উত্তরণ
চন্দ্রকান্তি দত্ত
অনন্তবাবুর সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছে মাত্র বছর দুই আগে। এর আগেও অবশ্য অনন্তবাবুকে চিনতাম। তবে ওই পর্যন্তই। অনন্তবাবুর সঙ্গে আমার দেখা ও কথা হত প্রধানতঃ আমাদের পাড়ার পুজোমন্ডপে। বছরের অন্য সময় দেখা-সাক্ষাৎ প্রায় হতো না বললেই চলে। কখনো-সখনো রাস্তাঘাটে দেখা হয়ে গেলে নমস্কার বিনিময় ও ‘কেমন আছেন’ জাতীয় অতি সংক্ষিপ্ত কুশল বিনিময় ছাড়া আর কিছুই হতো না।
অনন্তবাবু পুজোর চারদিন আমাদের পাড়ার প্রবীণদের আড্ডায় সামিল হলেও এ পাড়ার বাসিন্দা নন। ওঁর বাড়ি পাশের মন্ডলপাড়ায়। কিন্তু নিজের পাড়ার তুলনায় আমাদের পাড়ার প্রতিই ওঁর আকর্ষণ বেশী। কিন্তু সেটা কেন,তা অবশ্য আলাপের ছ-সাত বছর পর্যন্ত জানতে পারি নি। কারণ,অনন্তবাবু স্বল্পবাক ও অত্যন্ত নীচুস্বরে কথা বলেন।
মধ্যবয়স্ক থেকে প্রবীণ পর্যন্ত নাগরিকদের নিয়ে একটা বড় দল আছে এ পাড়ায়। এই দলেরই মজলিস বসে পুজোর চারদিন সন্ধ্যে থেকে প্রায় মাঝ রাত অবধি। মজলিসের প্রথম দিকে অবশ্য কথাবার্তা খুব একটা হতে পারে না। তখন একটানা ঢাক বাজে, মায়ের আরতি হয় ও তারপর অনেকটা সময় ধরে চলে ছেলে-ছোকরাদের ধুনুচি নাচ। আমাদের আসর জমে ঢাকের বাদ্যি থামলে।
অনন্তবাবু প্রতি বছরই এই চারদিন নিয়ম করে মন্ডপে আসেন। তবে কথা কম বলেন। সামান্য কিছু বললেও অধিকাংশ কথাই তাঁর নীচু স্বরের কারণে চাপা পড়ে যায়। সেই জন্যই বহুদিন পর্যন্ত অনন্তবাবু সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানার অবকাশ হয়নি। পরে ওঁর প্রতি আমার আগ্রহ কিছুটা বাড়ার ফলে ওঁর সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছি। এতদিনে অনন্তবাবুর সাথে অন্যদের কতটা নৈকট্য স্হাপিত হয়েছে জানিনা,কিন্তু আমার সাথে ওঁর বন্ধুত্ব যথেষ্ট গভীরতা লাভ করেছে। আমরা এখন পরম সুহৃদ।
অনন্তবাবু চাকরী করেন। বইপাড়ার এক নামকরা প্রকাশকের প্রুফ রিডার। অর্থাৎ বই ছেপে বেরোনোর আগে প্রতিটি শব্দ,প্রতিটি লাইন,দাঁড়ি,কমা,ইত্যাদি পরীক্ষা করা ও সংশোধন করা অনন্তবাবুর কাজ। তবে,কাগজে-কলমে অনন্তবাবুর পদ প্রুফ রিডার হলেও,প্রকাশক মশাইএর হুকুমে ওঁকে অন্য কাজও করতে হয়।
বই পাড়ায় একটা কথা খুব শোনা যায়। বড় বড় লেখক,কবি,সাহিত্যিকদের কলম থেকে কালজয়ী সব রচনা সৃষ্টি হলেও তাঁদের মধ্যে কিছু মানুষ আছেন যাঁরা সঠিক বাংলা বানান প্রয়োগের ব্যাপারে কিছুটা উদাসীন। স্বাভাবিক কারণে ছাপার সময় কম্পোজারকে বিপদে পড়তে হয়। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য প্রকাশক মশাই প্রতিটি লেখার পান্ডুলিপি অনন্তবাবুর হাতে তুলে দেন। অনন্তবাবুকে বানান-শুদ্ধির এই সময়সাপেক্ষ ও শ্রমসাধ্য কাজটা অতি অল্প সময়ে করতে হয়। এর জন্য অবশ্য বাড়তি কিছু পাওনার কোন প্রশ্ন আসে না। নির্বিরোধী অনন্তবাবু সাধ্যের বাইরে গিয়েও এই কাজগুলো নিষ্ঠার সাথে করেন। এইরকম এক কাজের মাধ্যমেই একদিন প্রখ্যাত সাহিত্যিক কমলেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাস অনন্তবাবুর হাতে এল। অনন্তবাবু যথারীতি তার বানান-শুদ্ধিতে লেগে পড়লেন। সবটুকু কাজ শেষ হওয়ার পর তিনি আবার একবার উপন্যাসটা ভাল করে পড়লেন। হাতে সময় ছিল না। তবু রাত জেগে পড়লেন। না,আর কোন ভুল চোখে পড়ছে না। তবে ওঁর হঠাৎ মনে হল,গল্পের শেষ অনুচ্ছেদটা খুব একটা ভাল লাগছে না। অনন্তবাবু সাহিত্যিক নন,নিছক একজন প্রুফ রিডার মাত্র। সাহিত্য আলোচনা বা সমালোচনা তাঁর শোভা পায় না। তিনি মনে মনে সংকোচ বোধ করলেন। কিন্তু মনকে মানাতে পারলেন না। তাঁর বারবারই মনে হতে লাগল,পুরো কাহিনীর সাথে শেষ অনুচ্ছেদটা ঠিক মানানসই হচ্ছে না। পাঠক এটা গ্রহণ নাও করতে পারে। অনেকক্ষণ ভাবনাচিন্তার পর অনন্তবাবু সেই কাজটাই করলেন যা এতকাল করেন নি। একটা কাগজে শেষ অনুচ্ছেদটা নিজের মত করে লিখলেন। তারপর সেটা ভাঁজ করে এমনভাবে লুকিয়ে রাখলেন যেন খুব বড় একটা অন্যায় করে ফেলেছেন।
অনন্তবাবু মনে মনে শপথ নিয়েই ফেলেছিলেন,যা করেছেন করেছেন,কিন্তু কমলেন্দুবাবুর কাছে এ প্রসঙ্গ কোনভাবেই তুলবেন না। কিন্তু পরদিন কমলেন্দুবাবু প্রকাশকের কাছে এসেছেন দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। গুটি গুটি পায়ে পাশে এসে দাঁড়ালেন। অনন্তবাবুকে এখানে দেখে কমলেন্দুবাবু যতটা উচ্ছ্বসিত হলেন,ঠিক ততটাই বিরক্ত হলেন প্রকাশক মশাই। তিনি বেশ রূঢ়ভাবেই বললেন,”কি হল অনন্তবাবু,আপনি আবার এখানে কেন? যান যান,কাজ করুন। অনেক কাজ পড়ে আছে।”
কমলেন্দুবাবু বাধা দিলেন। বললেন,”দাঁড়ান মল্লিকবাবু। ওঁকে যেতে বলবেন না। আমি একটু ওঁর সাথে কথা বলব।”
অনন্তবাবুর দিকে ঘুরে নমস্কার জানিয়ে বললেন,”কি অনন্তবাবু? কেমন আছেন? আমার লেখার ভুলগুলো শুধরে দিয়েছেন তো?”
অনন্তবাবু খুব নীচুস্বরে বললেন,”আজ্ঞে হ্যাঁ। দেখে দিয়েছি। তবে……..।”
মল্লিকবাবু প্রায় গর্জে উঠলেন,”তবে মানে? আপনি ওঁর লেখার উপর কলম চালাবেন নাকি? যান যান। ওঁকে বিরক্ত করবেন না।”
কমলেন্দুবাবু আবারও হাত তুলে মল্লিকবাবুকে থামতে ইশারা করলেন। অনন্তবাবুকে বললেন,”বলুন অনন্তবাবু,কি বলছিলেন।”
পরমুহূর্তেই মল্লিকবাবুকে বললেন,”বসার ঘরটা কি খালি আছে,মল্লিকবাবু? তাহলে আমি অনন্তবাবুকে নিয়ে ওখানেই বসছি। আপনি দয়া করে এই একশটা টাকা নিন। তিনটে ভাল চা আর কিছু ভাল বিস্কুট আনিয়ে দিন। ওখানেই দিতে বলবেন। আপনিও আসবেন।”
মল্লিকবাবু যারপরনাই লজ্জিত হলেন। বললেন,”না না। সে কি? আপনি আমার এখানে এসেছেন। নিজে পয়সা দিয়ে চা খাবেন। তাই কখনও হয়?”
