শম্ভুচন্দ্র শেঠ
(দেশশ্রী হরিহর শেঠ মহাশয়ের পিতামহ)
অনির্বাণ সাহা
হুগলি জেলার মহানাদ গ্রাম থেকে হুগলির হারিট গ্রাম হয়ে প্রায় তিনশ বছর আগে চন্দননগরে আসা প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী শেঠ পরিবারের চতুর্থ পুরুষ হলেন শম্ভুচন্দ্র শেঠ । তাঁর পিতার নাম ছিল রাধামোহন শেঠ এবং মাতা হলেন রাধারানী দেবী । পণ্ডিত শ্রী শিবেন্দ্রনারায়ণ শাস্ত্রী মহাশয়ের লেখা “বাংলার পারিবারিক ইতিহাস” বইটিতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মনে করা হয় কালীচরণ শেঠের (যদিও কালীচরণ শেঠ মহাশয়কে শেঠ বংশের প্রথম পুরুষ হিসেবে মনে করা হয়) কনিষ্ঠপুত্র প্রাণকৃষ্ণ শেঠ মহাশয়ের দ্বিতীয় পুত্র রাধামোহন শেঠ থেকেই বর্তমান শেঠ বংশের উৎপত্তি হয়েছে । বংশানুক্রমে (পিতামহ কালীচরণ শেঠ মহাশয় চন্দননগরের বোড় কৃষ্ণপুরে প্রায় সাড়ে ষোলো কাঠা জমির উপর একটি ভবন প্রস্তুত করেন) পাওয়া চন্দননগরের বোড় কৃষ্ণপুরে তৈরি ভবনেই রাধামোহন শেঠ সপরিবারে বসবাস করতেন ।
রাধামোহন শেঠ ও রাধারানী দেবীর কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন শম্ভুচন্দ্র শেঠ । তাঁর দাদার নাম ছিল রামনারায়ণ শেঠ (মধ্যম পুত্র) এবং দিদির নাম ছিল পদ্মমণি দেবী (জ্যেষ্ঠ কন্যা) । রাধামোহন শেঠ মহাশয় ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং দানবীর ব্যক্তি । তিনি মুক্ত হস্তে দরিদ্র মানুষের কাছে তাঁর সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠা বোধ করতেন না । পণ্ডিত শ্রী শিবেন্দ্রনারায়ণ শাস্ত্রী মহাশয়ের লেখা “বাংলার পারিবারিক ইতিহাস” বইটি থেকে জানা যায় যে, জীবনের শেষলগ্নে এক ব্রাহ্মণের কাতর অনুরোধে তাঁর নেওয়া ঋণের মৌখিক জামিনদার হন রাধামোহন শেঠ মহাশয় । পরবর্তীতে সেই ব্রাহ্মণ ঋণ শোধে অসমর্থ হলে চন্দননগরের বোড় কৃষ্ণপুর নামক জায়গার পদ্মপুকুর পল্লীর পৈত্রিক বাসভবনটি বিক্রি করে (১৮১৬ সালে) সেই ঋণ পরিশোধ করেন তিনি । ফলস্বরূপ জীবন সায়াহ্নে এসে রাধামোহন বাবু চরম অর্থকষ্টের মধ্যে পড়েন, সাথে সাথে তার সন্তানাদিরাও এই কষ্ট ভোগ করতে থাকে ।
এই অত্যধিক দারিদ্রতার জ্বালা রন্ধ্রে রন্ধ্রে কষ্ট দিতে থাকে শম্ভুচন্দ্র শেঠকে । জীবন ও সংসার চালনার দায়ভার কাঁধে নিয়ে মাত্র ৬৭ টাকা মাস মাহিনার পরিবর্তে কলকাতার এক সাধারণ তুলার দোকানের কর্মচারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন । পরবর্তী সময়ে চন্দননগরের বারাসত নিবাসী অত্যন্ত বিত্তশালী ব্যবসায়ী কার্তিক প্রসাদ শ্রীমানীর কন্যা অন্নপূর্ণা দাসীর সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন । বিয়ের পর শ্বশুরমশাই নতুন ব্যবসার সূচনা ও উন্নতির জন্য ১০০০ টাকা মূলধন দিয়ে শম্ভুচন্দ্র শেঠ মহাশয়কে সাহায্য করেন । সেই অর্থ দিয়েই তৎকালীন কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলে ছোট করে লোহার ব্যবসা আরম্ভ করেন তিনি । ক্রমে ক্রমে সেই ব্যবসা মহীরুহে পরিণত হয় এবং তিনি হয়ে ওঠেন ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের সাথে লৌহ আমদানি-রপ্তানিকারী প্রথম বাঙালি । শুধু তাই নয় তৎকালীন যুগেই লোহা, স্টিল ও হার্ডওয়ার সম্পর্কিত ব্যবসার পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন তিনি । পৈত্রিক বাসভবনটি বিক্রি হয়ে যাওয়ার ফলে বিয়ের ঠিক পরপরই শম্ভুচন্দ্র শেঠের শ্বশুরমশাই তৎকালীন পালপাড়া অঞ্চলে একটি ভবন প্রদান করেন (যদিও স্বর্গত হরিহর শেঠ মহাশয়ের শ্রাদ্ধবাসরে তার পুত্র-কন্যা দ্বারা প্রকাশিত “পরমপূজ্য পিতৃদেবের উদ্দেশ্যে অন্তরের গভীরতম ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিবেদন” নামক বংশ পরিচয় সম্বলিত পত্রিকায় বলা হয়েছে এই বাসভবনটি শম্ভুচন্দ্র শেঠ মহাশয় নির্মাণ করেন)। এই বাসভবনটিতেই শেঠ বংশের বর্তমান প্রজন্মের মানুষেরা বসবাস করেন । অন্নপূর্ণা দাসীর গর্ভেই একটি পুত্রসন্তান বিনষ্ট হয়, তিনিও অকালে ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে আশ্রয় নেন পরপারে ।
