পৌষ পরব
শ্রাবণী দাশগুপ্ত
বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। অফিস-ফেরত ভাসুরের ঘরে ঢুকবে কি ঢুকবে না করে ,শেষ পর্যন্ত ঢুকল না স্বাগতা। পরমেশই এখন বাড়ির মাথা, জ্যেষ্ঠপুরুষ। তার চেয়ে বয়সে দু-যুগের বেশী সিনিয়র। শ্বশুরের মধ্যযৌবনের, শাশুড়ির কৈশোরের সন্তান। স্বাভাবিক নিয়মে তাঁরা কেউ আর ইহজগতে নেই।
দরজার মুখে দাঁড়িয়েছিল বড়-জা অসীমা, স্বাগতার মা-র চেয়ে মোটে বছর চারেকের ছোটো। প্রবীণ হলেও যথেষ্ট সবুজ মানুষ – স্বাগতা-নিখিলেশের বিয়েটা আদতে সম্বন্ধ-করা বিয়ে ছিল কিনা এ সন্দেহ তার আজও ঘোচেনি। মাঝে-মধ্যেই ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে বসে,“বাচ্চু মিথ্যে বলেছিল তখন, তাই না রে?”
স্বাগতা-নিখিলেশের ভার্সিটি-প্রেম, বছরদুই সিনিয়ার ছিল নিখিলেশ। ভালোমানুষ ছেলে কনভেন্ট-শিক্ষিত, কটাচোখ, মাখনের মতো রঙ, ঝকঝকে মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু। চাকরি পাওয়ার পর স্বাগতা রাজি হল, স্বাগতার উদার মা-বাবা সম্মতি দিলেন, কিন্তু ওদিকে—! স্বাগতা বলেছিল,“আমিই বরং তোমাদের বাড়িতে গিয়ে একদিন—!”
“ওরে বাবা না না!”
আতঙ্কে গলা ধরে গিয়েছিল নিখিলেশের। মাথার ওপর বাবা-মা,তিন রাশভারী দাদা, দুই রাশভারী দিদি। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেয় এরা সব পিঠোপিঠি। সে-ই এত পরে—অনাহূত,অকালে আগত! ভাবতে গিয়ে মনে মনে জিভ কেটেছিল নিখিলেশ। অগত্যা গড়িয়াহাটের এক বসু পরিবার থেকে অভিভাবকেরা শুভদিন দেখে রাজা মণীন্দ্র স্ট্রিটের এক মিত্র পরিবারে বিনম্রভাবে কন্যার বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তারপর গত তেত্রিশ বছরে মা-র সমস্ত আশঙ্কা ধূলিসাৎ করে স্বাগতা সাফল্যের সঙ্গে ছোটবউয়ের ভূমিকা পালন করেছে। যতটা মেনেছে,বাকিদের মানিয়েছে তার চেয়ে বেশী। আপাতত অবস্থা সঙ্গীন। মাস তিন আগে অফিস থেকে বেরিয়ে সবে ক্যাব ধরে উঠে বসেছে স্বাগতা,সঞ্চয়নের ফোন।
“মা শোনো। খুব আর্জেন্ট।”
“বল।”
“আমি আর নাদিরা জানুয়ারিতে ইণ্ডিয়া যাচ্ছি!”
“কী!?”
“আঁতকে উঠলে? বাঃ! কোনও মা ছেলে যাচ্ছে শুনলে আঁতকে ওঠে,জীবনে কেউ শোনে নি।”
“ছেলের কীর্তিকলাপ যদি আঁতকে ওঠার মতো হয় তো কী করব বল?”
“তোমার কথামতো বিয়ে তো করেছি, রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। সার্টিফিকেট সঙ্গে থাকবে, দেখে নিয়ো।”
“তাতে কী? এরপর যে বিধ্বংসী আয়লা না উম্ফুন আসবে, সামলাবে কে?”
“সে তোমাদের ব্যাপার। তিনবছর তোমাদের দেখি নি মা—!”
“তোকে অতদূরে যেতে বলেছিল কেউ?”
বলে দেখে,ছেলে ফোন কেটে দিয়েছে। স্বাগতা ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইল। গতবছর যখন নাদিরার কথা প্রথম জেনেছিল স্বাগতা, চমকে উঠেছিল। একেবারেই সাধারণভাবে সঞ্চয়ন জানিয়েছিল,তারা লিভ-ইন করছে। ইণ্ডিয়া যাওয়ার সময়ে দু-জনে একসাথে যাবে কারণ নাদিরা তাই চায়। স্বাগতা রেগে গিয়েছিল,
“বিয়ে-থা না করে এদেশে ঢুকলে যেখানে ইচ্ছে থাকো,বাড়িতে এসো না। ঠ্যাঙ ভেঙে রেখে দেব।”
“তথাস্তু মা জননী!”
