Shadow

দুই এক্কে দুই – সুজয় দত্ত

PC: Women News

দুই এক্কে দুই

সুজয় দত্ত 

(১)  রঙ্গন

জানলাটা বন্ধ হয়না ভাল করে। শীতের পড়ন্ত বিকেলের হিমেল হাওয়া হুহু করে ঢুকছে তার ফাঁক দিয়ে। ট্রেনের গতির সঙ্গে তাল রেখে। পরের স্টেশন আসতে এখনো খানিকটা দেরী। আমার মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এল,”ঠান্ডা লেগে যাবে। সরে এসো এদিকে।” 
তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলাম না ওর। একরাশ ফিনফিনে কোঁকড়া চুল হাওয়ায় উড়ছে এলোমেলো। মুখ আলতো ছোঁয়ানো জানলার কাঁচ।  উষ্ণ নিঃশ্বাসে মাঝেমাঝেই ঝাপসা হয়ে উঠছে সে-কাঁচ। খানিক পরে মুখ ফিরিয়ে আস্তে আস্তে বলল, “জ্বর এলে রাত জেগে জলপটি দিতে হবে,তাই তো?” 
আমার মাথা নীচু,চোখ কামরার মেঝেতে। মনের ক্যালেন্ডারে ফুটে উঠছে একটা তারিখ। ১১ই মে। চার বছর আগের। শেষ যখন ওর শিয়রে বসে তপ্ত কপালে হাত ছুঁইয়েছিলাম–জলপটি দিতে। আগের দিন কালবৈশাখীর হঠাৎ হওয়া বৃষ্টিতে ছাতাহীন বাড়ী ফিরেছিল। বৃষ্টি হলেই কেমন যেন কিশোরীর চাঞ্চল্য পেয়ে বসত ওকে। জ্বর এল সে-রাতেই। তারপর সারাদিন দেহের উত্তাপ উঠল নামল। ঠিক যেমন করে শরীরে উত্তাপের ওঠানামা চলেছিল আরো কিছু বছর আগে এক উৎসবমুখর ১১ই মে-র রাতে। সারারাত ধরে পরস্পরকে চিনেছিল দুটো শরীর। সেই প্রথমবার। বন্ধ সে-ঘরের দেওয়ালে মেঝেতে টেবিলে খাটে সেদিন ছড়ানো ছিল সামাজিক স্বীকৃতির নানা সুদৃশ্য সুগন্ধী ছাড়পত্র। হায়,সময়ের নিষ্ঠুর জাদুদন্ডে কত মায়াকানন যে মরুভূমি হযে যায়। আজ এতবছর পর এভাবে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া–তার ওপরেও কি আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল? দূরপাল্লার ট্রেনে মাঝপথে উঠে দেখি ফার্স্টক্লাস রিজার্ভড কামরায় জানলার ধরে আমার সামনের সীটে ও। ওর চাহনিতে প্রথমে ছিল চমক,তারপর অস্বস্তি,শেষে জোর করে মুখোশের মতো পরে থাকা একটা নির্লিপ্ততা। এইভাবেই কেটে গেছে কয়েক ঘন্টা–যেন কয়েকটা যুগ। 
মেঝে থেকে চোখ তুলতেই দেখি ও চোখাচোখি এড়াবার জন্য মুখ ঘুরিয়ে নিল। তার মানে এতক্ষণ তাকিয়েছিল আমার দিকে? কী ভাবছিল? সেই মধুচন্দ্রিমায় শিমলা যাওয়ার ট্রেনজার্নির কথা? স্টেশনে থেমেছে গাড়ী,গরম পানীয়ের সন্ধানে আমি প্লাটফর্মে আর ওর উৎসুক,উদ্বিগ্ন চোখ জানলা দিয়ে খুঁজছে আমায়? নাকি সেই বিষণ্ণ সন্ধ্যেগুলোর কথা যখন ক্রমশঃ তীব্রতর হতে থাকা মাইগ্রেনের ব্যথায় আমি ঠিক এইরকমভাবে মাটির দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম আর ও আমার মাথায় প্রাণপণে হাত বুলিয়ে ব্যর্থ চেষ্টা করত আরাম দেবার? নাকি ক’বছর আগের আমার সেই প্রশ্ন কঠিন মুখ–নির্মম কৈফিয়ত চাইছি কেন সে গোপন করেছে তার অতীত  ভালবাসা আমার কাছে ?    
গাড়ীর গতি কমে আসছে। স্টেশন আসার সময় হয়ে গেল বোধহয়। ঈষৎ চাঞ্চল্য চারপাশের যাত্রীদের মধ্যে। গুছিয়ে গাছিয়ে নামার প্রস্তুতি। ও-ও কি নামবে? কেন জানিনা ওকে আর জিজ্ঞেস করে উঠতে পারিনি কোথায় যাচ্ছে। তেমন কোনো তৎপরতা অবশ্য দেখছিনা ওর মধ্যে,সেই একইভাবে জানলার বাইরে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে আছে। এবার কারশেড দেখা যাচ্ছে জানলা দিয়ে, ইতস্ততঃ ছড়িয়ে থাকা ফাঁকা ওয়াগন আর অচল ইঞ্জিন,স্টেশন রোডের বাজারের ব্যস্ততা,সাইকেল রিক্সার হর্ন,লাইনম্যানের কেবিন। ধূসর প্লাটফর্মটা মাটি থেকে হঠাৎ গজিয়ে উঠতেই উঠে দাঁড়াল ও। সীটের তলা থেকে চাকালাগানো পুলম্যানটা বার করে এক হাতে সামলে অন্য কাঁধে গলিয়ে নিল সঙ্গের ব্যাগটা। আমি নীরবে তাকিয়ে সেদিকে–কিছু বলবে কি ও? কিচ্ছু বলবে না? সহযাত্রীদের আগে বেরোতে দিয়ে তাদের পিছু পিছু কামরার দরজার দিকে এগোল ধীরপায়ে। একেবারে শেষ মুহূর্তে ফিরল আমার দিকে। অজানা প্রত্যাশায় স্তব্ধ আমার হৃদস্পন্দন। ঠোঁটদুটো নড়ে উঠল ওর–“সেই রঙ্গন গাছটায় এখনো ফুল হয়?” কি বলব এর  উত্তরে? সারারাত কথা বললেও কি উত্তর হবে এ-প্রশ্নের? ক্ষণিক তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম মেঝেতে। বেজে উঠল ট্রেনের বাঁশী। জীবনে কত প্রশ্নই তো এমন জবাবহীন রয়ে যায়।