কমলেন্দুবাবু হাসলেন। বললেন,”সমস্যাটা কোথায় জানেন? আপনি চা আনালে অনন্তবাবু বাদ পড়বেন। সেটা আমি চাই না। আমরা একসাথে চা খাব। আপনি কাউকে টাকাটা দিয়ে পাঠিয়ে দিন।”
অনন্তবাবুকে নিয়ে কমলেন্দুবাবু পাশের ঘরে ঢুকলেন। অনন্তবাবুকে বললেন,”বসুন অনন্তবাবু। শরীর ভাল আছে তো?”
অনন্তবাবু একটু দূরত্ব রেখে বসে বললেন,”আজ্ঞে শরীর মোটামুটি ভালই আছে।”
– “আপনিই আমার এ উপন্যাসের প্রথম পাঠক। লেখাটা কেমন লাগল বলুন।”
– “আজ্ঞে ভীষণ ভাল লেগেছে। অন্য সব পাঠকেরও ভাল লাগবে। আপনার লেখার তো কোন তুলনা হয় না।”
– “সে তো হল অনন্তবাবু। কিন্তু আপনি কি একটা যেন বলতে চাইছিলেন। সেটা একটু বলবেন?”
অনন্তবাবু আবার কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর মল্লিকবাবুর অনুপস্থিতিতে দ্বিধা কাটিয়ে বলেই ফেললেন,”আজ্ঞে মানে, আমার মনে হয়েছে,মানে,আমার ভুলও হতে পারে,শেষ অনুচ্ছেদটা গল্পের ভাবের সাথে যেন একটু অবিচার করছে। যদিও আমি গল্পের কিই বা জানি?”
কমলেন্দুবাবু হাসলেন। বললেন,”আপনি একটু বসুন। আমি আসছি,”বলে উঠে গিয়ে মল্লিকবাবুর কাছ থেকে পান্ডুলিপিটা চেয়ে নিয়ে এলেন। শেষ অনুচ্ছেদটা আবার পড়ে বললেন,”হ্যাঁ অনন্তবাবু,বলুন এটা কেমন হলে ভাল হয়।”
নতমস্তক অনন্তবাবু আরও নত হয়ে গেলেন। মৃদুস্বরে বললেন,”আজ্ঞে,যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলি,এরকম হলে ভাল হয়,”বলে নিজের লেখা কাগজটা কাঁপা কাঁপা হাতে কমলেন্দু বাবুর দিকে বাড়িয়ে ধরলেন।
কমলেন্দুবাবু প্রায় বাকরূদ্ধ হয়ে গেলেন। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিতেও ভুলে গেলেন। এতকাল বহু পাঠক,সমালোচক তাঁর লেখার প্রশংসা,নিন্দা দুই-ই করেছে। কিন্তু কেউ কখনও একটা গোটা অনুচ্ছেদ নিজের মত করে লিখে পাঠায় নি। মতামত জানিয়েছে মাত্র। আজকের ঘটনাটা তাঁর জীবনের একটা নতুন অভিজ্ঞতা।
কমলেন্দুবাবু নিচ্ছেন না দেখে অনন্তবাবু কাগজটা গোটাতে আরম্ভ করেছিলেন। কমলেন্দুবাবুর হুঁশ ফিরল। তিনি হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে প্রথমে একটু উল্টেপাল্টে দেখলেন। তারপর পড়ায় মন দিলেন।
কিছুটা সময় কাটল রূদ্ধশ্বাস নিস্তব্ধতায়। কমলেন্দুবাবু পড়লেন,অনন্তবাবুর দিকে তাকালেন,আবার পড়লেন।
এই সময়টুকুতে অনন্তবাবুর দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। তিনি অনুধাবন করলেন,তাঁর মত একজন ক্ষুদ্র মানুষের এতখানা স্পর্ধা দেখানো উচিৎ হয় নি। তিনি নিজের মধ্যেই শামুকের মত গুটিয়ে যেতে লাগলেন। একটুখানি মুক্ত বাতাসের জন্য অনন্তবাবুর প্রাণ নীরবে হাহাকার করতে লাগল।
অবশেষে নীরবতা ভাঙ্গলেন মল্লিকবাবু। চা নিয়ে নিজেই এ ঘরে এলেন। দেখলেন,কমলেন্দুবাবু মনযোগ সহকারে একটা কাগজ পড়ছেন। কিছুটা দূরে অনন্তবাবু সংকুচিত হয়ে বসে আছেন। মল্লিকবাবুকে দেখামাত্র অনন্তবাবু উঠে দাঁড়ালেন। ঘটনাটা কমলেন্দুবাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তিনি ঘুরে মল্লিকবাবুকে দেখে বললেন,”আরে মল্লিকবাবু,আপনি নিজেই চা নিয়ে এলেন? বসুন বসুন,একসাথে চা খাই।”
