“রিংচিংটন,,,,,,,একটি ব্যক্তিগত অনুভব”
শ্রুতি দত্ত রায়
আশ্বিনের মাঝামাঝি যেই না ঢাকে কাঠি পড়ে আর আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়ায় “ড্যাড্ড্যানাকুড়” বোল,অমনি আপামর বাঙালির মন হু হু করে ওঠে। মনে হয়, বারমাসের রোজনামচার একঘেয়ে টানাপোড়েনের থেকে রেহাই নিয়ে লাগাম ছাড়া কটা দিন কাটিয়ে আসি,অন্য কোথাও,অন্য কোনখানে। তা সে পাহাড়,সমুদ্র,জঙ্গল,মরুভূমি কিংবা সুমেরু মহাদেশও হতে পারে।
বাঙালি হিসেবে আমি এবং আমার পরিবারও তার ব্যতিক্রম নই। কাজেই এবারও পুজোর রূপ-রস-গন্ধে প্রকৃতি যখন মাতোয়ারা হয়ে উঠল,আমাদের মনও দৈনন্দিন জীবনের রুটিন থেকে ছুটি নিতে চাইল। তবে এবারে বাধ সাধল ছেলের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং আমার কর্তার অফিসের ইমার্জেন্সী ডিউটি। তা বলে কি মনের ইচ্ছের পায়ে শেকল পড়িয়ে ঘরবন্দী থাকা যায়? কাজেই ঠিক হল একসাথে “রথ দেখা ও কলা বেচা” দুটোই করা যাক। চাকরির দায়িত্ব পালন হোক,সঙ্গে ঘোরাঘুরি। কর্তার পরামর্শ ছিল রিংচিংটন জল বিদ্যুৎ প্রকল্পে ভিসিট করা। কিন্তু এমন নাম আগে তেমন শুনিনি তো ! যেহেতু আমরা ডুয়ার্সবাসী,সেক্ষেত্রে বাঙালি হিসেবে আমরা কিঞ্চিত বেশি ভাগ্যবান। পাহাড়,জঙ্গল,উপত্যকা–সবকিছুই আমাদের বেশ হাতের নাগালে। কেবল সময়টুকু বের করে বেড়িয়ে পড়লেই হল। প্রকৃতি কখনও আমাদের সেখানে নিরাশ করে না। সে ভরসাতেই ঐ অখ্যাত স্থানটির অন্বেষণে যাব ভাবলাম।
সপ্তমীর সোনাঝরা সকালে রওনা দিলাম কার্শিয়াং-এর পথে। শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াং-এর পথ বহু চেনা,অনেক জানা। তবু যতবার যাই, প্রকৃতি যেন নতুন নতুন রূপে ধরা দেয়। এবারে অবশ্য এই শৈল শহরটিকে পেছনে ফেলে গাড়ি ধরল বাঁদিকের উৎরাই-এর একটি অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ পথ। কার্শিয়াং টুরিস্ট লজ ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে সে পথ সরাসরি ঢালু হয়ে নেমে গেছে এঁকে বেঁকে। জানতে পারলাম এখান থেকে আমাদের গন্তব্যের দূরত্ব প্রায় নয় কিলোমিটার। পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় আধঘন্টা বা কিছু বেশি সময়। এক দুই মিনিট চাকা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা যেন পৌঁছে গেলাম এক স্বর্গরাজ্যে। কি নেই সেখানে? মাথার ওপর আশ্চর্য রকম কোমল এক নীল আকাশ,আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজের নানান শেডের পাহাড়িয়া ঢেউ। সেই এলোপাথারি ঢেউ-এর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে উঁচু নীঁচু সর্পিল রাস্তা। তার একধারে সবুজ কার্পেটের মত বিছানো চা বাগিচা,আর অন্যদিকে সুদূর নভনীলিমার হাতছানিতে মাথা উঁচু করে থাকা পাইন গাছেদের সারি। প্রকৃতির উথাল পাথাল করা এমন সৌন্দর্য যে হাতের এত নাগালে আছে সেটা বোধহয় এখানে না এলে কোনদিন জানাই হত না। বার বার ড্রাইভার ভাইকে গাড়ি থামানোর আর্জি জানিয়ে তাই দুচোখ ভরে উপভোগ করতে লাগলাম সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলী। একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যও নজরে এল। এপথে কিছুদূর পরপরই আছে বাঁশ কিংবা লোহার জাফরি কাটা বসার বেঞ্চ। স্থানীয় জনজাতির লোকেরা পথিকের সুবিধের জন্য হয়তো বা এই আরামটুকুর ব্যবস্থা করে রেখেছেন। কারণ এই পথে একবার গেলে এপথের প্রেমে না পড়ে যে পারাই যাবে না। যাইহোক কর্তামশাই-এর কাজের জায়গা অর্থাৎ রিংচিংটন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অফিসে পৌঁছানোর তাড়ায় তাই আবার আমরা এগিয়ে চললাম।