———————————————–


(২) ভোজ


“কই রে কমলা,বাইরের ঘরটা ঝাঁট দেওয়া হল? এবার বারান্দায় আয়।”
“এই হল বলে,বৌদি। খাটের তলায় ঝুল জমেছে অনেক,ঝ্যাঁটা দিয়ে পোস্কার করতিছি।”
“দূর বাবা,এই সকালবেলা অফিসটাইমে তোকে ঝুল ঝাড়তে হবেনা,রান্নাঘরে একগাদা বাসন পড়ে আছে –“
“আসতিছি গো আসতিছি। আগে তোমার তয়-তরকারীগুলো কেইটে দিই,তুমি রান্না বসাও,তারপর বাসনে হাত দেবোখন।”
আশির দশকের মাঝামাঝি কলকাতার একপ্রান্তে মধ্যবিত্ত আবাসনে দুকামরার ছোট ফ্ল্যাট। রোজ সকালে ঘড়ি ধরে সোয়া ছটায় কাজে আসে কল্পনা। সেই শহীদ কলোনী বস্তি থেকে হাঁটতে হাঁটতে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা। যদি না শরীর খারাপ থাকে বা বৌদিদিমণির কাছে আগেভাগে ছুটি নেওয়া থাকে।  বৌদি মাঝেমাঝেই ওকে ‘কমলা’ বলে ডেকে ফেলেন। আসলে আগে এ-বাড়ীতে কমলার মা কাজ করত তো,তাই। 
“ওবাবা, এই অ্যাত্ত শিম? দাঁড়াও,কাটাপোনার আঁশটা আগে ছাইড়ে দিই,তুমি মাছটা ভেইজ্যে নাও। তারপর শিমে হাত দিতিছি। আজ কী করবে গো বৌদি? শিমবেগুন না শিম দিয়ে নিরিমিষ্যি ঝোল?”
“শিমবেগুন। তোর অত খবরে দরকার কী? কাটতে বসেছিল,কাট। আর হ্যাঁ,নলী বেগুনগুলো ডুমোডুমো করে কাটবি আজ, লম্বালম্বি নয়।” 
“না গো বৌদি,শিমবেগুন কত্তিছ করো,কিন্তু এই কচি কচি শিম দিয়ে শিম-সর্ষে যা হয় না–এক্কেরে ফাস্টোকেলাস। পোস্তবাটা দিয়ে শিম দিয়ে বড়ির ঝালও খুব জমে,কিন্তুক শিম-সর্ষের মতো না।”
“আঃ,এখন সকালবেলা তাড়াহুড়োর সময় ঐসব রান্নার ফিরিস্তি দিসনা তো! কাট,কাট,হাত চালিয়ে কাট।”
“কাটতিছি তো। না গো,শিম-সর্ষে মোট্টে শক্ত নয়,শিমগুলো গোটাগোটাই থাকবে,শুধু চিরে বিচিগুলো বার করি নিতি হবে। সর্ষেটা ভাললো করে বাটতি হবে কিন্তু,বড়ির ঝালের পোস্তর মতো অত্ত মিহি করে নয়,কিন্তুক বেশ পিষে পিষে। আর এসব রান্নায় তোমাদের ওই রেপছি তেল,শাপলা তেল একদম দিওনি গো বৌদি,শুদ্ধ সস্যের তেল –“
“ধ্যাৎ,শাপলা তেল আবার কী? স্যাফোলা,স্যাফোলা। নাঃ,তুই যা গল্প জুড়েছিস,দিলি আজ দাদাবাবুর অফিসের দেরী করিয়ে।”
“না না,কত্তিছি কত্তিছি। শিমে তো অত বেগুন লাগবেনি গো,চারখান সরিয়ে রেইক্যে দিই? বেগুনপোস্ত করবে।”
“উঁউঃ,বেগুনপোস্ত করবে না ইয়ে করবে। ছটায় উনুন ধরিয়ে সাড়ে আটটার মধ্যে অফিসের ভাত রেডি করতে হয়,আবার বেগুনপোস্ত? বকিস না তো উল্টোপাল্টা!”
