ফেরা
মধুমিতা মিত্র
মহানগরীর প্রভাব যেখানে আলতোভাবে ফিকে হতে শুরু করেছে গ্ৰাম মফ:স্বলের গন্ধমাখা সেই প্রান্তরেখায় ব্রিটিশ আমলের তৈরী এক রেল কলোনী-এই গল্পের স্হান। স্হানের পরেই আসে কাল আর পাত্র,কাল কিন্তু আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের এক স্বর্ণ যুগ যখন জীবন ছিল সরলতায় পরিপূর্ণ,প্রযুক্তির মাথা না গলানো অনাড়ম্বর জীবনে সারল্যই প্রধান অনুষঙ্গ ছিল;এ কাহিনী সেই সময়েরই,আর পাত্র?-ঐ রেল কলোনীর এক গুচ্ছ বালক বালিকা যারা ছেলে মেয়ের পরিচয় তুচ্ছ করে শিশু হিসেবেই গোটা কলোনীর যত্র তত্র প্রায় সারাটি দিনমান তাদের অবসর অনুযায়ী বিচরণ করে বেড়াতো।
এ হেন রেল কলোনীর বারো নম্বর ব্লকে সেদিন বড়ো হৈ চৈ। অকৃতদার জেঠু তাঁর যাবতীয় প্রতিবেশী ভাইপো,ভাইঝিদের নিয়ে চলেছেন বেশ কাছাকাছিই আলিপুর চিড়িয়াখানায় বেড়াতে। বছরের এই শেষ বেলায় সব কুচোদের পরীক্ষা তখন শেষ। কলোনীর অনেক বিল্ডিং এরই ছাদে উঠে,সব কটি মাঠে ক্রিকেট বল পিটিয়ে,পিট্টু খেলে,ব্যাডমিন্টন র্যাকেট ভেঙে কুচো বাহিনী তখন সামান্য একঘেয়েমির ক্লান্তিতে একটু ঝিমিয়ে পড়েছে। জেঠু এদের সেই ঝিমিয়ে পড়া চেহারা দেখেই প্ল্যান করলেন এদেরকে নিয়ে একটু আউটিং এর। আসলে পরিবারহীন জেঠুর এই বাল বাহিনীই ছিল প্রাণ। ছেলেদের কানটি মুলতে তিনি যেমন দ্বিধা করতেন না আবার এদের নিয়ে ঠাকুর দেখা,ঘুড়ি ওড়ানো, লাট্টু খেলা এবং খেলানো সবেতেই তাঁর সমান উৎসাহ ছিল। সে পাড়ায় ওই যুগটাই ছিল অমন। এমন নয় যে ঘরে ঘরে অনেক ছেলেপুলে-ওই একটা,দুটো কিংবা খুব বেশী হলে তিনটে। সে পাড়ার মা বাবারা কিন্তু তখনও তেমন অধিকার প্রবণ ছিলেন না। কলোনীর মধ্যে খুব একটা একাত্মতা বোধ ছিল,তাই জেঠুও পারতেন তথাকথিত পরের ছেলেদের অমন করে ভালোবাসতে, আবার একান্ত নিজের মানুষের মতো অমন শাসন করতে। যাই হোক খুদে বাহিনী যখন গন্ডিবদ্ধ রাজত্বে দস্যিপনায় খানিক দৌরাত্ম্য-ক্লান্ত, তখন এই জেঠুরই মাথায় এল এদেরকে নিয়ে এই কাছে পিঠের চিড়িয়াখানায় গেলে তো বেশ হয়!
