পঞ্চানন
পল্লব চট্টোপাধ্যায়
“চপ-সিঙড়ে-জিলিপি-রসগোল্লা……”-পরিচিত গলার ডাক শুনে বিহারের দামোদর তীরের এই ছোট্ট শহরের প্রান্তে থাকা আশ্রমপাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ছুটে আসতো বাড়ির বাইরে। ওরা যেন বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পর এই ডাকটার জন্যেই অপেক্ষা করে থাকতো। তারপরেই মাথায় খানদুই অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি আর কাঁধে দু’খানা ঝোলা ব্যাগ নিয়ে আবির্ভাব হত সদাহাস্যময় পঞ্চাননের। না,ইনি পাঁচ মুখওয়ালা কৈলাশপতি পঞ্চানন নন,এমনকি ময়রা ভোলা হরুর চ্যালার মত কবিয়ালও নন। তবু এই স্বল্পখ্যাত মফঃস্বল শহরের একেবারেই অখ্যাত ময়রা পঞ্চানন দাসের জনপ্রিয়তা ছেলেমহল ছাপিয়ে তাদের অভিভাবক-মহলেও পৌঁছে গেছিল। তার জনপ্রিয়তার চাবিকাঠিটি কি সিঙাড়া-মিষ্টির স্বাদ না পঞ্চাননের মুখের হাসি তার রহস্য না হয় রহস্যই থাক,আপাততঃ মানুষটার সম্বন্ধে কিছু বলি।
শহরের এই প্রান্তিক মহল্লার একমাত্র আকর্ষণ ছিল রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রম যার নামে এই পাড়ার নাম। এছাড়া একটা ছোট্ট শপিং সেন্টারে দুয়েকটা মুদির দোকানের মাঝে ছিল বুড়ো কেদারের সেলুন আর অন্যপ্রান্তে যাদব পালের পান-সিগারেট আর চা-বিস্কুটের গুমটি। অপর পারে ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বিশাল পাঁচিল। এই পাঁচিল ছিল চতুর্দিকে ভাঙাচোরা,তাই কলেজ অঞ্চলের সীমারেখা বোঝানো ছাড়া তার আর কোন কাজ ছিল না। এই কলেজের এই প্রান্তে ছিল অশিক্ষক কর্মচারিদের বাসাবাড়ি বা নন-গেজেটেড কলোনি,অন্য পারে শিক্ষকদের পাড়া,মাঝে কলেজ আর হোস্টেল। এই নন-গেজেটেড কলোনির বাসিন্দা টাউন-মেনটেনেন্সের অফিসার কেশরীবাবুর ভৃত্যাবাসে প্রায় বিনাভাড়াতেই সপরিবারে বাস করত পঞ্চানন দাস। স্ত্রী বোধহয় কেশরীর বাসায় রান্না করতেন আর পঞ্চানন সকালটা চপ-সিঙাড়া-জিলিপি-রসগোল্লা তৈরি করে বিকেলটা মাথায় হাঁড়ি-ঝুড়ি চাপিয়ে বিক্রি করে বেড়াত। শহরের এই অঞ্চলে পঞ্চাননকে চেনেনা বা তার সিঙাড়া খায়নি এমন মানুষ দুর্লভ ছিল,অন্ততঃ তার ‘সিঙড়ে’ হাঁকটি যে বিকেলে শোনেনি! সে ‘সিঙড়ে’ কেন বলত সে রহস্যের আমি কোন কিনারা করতে পারিনি আজও,ভাষাতত্বের জ্ঞান আমার কম।
