অপরাজিতা
নাজির হোসেন বিশ্বাস
“ও রুনাদি তোমার মেয়ের তো খুব সুনাম শুনছি গো! এতদিন পাড়ার লোকে কত গালমন্দ করতো,যেই দেখেছে মেয়েটা একটু নাম কিনেছে,সবাই কেমন পাল্টি খেয়ে গেল। মানুষ হলো গিয়ে সব বেইমানের জাত।”
“সাত সকালে তুই কি নিয়ে পড়লি রাধা,লোকে কত কি বলবে সব শুনতে গেলে চলবে? তুই নিজের কাজ কর দেখি,না হলে যে মেয়েটা খেয়ে যেতে পারবে না।”
“না দিদি তুমি যাই বলো না কেন,তোমাকে তো কম কথা শুনতে হয়নি? সারা জীবন ধরে কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে,বলতে গেলে যুদ্ধ করে টিকে আছো,কেউ না জানুক আমিতো জানি।“
“ঠিক আছে,তুই বাসনগুলো ধুয়ে,ঝাঁটটা দিয়ে দে আগে,আমি রান্না বসাবো।” বলেই রুনা দূরের নীল আকাশের দিকে চেয়ে রইলো! সেখানে কত ভাঙাগড়া চলছে,ঠিক তার জীবনের মত।
“রুনা,সামনে বার তোকে কিন্তু আরও ভালো রেজাল্ট করতে হবে। তুই কোনো পড়া বুঝতে না পারলে আমাকে বলবি,দেখিয়ে দেব।” ঘাড় নাড়ে রুনা,”আচ্ছা স্যার” বলেই হাসিহাসি মুখ নিয়ে স্যারের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
রুনা একটা পাতলা ফর্সা মেয়ে,মাথার চুল লাল ফিতে দিয়ে দুই দিকে বেণী করে বাঁধা, পায়ে সস্তা রবারের চপ্পল,গায়ে ফুল তোলা রঙিন জামা। হাঁটবে তো যেন প্রজাপতির মতো ফিনফিন করে উড়বে।
রুনা স্কুল থেকে এসেই বলে,”মা খুব খিদে পেয়েছে গো! কিছু খেতে দাও না!”
-“হাত মুখ ধুয়ে নে মা,গুড় মুড়ি দিচ্ছি,খেয়ে নে।”
এক মুঠো মুড়ি মুখে দিয়ে রুনা বলে উঠলো,”মা জানো তো স্কুলের হেডস্যার খুব খুশি হয়েছেন,আমার রেজাল্ট দেখে। বলেছেন তোকে অনেক বড় হতে হবে, স্কুলের মান রাখতে হবে।”
“না,স্কুলে গিয়ে আর কাজ নেই মা,আর বাড়ির বাইরে যাবি না,বিকেলে তোর বিয়ের মানুষ আসবে। তোর বাবা বলছিলো,ভালো ছেলে পেয়েছে হাত ছাড়া করতে চায়না!”
“মা তাহলে আমার পড়ার কি হবে? আমি আর পড়বো না?”
“না মা! গরীব ঘরের মেয়েদের অত পড়ে কাজ নেই,বিয়েটা দিতে পারলে দুশ্চিন্তা মুক্ত হই। চারিদিকের যা অবস্থা! শকুন শৃগালের অভাব নেই। পেলেই ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। তার চেয়ে বিয়েই ভালো।”
রুনা মুড়ির বাটি রেখে ঘরে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে লাগলো। সেখানে নীল আকাশে পাখিগুলো কত সুন্দর উড়ে বেড়াচ্ছে ডানা মেলে। কত স্বাধীন ওরা,আমিও তো ওদের মতো উড়তে চেয়েছিলাম,কিন্তু আমার পায়ে শেকল পরাতে সবাই উঠে পড়ে লেগেছে। চোখের কোণ বেয়ে জলের রেখা,বুকের মাঝে স্বপ্ন মৃত্যুর হাহাকার।
যথারীতি রুনার বিয়ে হয়ে গেল এক মুদির দোকানির সঙ্গে। এক চালা ঘরে ছোট্ট মুদির দোকান,পাশের টালির চালায় থাকার জায়গা। একবেলা খাওয়া জুটলেও, দু’বেলা স্বামীর হাতের কিল ঘুষি খেয়ে দিন চলে রুনার।
“শোন রুনা,তোমার বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে এসো,আমার মুদির দোকানটা একটু জোরালো করতে হবে,বুঝেছো? টাকা পয়সার অভাবে মাল লাগাতে পারছি না।”
“এই তো গত মাসে পাঁচ হাজার টাকা এনে দিলাম,আবার? কিন্তু বাবা অত টাকা বারবার পাবেন কোথায়?”