শুরু হয়ে গেল ঘরে ঘরে তার প্রস্তুতি। কারুর ঘরের লুচি,কোনো ঘরের আলুর দম আর বা কেউ প্রেসার কুকারে বানানো কেক,কেউ বা বিস্কিট চানাচুর নিয়ে তৈরি–সেদিন রবিবারের শীতের সকাল হয়ে গেল অন্য ছন্দে বাঁধা। আসলে সে সময়ে তো বিনোদন অত সহজ ছিল না। মধ্যবিত্ত ঘরে কোথায় অত বিলাসের পয়সা ছিল? ছুটি ছাটা তে আত্মীয় স্বজনের বাড়ি যাওয়াটাই একমাত্র বিনোদন ছিল। কালে কস্মিনে কখনো সখনো বাবা মায়ের হাত ধরে বাচ্চাদের সিনেমা দেখা,কোনো কোনো বছর যদি বা যাওয়া হত এই চিড়িয়াখানা অথবা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল অথবা নেহেরু চিল্ড্রেন্স মিউজিয়াম। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সেই স্কুল থেকে লাইন দিয়ে যাওয়া হতো ৷ ক’জনার ভাগ্যে জুটতো এমন করে বাড়ি থেকে দল বেঁধে পাড়ার বন্ধুদের সাথে যাওয়ার? তা-ও আবার অমন মাই ডিয়ার জেঠুর অভিভাবকত্বে! রেল কলোনীর বারো নম্বরের বুবলা,টুম্পা,মুন্না,পিন্টু,টুলটুলি আজ আনন্দে তাই মাতোয়ারা। সাথে জুটেছে জেঠুর আরো দুটো দস্যি ভাগ্নে রাজাই আর টুকাই। পরিবার বলতে রেল কলোনীর একেবারে পাশটিতে থাকা জেঠুর নিজের বোনের এ দুটি ছেলে, এই বুবলা টুম্পাদেরই জুড়িদার,জেঠু এ দুটি কেও তাঁর বাহিনীতে সামিল করে নিয়ে চললেন চিড়িয়াখানায়। পাঠকপাড়া থেকে এসপ্ল্যানেডের দিকে যাওয়া পঁয়তিরিশ নম্বর ট্রামে চেপে শুরু হল এদের যাত্রা, এক্কেবারে সাতসকালেই। খিদিরপুরের মোড়ে এসে হৈ হৈ করে ট্রাম থেকে নেমে চিড়িয়াখানার টিকিট কাউন্টারের সামনে এসে সদলবলে জেঠু যখন দাঁড়ালেন দলের কারুরই যেন আর তর সইছেনা,ভিতরে যাবার জন্য সবারই সে কি ছটফটানি। ভিতরে ঢুকেই জেঠু তাই সবাইকেই নিয়ে গেলেন সব্বার আগে বাঁদরের ঘরে,বললেন-“এই দেখ্, তোদের এই বন্ধুগুলো কপাল দোষে আছে চিড়িয়াখানার এই জালিগুলির ভেতরে আর তোরা কেমন কপাল গুণে ছিটকে পড়েছিস রেল কলোনীতে”। তাই না শুনে তো মুন্না পিন্টুদের কারো বা চিড়বিড়িয়ে রাগ,কারুর বা খিলখিলিয়ে হাসি। সেখান থেকে বেরিয়ে এরা সব চষে বেড়ালো চিড়িয়াখানার প্রতিটা কোণা। কখনো পাখির ঘরে,কখনো বা সাপের কাঁচের ঘরে,আবার এই বাঘের খাঁচার সামনে তো ওই জলহস্তীর প্রাচীরের পাশে,হাতির পিঠে ওঠা-হাতিকে নয়া পয়সা দিয়ে তার কাছ থেকে সেলাম পাওয়া এ সব আনন্দে কুচো বাহিনী হল মত্ত। এরই মধ্যে সারা হল সকালের জলখাবার,দুপুরের লাঞ্চ–হলো কয়েক প্রস্হ চা কফি। এই চা কফির স্বাদই স্বর্গীয় কারণ বাড়িতে তো এসব নিষিদ্ধ। সারাটি দিন অমন টৈ টৈ করে চিড়িয়াখানার এ মুড়ো ও মুড়ো করে ক্লান্ত বাহিনী তখন বাড়ি মুখো,জেঠু গুনছেন একটি একটি করে মাথা।দিনভর জেঠুর এই একটি অন্যতম প্রধান কাজ ছিল–কিছু সময় অন্তর মাথাগুলি গুনে নেওয়া। আসলে অমন বাঁদর বাহিনীর এমন একক অভিভাবক! এই সাবধানতা তো অবলম্বন করতেই হবে। সারাদিনে বাচ্চাদের মাথা গুনতিতে দিব্বি মিলে গেছে,এখন দিনের শেষে একি মাথা কেন গুনে মেলে না?-কাকে পাওয়া যাচ্ছে না! দেখা গেল জেঠুর ছোট ভাগ্নে টুকাই মহাশয় দল থেকে গায়েব! জেঠুর তো মাথায় হাত,কি করি! কি করি অবস্হা! কোনো রকমে এই বিরাট বাহিনী কে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই জেঠু দৌড়লেন বেহালা থানায় ৷
