Shadow

শঙ্করদার বিয়ে – চন্দ্র কান্তি দত্ত

PC .. Shutterstock

শঙ্করদার বিয়ে

চন্দ্র কান্তি দত্ত

আমাদের অফিসের শঙ্করদা একটা বর্ণময় চরিত্র। সুদর্শন,সুঠাম,অধিকাংশ সময় হাস্যময় রসিক এবং কখনো সখনো প্রয়োজনের তাগিদে অত্যন্ত কঠোর। অর্থাৎ কোমলে,কঠোরে চোখে পড়ার মত একজন মানুষ। সাধারণতঃ প্রফুল্ল মনেই থাকতেন। শঙ্করদা হৃষ্টচিত্তে আছেন কিনা বোঝা যেত তাঁর কথাবার্তায়। তখন প্রায় সব কথাতেই তাঁর ভব্য রসিকতা প্রকাশ পেত।
অফিসের দৈনন্দিন স্টেশনারির দায়িত্ব সামলাতেন শঙ্করদা। একদিন দেখলাম আমার পেনসিল কার্বন পেপারগুলো আর ব্যবহারযোগ্য নেই। আমি শঙ্করদাকে বললাম,”শঙ্করদা,আমার এক বাক্স কার্বন দরকার।”
শঙ্করদা নিজের কাজ করতে করতে গম্ভীর মুখে বললেন,”এটা অফিস। তুমি চাইলেও আমি কারো বোনকে ডাকতে পারব না।”
সবাই হাসছে। আমি হঠাৎ এরকম জবাব শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। যাই হোক সামলে নিয়ে বললাম,”শঙ্করদা,একবার কানের ডাক্তারের কাছে যান। কি বলছি আর কি শুনছেন। এক বাক্স পেনসিল কার্বন দিন।”
তবে রসিকতা যে সবসময় স্থান কাল পাত্র ভেদাভেদ মেনে চলত তা নয়। কখনো কখনো অসাবধানতায় একটু আধটু ভুলও হয়ে যেত।
একটা উদাহরণ দিই। ফিল্ড অফিসার পঞ্চাননবাবু বেলা বারোটা নাগাদ অফিসে ঢুকলেন। সেদিন বাইরে প্রখর রোদ। স্বাভাবিকভাবেই পঞ্চাননবাবু রোদে গরমে কাহিল হয়ে পড়েছেন। পঞ্চাননবাবু ঢুকেই দেখলেন,শঙ্করদার টেবিলে এক জাগ জল রয়েছে। তৃষ্ণার্ত পঞ্চাননবাবু জাগের দিকে হাত বাড়িয়ে শঙ্করদাকে জিজ্ঞাসা করলেন,”শঙ্করদা,জলটা একটু খাব?”
শঙ্করদা কিছু লেখায় ব্যস্ত ছিলেন। তবে বুঝতে পেরেছিলেন কথাটা পঞ্চাননবাবু বলছেন। মুখটা লেজার থেকে না তুলেই বলে উঠলেন,”হ্যাঁ হ্যাঁ! জল খাবে না তো কি খাবে? জলই তো মৃত্যুর কারণ। খাও খাও।”
পঞ্চাননবাবু জাগটা তুলে ফেলেছিলেন। শঙ্করদার ওই কথা শোনামাত্র একটা ঝটকা খেয়ে জলের জাগটা দ্রুত নামিয়ে রাখলেন। ততক্ষণে শঙ্করদা নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছেন। বললেন,”আরে না না। আমি খারাপ কিছু বলতে চাই নি। নাও নাও। তুমি জল খাও।”
পঞ্চাননবাবু ততক্ষণে শঙ্করদার টেবিল থেকে সরে এসে আমার টেবিলে রাখা জাগটা নিয়ে জল খেলেন। আমি শঙ্করদাকে বললাম,”শঙ্করদা,এটা কোন মজার কথা হল? কারো তেষ্টার মুখে মৃত্যুর কথা?”
তবে এরকম দু-একটা বেফাঁস কথা ছাড়া শঙ্করদার রসিকতা কখনও ভব্যতার সীমা লঙ্ঘন করত না।
শঙ্করদা আমার থেকে সাত বছরের বড়। বছর পাঁচেক আগে চাকরিতে ঢুকেছেন। আমি মাত্র তিন মাস আগে একই পদে চাকরি পেয়েছি।