“সেতো আমি জানি না। আমার টাকা চাই ব্যাস।”
“না! আমি টাকা চাইতে পারবো না,আমাকে বরং বেচে দিয়ে টাকা নিয়ে এসো”, বলেই কাঁদতে লাগলো রুনা।
“ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদোনা তো,ভাল্লাগে না,প্রয়োজন হলে বেচেই দেব। ঘরে বসিয়ে খেতে দেবার মুরোদ আমার নেই,বুঝেছো?”
“হ্যাঁ,তাই দিও,এইভাবে তোমার সংসারে মার খাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।”
“তবে রে,যত বড় মুখ নয় ততবড় কথা!” ভ্যাকভ্যাক করে দু’লাথি মেরে চুলের মুঠি ধরে ঘরের থেকে বের করে দিয়ে,”যা যেদিকে পারিস চলে যা আমার সামনে থেকে।”
সেদিন এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েছিল রুনা। এই বিশাল পৃথিবীর কোথাও তো যাওয়ার জায়গা নেই,মায়ের কাছে ফিরে গেলেও অশান্তি। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। চোখে মুখে একরাশ শূন্যতা।
“কিরে রুনা,এইভাবে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস? শরীর ভালো আছে তো?”
মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে পড়ে রুনা। দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা।” কি হলো কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে বল আমাকে?”
“বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল…!” কেঁদে ফেললো রুনা।
“তাড়িয়ে দিল? মানে?”
“আমার বর,আরও টাকা চাইছে,আমি বলেছি,বাবা টাকা আর দিতে পারবে না। তখনই লাথি মেরে,চুলের মুঠি ধরে বের করে দিল।”
“ঠিক আছে কাঁদিস না,আপাতত আমার বাড়িতে চল,একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে।”
“স্যার! আপনার বাড়িতে কোন মুখে যাবো? আপনার কথার মান রাখতে পারিনি। তার আগেই বাবা বিয়ে দিয়ে দিল।” বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে রুনা।
“ঠিক আছে চল আগে বাড়িতে,তোর বাবাকে ডেকে পাঠাচ্ছি। কথা বলে একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে। আয় আমার সঙ্গে।”
“শোন রমেন,তোমার মেয়ের এই অবস্থা,কি করবে বলো?”
‘আপনি তো সবই জানেন মাস্টার,দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ আমি। তবুও বেশ ক’বার টাকা দিয়েছি কিন্তু আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না।”
“সে তো বুঝলাম,কিন্তু মেয়ে তো তোমার,ওকে কি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখবে নাকি?”
“মাস্টার,আর একটা মেয়ে আছে আমার ঘরে,আবার এটা গিয়ে জুটলে ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে পারবো না। ও বরং স্বামীর ঘরেই ফিরে যাক।”
“এত অত্যাচারের পরেও জামাইয়ের কাছে ফিরে যেতে বলছো?”
“এছাড়া আমি নিরুপায় মাস্টার।“
“বেশ তুমি যাও রমেন।
রুনা তুই এখন কি করবি বল? যেমন বলবি তেমন ব্যবস্থা করে দেব।”
মাস্টারের স্ত্রী বলে উঠলেন,”রুনা আপাতত আমাদের এখানে থাক,সংসারের কাজ কাম করুক। পরে দেখেশুনে কোন ব্যবস্থা করে নেবে। তাছাড়া ওর পেটেও তো বাচ্চা আছে মনে হচ্ছে।”
তারপর দিন যায় মাস যায়…!