ওদিকে হয়েছে কি জেঠুর ছোট ভাগ্নে টুকাই ছটফটে মিষ্টি খুব দুষ্টু একটি ছেলে। সারাক্ষণ মামুর গার্জেনী সহ্য করে,মামু যখন দলবল নিয়ে চিড়িয়াখানার মেন গেটের দিকে বাড়িমুখো হয়ে রওনা দিচ্ছে টুকাই বাবুর তখন বিশেষ মন খারাপ-আবার সেই বাড়ি! মা বাবার এই কোরো না,সেই কোরো না–পড়তে বোসো, ঘুমোতে যাও সব নিয়ম কানুন! হে ঠাকুর রোজ কেন চিড়িয়াখানার দিন আসে না?”ধুরত্তারিকা আমি বাড়িই যাবো না…চিড়িয়াখানার এই আশেপাশেই লুকিয়ে থাকবো,আর রোজ সকালে গেট খুললেই গার্ড কাকুকে লুকিয়ে চিড়িয়াখানায় ঢুকে চারিদিকে ঘুরে বেড়াবো ৷ ” এই না ভেবে টুকাই মহারাজ একটু একটু করে পায়ে পায়ে পিছিয়ে পড়লো মামুর দলের থেকে। মামুর দল যখন চোখের আড়ালে চলে গেল–টুকাই মহারাজের সে কি আনন্দ!! কোন্ দিকে যায় সে ভেবে সে দিশাহারা। চারিদিকে গিজগিজে মানুষ,কত গাড়ি,কত ঘোড়া!! প্রায় সবাই ছুটছে নিজের তাগিদে,কারুর আর তার দিকে ফিরে তাকানোর সময় নেই,কেউ কেউ অবশ্য সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। একজনের সেরকম দেখা টুকাই এর মনে কেমন ভয় ধরিয়ে দিল,সে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করলো; কিন্তু ওই অত লোকের মধ্যে দিয়ে দৌড়োনো কি সহজ কথা? ভয়ে টুকাই মহারাজের হাত পা তো ঠান্ডা। ডানপিটে টুকাই কিন্তু অমন ভীতু নয়,মনে ভয় পেলেও,মাথায় তার গিজ্ গিজে বুদ্ধি। মাথা তার চলতে শুরু করল সাথে সাথে।
এদিকে হয়েছে কি দস্যু বাহিনী যতখানি আনন্দ উৎসাহ নিয়ে বেরিয়েছিল ততটাই মন খারাপ নিয়ে ফেরৎ এল,হরিষে বিষাদ।গোটা বিল্ডিং,আশেপাশে সবার ই মন খারাপ,দুশ্চিন্তা। টুকাইদের বাড়ীতে এ সব কথা না পৌঁছানোর ফিসফাস চলছে,আরও কিভাবে খোঁজ করা যায় তারও জল্পনা কল্পনা চলছে। কেউ কেউ আবার এ-ও বলছে এই যে খিদিরপুর বন্দর এলাকা; সেখানে নিখোঁজ হলে কি আর ফিরে পাওয়া যাবে?-সবাইকে মন খারাপ, দুশ্চিন্তা চেপে ধরেছে। জেঠু তো সেই থেকে বেহালা থানায় হত্যে দিয়ে বসেই রয়েছেন।
টুকাই মহারাজ এদিকে মনে ভয় মাথায় বুদ্ধি নিয়ে সেই দুষ্টু লোকটার নজর থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করে ই চলেছে–এমন সময় সামনে দেখে এক ট্রাফিক পুলিশ! দৌড়ে গিয়ে পুলিশকে ধরে টুকাই-“ও পুলিশ কাকু,পুলিশ কাকু—দেখো না মামুর সাথে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে এসে হারিয়ে গেছি আমি। আমাকে তুমি বাড়ি পৌঁছে দেবে? আমি বেহালায় থাকি,আমার মা না খুউউউব ভালো রান্না করে। তুমি যাআআআ খেতে চাইবে আমার মা তোমায় যত্ন করে ভালোবেসে তাই খাওয়াবে। আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো না গো”!!! এই না বলে এতক্ষণে টুকাই ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো। কিন্তু কাঁদলে কি হবে আড় চোখে চারিপাশ দেখে দেখে সেই দুষ্টু লোকটা তো আর নেই!!