শঙ্করদার সাথে আমার আলাপ ও সখ্যতা আমার চাকরির প্রথম দিন থেকেই। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম আমার অফিসের বাইরে। নতুন চাকরি পেয়েছি। তাই সময়ের আধঘন্টা আগেই এসে পৌঁছেছি। নিয়ম-কানুন কিছুই জানি না। কার কাছে গিয়ে দেখা করব, কিভাবে কাজে যোগ দেব,এসব নিয়েই ভাবছিলাম। এমন সময় বলিষ্ঠ চেহারার এক ভদ্রলোক সাইকেল স্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে এসে নাম জিজ্ঞাসা করলেন। আমি জবাব দিলে বললেন,”এসো”। তারপর হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেলেন। নিয়ম মেনে আমাকে কাজে যোগদানও করিয়ে দিলেন। আমি সেইদিনই শঙ্করদার ভক্ত হয়ে গেলাম।
কথিত আছে,একজন পুরুষ যদি একা জীবনযাপন করেন তবে তাঁর জাবনযাত্রায় কোন শ্রী খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি একরকম বাউন্ডুলে জীবনযাপন করেন। শঙ্করদার ক্ষেত্রে কিন্তু একথা বলা যেত না। শঙ্করদা খুব গুছিয়ে সংসার করতেন। ঘর-দোর পরিপাটি করে গোছানো থাকত। একার জন্য হলেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা রকম পদ রান্না করতেন। রান্নার হাতটাও ছিল চমৎকার।  কমলাদি বলতেন,”এ ছেলের বউ জুটবে কিভাবে? নিজেই তো পাক্কা গৃহিণী।”
একথা সত্যি যে শঙ্করদার এত গুণ থাকা সত্ত্বেও বিয়ের জন্য একটা কনে জুটছিল না। দোষটা অবশ্য খানিকটা ভাগ্যের আর কিছুটা শঙ্করদার নিজের। শঙ্করদার তিন কুলে কেউ ছিল না। এক বিধবা পিসির কাছে মানুষ হয়েছিলেন। পরে তিনিও ইহলোক ত্যাগ করেন। তাই বিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না।অন্যদিকে শঙ্করদা এত গোছানো মানুষ হওয়া সত্ত্বেও প্রেম-ট্রেম করার ব্যাপারে একেবারেই পারদর্শী ছিলেন না। এই একটা ক্ষেত্রে তাঁর চরিত্রে কিছুটা ঘাটতি ছিল বলেই আমাদের মনে হয়েছে। আমরা অনেক চেষ্টা করেও আমাদের গন্ডির মধ্যে কারও সাথে মেলবন্ধন ঘটাতে পারি নি। তবে নিজে বিয়ে না করতে পারলেও অন্য কারও বিয়ের নিমন্ত্রণ এড়িয়ে যেতেন না। সেসব ক্ষেত্রে বেশ উৎসাহ নিয়েই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেন।
অরূপের বোনের বিয়ে। আমাদের সবারই নিমন্ত্রণ রয়েছে। তবে যেতে পারব না কেউই। কারণ অরূপের বাড়ি মালদা। বিয়েটা সেখানেই হবে। হঠাৎ জানা গেল,আমরা কেউ না গেলেও শঙ্করদা যাচ্ছেন। অরূপ খুশী,কিন্তু আমরা অবাক। অরূপ শঙ্করদার আত্মীয় নয়। সহকর্মী মাত্র। সম্পর্ক অবশ্য খুবই ভাল। তবু সহকর্মীর বোনের বিয়েতে দুর্গাপুর থেকে একেবারে মালদা চলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক।
যা-ই হোক,শঙ্করদা গেলেন। ফিরলেন দিন সাতেক বাদে। আমরা খবর পেলাম,শঙ্করদা গত রাতে ফিরেছেন। সাথে নতুন বউ। মানে? শঙ্করদা বিয়ে করেছেন?
আমাদের কাজকর্ম্ম  মাথায় উঠল। টেবিলে টেবিলে নানারকম আলোচনা শুরু হল। কেউ বলল,এ তো বিভূতিভূষণের অপু। কেউ বলল, আসলে অরূপের বোনের সাথে শঙ্করদারই বিয়ের ঠিক হয়েছিল। ওরা আমাদের নেমন্তন্ন করলেও দুজনেই কথাটা গোপন রেখেছিল। একজন তো একথাও বলল যে রোমান্সটা আগে থেকেই চলছিল চিঠির মাধ্যমে।