সে প্রসঙ্গ থাক। এই পঞ্চাননের যে একটা বড় ছেলে ছিল,আর সে যে দেখতে দেখতে ম্যাট্রিক পাশ করে শহরের কলেজে ভর্তি হয়েছে,সে খবর আমার অজানা ছিল,একদিন সে খবর পেলাম আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এক সিনিয়ার ছাত্রের কাছে। সে ছাত্রটি আর কেউ নয়,কেশরীবাবুর ছেলে সুনীল। সায়েন্স আর অঙ্কের এগারো-বারো ক্লাসের পুরনো বই খুঁজতে একদিন আমাকে বলায় এত কথা জানতে পারলাম। এই চেয়ে পাওয়া বই পড়ে আর সুনীল,মিলিন্দদের কাছে পড়া বুঝে সে একদিন প্রথম বিভাগে হায়ার সেকেন্ডারি পাশও করল। তারপর এল এক কঠিন সময়। পঞ্চানন-পুত্র সুরেশ নিজের বাবাকে না জানিয়ে বিহারের ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ট্রান্সের পরীক্ষায় বসল আর যেখানে তিনহাজার সীটের জন্যে পঞ্চাশ হাজারের উপর পরীক্ষার্থী, সেখানে সে মনোনীতও হল। এবার সে খবর পঞ্চাননের কাছেও আর গোপন থাকল না। একদিন এন-জি কলোনির এক বন্ধু ওমপ্রকাশ বিশ্বকর্মা খবর দিল,জানিস,সুরেশ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে না,বিএসসি পড়া চালিয়ে যাবে।
অবাক কাণ্ড! কেন? না,পঞ্চাননের সিদ্ধান্ত। একদিন সুনীলভাইয়ের সঙ্গে কথা হল। ওকে পঞ্চানন বলেছে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া নাকি ওদের জন্যে নয়। ও অনেক খরচের ব্যাপার,গরীবের ঘোড়া-রোগ পোষায় না। বাপরে,কত ভারি ভারি বই! তারপরে ওর অনেকদিনের সাধ গ্রামে গিয়ে দেখায় যে ছেলে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করলে তো আর গ্র্যাজুয়েট হবে না!
বোঝো ঠ্যালা! লোকে বলে নাকি শিক্ষিতরা তর্ক বোঝে আর অশিক্ষিতদের জন্যে থাকে বিশ্বাস। আমি বললাম,দাদা চলো ওদেরকে বোঝাই,আমার তখন বি-টেক থার্ড ইয়ার,সুনীলভাইয়ার ফোর্থ। ওম এবার বিএসসি অনার্স ফাইনাল দেবে। তিনজনে মিলে পঞ্চানন আর সুরেশকে ডেকে আনলাম সুনীলদের বাড়ির বারান্দায়। অনেক কষ্টে বোঝানো হল যে ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়াররাও গ্র্যাজুয়েট, আর সাধারণ বিএসসি পাশদের থেকে যেহেতু দু’বছর বেশি পড়ে তাই দামটাও বেশি। ওম বলে, ‘দেখো না পঞ্চুচাচা,আমি দুবার রগড়াই মেরেও বি-টেকে ঢুকতে পারলাম না,বিএসসি পড়ছি,চাকরি পাব কিনা জানিনা। আমাকে বরং তুমি সামোসা ভাজা শিখিয়ে দিও।’ ইতোমধ্যে আমার আরেক বন্ধু ওমের ক্লাশমেট গৌতমও চলে এসেছে খবর পেয়ে। ও শুনে বলল,‘ভালই হবে পঞ্চাদা,আমি আর ওম পাশ করে সিঙাড়া ভাজবো,সুরেশ মাথায় করে বিক্রি করবে বিকেলে।’
এতক্ষণে পঞ্চাননের কিছুটা চৈতন্য হল। বলে,‘কিন্তু খরচা? ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পড়া- সে তো অনেক টাকার ব্যাপার?’