যত এগোতে লাগলাম, দৃশ্যপট ক্রমাগত পাল্টে যেতে থাকল। পথে পড়ল ছবির মত সাজানো আমবুটিয়া ও সিঙ্গেল চা বাগান। আমাদের জন্য অজানা চমক আরো বাকি ছিল। আমরা জানতাম না নবরাত্রির সপ্তমী তিথিতে নেপালী জনজাতিরা পালন করে “ফুলপাতি” উৎসব। তাই সেদিন পাহাড় সেজেছিল উৎসবের রঙে। যেতে যেতে দেখতে পেলাম ঐতিহ্যমন্ডিত নেপালী পোশাক ও গয়না পরা সুসজ্জিত নারী পুরুষের। গ্রামের কোন কোন বাড়িতে আয়োজন করা হয়েছিল এই উৎসবের। সুনির্মল আকাশ, সবুজ বনানী, গলানো সোনার মত রোদের পরিপ্রেক্ষিতে,উজ্জ্বল হলুদ,লাল,মেরুণ রঙের পোশাকে হাসিখুশি পাহাড়ী মানুষগুলোর আনন্দ মাখা মুখগুলো আমাদের মনেও বুলিয়ে দিল খুশির রঙ। বাতাসে ভেসে আসছিল স্থানীয় পাহাড়িয়া সুরে বিভিন্ন বাজনার মাদকীয় মূর্ছনা। লহরীর পর লহরী তুলে সে বাঁশির সুর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল এক পাহাড় থেকে অন্য উপত্যকায়। পথের দুই ধারে ছিল নাম না জানা সবুজ ঝোপে ফুটে থাকা থোকা থোকা হলুদ ফুল। এ যেন এক রূপকথার দেশ।
এগিয়ে চলল গাড়ি,,,,ধীরে ধীরে গ্রাম ও সদ্য গজিয়ে ওঠা “হোম স্টে” গুলোকে পেছনে ফেলে। এবার রাস্তা যেন আরও সংকীর্ণ। পাকা রাস্তার মাঝে দেখা মিলল ঘাসের আস্তরণের। দুই ধারের ঝোপ,বাঁশের ঝাড় ও নাম না জানা পাহাড়ি গাছেরা নুয়ে পড়ে পথকে এবার ছায়া সুনিবিড় করে তুলল। বিজন,সরু,কিছুটা ভঙ্গুর পথ ধরে এগোতে লাগলাম। অবশেষে পৌঁছলাম প্রকল্পের অফিসে। গাড়ির চলমান ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চারিদিক থেকে আমাদের ঘিরে ধরল প্রকৃতির নিজস্ব সঙ্গীতের ধ্বনি,,,,, the music of mother earth। জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে আসা নাম না জানা পাখিদের কিচিরমিচির, না দেখা রিংচিংটন নদীর উপলমুখরতা, আর শীতল পাহাড়ি বাতাসের কোমল স্পর্শে মন একমুহূর্তে যেন সতেজ হয়ে উঠল। বৃত্তাকারে ঘিরে থাকা পাহাড়ের ঠিক মাঝখানে রিংচিংটন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অফিস,পাওয়ার হাউস ইত্যাদি। আওয়াজ ভেসে আসলেও তখনও পর্যন্ত আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না নদীর গতিপথ। পাওয়ার হাউসের কর্মীরা তাই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন মস্ত প্রাচীর ঘেরা প্রকল্প অফিসের পেছন দিকে। কারণ বিদ্যুৎ পর্ষদের কর্মীরা ছাড়া নিরাপত্তার নিরিখে এখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। জংলী ঝোপঝাড়ে ঢাকা পাথুরে ঢালু জমি ধরে আমরা নেমে এলাম আরও বেশ কিছুটা নীচু উপত্যকায়। এবার দেখা মিলল উচ্ছল হরিণীর মত ছুটে চলা চঞ্চল রিংচিংটন নদীর। সূর্যের আলো মেখে তারার মত ঝিকমিক করছে তার জলবিন্দুগুলি। এমন পাগল করা প্রকৃতির রূপে মানুষের মন দ্রব না হয়ে পারে কি? এক অলীক সুখে তাই ভরে উঠল আমাদের বুক। কি ভাবে যে কটা ঘন্টা কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। পাহাড়ের ঢালে আস্তে আস্তে সূর্য ঢলে পড়লে মনে পড়ল এবার আমাদের ফিরতে হবে ঘরে।
ফিরতি পথে মন এক অদ্ভূত উদাসীনতায় ভরে উঠল। প্রকৃতির এই সৌন্দর্যের বিশালতার কাছে অতি তুচ্ছ মনে হল জাগতিক সকল চাওয়া পাওয়া। সমগ্র মানবজাতি আজ উগ্র আধুনিকতা ও নাগরিকতার মোহে নির্দ্বিধায় ধ্বংস করছে প্রকৃতি। একবারও ভেবে দেখছে না সাময়িক আরামটুকুর ফলস্বরূপ গোটা বিশ্বকে তারা ঠেলে দিচ্ছে এক মারণ ব্যারামের দিকে। রিংচিংটনের কৌমার্য্যও হয়তো একদিন ধর্ষিত হবে মানুষের অতিরিক্ত চাহিদার কারণে। যতদিন তা না হয় ততদিন নীল পাহাড়ের হলুদ ফুলের ঝোপে উড়ে বেড়াক কমলা প্রজাপতির দল,সবুজ ঘাসের জমিতে রূপোর চুলের কাঁটার মত আঁকা থাক রিংচিংটন নদী আর আমাদের বুকে কুলুকুলু বয়ে যাক সোনালী স্মৃতির ঝরণা।
**************************************
শ্রুতি দত্ত রায় পরিচিতি:সুন্দরী ডুয়ার্সের মফস্বল শহর জলপাইগুড়িতে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। পেশায় সরকারি বিদ্যালয়ের ভাষা সাহিত্যের শিক্ষিকা। ভালবাসেন গান শুনতে,বই পড়তে,ডুয়ার্সের প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াতে। আর গান গাইবার মধ্যে খুঁজে পান মুক্তির স্বাদ।
Porlam ..besh valo laglo ..gach dhore chobigulo eijaygar e chilo taina???segulo khub sundor chilo…