স্বপ্ন ফেরি
সুজয় দত্ত
নিঃশ্বাস ফেলার সময়টুকুও নেই তার। একদঙ্গল খুদে খুদে শরীর ঘিরে ধরেছে তাকে। তার হাতের লম্বা লাঠির আগায় আড়াআড়ি লাগানো কতকগুলো ছোট লাঠি। আর তা-থেকে ঝুলছে রংবেরঙের ঐশ্বর্য। হাওয়াভরা হালকা শরীরে দুলছে এদিক ওদিক। সেইসব ঐশ্বর্যের দাবীদাররা ঊর্ধ্ববাহু হয়ে অধৈর্য বায়না করছে পাশে দাঁড়ানো অভিভাবকদের কাছে,আর সে একের পর এক ফরমায়েশমতো যোগান দিয়ে যাচ্ছে। একটু আগে যখন সে তার পসরা নিয়ে হেঁটে হেঁটে এদিকে আসছিল,হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো তার পিছু ধাওয়া করেছিল খুদের দল। এখন মাঠের একধারে ওকে পাকড়াও করে নিজেদের স্বপ্নপূরণে ব্যস্ত ওরা।
স্বপ্নই তো। স্বপ্ন যেমন হঠাৎ জেগে উঠলেই শূন্যে মিলিয়ে যায়,আর তার নাগাল পাওয়া যায় না,এখানেও মাঝে মাঝে হচ্ছে সেটা। সদ্য-ফোলানো তেজী গ্যাসবেলুন কচি কচি হাতের মুঠো বা আঙুলের প্যাঁচ থেকে হঠাৎ মুক্ত হয়ে চোখের পলকে মিলিয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যের আকাশে। আর এমন মহামূল্য সম্পদ আচমকা হারিয়ে ফেলার দুঃখ কচিগলার কান্না হয়ে বেরিয়ে আসছে। আরেকটা শব্দও শোনা যাচ্ছে থেকে থেকেই। দুম ফটাস। কারো হাতের বেলুনে হয়তো কারো নখের খোঁচা লেগে গেল, কিংবা কনুইয়ের ধাক্কা। এতো ভীড়ে তো ওরকম হবেই একটু আধটু। ভীড়ের কারণটা মাঠের ঠিক মাঝখানে স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার সারা গা টুনি-বাল্বে মোড়া,মাঠের চারধারে প্রতিটি গাছ আর ল্যাম্পপোস্টে রংবেরঙের নিয়ন আলোর জ্যামিতি। একটু পরেপরেই চারপাশের সমস্ত কোলাহলকে ছাপিয়ে মন্দ্রস্বরে বেজে উঠছে ঢাক। তার ফাঁকে ফাঁকে অনর্গল চলেছে লাউড স্পীকারে নানারকম ঘোষণা। ঘোষকেরা বোধহয় বছরভর মাইক হাতে না পাওয়ার অভাববোধ এক সন্ধ্যেতেই মিটিয়ে নিতে চায়। তা নিক। আজ সবার সাত খুন মাফ। আজ যে পুজোর প্রথম রাত। মহাষষ্ঠী।
শহরতলীর একপ্রান্তের এই একফালি সবুজ মাঠের পোশাকি নাম গুরুদাস স্মৃতি পার্ক। সেখানে কাদাপাড়া সবুজ সংঘের এই সর্বজনীন দুর্গোৎসব বহু বছরের পুরোনো। মিলনই তো এই পুজোয় বেলুন বেচছে আজ ছ-সাত বছর হল। তারও অনেক আগে ছোটবেলায় আসত দাদার হাত ধরে,বাবার পিছু পিছু। বাবা এই মাঠের এককোণে মুড়ি-তেলেভাজার দোকান দিত পুজোর কদিন। গরমাগরম ফুলুরি-বেগুনী-আলুর চপ আর চাটমশলা মাখানো মুড়ি। বাবা-দাদা চার হাতে সাপ্লাই করে কুলিয়ে উঠতে পারতো না,ওকেও অনভিজ্ঞ হাতে ঠোঙা ভরতে হত। ভাল্লাগতো না মহোৎসবের সন্ধ্যেগুলোয় সেই গুমোট দোকানে আটকা পড়ে থাকতে। মাঝেমাঝেই বাবার কাছে বায়না করে চারআনা-আটআনা চেয়ে নিয়ে ছুটে যেত মাঠের উল্টোদিকে–ফুচকাঅলা,বুড়ির চুলঅলা আর বেলুনঅলার কাছে।