‘কুড়ি টাকা মাসে। আমি বললাম। তোমার কুড়িখানা সিঙাড়া আর কুড়িটা রসগোল্লার দাম। বই? আমি,সুনীল ভাইয়া,মিলিন্দ ভাইয়া আছি,তাছাড়া এতবড় লাইব্রেরি কী কাজে লাগবে? সকালে ভাত-ডাল খেয়ে যাবে,হোস্টেলের খরচাও নেই! শুনে বিশ্বাস করতে চায় না পঞ্চানন। বলে কি এই বাবুদের পোলারা! আপাততঃ নিমরাজি করানো গেল তাকে। সুরেশ আনন্দে সুনীলভাইয়ের হাত দুটো জড়িয়ে ধরলো।
আমার এই কাহিনী ১৯৭৯ সালের। আজ পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। এখন জয়েন্টে বসার জন্যে,একটা ভাল টেকনিক্যাল কলেজে বা মেডিক্যালে আডমিশনের জন্যে গরিব-অশিক্ষিত-গ্রাম্য লোকেরাও ঘটি-বাটি জমি-জিরেত বেচে ছেলেমেয়েকে কোচিং করাচ্ছে,তারা এসব গল্প হয়তো বিশ্বাস করবে না। কাউকে কোন অনুযোগ-অভিযোগ করছি না,কিন্তু শুধু বাপ-মায়ের প্রচলিত ধারণার প্রভাবে আর সাধারণ বুদ্ধির অভাবে কত ছেলের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতর হতে পারেনি। অবশ্য পঞ্চাননকে বেশিদিন গরিব থাকতে হয়নি,আর তার সাথে তার পুত্রদের কোনও যোগ নেই। তবে সে অন্য গল্প,সেটাই বলি এবার।
(২)
– ‘ভাইটি,টাকার জন্যে নিজের ভাইঝির বিয়ে ভেঙে গেলে পারবি তুই সহ্য করতে? তুই তো আমার আপন ভাই! তোর তো নিজের মেয়ে নেই,আমার মেয়েটা কি তোর নয়?’
– ‘হ্যাঁরে দাদা,অমন করে বলছিস কেন,কত টাকার ব্যাপার?’
– ‘তা ধর হাজার দশ। গয়নাতেই তো পাঁচ যাবে। তার পরে লোক খাওয়ানো আছে।’
-‘এতদিন পরে দিদি-জামাইবাবুর বাড়ি এলাম,নিশ্চয় তোমরা অন্ততঃ মাসখানেক থেকে যেতে বলবে।’
– ‘না না সেকি,নিশ্চয়! তবে দেখছই তো আমাদের ছোট এক কামরার বাসা,তাও আবার মালিকের দয়ায় থাকা। তোমাদের নাহক কষ্ট হবে।’
– ‘কি যে বলো জামাইদাদা! নিজের বাসায় আবার কষ্ট কিসের? দিদি তো আমার নিজের,পর তো নয়!’
– ‘পঞ্চাননদা,এবার কালীপুজোয় কিন্তু তোমার নামে দু’শো ধরেছি। সিঙাড়া বেচতে বলে কোনকালে পাঁচটাকার বেশি চাইনি।’ পাড়ার ছেলেরা,যারা এতকাল ওকে ‘পঞ্চা’ ডেকে এসেছে,‘সিঙড়ে’-বলে হাঁকটা নকল করেছে। এমনকি কিছু শয়তান ওকে দেখলেই পাণ্ডব গোয়েন্দার নকল করে ‘পঞ্চু’ বলে ডেকেছে (বাবলু-বিলুদের কুকুরের নাম,মনে আছে তো?) আর অন্যজন ‘ভৌ-উ-উ-উ’ ডাকে সাড়া দিয়েছে। আজ দেখি তাদের অন্য রূপ,কিন্তু কেন?
