কাঞ্চনজঙ্ঘার রঙ
চিন্ময় চক্রবর্তী
ঠিক রঙটা কিছুতেই আসছিল না। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছিল অর্চি। তবু যেটা চাইছিল আসছিল না কিছুতেই। সেই যে শিটং পাহাড়ে গিয়েছিল সেবার,সেখানে হোমস্টের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে ভোরবেলার কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখেছিলো। পিছন থেকে সূর্যটা যেমন উঁকি মারছে,কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়োগুলোয় ছড়াচ্ছে কত রকমের রঙ। হাঁসের ডিমের লালচে কুসুম, টকটকে পাকা সোনা থেকে রূপোর রূপ। তার মাঝে কত রঙ । কি বিচিত্র। আলোর কি খেলা।তার সামনে সম্রাটের চূড়ার মত বিশাল মুকুট। কাঞ্চনজঙ্ঘা।
এর মধ্যে একটা রঙ মাথার মধ্যে গেঁথে আছে তার,কিন্তু আনতে পারছে না কিছুতেই। রঙটা কিছুক্ষণের জন্য প্রকট ছিল তার চোখে।অর্চিষ্মান চিত্রশিল্পী। ল্যান্ডস্কেপ তার প্রিয় বিষয়। অনেক দামে বিক্রি হয় তার ছবি। তার তুলির টান আর রঙের অনবদ্য প্রয়োগ অকল্পনীয়। দেশে বিদেশে তার ছবির কদর। কিন্তু আজ কি হলো তার? তার মনের রঙের প্রতিফলন ক্যানভাসে আসছে না কেন? কাঞ্চনজঙ্ঘার রঙ পরিবর্তনের একটা রঙ অর্চির মনে গেঁথে গেছে। ওটা না আনতে পারলে পাগল পাগল লাগছে নিজের। প্রচুর পারমুটেশন কম্বিনেশন করলো সে।নানান তাপমাত্রা প্রয়োগ করলো। তার নিজস্ব কিছু ফর্মুলা আছে। সেগুলোও কাজে লাগালো। আসছে না। তবুও আসছে না কিছুতেই।
মনটা কেমন যেন গুমরে আছে। সারাদিন চেষ্টা করেছে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। স্টুডিওর আলোগুলো জ্বালিয়ে দিলো। একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তার তেরোতলার এই ফ্ল্যাটের কাঁচের শার্সি দিয়ে কলকাতা শহরটা খুব সুন্দর লাগে। রাস্তাঘাট গুলো যেন শুঁয়োপোকোর মত চলেছে আর চলেছে। গত বছর গ্রীস থেকে আনা উজু হুইস্কিটার একটা শট্ বানিয়ে গলায় ঢেলে দিল। বেশ মৌরীর গন্ধ আর মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ। বেশ ভাল লাগে অর্চির। মনটা খিঁচড়ে আছে যেন। আর একটা শট্ নিলো। তারপর বেরিয়ে এলো ব্যালকনিতে। একটা সিগার ধরালো। বেশ হালকা লাগছে মাথাটা।
কিন্তু রঙটা ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে যেন। শিল্পীদের এটাই মুশকিল। খুব কাছাকাছি যে রঙটা এসেছিলো,সাধারণ মানুষের চোখে সেটাই একদম অবিকল। কিন্তু অর্চির চোখ বলছিল,হচ্ছে না। হচ্ছে না। কিছুতেই আসছে না রঙটা।
সুপর্ণাও নেই। শিলং পাহাড়ে বেড়াতে গেছে বান্ধবীরা মিলে। অল গার্লস ট্রিপ। অর্চির নো এন্ট্রি। সুপর্ণা থাকলে ওর সাথে কথা বলে কিছু আইডিয়া পেত হয়তো। সুপর্ণা বুদ্ধিমতী। রসায়নের ছাত্রী। দারুণ এ্যস্থেটিক সেন্স। মাঝে মাঝে খুব জটিল প্রব্লেমের সহজ সমাধান করে দেয় ও। আজ খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছিল ওকে। একটা ফোন করবে? নাঃ থাক্। কারুর প্রাইভেসিতে হস্তক্ষেপ করা অর্চির স্বভাব বিরুদ্ধ । আর একটা উজু শট্ ঢাললো গলায়।