হেসেছিল সঞ্চয়ন। মাকে সে খুব ভালো করে চেনে।
অসীমাকে জাপটে ধরে নিজের ঘরে নিয়ে যায় স্বাগতা,
“ও বড়দিদি,সিরিয়াস কথা আছে। একটা রিসেপশনের যোগাড়যন্তর করতে হবে।”
“রিসেপশন? কিসের রে?”
“বিয়ের,না মানে বৌভাতের!”
“পোষমাসে বিয়ে? এরকম অলুক্ষুণে নিয়ম কোন বাড়িতে?”
“এই আমাদের বাড়িতে—,শিরে সংক্রান্তি গো বড়দিদি!”
“বিয়ে এই বাড়িতে? কার?”
“সানির গো! একা আসছে না এবারে,বউ আসছে সঙ্গে।”
“ও-মা গো জানা নেই চেনা নেই,ওইটুকু ছেলে আমাদের,বিয়ে করে ফেলল?”
“ওইটুকু নয় গো বড়দিদি,তারও ডিসেম্বরে তিরিশ হল!”
“তা আসবে কবে?”
ক্রমে মেয়েমহলে ছড়াল খবরটা। ছোটোকাকিমার চেলী বাড়ির বউ-ঝিরা রোজই ‘ভিড় আসে রোজ সন্ধের পর সে অফিস থেকে ফিরলে। প্রশ্ন,কৌতূহল,শলা-পরামর্শ।
“ওকী কাণ্ড ছোট্কাকী! শেষে সানি! ভ্যাবলাকান্ত প্রচণ্ড জিদ্দি ছেলেটা! এবার কী হবে গো?”
ঘরের কোণে মুখ শুকিয়ে বসে-থাকা সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সবার প্রিয় ছোটকার দিকে তাকিয়ে তাদের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। ছোটকার বিয়ে তাদের ইন্সপিরেশন,সে পথে সাহস করে হেঁটেছে এবাড়ির আরও দু-টি ছেলেমেয়ে। নেহাৎ সেখানেও বর্ণে-গন্ধে মিল ছিল। তাই ত্যাজ্যপুত্র,ত্যাজ্যকন্যা হতে হতে বেঁচে গিয়েছে। তা বলে সানি এমন একটা কাণ্ড—! সানি বাড়ির কৌস্তুভ মণি! পাঁচবছর আগে যখন চাকরি নিয়ে নাইজেরিয়া গেল,বড়জ্যেঠু খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
“ওরে সানু রে, কেন তুই—!”
প্রায় ডুকরে-ওঠা বড়জা-র মুখ চেপে ধরে স্বাগতা,
“চুপ চুপ বড়দিদি,পরে কেঁদো। এখন ম্যানেজ করবে কী করে তাই ভাবো।”
“ক-দিন থাকবে রে?”
“এইতো পৌষ সংক্রান্তির দুদিন আগে আসবে,দিনদশেক থাকবে। তারপরের দিনদশেক নাকি হনিমুন–ইণ্ডিয়ার কোথায় কোথায় ঘুরবে। এই তো বলল।”
“তা বিয়ের রিসেপশন বললি,সেটা কবে দিবি? পোষমাসেই?”
“মাঘে ডেট নেই? দ্যাখো না একটু– পয়লা,দোসরা,কোনও একটা দিন।”
“ততদিন থাকছে কই? হনিমুন না কী ছাইপাঁশ বলছিস যে!”
“পৌষ সংক্রান্তির দিনে—আচ্ছা রিসেপশন তো যে কোনও সময়েই—?”
“ওঃ ছোট্মামী!”