ব্যাপারটা কী? পঞ্চানন কি স্বপ্ন দেখছে? সেই হতদরিদ্র সিঙাড়াওয়ালা পঞ্চানন দাস কি সাত রাজার ধন মাণিক খুঁজে পেয়েছে, না কি বৃন্দাবনের সনাতন ঠাকুরের সেই পরশপাথর? সেসব কিছু নয়। বড় ছেলে সুরেশ ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হবার পর তার খরচা বেড়ে গেছিল। কলেজের খরচা আর কতটুকু,মাইনে-পত্তর,ল্যাব-চার্জ,সেসন্যাল-জার্নাল আর বইখাতা মিলে বড় জোর মাসে একশো। তবে তার হাতখরচা বেড়েছে, অন্ততঃ মাসে পঞ্চাশ না খরচ করলে নাকি বন্ধুদের সামনে মানসম্মান থাকে না। তাও তো তখনও সে কলেজে পাইকারি হারে মেয়েদের ভর্তি হওয়া শুরু হয়নি। পঞ্চানন গরিব ময়রা,এসবের কী বোঝে! ছোট ছেলে দেবেশটা গ্রামের বাড়িতে থাকলেও তার পড়াশুনার খরচ বাড়ছে, সেও তো পঞ্চাননকেই চালাতে হয়! তাই অবস্থার সামাল দিতে সিঙাড়া-জিলিপি ফিরির শেষে পোস্টাপিসের পাশের একটা দোকানের বারান্দার এককোনে একচিলতে জায়গা নিয়ে লটারির টিকিট বিক্রি করা শুরু করেছে। টাকায় বিশ পয়সা কমিশন থাকে,মাস গেলে সব খরচা বাদে শ’দু-আড়াই আসে হাতে।
সেবার শরীর অসুস্থ ছিল বলে হরিয়ানা রাজ্য লটারির বাড়তি টিকিটগুলো ফেরত দেওয়া হয়নি। আজকাল অনলাইনে অনেক উন্নত ব্যবস্থা হয়েছে,তবে সেযুগে ড্র-এর আগে এজেন্টের অফিসে ফেরৎ না দিলে নিয়মমাফিক অবিক্রিত টিকিট ডিসকাউন্টেড দরে সাব-এজেন্টকে কিনে নিতে হত। গচ্চা গেল বেশ কয়েকটা টাকা-এসব ভাবতে ভাবতে দেখে রেজাল্টটা দিয়ে গেছে এজেন্টের লোক,সঙ্গে একটা চিঠি-‘বধাই হো! জো মিলল উসমেঁ বিশ টকা হামার বা’। হতভম্ব পঞ্চানন নম্বর মিলিয়ে দেখে ফার্স্ট প্রাইজের দু’লাখ তার বিক্রি না হওয়া টিকিটগুলো থেকেই উঠেছে! ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যেই, ভাগ্যিস জ্বরটা হয়েছিল!
এরপরের ঘটনাগুলো আশানুরূপভাবেই ঘটতে থাকল। ইনকাম ট্যাক্স,এজেন্টের কমিশন আর তার দাবীর ‘বিশ টাকা’ কেটে তবু এক লাখ কুড়ি হাজার এল হাতে। তখনকার দিনে সেটা অনেক অনেক টাকা! তারপরেই শুরু হল ‘দীয়তাং ভুজ্যতাং’, পাড়াপড়শিদের খাওয়াতে হল,ছেলের কলেজের বন্ধুদের মিষ্টি। আত্মীয়স্বজন যারা গরিব লোকটার কোন বিপদে-আপদে কোনদিন পাশে দাঁড়ায়নি, তারা এসে ভীড় করল-কেউ আর নড়তে চায় না। হঠাৎ-বড়লোক আত্মীয়কে শোষণ করতে কেউই কম যায় না,সে বর্ণনা আগেই দিয়েছি। অবস্থা এমন হল যে এবার বাড়ির মালিক কেশরীজিও ভীড়ভাট্টায় অতিষ্ঠ হয়ে পঞ্চাননকে নোটিশ দিয়ে দিলেন!