মল্লিকবাবু বসলে অনন্তবাবুর দিকে ঘুরে বললেন,”অনন্তবাবু,আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন। নিন,চা খান।
চায়ে চুমুক দিয়ে তৃপ্তিসুচক একটা ‘আহ্’ শব্দ করে কমলেন্দুবাবু আবার বললেন,”জানেন মল্লিকবাবু,আমি অভিভূত। অনন্তবাবু আজ আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। একটা কাহিনীর সমাপ্তি যে এত সুন্দর হতে পারে,অনন্তবাবুর লেখাটা না পড়লে আমি বুঝতে পারতাম না। অসাধারণ লেখেন অনন্তবাবু।”
তারপরই অনন্তবাবুকে বললেন,”অনন্তবাবু,আপনি অনুমতি দিলে কোন পরিবর্ত্তন ছাড়াই আপনার লেখাটা এই কাহিনীর সমাপ্তি হিসেবে রাখতে চাই।”
মল্লিকবাবুর সামনে অনন্তবাবু কোন কথাই বলতে পারলেন না। কোনরকমে মাথাটা একটু নাড়ালেন। সেটা সম্মতিসুচকও হতে পারে আবার অন্য কিছুও।
একজন স্বনামধন্য লেখকের এত প্রশংসা কিন্তু অনন্তবাবুর জন্য অশনিসংকেত বয়ে নিয়ে এল। অনন্ত সরখেলের মত একজন সরীসৃপের মাথা তুলে দাঁড়ানোটা মল্লিকবাবু বরদাস্ত করতে পারলেন না।
কমলেন্দুবাবু চলে গেলে অনন্তবাবু কাজে লেগে গিয়েছিলেন। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই মল্লিকবাবুর দপ্তরে ডাক পড়ল।
মল্লিকবাবু অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে বললেন,”দেখুন অনন্তবাবু! আপনি একজন মস্ত বড় মাপের মানুষ। আপনার মত বড় মাপের মানুষকে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানে ঠিক মানাচ্ছে না। আপনার অনেক বড় প্রতিষ্ঠানে থাকা উচিত। আপনি আপনার পাওনা-গন্ডা বুঝে নিন। কাল থেকে আর আপনাকে এখানে আসতে হবে না।”
অনন্তবাবুর চোখের সামনে তখন নিকষ কালো অন্ধকার। পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছে। অনন্তবাবু প্রবল মানসিক আঘাতে পর্যুদস্ত। পতন ও মূর্চ্ছা থেকে কোনক্রমে নিজেকে সামলে অনন্তবাবু মনিবের পা দুটো জড়িয়ে ধরলেন। প্রায় ক্রন্দনরত অবস্থায় বারবার বলতে লাগলেন,”আমার অন্যায় হয়ে গেছে বাবু। আর কক্ষণো হবে না। এবারকার মত মাফ করে দিন। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে না খেতে পেয়ে মরে যাব বাবু। দয়া করুন।”
মল্লিকবাবুকে গলানো গেল না। বললেন,”আপনার জন্য যে অপমানটা আজ আমাকে সহ্য করতে হয়েছে,তারপর অন্য কারও জায়গা হলেও আপনার এখানে কোন জায়গা হতে পারে না। আপনি যান।”
আমি যখন খবরটা পেলাম তখন ছ-সাত দিন পেরিয়ে গেছে। অনন্তবাবুর এক সহকর্মী আমাকে ঘটনাটা বিশদে জানালেন। ছুটে গেলাম অনন্তবাবুর বাড়ি। দেখলাম,অনন্তবাবু অসুস্থ,শয্যাশায়ী। একটা মোড়া টেনে বিছানার পাশে বসলাম। আমাকে দেখে অনন্তবাবু বললেন,”অখিলবাবু,এতবড় একটা অপরাধ আমি কি ভাবে করলাম,বলতে পারেন? এই একটা ভুলের জন্য আজ আমি সব হারিয়েছি।” অনন্তবাবুর দুচোখ বেয়ে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছিল। আমি যত্নে মুছিয়ে দিলাম। বললাম,”কিন্তু ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না,অনন্তবাবু। উঠে দাঁড়াতে হবে। আপনার যোগ্যতা আছে। কাজ ঠিকই পেয়ে যাবেন।”
অনন্তবাবুু ক্রমাগতঃ হতাশাব্যঞ্জক মাথা নাড়াচ্ছিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম,”আচ্ছা অনন্তবাবু,কমলেন্দুবাবু কি ঘটনাটা জানেন?”