খুকখুক করে হাসে ছোটো ননদের পুত্রবধূ। অবস্থা সত্যিই ঘেঁটে ঘ।
কলকাতা এয়ারপোর্টের বাইরে জনসমাগম দেখে সঞ্চয়ন উচ্ছ্বসিত। নতুন মেয়েটি অবাক। দু-খানা গাড়ি এসেছে বাড়ি থেকে। তিন জ্যেঠু, পিসিরা ও বড়জ্যেঠি ছাড়া সকলেই হাজির। স্বাগতার বুকের মধ্যে নানা রঙের ঢেউ খেলছে। দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে জাপটে ধরার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে গিলে ফেলে। তামাটে রঙের সানির পাশে দীর্ঘাঙ্গীর গাঢ় শ্যামবর্ণ ত্বকে রোদ ঝলসাচ্ছে। অসীমা বরণডালা নিয়ে আসতে বলেছিল,সে ধানদুব্বোটুকু নিয়ে এসেছে। আড়চোখে লক্ষ করে ছেলে তার উপদেশ মেনে দিল্লী নেমে বউকে চুড়িদার কিনে পরিয়েছে। মেয়েটা ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকেছে সুন্দর করে। বেশ দেখাচ্ছে মসৃণ চওড়া কপাল,কোঁকড়া চুলের বউমাকে। ভারী মিষ্টি হাসি। এগিয়ে গিয়ে সে ধানদুব্বো ঠেকাল দুজনের মাথায়,একসঙ্গে জড়িয়ে ধরল দুজনকে। নাদিরা তার গালে চুমু দিল,সেও দিল বউমার গালে। সোনা-বাঁধানো লোহাখানা ছেলের হাতে ধরিয়ে বলল,
“পরিয়ে দে।”
পৌষ সংক্রান্তিতে জমজমাট আয়োজন। স্ত্রী-আচার,ভাত-কাপড় কায়দা করে বাদ দিয়েছে স্বাগতা। পৃথিবীর অন্যপ্রান্ত থেকে আসা সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মেয়ের ওপর কোনও নিয়ম চাপিয়ে দিতে চায়নি। নেমতন্ন করে জনে-জনে বলেছে,
“এটা কিন্তু পিঠে-পায়েসের নেমন্তন্ন। অবশ্যই এসো।”
আত্মীয়-পরিজন অনেকে কানাঘুষো শুনেছে সঞ্চয়নের বিয়ের খবর। কৌতূহল নিয়ে এসেছে প্রায় সবাই। এমন নিয়মভাঙা বধূ-পরিচয় এবাড়িতে প্রথম। নাদিরা বাংলা একেবারেই বোঝে না,বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাচ্ছে আয়োজন দেখে। তাদের মহাদেশ, জাতি, ধর্ম সমস্ত আলাদা। তার দেশে তার পরিবার তুলনামূলকভাবে অনেক আধুনিক,তবু সঞ্চয়নের সঙ্গে সম্পর্ক স্বীকার করে নেয়নি। দু-জনেই ভাবছে কাজ নিয়ে মার্কিন দেশে চলে যাবে।
স্বাগতাকে বড় ভালো লেগেছে, দু-চারবার ‘মম্’ বলে ডেকে কথাও বলেছে। ‘মম্’ তাকে অনেক গোল্ড জুয়েলারি উপহার দিয়েছে। স্বাগতা লক্ষ করেছে মেয়েটির মুখে বিষণ্ণতার আভাস। কিচ্ছু জানতে চায়নি, নিজের ডানা মেলে উষ্ণতাটুকু দিয়েছে তাকে, যাতে ক-দিন সহজ থাকতে পারে। পরিবারের বয়স্কদের বিরূপ মন্তব্যের ধারালো তির তাকে আর নিখিলেশকে আঘাত করেছে।
তবু অঢেল আয়োজন পিঠে-পুলি উৎসবের,সুগন্ধে ভরে উঠছে বাড়ি। পরের রাতে ধূমধাম নৈশভোজ।
শুধু সঞ্চয়নের বড়জ্যেঠু ঘর ছেড়ে বেরোন নি, দেখাই করতে চাননি। সঞ্চয়ন চেষ্টা করেছিল। বলেছেন,
“তোমরা নিজেদের মতো ভালো থেকো সানিবাবা। আমি তোমার সেই বয়সের স্মৃতি নিয়ে থাকি—যখন তুমি স্কুল যাওয়া শুরু করোনি। তোমার বাবা-মা দুজনে অফিস যেত আর তুমি আর আমি রিক্সো চেপে হেদোয় যেতাম বেড়াতে—। যেদিন নিজের মন থেকে সংস্কারের পাথর সরাতে পারব,সেদিন তোমাদের আশীর্বাদ করব। সেটা এজন্মে হবে কিনা তাও জানিনা।”
সঞ্চয়ন অনেক কষ্টে চোখের জল সামলে বেরিয়ে এসেছিল। স্বাগতা বলেছিল,
“দুঃখ পাসনা সানি,অনেক দুঃখে উনি বলছেন।”
“তবে কি আমার ভবিষ্যতে না আসাই উচিত মা?”
স্বাগতা ধীরে ধীরে বলে,
“না। তবে খুব সহজে কিছু বদলায় না সানি,বদলানোও যায় না। কোথাও না,কেউ না। তার জন্য ধৈর্য ধরে চেষ্টা করতে হয়। আসবে পরিবর্তন,অপেক্ষায় থাকো।”
****************************************
শ্রাবণী দাশগুপ্ত:
জন্ম ও শিক্ষা কলকাতায়। বিবাহ-পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন কলকাতার বাইরে কাটিয়ে বছরচারেক আগে কলকাতায় ফেরা। ভালোবেসে লেখালেখি। অনলাইনে ম্যাগাজিন এবং বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশিত। লেখালেখি নিয়ে তিনটি বই প্রকাশিত-দুটি ছোটো গল্প সঙ্কলন (বাইফোকাল,বিষমবাহু,) এবং একটি উপন্যাস (হাওয়ামোরগ)।