স্টুডিওতে ঢুকলো আবার। দুতিনটে বড় বড় ড্রইং বোর্ড। তার একটাতে এই ছবি অসম্পূর্ণ হয়ে আছে। প্যালেটটা একবার বাঁ হাতে নিলো। ব্রাশ দিয়ে রঙ মিশিয়ে মিশিয়ে নানান ভাবে চেষ্টা করল আবার। হচ্ছে না। বাতি নিভিয়ে স্টুডিওয় তালা বন্ধ করে বেড রুমে চলে গেল। সুপর্ণার ফোন। অর্চিকে মিস করছে খুব। চেরাপুঞ্জিতে খুব ভাল কেটেছে আজ ওদের। এমন গাঢ় সবুজের বন নাকি সে কখনো দেখেনি। কি অপূর্ব রং। শিল্পী অর্চির চোখ দিয়ে দেখলে নাকি আরো ভাল লাগতো। অর্চির মাথায় ঘুরছে সেই সূর্যোদয়ের রঙ। হুঁ হাঁ করে আর দুয়েকটা কথা বলে গুড নাইট করে দিল সুপর্ণাকে। সুপর্ণাও বুঝলো যে অর্চি বেশ অন্যমনস্ক। ঘাঁটালো না আর ওকে।
এমনটা হয়। শিল্পমনষ্ক মানুষের মাথায় কখন যে কি ঘুরছে,কজন তা বোঝে? সুপর্ণা এটুকু বোঝে যে এখন অর্চিকে নিজের মত ভাবতে দেওয়া প্রয়োজন। কারণ তার প্রবলেম তাকেই সমাধান করতে হবে। কেউ সাহায্য করতে পারবে না। সুপর্ণা মনের চোখে অর্চির ছটফটানি দেখতে পাচ্ছে। বাড়ী থাকলে তাকে ক্রমাগত চায়ের যোগান দিতে হত সুপর্ণাকে। অর্চিও মিস্ করছে সেটা। সুপর্ণার হাতের চা না হলে অর্চির মন ভরে না কিছুতেই। সুপর্ণা খুব জানে সেটা। অর্চি কফিতে বিশ্বাস করে না। দার্জিলিং এ শুদ্ধ উৎকৃষ্ট পাতা চা ছাড়া ওর মন ভরে না। নেশা বলতে এটাই।
ভোর বেলা উঠে পড়লো অর্চি। উঠেই ব্যালকনিতে চলে গেল সূর্যকে দেখতে। পঞ্চাশ বছরের এত চেনা সূর্যটাকে আজ কি অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে সে কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না আজ অর্চির কাছে। তার কোন রঙটা সেদিন ছড়িয়েছিল সেদিন সেই তুষার শুভ্র হিমালয়ের ওপর? কি সেই রহস্যময় রঙ?
আর্ট কলেজে পড়তে রঙের বিন্যাস নিয়ে সে প্রচুর পড়াশোনা করেছিলো। সে এক অসাধারণ রসায়ন। সামান্য হিসেবের তারতম্যে কত বদলে যায় রঙের শেড। তাছাড়া একেকটা রঙ যেন একেকটা অনুভূতি। মনের একেকটা অবস্থা ফুটিয়ে তোলে একেকটা রঙ। একেকটা শেড সরাসরি আনন্দময় এক অনুভূতিকে বিষাদে ঢেকে ফেলতে পারে। কি সুক্ষ্ম এর প্রকাশ। গানের লোকেরা,যারা রাগ রাগিনী নিয়ে খেলা করে,তারা বুঝবে। তানসেন যেমন গান গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারতেন, অঝোরে কাঁদাতে পারতেন বা মনে স্বর্গীয় আনন্দের সঞ্চার করতে পারতেন, ঠিক তেমনই রঙের একেকটা শেড। এটা প্রকৃত শিল্পী ছাড়া বুঝবে না। সেই দেখার চোখও তৈরী করতে হয় অনেক সাধনা করে।
তানিয়াকে একটা ফোন করলো। তানিয়া ওরই আর্ট স্কুলের জুনিয়র । অর্চির গুণমুগ্ধ । খানিকটা প্রেম প্রেম সম্পর্কও নেই যে তা নয়, তবে শিল্পীদের কি প্রেমের থেকে দূরে রাখা যায়? তবে সুপর্ণা জানে যে ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়। তার সাথেও তানিয়ার খুবই বন্ধুত্ব। আসলে তানিয়ার সঙ্গে সুপর্ণার যোগাযোগটা অর্চির থেকে বেশীই।
