙ্গে বেথুন স্কুলে সাক্ষাতের অনুরোধ জানান। সেখানেই মিস কার্পেন্টারের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের পরিচয় হয়। তিনি ও অ্যাটকিনসন, বিদ্যাসাগরকে সঙ্গে নিয়েই কলকাতা ও উত্তরপাড়ার বালিকা বিদ্যালয়গুলি পরিদর্শন করেন। পরিশেষে মিস কার্পেন্টার এদেশে স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষাদান পদ্ধতির উন্নতির জন্য একটি ‘ফিমেল নর্মাল স্কুল’ স্থাপনের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করেন। তিনি ছোটলাট উইলিয়ম গ্রে-র কাছে প্রেরণ করা বক্তব্যে জানালেন এদেশের নারীসমাজ থেকে শিক্ষয়িত্রী গড়ে তোলার জন্য মিস কার্পেন্টার যে পরিকল্পনা নিতে চান তা হিন্দুসমাজের তখনকার অবস্থায় ফলপ্রসূ হতে পারে না। গভর্ণর উইলিয়ম গ্রে বিদ্যাসাগরের বক্তব্যকে মেনে নিলেও নর্মাল স্কুল স্থাপনের দাবীকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষাদপ্তর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে বেথুন স্কুলেই শিক্ষাদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তাবিত নর্মাল স্কুল স্থাপিত  হবে। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে নতুন নিয়ম কার্যকরী হল। তার পরেই বিদ্যাসাগর বেথুন স্কুলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। এখানে জানিয়ে রাখি অনেক পরিশ্রম ও অর্থব্যয়ের পর পরবর্তী গভর্ণর জর্জ ক্যাম্বেলের আমলে সেই স্কুলটি উঠিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে বিদ্যাসাগরের বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হয়। তিনি ছিলেন প্রখর বাস্তব চেতনাসম্পন্ন পুরুষ। এই প্রসঙ্গে Daniel Lerner-এর মন্তব্য উদ্ধৃত করছি – “He assumes a calculating attitude towards a manipulable and open future. He is therefore rational and goal-oriented.” প্রমথনাথ বিশীর ভাষায় – “বাংলাদেশে বিদ্যাসাগরের ন্যায় practical ব্যক্তি আর কেহ জন্মিয়াছেন কিনা সন্দেহ।”
নারীশিক্ষার কাজ থেকে বিদ্যাসাগর কখনই পিছিয়ে যান নি। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বীরসিংহ গ্রামে ভাই শম্ভুচন্দ্রের মাধ্যমে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। এই বিদ্যালয়টি মায়ের নামে উৎসর্গ করে তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘ভগবতী বিদ্যালয়’। বিদ্যাসাগরই আধুনিক ভারতের প্রথম মানুষ যিনি শিক্ষার এই মূলনীতিটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে নারীকে নিজের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করার জন্যই নারীশিক্ষার সম্প্রসারণ করা দরকার। তাছাড়া বহু ব্যক্তিকে তিনি বিদ্যালয় খুলতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বিদ্যাসাগরের অনুরোধে বর্ধমানের চকদিঘীর অপুত্রক জমিদার সারদাপ্রসাদ সিংহরায় তাঁর টাকা ও সম্পত্তি অবৈতনিক এন্ট্রান্স স্কুল স্থাপনের জন্য দিয়েছিলেন। ভাটপাড়ার রাখালদাস ন্যায়রত্নকে তিনি টোল করার জন্য টাকা দিয়েছেন। তাঁর পরামর্শে কান্দিতে রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ইংরেজি-সংস্কৃত বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ঘাটালে স্কুলবাড়ি তৈরীর জন্য তিনি অর্থসাহায্য করেছেন। বৈঁচিগ্রামের জমিদার বিহারীলাল মুখোপাধ্যায়কে পরামর্শ দিয়ে তিনি সেখানে কমলেকামিনীদেবী দাতব্য বিদ্যালয় স্থাপন করান।