অনন্তবাবু প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন,”আমি জানি না অখিলবাবু,আমি কিছু জানি না। শুধু এইটুকুই জানি যে,সামনের দিন দশ-বারো মাত্র আমার সংসারে হাঁড়ি চড়বে। তারপর কি হবে,ঈশ্বরই জানেন।”
অনন্তবাবুর হতাশা কাটানোর জন্য আমি একটা মরিয়া চেষ্টা করলাম। বললাম,”ভেঙ্গে পড়বেন না অনন্তবাবু। কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই। আমি দেখছি কি করা যায়। তবে একটা কথা আপনাকে না বলে পারছি না। এই যে কমলেন্দু চট্টোপাধ্যায় আপনার লেখার এত প্রশংসা করলেন। শুধু তাই নয়,আপনার লেখাটার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না করে তাঁর লেখার সাথে জুড়ে দিলেন,এর কি কোন সুদূর প্রসারী ফল নেই?”
অনন্তবাবু কিছু বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হল না। আমি আবার বললাম,”অনন্তবাবু,আপনি যদি এত ভাল লেখেন,তাহলে সে চেষ্টাটাও করছেন না কেন? তাছাড়া,কমলেন্দুবাবু তাঁর লেখায় আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকারও করেছেন। আপনি তো পাঠক মহলে কিছুটা পরিচিত। আর আপনি লিখলে তো কোন ক্ষতি নেই,তাই না?”
অনন্তবাবু কিছুক্ষণ নির্বাক চেয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে আমার হাতদুটো নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললেন, “অখিলবাবু! আপনিই আমার একমাত্র বন্ধু। তাই আপনাকেই বলছি। বিগত মাস তিনেক ধরে আমি একটা বই লিখেছি। বই মানে একটা উপন্যাস। কিন্তু লেখাটা শেষ হয়ে গেলেও কাউকে বলতে পারি নি।”
আমি বিস্মিত ও হতবাক। অনন্তবাবু একটা গোটা উপন্যাস লিখে ফেলেছেন! অথচ,নিজেকে সমাজের একজন নিকৃষ্ট জীব মনে করেন বলে সে কথাটা কাউকে বলতে পারেন নি। লেখাটা বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে।
আমি বললাম,”লেখাটা আমাকে একবার দেখাবেন অনন্তবাবু?”