প্রথমা পত্নীর মৃত্যুর পর শম্ভুচন্দ্র শেঠ পুনরায় বিবাহ করেন । তার দ্বিতীয় পত্নীর নাম হল তারাসুন্দরী দাসী । কিন্তু সেই সুখও শম্ভুচন্দ্রের ভাগ্যে বেশিদিন স্থায়িত্ব লাভ করেনি । মাত্র ৭ বছর বয়সেই তাঁর দ্বিতীয় পত্নীর গর্ভে জন্ম নেওয়া শ্যামলাল শেঠ নামক একমাত্র পুত্র অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে । পুত্রশোকে ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার কিছুদিনের মধ্যেই তারাসুন্দরী দাসীও স্বর্গলাভ করেন । ব্যবসায়িক উন্নতির চরম শিখরে উঠলেও সাংসারিক জীবনে সুখ-শান্তি এতদিন পর্যন্ত সেরকম ভাবে পাননি শম্ভুচন্দ্র শেঠ । সেই সুখ শান্তি ও সাংসারিক আনন্দ লাভের আশায় চন্দননগরের বোড় অঞ্চলে বসবাসকারী জীবনচন্দ্র কুন্ডু মহাশয়ের কন্যা সূর্য্মণি ওরফে বিন্দুবাসিনী দাসীকে তৃতীয়বারের জন্য বিবাহ করেন । তৃতীয়বারে এসে সেই আশা তাঁর পূর্ণ হয়, সাংসারিক জীবন সার্থক হয়, সুখ-শান্তিতে ভরে ওঠে তার সংসার । বিন্দুবাসিনী দাসীর গর্ভেই জন্ম লাভ করে (জ্যেষ্ঠ থেকে কনিষ্ঠ) – রমণীবালা, সৌরভ দাসী, গিরীন্দ্রনাথ, ফুলকুমারি, অক্ষয়কুমার, নৃত্যগোপাল, অঘোরচন্দ্র, রাজেন্দ্রনাথ ও অবিনাশচন্দ্র নামক ছয় পুত্র ও তিন কন্যা ।
শম্ভুচন্দ্র শেঠ মহাশয় পড়াশোনা তথা বাংলা ভাষাও সেরকমভাবে জানতেন না । এমন কি লিখতে ও বিশেষ পারতেন না, কিন্তু নিজের চেষ্টায়, পরিশ্রমে ও কপাল গুণে বাংলার বুকে তৎকালীন সময়েই তিনি হয়ে ওঠেন লৌহ ব্যবসার এক পথিকৃৎ । তিনিও পিতার মত দানধ্যান করতেন,পূজা-পার্বণ করতেন । শুধু তাই নয় হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যকলাপে তাঁর ছিল অত্যন্ত আগ্রহ ও ভালোবাসা ।
পালপাড়াস্থিত নিজ বাড়িতে তৎকালীন সময় থেকেই তিনি দুর্গা, কালী, সরস্বতী পূজা চালু করেন । এমনকি দোল পূর্ণিমার দিন রাধা-কৃষ্ণের পূজাও করা হতো সেই বাড়িতে, পণ্ডিত শ্রী শিবেন্দ্রনারায়ণ শাস্ত্রী মহাশয় এমনই মনে করেছেন । নিজ ভবনে শুধু পূজা-অর্চনাই নয়, বিশেষ পূজা উপলক্ষে সেই ভবনে কাঙ্গালীভোজেরও আয়োজন করতেন তিনি । সাথে থাকতো দরিদ্র নরনারায়ণ সেবা ও অর্থাদি দান । তার সরলতা, সাধুতা ও সর্বদা যথাসম্ভব সত্য কথা বলা প্রভৃতি গুণের জন্য তিনি তৎকালীন শহরে ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের কাছে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী হন । এহেন ঘটনাবহুল ব্যক্তিত্ব তাঁর পুত্র-কন্যাগণকে রেখে মাত্র ৭৫ বছর বয়সে সারা জীবনের উপার্জিত ধনরাশি, সম্পত্তি, বিশাল ব্যবসার মায়া এবং সর্বোপরি সংসারের মায়া ত্যাগ করে আশ্রয় নেন মৃত্যুর দেশে ।
তথ্যসূত্র :
→ পণ্ডিত শ্রী শিবেন্দ্রনারায়ণ শাস্ত্রী মহাশয়ের লেখা “বাংলার পারিবারিক ইতিহাস” ।
→ স্বর্গত হরিহর শেঠ মহাশয়ের শ্রাদ্ধবাসরে তাঁর পুত্র-কন্যা দ্বারা প্রকাশিত “পরমপূজ্য পিতৃদেবের উদ্দেশ্যে অন্তরের গভীরতম ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিবেদন” নামক বংশ পরিচয় সম্বলিত পত্রিকা ।
→ হরিহর শেঠ মহাশয়ের বর্তমান প্রজন্ম গৌতম শেঠ মহাশয়ের সাথে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাবলী ।
→ “জানা-অজানা চন্দননগর ” শীর্ষক তথ্যচিত্র ।
***************************************