দুদশক পেরিয়ে গেছে তারপর। আজ সে নিজেই বেলুনঅলা। না হয়ে উপায় ছিলনা। বছর দশেক আগে চিংড়িঘাটার মোড়ে আনমনে রাস্তা পার হতে গিয়ে বাবার রোগাপটকা শরীরটা যখন বাসের চাকায় দুমফটাস হয়ে গেল,তিনটে প্রাণীর খেয়েপরে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তাদের মুখরোচক স্ট্রীট ফুডের পারিবারিক ব্যবসাটা এসে পড়ল দাদার ঘাড়ে। এতবছর বাবার পাশে হাতনুরকুর থেকে দাদা তালিম ভালই পেয়েছিল এ-কাজের,কিন্তু ইচ্ছেটা ওর কোনোদিনই ছিলনা। তার ওপর বন্ধুভাগ্য খারাপ। পড়ল গিয়ে অসৎসঙ্গে,উচ্ছন্নে গেল বখাটে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। তিন বছরের মধ্যে তেলেভাজার দোকান তো লাটে উঠলই,চাকরি-ব্যবসার খোয়াব সব চুলোয় গেল। কাদাপাড়ার গলির গলি তস্য গলির মধ্যে একটা পলেস্তারা-খসা পুরোনো বাড়ীর একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকত ওরা,ভাড়া না দিতে পেরে সেখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে উঠল এসে গাঙ্গুলীবাগানের বস্তিতে। সুতরাং ওই বস্তিরই ছেলে নান্টু-সান্টু আর ছোটকা যখন বেলুন ফেরির ব্যবসায় ঢুকল,মিলনও জুটে গিয়েছিল সঙ্গে। স্রেফ পেটের দায়ে। অবিশ্যি জুটব বললেই তো আর জোটা যায়না–মূলধন চাই,খানিক তালিমও লাগে। তাছাড়া জানাশোনা না থাকলে গ্যাসবেলুনে ভরার গ্যাসের সিলিন্ডার পেতে প্রচুর ঝামেলা। ভাগ্যিস নান্টু-সান্টুর বাবা-কাকারও এটাই রুজিরোজগারের রাস্তা, তাই শেষের দুটোয় তেমন অসুবিধে হয়নি ওদের। আর মূলধন এসেছিল ওর মায়ের শেষ দুগাছা সোনাবাঁধানো চুড়ির বিনিময়ে।
এসব এখন ইতিহাস। মাঝে মাঝে স্মৃতি হাতড়ালে বুকের গভীর থেকে এক-আধটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে ঠিকই। কিন্তু বেলুন নিয়ে রাস্তায় বেরোলেই যে মুহূর্তে ওর নজর পড়ে মায়ের কোল থেকে তার হাতে-ঝোলানো রত্নসম্ভারের দিকে প্রলুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা বাচ্চা ছেলেটার চকচকে চোখদুটোর ওপর,বা বাবার হাত ধরে গুটিগুটি এগিয়ে আসা গোলাপী ফ্রকের ফুটফুটে মেয়েটার বাড়িয়ে দেওয়া উৎসুক আঙুলের দিকে,ও ভুলে যায় অতীতের কথা। ক্ষণিকের জন্য নিজেকে মনে হয় রাজাবাদশা–অফুরন্ত ভান্ডার থেকে খুশী বিলোচ্ছে দেদার। সে-খুশীর কত রকমারি চেহারা,রামধনুর সাত রঙ তার গায়ে। গোল আপেলবেলুন,লম্বা কাঠিবেলুন,প্যাঁচানো সাপবেলুন,ঢাউস হাতিবেলুন,বাঁশিলাগানো বেলুন–কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবে তার পুঁচকে খদ্দেররা? আজ পুজোর রাতে দাম একটু চড়িয়ে নেওয়াটাই দস্তুর। তবু পাশেই গরম কড়াই পেতে বসা ছোলাবাদামঅলার একরত্তি ছেলেটা একহাতে ঢোলা প্যান্ট সামলে অন্যহাতের আঙুল চুষতে চুষতে ওর দিকে করুণভাবে তাকিয়ে আছে দেখে তার আঙুলে একটা গ্যাসবেলুন এমনিই জড়িয়ে দিল ও। বিনিময়ে যে টোলখাওয়া গালের আকর্ণ হাসিটা পেল, সেটা কোনো শাহেনশা কোনো কোহিনূরেই কিনতে পারবেনা। কে বলেছে সবকিছুর টাকায় দাম হয়?