অনন্তবাবুর অসুস্থ শরীরেও যেন একটা উজ্জ্বল আভা ফুটে উঠল। বড় মেয়েকে ডেকে বাক্স থেকে দড়ি বাঁধা এক তাড়া কাগজ বের করে আমাকে দিলেন। বললেন,”জানি না এ লেখা কারও পড়ার যোগ্য কিনা। কিন্তু আপনাকে দেখাতে কোন লজ্জা নেই অখিলবাবু। আপনি পড়ুন। কারণ,আপনি ছাড়া এ লেখা কেউ পড়বে না,ছাপবেও না।”
অনন্তবাবুর কথাগুলো আমি মেনে নিতে পারলাম না। বাধা দিয়ে বললাম,”না অনন্তবাবু! আপনি গরীব হতে পারেন,কিন্তু কোনভাবেই সমাজের নিকৃষ্ট জীব নন। আপনার মধ্যে যে সৃষ্টিশীলতা আছে,তাকে আরও ফুটিয়ে তুলতে হবে। আমি জানি,এ লেখা ভাল হয়েছে। না পড়েও সে কথা বলে দেওয়া যায়। আপনি থামবেন না অনন্তবাবু। লিখতে থাকুন। থাক অভাব,থাক অনটন। চাকরী অবশ্যই একটা করতে হবে। তারই সাথে চলবে আপনার সৃষ্টি। আমি বলছি,আপনি সফল হবেন।”
লক্ষ কোটি মানুষের পদপৃষ্ঠ মাটির নীচে কখনো কখনো যে মাণিক্য পাওয়া যায়,তার মূল্য সকলে না বুঝলেও জহুরীরা বোঝেন। সমাজের এক কোণে পড়ে থাকা আপাত মূল্যহীন অনন্তবাবু যে মাণিক্যের সৃষ্টি করেছেন,তাকে চিনেছেন সাহিত্যের দৃকপালেরা। সাদরে গ্রহণও করেছেন।
পরবর্ত্তী এক বছরেরও বেশী সময় ধরে কলকাতার এক নামী সংবাদ পত্রিকার রবিবাসবীয় বিভাগে অনন্তবাবুর লেখা ‘মঞ্জরী’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সে লেখা পাঠক মহলে জনপ্রিয় হয়েছে। অনন্তবাবু খ্যাতি পেয়েছেন। সাথে লক্ষ্মীলাভও হয়েছে।
একজন সামান্য প্রুফ রিডারের স্বনামধন্য সাহিত্যিকে উত্তরণ কিন্তু বিধির নির্ম্মম আঘাতে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারল না।
খ্যাতি অর্জনের পরই অনন্তবাবুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাহিত্যিক স্বত্ত্বা জেগে উঠল। অনন্তবাবু নিরলসভাবে লিখে যেতে লাগলেন। বাংলা সাহিত্যের অপরূপ ভান্ডারে নিজের অসাধারণ সৃষ্টিকে মিশিয়ে সে ভান্ডারকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে লাগলেন।
কিন্তু জন্মাবধি যে অভাব,যে অনটনের মধ্য দিয়ে এই দীর্ঘ প্রায় ষাট বছর কাটাতে হয়েছে,যে জীবন সংগ্রাম বারবার জীবনের পথচলাকে থামিয়ে দিতে চেয়েছে,তার যে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব অনন্তবাবুর শরীরে পড়েছিল,তাই যেন জানান দিচ্ছিল প্রতিক্ষণে। অনন্তবাবুর লেখনী ও মস্তিষ্ক একটানা কাজ করে গেলেও শরীর যেন এ ধকল বইতে পারছিল না।
ক্রমশঃ থেমে গেল অনন্তবাবুর কলম,তাঁর অপরূপ সৃষ্টিরা। অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার একদিন আগে হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে অনন্তবাবু অত্যন্ত কাতর স্বরে আমাকে বললেন,”অখিলবাবু,যে কাজ আপনি আমাকে দিয়েছিলেন,সে কাজও আমি ঠিকমত করতে পারলাম না। আমাকে ক্ষমা করবেন। আর বোধহয় সময় নেই।
অনন্তবাবু নেই। কিন্তু ওঁরা আছেন। একদিকে মল্লিকবাবুর মত দাম্ভিক প্রকাশক,অন্যদিকে কমলেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মত সাহিত্যের প্রকৃত বোদ্ধারা যাঁরা অনন্তবাবুর উত্তরণের পথে পাশে থেকেছেন। আর আছে বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করা অনন্তবাবুর কিছু কালজয়ী সৃষ্টি।
মাঝে আমি-ঘটনা পরম্পরার নীরব সাক্ষী।
শেষ।
************************************************
লেখক পরিচিতি (চন্দ্রকান্তি দত্ত):
ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। জন্ম মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনা শহরে ১৯৫৯ সালে। স্কুল শিক্ষার শুরুটা পুরুলিয়ায় হলেও, প্রায় পুরোটাই হয়েছে দুর্গাপুরে। উচ্চ শিক্ষাও সেখানেই। নিজেকে লেখক না বলে গল্পকার বলতেই বেশী ভালবাসেন। লেখার শুরু গত শতকের নয়ের দশকের শেষ দিকে,তাও একজন সিনিয়র সহকর্মীর উৎসাহ ও চাপে। সেই থেকে টুকটাক লিখলেও,শারীরিক অসুস্হতার কারণে লেখাতে ছেদ পড়েছে অনেকবার। এখন,চাকরী থেকে অবসরের পরে,প্রায় নিয়মিত লেখেন। গল্প ছাড়াও কয়েকটি কবিতাও লিখেছেন-বাংলা ও হিন্দিতে।