তানিয়া বেশ অবাক হলো অর্চির ফোন পেয়ে। যাকে বলে প্লেজেন্টলি সারপ্রাইজড। তাই,সাধারণত ফোনগুলো তানিয়াই করে বেশী। আজ অর্চি করলো। কিছুটা স্বার্থপরের মতোই। তানিয়া আর্ট কলেজে পড়াশোনা শেষ করে একটা অ্যাডভার্টাইজিং ফার্মে চিফ আর্ট ডিরেক্টরের চাকরী করে। অর্চি বললো,“একটু আসতে পারো? দরকার আছে ৷” তানিয়া অরাজী হলো না। অফিস ফেরত চলে গেল অর্চির বাড়ী। রাত তখন সাড়ে আটটা হবে। অর্চি তখন স্টুডিওতে ডুবে আছে। হাতে রঙের প্যালেট আর ব্রাশ। তানিয়া পিছন থেকে এসে অর্চির মাথার চুলে হাত দিলো। অর্চি বললো “বসো”। তানিয়া জিজ্ঞাসা করলো,“সুপর্ণা কোথায়?” অর্চি বললো। তানিয়া হতাশ হলো। সুপর্ণা ছাড়া আড্ডাটা ঠিক জমে না। প্রেমটাও কেমন সাদামাটা হয়ে যায় যেন। অর্চি সমস্যাটা জানালো তানিয়াকে। জিজ্ঞাসা করলো ওর কি সাজেশন? গন্ডগোলটা কোথায়? তানিয়া খুঁটিয়ে রঙের কম্বিনেশন গুলো দেখলো। নানান রকম তারতম্য করতে লাগলো। শেডগুলো নানান ব্যাকগ্রাউন্ডে ফোটানোর চেষ্টা করলো।একটা করে ড্রিঙ্ক নিলো দুজনেই । অর্চি একটা সিগারেট ধরালো। খুব ইচ্ছে করলে এক আধটা সিগারেট খায় ও। সুপর্ণা ফোন করলো মাঝে। তানিয়া ধরলো। একটু ঠাট্টা ইয়ার্কি হলো যথারীতি। তারপর তানিয়া অর্চির সমস্যাটার কথা বললো সুপর্ণাকে। পরদিন সুপর্ণা ফিরছে। তানিয়াকে আর একবার আসতে বললো। তানিয়া বললো আসবে। সমস্যাটা বেশ ভোগাচ্ছে।
তানিয়ার সাথে কলেজের অনেক কথা শুরু হলো। শেডস্ গুলো কেমন ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। পাশ করার পর অনেক চাকরীর অফার ফিরিয়ে দিয়ে অর্চি একদম নিজের স্টুডিও তৈরী করে কাজ করবে ঠিক করেছিল যখন, কত কিছু শুনতে হয়েছিল তাকে! অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে কে না ভয় পায়? এমন কি তানিয়াও ধীরে ধীরে সরে গিয়েছিল। সুপর্ণা কিন্তু অর্চির প্রতিভার ব্যপারে সুনিশ্চিত ছিল। সম্পূর্ণ পাশে ছিল সবসময়। এমন কি যখন ওরা বিয়ে করে, তখনও অর্চির ছবি বিক্রি করে কটা আর টাকা পেত? তবু সুপর্ণা একটুও পিছিয়ে যাবার কথা বলেনি। আজ তানিয়াও সে কথা স্বীকার করে। ওদের তিনজনের প্রতি তিনজনের শ্রদ্ধাবোধ বোধহয় সম্পর্কগুলোর মধ্যে মলিনতা আসতে দেয় নি।
রাত প্রায় এগারোটায় তানিয়া বললো,“অর্চিদা,আজ চলি। কাল আসবো। ডিনার করব তোমাদের সাথে। দেখি কি করা যায় ৷” অর্চির মাথার মধ্যে অদ্ভুত সব চিন্তা ঘুরছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে,“কি শিখলাম?” এরকমই হয়। ভ্যান গগঁ নিজের কান কেটে ফেলেছিলেন। কারণটা যদিও আলাদা,তাঁর বন্ধু পল গ্যগ্যাঁর সাথে তাঁর বান্ধবী পালিয়ে যাওয়ায় কান কেটে ফেলেছিলেন তিনি। শিল্পীরা কি মনের অবস্থায় কি করবেন,কে বলতে পারে?