নানারকম তথ্য আবিষ্কৃত হলেও যাদের নিয়ে গবেষণা তারা দুজনেই অকুস্থলে নেই। না অরূপ,না শঙ্করদা,কেউই তখনও কাজে যোগ দেয় নি। যার ফলে গবেষণা হলেও প্রকৃত ঘটনা জানা যাচ্ছে না।
এই যখন অবস্থা,তখন অন্য ব্রাঞ্চের মুকুলদা আমাদের উদ্ধার করতে আসরে অবতীর্ণ হলেন। বেলা তিনটে নাগাদ এসে শঙ্করদার তরফে আমাদের সবাইকে বৌভাতের নেমন্তন্ন করলেন। আমরা মুকুলদাকে চেপে ধরলাম। গোপন কথাটা আর গোপন রাখা চলবে না। মুকুলদা মুখ খুললেন না। শুধু বললেন,”যার বিয়ে তার কাছেই শুনে নিও।”
অরূপের বোনের বিয়েতে শঙ্করদা নিমন্ত্রিত হিসেবেই গিয়েছিলেন। নিজে বিয়ে করবেন,এ জাতীয় কোন পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে পাত্র বা পাত্রপক্ষ কেউ এসে পৌঁছলেন না। খবর নিয়ে জানা গেল,তাঁরা নাকি আসছেন না। যুগটা যেহেতু আধুনিক তাই লগ্নভ্রষ্ট হওয়ার মত কোন ঘটনা ঘটল না। কিন্তু যেটা ঘটল সেটা অভিনব। অরূপ নিজের বাবা-মাকে জানালো,”এত খরচ যখন হয়েই গেছে,এত নিমন্ত্রিত অতিথিও যখন হাজির,তখন বিয়ের আসর পণ্ড করে কি হবে? তার চেয়ে আমার সাথে যে ভদ্রলোক এসেছেন,সেই শঙ্করদার সাথে বোনের বিয়ে দেওয়া যেতে পারে। খুব ভাল মানুষ। বাকি শুধু শঙ্করদাকে রাজি করানো।”
অন্যদিকে শঙ্করদা মালদা গিয়ে অবধি অরূপের বোনের রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই মৃদু আপত্তি করলেও শেষে রাজি হলেন। তিন কুলে কেউ নেই। তাই কারও অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। অপরের প্রয়োজনে শহীদ হয়েছেন,এরকম মুখের ভাব নিয়ে বিয়েটা করেই ফেললেন।
আমরা যারপরনাই আনন্দিত। সবাই কবজি ডুবিয়ে খেলাম।
আমাদের অফিসের একমাত্র কবি সন্তু চক্রবর্তী মুচকি হেসে শঙ্করদার চিবুক ধরে বলল,”তুমি সত্যিই বর্ণময় দাদা।”
                — শেষ —
****************************************

চন্দ্রকান্তি দত্ত

লেখক পরিচিতি (চন্দ্রকান্তি দত্ত):
ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। জন্ম মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনা শহরে ১৯৫৯ সালে। স্কুল শিক্ষার শুরুটা পুরুলিয়ায় হলেও, প্রায় পুরোটাই হয়েছে দুর্গাপুরে। উচ্চ শিক্ষাও সেখানেই। নিজেকে লেখক না বলে গল্পকার বলতেই বেশী ভালবাসেন। লেখার শুরু গত শতকের নয়ের দশকের শেষ দিকে,তাও একজন সিনিয়র সহকর্মীর উৎসাহ ও চাপে। সেই থেকে টুকটাক লিখলেও,শারীরিক অসুস্হতার কারণে  লেখাতে ছেদ পড়েছে অনেকবার। এখন,চাকরী থেকে অবসরের পরে,প্রায় নিয়মিত লেখেন। গল্প ছাড়াও কয়েকটি কবিতাও লিখেছেন-বাংলা ও হিন্দিতে।

1 Comment

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!