পুলিশ কাকু তো টুকাই এর বুদ্ধি দেখে খুব খুশী,সাথে সাথে সে টুকাই কে নিয়ে চললো খিদিরপুর থানায়। খিদিরপুর থানা থেকে বেহালা থানায় খবর আসা মাত্র জেঠু লাফিয়ে উঠলেন।
সত্যি সত্যি টুকাই যখন বাড়ি ফিরল টুকাই,আর অন্য সব পুলিশের সাথে সেই ট্রাফিক পুলিশ কাকু কেও সঙ্গে করে এনেছিল। টুকাই এর মা অত রাতেও টুকাই এর সব পুলিশ কাকু দের পঞ্চ ব্যঞ্জন,মাছ মাংস রান্না করে খাওয়ালেন।
শুধুমাত্র টুকাই এর সাহস আর বুদ্ধির জোরেই সে যাত্রা টুকাই এর বাড়ি ফেরা হলো। জেঠু তার দস্যু বাহিনী নিয়ে আর কোথাও বেরিয়েছিলেন কিনা তার খবর আর পাওয়া যায় নি।
**********************************
মধুমিতা মিত্র: পেশা–স্বপ্ন দর্শন,স্বপ্ন গুলো ই বাঁচিয়ে রাখে,
নেশা–আনন্দ চয়ন,জীবন পথের সমস্ত জঞ্জাল,বোঝা,দুঃখ সব দূর করে ফেলে দিয়ে আনন্দ কুড়িয়ে বেড়ানো,
প্রেম-রবীন্দ্রনাথ,উদয়শঙ্কর, উত্তমকুমার।সাম্প্রতিকতম প্রেম শ্রীকৃষ্ণ ..
আমি অভিভূত৷সৌন্দর্য্য প্রকাশের বা সুন্দরকে আবাহন করার এই প্রয়াস, যেখানে সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয়গুলির অবতারণা ও বিশ্লেষণ সুচারুভাবে পরিবেশন করা হয়েছে, তা যথার্থ অর্থেই প্রশংসার্হ৷ অভিনন্দন জানাই৷
ধন্যবাদ দিয়ে এত সুন্দর মন্তব্যকে ছোট করবো না,শুধু একটাই প্রার্থনা যেন আপনাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারি রামকৃষ্ণ দা 🙏
মুক্তো করে ভয়,
আপনা মাঝে শক্তি ধরো
নিজেরে করো জয়৷
শুভায় ভবতু ৷৷
দারুণ মিষ্টি একটা গল্প।
তোদের ভালো লেগেছে এটাই আমার অনেক বড়ো পাওয়া, অনেক অনেক ভালবাসা নিস ❤️❤️❤️
ধন্যবাদ দিয়ে এত সুন্দর মন্তব্য কে ম্লান করবো না,একটাই কথা বলি যেন সব সময়েই আপনাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারি🙏 রামকৃষ্ণ দা
Khub shundor likhechhish..ekdin khub naam korbi….lekha chaliye ja..khub gorbito aami..
অনেক অনেক ভালবাসা নিস রে❤️❤️❤️