শিক্ষাব্রতী বিদ্যাসাগরের শ্রেষ্ঠ কাজ মেট্রোপলিটান ইনষ্টিটিউসন ও কলেজের প্রতিষ্ঠা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন –“সংস্কৃত কলেজের কর্ম ছাড়িয়া দিবার পর বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি মেট্রোপলিটান ইনষ্টিট্যুসন। বাঙালীর নিজের চেষ্টায় এবং নিজের অধীনে উচ্চতর শিক্ষার কলেজ স্থাপন এই প্রথম। আমাদের দেশে ইংরাজী শিক্ষাকে স্বাধীনভাবে স্থায়ী করিবার এই প্রথম ভিত্তি বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হইল।” বস্তুত কোনও সরকারী সাহায্য না নিয়ে এবং শুধুমাত্র বাঙালী অধ্যাপক দিয়ে দেশীয় ব্যবস্থাপনায় একটি বেসরকারী কলেজ স্থাপন তাঁর অদম্য পৌরুষেরই প্রমাণ। বিপিনচন্দ্র পাল তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন – “ইহাই কলিকাতায় বাঙ্গালীর প্রতিষ্ঠিত ও বাঙ্গালীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বেসরকারী কলেজের পথপ্রদর্শক। এই মেট্রোপলিটান ইনষ্টিটিউসনের প্রতিষ্ঠা না হইলে প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং পাদ্রীদের কলেজের উপরেই বহুল পরিমাণে বাঙ্গালীর উচ্চ ইংরাজী শিক্ষা লাভ নির্ভর করিত।”
১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়ে বিদ্যাসাগর প্রথমে স্কুল কমিটির সভাপতি রূপে যোগদান করেছিলেন। পরে স্কুলের নাম বদলে হয় ‘হিন্দু মেট্রোপলিটান স্কুল’, তিনি হন সম্পাদক। পরিচালকরা স্কুল চালাতে না পারায় পুরো কর্তৃত্ব বিদ্যাসাগরের হাতে আসে। ১৮৬৫-৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হিন্দু শব্দটি বাদ দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম দেন ‘মেট্রোপলিটান ইনষ্টিটিউসন’। স্কুল পরিদর্শক হেনরী উড্রো ১৮৭০-৭১ খ্রিষ্টাব্দের প্রতিবেদনে লিখেছিলেন –“The Metropolitan Institution, under the management of Pundit Iswar Chunder Bidyasagar, is the best of these schools and was at the last University Examination one of the most successful schools of India.” বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় স্কুলের ফলাফল ভাল হওয়ায় উৎসাহিত হয়ে তিনি কলেজ খোলার জন্য সচেষ্ট হন। অনেক চেষ্টার পর ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে উপাচার্য বেলির সহায়তায় সিণ্ডিকেট মেট্রোপলিটান ইনষ্টিটিউসনকে অনুমোদন করলে গভর্ণর তাতে সম্মতি দেন। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ. ক্লাশ খোলার অনুমতি পাওয়া গেলে এটি পূর্ণাঙ্গ কলেজে পরিণত হয়। শিক্ষা অধিকর্তা এ. ডব্লিউ. ক্রফট্ ১৮৮১-৮২ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ প্রতিবেদনে লিখেছিলেন –“The Metropolitan Institution is the only un-aided college which regularly teaches the full University Course in Arts . . .” এর প্রথম অধ্যক্ষ হয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের জামাতা সূর্যকুমার অধিকারী। ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে সূর্যকুমারের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলে বিদ্যাসাগর আবার নিজের হাতে দায়িত্বভার তুলে নিয়েছিলেন। শিক্ষা অধিকর্তা সি. এইচ. টনি তাঁর ১৮৮৮-৮৯ খ্রিষ্টাব্দের প্রতিবেদনে লিখেছিলেন “The Metropolitan Institution continues to be by far the largest of all the colleges in the province and probably in India . . . .”।
বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন দেশজুড়ে ধর্মনিরপেক্ষ ও উদার মানবিকতার উপর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষার একটি পরিমণ্ডল গড়ে তুলবেন যার ফলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। অত্যন্ত বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ছিলেন বলেই তিনি একদিকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করেছেন, আবার অন্যদিকে বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করতে চেয়েছেন। অথচ শিক্ষণীয়, বিষয় নির্বাচন করতে গিয়ে তিনি পশ্চিমের বিজ্ঞানচেতনা ও মানবিকতার দর্শনকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সে যুগের মানুষকে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাদর্শন উপহার দেওয়া একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। যুগের প্রয়োজনেই যেন তিনি অসাধারণ ব্যত্তিত্ব ও অসামান্য জীবনচেতনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যুক্তির সাহায্যে তিনি মানুষের মনের মধ্যে দৃঢ়প্রোথিত সংস্কারকে ছিন্ন করতে চেয়েছেন।  প্রমথনাথ বিশী মন্তব্য করেছেন – “কাজের পথের বাধা ছিন্ন-ভিন্ন করিবার জন্য তাঁহার হাতে ছিল একখানা অসি; চালনা নৈপুণ্যে সেই একখানা অসিকে দশখানা মনে হইয়াছে – সাহিত্য, করুণা, শিক্ষাবিস্তার, সমাজ সংস্কার, কত না মনে হইয়াছে; কিন্তু অসি দশখানা নয়, একখানা মাত্র, সে খানার নাম লজিক।”
সহায়ক গ্রন্থাবলী :
১. Dr. Amitabha Mukherjee – Reform and Regeneration in Bengal।
২. সবিতা চট্টোপাধ্যায় – বাঙ্গালা সাহিত্যে ইউরোপীয় লেখক।
৩. উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘বিদ্যাসাগর’।
৪. ডঃ অনিলবরণ গঙ্গোপাধ্যায় – মুদ্রণ শিল্পে বিদ্যাসাগর (সন্তোষকুমার অধিকারী সম্পাদিত বিদ্যাসাগর পরিক্রমা)
৫. বিনয়ভূষণ রায় – শিক্ষা সংস্কারে বিদ্যাসাগর ও বর্ণপরিচয়।
৬. সন্তোষকুমার অধিকারী – বিদ্যাসাগরের জীবনের শেষ দিনগুলি।
৭. Dr. Ramesh Chndra Mazumdar – Glimpses of Bengal in the Nineteenth Century
৮. David Kopf – British Orientalism and Bengal Renaissance।
৯. Santosh Kumar Adhikari – Vidyasagar and the Regeneration of Bengal।
১০. বিদ্যাসাগর রিসার্চ সেন্টার থেকে প্রকাশিত ‘বিদ্যাসাগরের নির্বাচিত পত্রাবলী’।
১১. শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন – বিদ্যাসাগর জীবনচরিত (বুকল্যাণ্ড সংস্করণ)।
১২. Arabinda Guha – Unpublished Letters।
১৩. Subal Chandra Mitra – Iswar Chandra Vidyasagar
১৪. সাহিত্য সাধক চরিতমালা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
১৫. বিদ্যাসাগর রিসার্চ সেন্টার থেকে প্রকাশিত বিদ্যাসাগর পত্রিকা (দ্বিতীয় সংকলন)।
১৬. সন্তোষ কুমার অধিকারী – বিদ্যাসাগরের শিক্ষানীতি ও বর্ণপরিচয় (অনন্য প্রকাশন)।
১৭. বিদ্যাসাগরের নির্বাচিত পত্রাবলী।
১৮. সুরেশপ্রসাদ নিয়োগী – মেট্রোপলিটান কলেজের ইতিহাস (বিদ্যাসাগর কলেজ শতবর্ষ স্মরণিকা)।

*******************************************

বাংলা ভাষায় শিক্ষার সূচনাপর্ব এবং বিদ্যাসাগর (প্রথম ভাগ)

রঞ্জন চক্রবর্ত্তী পরিচিতি :
রঞ্জন চক্রবর্ত্তীর জন্ম ১৬ মে ১৯৭৪, কলকাতায়। ১৯৯৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শরীরবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে রাজ্য প্রশাসনে আধিকারিক হিসেবে কর্মরত। ছাত্রাবস্থা থেকেই নিয়মিত লেখালিখির শুরু। এ যাবৎ বহু পত্র-পত্রিকায় তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরে যাব একদিন নৈঃশব্দ্য হয়ে’ এবং দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘স্বপ্নের মুখ ঢেকে রাখি দর্পণে’ পাঠকমহলে জনপ্রিয় হয়েছে। প্রবন্ধ সংকলন ‘বেদ থেকে পুরাণ’ পাঠক ও সমালোচকদের কাছে সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়েছে। ইতিমধ্যে সারস্বত সাহিত্য সম্মান, বিবৃতি সাহিত্য সম্মান, শীতলগড় সাহিত্য সম্মান ইত্যাদি বিবিধ সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!