আজকাল চতুর্থী-পঞ্চমীর দিন থেকেই লোকের প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে আনাগোনা শুরু। ষষ্ঠীর সন্ধ্যেকে যেন মনে হচ্ছে অষ্টমীর রাত। ভীড়টা ক্রমশঃ বাড়ছে। আরেঃ,প্যান্ডেলের পিছনে ওটা আবার কী? ফুলঝুরির মতো আগুনের ফুলকি যে। একবার,দুবার,তিনবার। মাঠের যে-কোণে ও বেলুন বিক্রি করছে সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা গেল। বাজি পোড়াচ্ছে নাকি কেউ? লোকের আজকাল কালীপুজো অবধি তর সয়না বুঝি? ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে খদ্দেরদের দিকে মন দেয় ও।
আচমকা লাউডস্পীকারের আওয়াজ,ঢাকের বাদ্যি,জনতার কলরব ছাড়িয়ে প্যান্ডেলের ভেতর থেকে চীৎকার উঠল, “আগুন! আগুন!! আগুন!!!” চমকে তাকিয়ে মিলন দেখল ফুলঝুরির ফুলকি নয়,প্যান্ডেলের পিছনে এখন স্পষ্ট লাল আভা। মুহূর্তে মাঠের ঠাসাঠাসি ভীড়টা চঞ্চল হয়ে উঠল,সবাই প্রাণপণে পৌঁছতে চায় মাঠের চারধারে রেলিংয়ে যে দুটোমাত্র গেট আছে তাদের কাছে। হুড়োহুড়ি,ঠেলাঠেলি,ধাক্কাধাক্কিতে ছিটকে গেল ওর গ্যাস সিলিন্ডার,বাদামঅলার কড়াই। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরতেই বাদামঅলা চারপাশে কোথাও ওর ছেলেটাকে দেখতে না পেয়ে তার নাম ধরে অসহায় চিৎকার করতে লাগল। ধাঁ করে মনে পড়ল মিলনের–বাচ্চাটা ওর দেওয়া বেলুন হাতে লাফাতে লাফাতে প্যান্ডেলের দিকেই তো গিয়েছিল। বেলুন-টেলুন রেখে বর্ষায় ফেঁপে ওঠা নদীর স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতরাবার মতো ধাবমান জনস্রোত ঠেলে প্যান্ডেলের দিকে এগিয়ে যায় ও। আগুন তখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা প্যান্ডেলে। শুধু ঢোকার মুখটুকু ছাড়া। ঢুকে দেখে তখনও সেখানে আটক কিছু মানুষ। আতঙ্কে দিশাহারা। দুহাতে তাদের টেনে টেনে যতজনকে সম্ভব জ্বলন্ত প্যান্ডেলের বাইরে চালান করতে থাকে ও আর অন্য কিছু যুবক। ঠিক এই সময়েই মণ্ডপের ভেতরের ছাদের বাঁশের কাঠামোয় আগুন লেগে যাওয়ায় উঁচু চুড়োর ভার আর নিতে পারল না। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল।
সেদিন ভোররাতে পূর্ব-বেলেঘাটার বিধানচন্দ্র মেমোরিয়াল হাসপাতালেের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে একটা আধপোড়া,কোমায় চলে যাওয়া শরীর লড়ছিল। আর কেউ দেখতে পায়নি,কিন্তু সেই ঘরের ভেতর ওড়াউড়ি করছিল একরাশ রামধনু-রং বেলুন। উড়তে উড়তে তারা একে একে খোলা জানলা দিয়ে ভোরের সদ্য-ওঠা সূর্যের পানে হারিয়ে যাচ্ছিল।
*****************************************
সুজয় দত্ত বর্তমানে আমেরিকার ওহায়ো রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানতত্ত্বের (statistics) অধ্যাপক। তিনি কলকাতার বরানগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ছাত্র। তরুণ বয়স থেকেই সাহিত্য তাঁর সৃজনশীলতার মূল প্রকাশমাধ্যম,সাহিত্য তাঁর মনের আরাম। ছোটগল্প, বড় গল্প, প্রবন্ধ ও রম্যরচনার পাশাপাশি নিয়মিত কবিতাও লেখেন তিনি। এছাড়া করেছেন বহু অনুবাদ–হিন্দি থেকে বাংলায় এবং বাংলা থেকে ইংরেজিতে। তিনি হিউস্টনের “প্রবাস বন্ধু” ও সিনসিনাটির “দুকুল” পত্রিকার সম্পাদনা ও সহসম্পাদনার কাজও করেছেন। এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত ‘বাতায়ন’ পত্রিকাটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এই পত্রিকাগুলি ছাড়াও ‘অপার বাংলা’ ও ‘গল্পপাঠ’ নামক ওয়েব ম্যাগাজিন দুটিতে,নিউজার্সির ‘আনন্দলিপি’ ও ‘অভিব্যক্তি’ পত্রিকা দুটিতে,কানাডা থেকে প্রকাশিত ‘ধাবমান’ পত্রিকায়,ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত পূজাসংকলন ‘মা তোর মুখের বাণী’ তে,ভারতের মুম্বাই থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা পরবাসে’ রয়েছে তাঁর লেখা। কলকাতার প্রসিদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজসেবী সংস্থা ‘পোয়েট্স ফাউন্ডেশন’-এর তিনি অন্যতম সদস্য। সম্প্রতি নিউ জার্সির “আনন্দ মন্দির” তাঁকে “গায়ত্রী গামার্স স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কারে” সম্মানিত করেছে। সাহিত্যরচনা ছাড়া অন্যান্য নেশা বই পড়া, দেশবিদেশের যন্ত্রসঙ্গীত শোনা এবং কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র বাজানো।
মর্মস্পর্শী দরদী এক কাহিনী ❤️