সুপর্ণা সকালের ফ্লাইটেই চলে এলো। এসে দেখে অর্চি কেমন যেন থম মেরে বসে আছে। স্নানটান সেরে অর্চির বড় কাঁচের কাপে এক কাপ চা নিয়ে এলো সুপর্ণা। নিজের জন্যও এক কাপ। আবহাওয়া হালকা করার জন্য জিগ্যেস করলো,“কেমন প্রেম হলো কাল বান্ধবীর সাথে?” অর্চি একটু অপ্রস্তুত হাসি হাসলো। কিন্তু আবার যে কে সেই।
সুপর্ণা ছবিটা দেখলো। অপূর্ব তুলির টান অর্চির। বিশাল ক্যানভাসে কাঞ্চনজঙ্ঘার পাঁচটা শৃঙ্গ কি অপূর্ব শোভা পাচ্ছে,আর তার কি রঙ্। যেন সেই শিটং পাহাড়ে বসে সে আর অর্চি সেই স্বর্গীয় শোভা উপভোগ করছে। এত নিখুঁত রঙে আরো কি খুঁজছে অর্চি? সুপর্ণা বুঝতে পারছে না।
তানিয়া তাড়াতাড়ি চলে এলো সন্ধ্যেবেলা। দুই বান্ধবীর খুনসুটি লেগেই থাকে। চললো কিছুক্ষণ। তারপর তিনটে ধূমায়িত চায়ের কাপ নিয়ে সুপর্ণা আর তানিয়া স্টুডিও তে ঢুকলো। দেখে অর্চি একমনে তাকিয়ে আছে তার সৃষ্টির দিকে। আর তার চোখে টলটল করছে জল। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। উঠে এসে দুজনকে একসাথে জড়িয়ে ধরলো অর্চি। বললো,“আমি পেয়েছি।” এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি ওর চোখে মুখে। কোনো এক পরমার্থ লাভের তৃপ্তি। সুপর্ণা আর তানিয়া দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে।
ওরা দুজনেই অবাক। অর্চি যখন শিটং পাহাড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখছিল,প্রায় ঘন্টা দুয়েক একদৃষ্টিতে চেয়েছিল ঐ বিশালত্বের দিকে। সেদিনও তার চোখে জল এসে গিয়েছিলো।
আজ নিজের মনকে ধীরে ধীরে সেই জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল শিল্পী অর্চিষ্মান। সে যেন বসে আছে ওই পাহাড়ে আর সূর্যদেব ক্রমশ প্রকট হচ্ছেন বরফে ঢাকা ওই পর্বতমালার পিছন থেকে। তার চোখে জমে গিয়েছিল লবণাক্ত জল। তার ভিতর দিয়ে যে রং সে দেখেছিল,তা কিছুতেই আসছিল না পার্থিব রঙের নানান কম্বিনেশনে।।
*************************************
চিন্ময় চক্রবর্তী পরিচিতি
জন্ম ১৯৬৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি চন্দননগরে।রসায়নে সাম্মানিকের পর পরিবেশ বিজ্ঞানে স্নাতোকোত্তর। তারপর কর্মসূত্রে নানান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার বুড়ি ছোঁয়া। তার মধ্যে আই আই এম কলকাতা উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম প্রথম সারির বহুজাতিক সংস্থায় পূ্র্বভারতের বাণিজ্যিক কর্ণধার। কবিতা রাজ্যে বিচরণ করা নিজের মনের জানালা খোলা রেখে। ইতিমধ্যেই চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত: আমার আকাশ,ভেঙেছে আকাশ,মেঘের ওপারে তারার খোঁজে এবং সাঁঝবেলার আগুনপাখি ।।