“ওই দেক,তোমায় একা হাতে কত্তে বলতিছি নাকি? আমি বেগুন কেইটে দেব,পোস্ত বেইটে দেব। আচ্চা,দাদাবাবুকে বলতে পারোনি রোজ রোজ  নলিবেগুন না এনে বড় বড় ঠাসবেগুন আনতে? এই শীতের দিনে বেগুনপোড়া দিয়ে গরম গরম রুটি,সঙ্গে কুচো পিঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা–আঃ”
“এই তুই ওঠ তো ওখান থেকে ! যা রান্নাঘরে বাসন মাজগে যা। বাকি তরকারী আমি কেটে নিচ্ছি।”
“যাচ্ছি গো যাচ্ছি। এই আলুর খোসাগুলো ছাইড়ে দিয়ে যাই। তোমার হাত কেইটেছিল না কাল? এই গোল গোল নতুন আলুর কাশ্মীরী আলুদ্দম নুচি দিয়ে একদিন খাওয়াতে পারো তো দাদাবাবুকে ছোড়দাবাবুকে–ছুটির দিন দেকে। আমি বেলে দেব’খন। পাতে একটু খেজুরগুড় কি নলেন গুড় –“
বৌদি জোরে বকুনি দেওয়ার আগেই তাঁর এগারো-ক্লাসে-পড়া ছেলে নিজের বেডরুম-কাম-স্টাডিরুম থেকে জামা পরতে পরতে বোঁ করে বেরিয়ে এসে বলল,”চা-টা একটু ঘরে দিয়ে আসতে পার না কেউ? প্রতি মঙ্গলবার ট্যুইশনে লেট্ করে যাওয়া আর স্যারের বকুনি খাওয়া–ভাল্লাগে,বল? ওয়ান আদার থিং–ফর হেভেন্স সেক্ রোজ সক্কালবেলা থেকে তোমাদের এই চর্ব্য-চুষ্য-লেহ্য-পেয় রান্নার গল্প বন্ধ করবে? আই সিম্পলি কান্ট্ টলারেট ইট।”
“সেকি গো ছোড়দাবাবু,রান্নার গল্প ভাল লাগেনিকো তোমার? দুমুঠো খাওয়ার জন্যিই তো সব গো। দাঁড়াও,একদিন আমি তোমায় মশুর মামলেট করে খাওয়াব–“
“হোয়াট?”
“মশুর মামলেট গো,ওই যে পুরু করে ডিমের মামলেট করে তার ভাঁজে ভাঁজে মশুর কেটে কেটে দিতে হয়–ব্যাঙের ছাতা গো ব্যাঙের ছাতা। তারপরেতে সেই মামলেটের গায়ে এট্টু মাখন মাখিয়ে –“
“হোপলেস” বলে চা-ব্রেকফাস্ট হাতে নিয়ে বোঁ করে আবার নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল সে। খেয়েদেয়ে জামাজুতো পরে প্রায় ছুটেই বাস ধরতে বেরিয়ে গেল। দেখতে পেলনা যে,বাসন মাজা ঘর মোছা কাপড় কাচা শেষ করে বিদায় নেওয়ার আগে তার প্রতিদিনের বরাদ্দ বাসিরুটি-গুড়ের সঙ্গে একটা প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগও পেয়েছিল আজ কল্পনা তার বৌদির কাছ থেকে। তাতে ছিল কালকের বাসিগন্ধঅলা ডালমাখানো ভাত আর টকটক আলুচচ্চড়ি। বয়স কম,তাই এটাও জানা বাকী ছেলেটার যে,এই পৃথিবীর সব কল্পনারই ওই শিমবেগুন-শিমসর্ষে-বড়ির ঝাল-বেগুনপোস্ত-বেগুনপোড়া-আলুদ্দম-লুচি-নলেনগুড় আর মশুর মামলেট আসলে থাকে তাদের কল্পনায়। শুধুই কল্পনায়। সেখানেই সারাদিন পাত পড়ে ভুরিভোজের। 
****************************************