সেই একলাখ কুড়ি যখন প্রায় সত্তরে ঠেকল,টনক নড়ল পঞ্চাননের। কেশরীজিকে ঠেকানো গেছে কোনমতে,কিন্তু খুঁটি গেড়ে বসে থাকা আত্মীয়স্বজন আর নড়ে না। সিঙাড়া বেচা বন্ধ বলে পঞ্চাননের দেখা আর পাই না,তবে খেলার মাঠে ওম, দারা, গৌতমদের কাছে সব খবর পাই। একদিন নাকি পাগল হয়ে গেল পঞ্চানন। একটা খাটোমতন লাঠি নিয়ে দাদা,বৌদি, ভাইপোদের দিকে তেড়ে যায়,ভায়রাভাইকে লাগিয়ে দেয় দু’ঘা। শেষে একদিন মাঠে সুনীল ভাইয়া হাসতে হাসতে এসে খবর দিল-‘অল ক্লিয়ার!’ তা এই ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’-মার্কা বুদ্ধিটা কার? ‘কার আবার?’ নিজের দিকে আঙুল তুলে দেখাল সুনীল।
কিন্তু বসে খেলে টাকা আর ক’দিন? ‘একটা মিষ্টির দোকান খোলো না’- পাশের বাড়ির কাকু বুদ্ধি দেন। নাঃ,এতে কমপিটিশন বেশি তাছাড়া দোকানঘর খালি নেই একটাও। আর নিজে কিছু করতে গেলে দোকান বানাতেই ক্যাপিটাল শেষ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে পুরনো বাজারের ভেতর বাসন-পট্টিতে বাসুদেবের পেতল-কাঁসার দোকানের পাশে একটা দোকানঘর খালি হল, তবে বাজার-কর্তৃপক্ষ সেখানে আগুন বা জলের কারবার করতে দেবে না। অগত্যা একটা স্টীলের বাসনের দোকান খুলে বসল পঞ্চানন। মিষ্টি-কথা আর হাসিমুখের জয় সর্বত্র। তাই পাশে আরো বাসনপত্রের দোকান থাকা সত্ত্বেও ওর ভালই চলতে লাগল।
এদিকে সুরেশ ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর কলকাতা না পাটনায় কোথায় যেন একটা ভাল চাকরি পেয়েছে। কিন্তু সে আর বাড়ির সঙ্গে কেন জানিনা কোন সম্পর্ক রাখে না। কোন এক বড়লোকের মেয়ের সঙ্গে তার চেনাশোনা হয়েছে-সেখানে একজন মাথায় করে সিঙাড়া-বেচা ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষকে বাপ বলে পরিচয় দেওয়াটা হয়তো নিতান্তই অপমানজনক। এরই মাঝে ছোট ছেলে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ফেলেছে। দাদার ব্যাপার-স্যাপার দেখে তার আর উচ্চশিক্ষার বাসনা নেই, ও ক’দিন পঞ্চাননের সঙ্গে বাসনের দোকানেই বসছিল। কিন্তু বাপ-মায়ের উচ্চাশাও তো থাকে। বাবার ইচ্ছে সে অন্ততঃ বি-এস-সিটুকু পাশ করুক। শেষ পর্যন্ত সুহৃদ-বন্ধুদের পরামর্শে ওকে মিহিজামের হোমিওপ্যাথি মেডিক্যাল কলেজে-অবশ্য বেশ নামী সেটাও,ভর্তি করে দেওয়া হল।
কিন্তু মন ভেঙে গেছে পঞ্চাননের। বড় ছেলেকে ঘিরে তেমন উচ্চাশা ছিল না তার,ভেবেছিল গ্র্যাজুয়েট হয়ে একটা চাকরি-বাকরি করে বাপ-মায়ের বয়সকালের অবলম্বন হবে। ছোট ছেলে পাশ করে এসে শহরেই একটা হোমিওপ্যাথির ক্লিনিক খুলে বসেছে-মোটামুটি ভালোই আয় হচ্ছে। তার কর্তব্য সে পালন করে যাচ্ছে,কিন্তু মন জিনিসটা এমনই যে একবার ভেঙে গেলে কোন আঠাতেই সে