সুজয় দত্ত বর্তমানে আমেরিকার ওহায়ো রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানতত্ত্বের (statistics) অধ্যাপক। তিনি কলকাতার বরানগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ছাত্র। তরুণ বয়স থেকেই সাহিত্য তাঁর সৃজনশীলতার মূল প্রকাশমাধ্যম,সাহিত্য তাঁর মনের আরাম। ছোটগল্প,বড় গল্প, প্রবন্ধ ও রম্যরচনার পাশাপাশি নিয়মিত কবিতাও লেখেন তিনি। এছাড়া করেছেন বহু অনুবাদ–হিন্দি থেকে বাংলায় এবং বাংলা থেকে ইংরেজিতে। তিনি হিউস্টনের “প্রবাস বন্ধু” ও সিনসিনাটির “দুকুল” পত্রিকার সম্পাদনা ও সহসম্পাদনার কাজও করেছেন। এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত ‘বাতায়ন’ পত্রিকাটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এই পত্রিকাগুলি ছাড়াও ‘অপার বাংলা’ ও ‘গল্পপাঠ’ নামক ওয়েব ম্যাগাজিন দুটিতে,নিউজার্সির ‘আনন্দলিপি’ ও ‘অভিব্যক্তি’ পত্রিকা দুটিতে,কানাডা থেকে প্রকাশিত ‘ধাবমান’ পত্রিকায়,ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত পূজাসংকলন ‘মা তোর মুখের বাণী’ তে,ভারতের মুম্বাই থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা পরবাসে’ রয়েছে তাঁর লেখা। কলকাতার প্রসিদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজসেবী সংস্থা ‘পোয়েট্স ফাউন্ডেশন’-এর তিনি অন্যতম সদস্য। সম্প্রতি নিউ জার্সির “আনন্দ মন্দির” তাঁকে “গায়ত্রী  গামার্স স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কারে” সম্মানিত করেছে। সাহিত্যরচনা ছাড়া অন্যান্য নেশা বই পড়া, দেশবিদেশের যন্ত্রসঙ্গীত শোনা এবং কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র বাজানো।
 
    

                                                                              

1 Comment

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!