আর জোড়া লাগে না। একদিন পঞ্চানন কেন জানিনা হঠাৎই বাসনের দোকানটা বিক্রি করে দিল। সবাই ভাবল বুঝি ছেলেরা দাঁড়িয়ে গেছে,তাই আর বাবাকে কাজ করতে দিতে চায় না। তারপর শহরের লোক একদিন অবাক হয়ে দেখল হাঁড়ি-ঝুড়ি মাথায় সেই পুরনো পঞ্চাননকে পাড়ার পথে পথে,সেই ‘চপ-সিঙড়ে’ বলে হাঁকতে। এসব আমার নিজের চোখে দেখা নয়,শোনা কথা,কারণ আমি তখন কর্মসূত্রে অন্য শহরে। তবু খবর পেতাম,পাড়ার লোকজন একদিন ওকে ধরেবেঁধে অনেক করে বোঝাল,ওর ছোট ছেলে দেবুও এল ক্লিনিক ছেড়ে।
পঞ্চাননকে তারপর থেকে আর দেখা যায়নি সে শহরে। শোনা যায় ও স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে গেছিল ওদের গ্রামের বাড়িতে, জানিনা এখনও বেঁচে আছে কিনা। না থাকাটাই স্বাভাবিক। সুরেশ আর দেবেশ-দু’জনেরই কোন সঠিক খবর নেই তার পর থেকে,যতদূর জানি সুরেশ বিয়ের পর আর কোন পুরনো সম্পর্কই রাখেনি,তবে ছোট ভাই দেবেশের ক্লিনিক ওদের গ্রামে মোটামুটি চলছে।
* * * * * * * * *
পঞ্চাননের মতো এমন অজস্র মানুষ আছে এই বিশ্বে যারা গোটা জীবন ধরে কোন উচ্চাশা পালন করে না,শুধু খোঁজে একটু সাধারণ সচ্ছল জীবন,দারা-পুত্র-কন্যাসমাবৃত একটা সুখী পরিবার। আমি আজও ভেবে পাই না,ও জীবনে কী ভুল করেছিল যে যা চেয়েছিল তা পেল না আর যা পেয়েছিল তার উপর ভরসা রাখতে পারল না! আজকের সমাজের মানুষ হলে হয়ত সে ভুলটা করত না,কারণ আমরা তো আজ মেনেই নিয়েছি যে শেষ জীবনটা আমাদের হয়তো একাই কাটাতে হবে! এখানে শংকরাচার্যের মোহমুদ্গর-‘কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ’ শুধুই একটা স্তোকবাক্য মনে হয়না কি এই ভীরু-দুর্বল সদাহাস্যময় নরম মনের মানুষগুলোর কাছে !!!
************************************
পল্লব চট্টোপাধ্যায় পরিচিতিঃ
রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংএ স্নাতক। কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশের খনিজ তৈলক্ষেত্রে কাটিয়েছেন সারাজীবন, সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত। বিহারের, অধুনা ঝাড়খণ্ড, যে অঞ্চলে তিনি মানুষ সেখানে ‘নানা ভাষা, নানা জাতি, নানা পরিধান’ হলেও একসময় বাংলাভাষা শিক্ষা ও চর্চার আবহ ছিল। সেই শিক্ষা থেকে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জন্মায় ও বিগত কয়েক বছরে অবসর, জয়ঢাক, ম্যাজিক-ল্যাম্প, ছুটির ঘন্টা, আদরের নৌকা, ঋতবাক ইত্যাদি নেট-পত্রিকা ও যুগ, ট্রৈনিক, বোম্বে-ডাক ইত্যাদি মুদ্রিত পত্রিকায়, ক্যাফে-টেবল প্রকাশিত শরদিন্দু স্মৃতি-সংখ্যায় লিখে আসছেন। তাঁর প্রকাশিতব্য গল্প সংগ্রহ ‘আড্ডা আনলিমিটেড’ ও ‘বরাহ-নন্দন ও অন্যান্য গল্প’- দুটিই এখন যন্ত্রস্থ।