ঘরঘর করে সেলাই মেশিন চলছে,”মা নামতা ধরবে না? আমার মুখস্ত।” মেয়ে রুবি ঘরের ভেতর থেকে বলে উঠলো।
“ঠিক আছে,তুই নামতা রেখে ইংরেজি রাইমসটা মুখস্থ করে নে।” বলেই ঘরঘর করে মেশিন চালাতে শুরু করলো রুনা।
“কইগো রুবির মা,আমার সায়া ব্লাউজ কটা সেলাই করে দাও দেখি।” বলেই পাড়ার চপলা বৌদি টুলটা টেনে নিয়ে বসে পড়লেন। ওদিকে ঘরের মধ্যে রুবি জোরে জোরে রাইমস মুখস্থ করছে,টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটিল স্টার…!
চপলা বৌদি বলে উঠলেন,”তোমার মেয়ে খুব সুন্দর ইংরেজি পড়ছে তো। ওকে পড়াও কষ্ট করে হলেও। খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে তোমার।”
“ওইটুকুই তো আশা ভরসা বৌদি। ওকে নিয়েই বেঁচে আছি,যুদ্ধ করছি।”
“হ্যাঁ,তোমার মেয়ে দেখতেও বেশ মিষ্টি,ঠিক যেন তোমার মুখ কেটে বসানো।”
“হ্যাঁ,সবাই তাই বলে।
এই নাও বৌদি,কেমন হলো দেখে নাও।”
“তোমার হাতের কাজ ভালো বলেই তো আসি। খুব সুন্দর হয়েছে,এই নাও টাকা। বাড়ি গিয়ে আবার রান্না বসাতে হবে,যাই গো।”
“বৌদি কেমন আছো?” পাড়ার রতন ক’দিন থেকে ঘুরঘুর করছে,যা রুনার একদম পছন্দ নয়। তবুও মুখে বললো,“এই তো ভাই,এখন কি মনে করে?”
“বৌদি এইভাবে আর কতদিন চলবে? চলো না আমরা দুজনে বাইরে কোথাও চলে যাই। খুব সুখে রাখবো তোমাকে।”
“না ভাই,আমার কোন স্বপ্ন নেই,এই বেশ ভালো আছি।”
“তুমি আমার কথা শোন বৌদি,তোমার খুব ভালো হবে।”
“আমি বললাম তো,তুমি এখন যাও। বাজে কথা শোনার সময় আমার নেই।”
“ঠিক আছে চলেই যাচ্ছি,তবে তোমার ব্যবস্থা আমি করেই ছাড়বো।“,ঘোঁতঘোঁত করতে করতে রতন চলে গেল।
“মা ওই মানুষটা তোমাকে কি বলছিলো গো? আমাকেও রাস্তায় ধরে সেদিন কেক দিতে এসেছিল,আমি নিইনি মা।”
“খুব ভালো করেছিস মা”,বলেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো রুনা।
“তুমি কেঁদোনা মা,আমি তো আছি “,বলেই রুবি তার মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দেয়।
“জানিরে মা,তোর জন্যই তো আমার শরীরপাত করে কাজ করে যাওয়া। তোকে অনেক বড় হতে হবে মা,অনেক বড়।”
রুবি হিহি করে হেসে উঠে,” আমি ওই ইউক্যালিপটাস গাছটার মত বড় হবো মা।”
“হ্যাঁ তাই যেন হয় মা।”
দেখতে দেখতে রুবি বড় হয়ে গেল। এবারেই উচ্চ মাধ্যমিক ফাইনাল দেবে। রুবি টিউশন থেকে বাড়ি ফিরছে,তখনও গোধূলীর আলো লেগে রয়েছে গাছের পাতায় পাতায়। এমন সময় একখানা বাইক এসে পথ রোধ করে দাঁড়ালো রুবির সামনে।
“কি হলো,বাইক এনে দাঁড় করালেন কেন?”
“রুবি,তোর জন্য একটা গোলাপ এনেছি,আজ যে ভ্যালেন্টাইনস্ ডে,জানিস না?”
“না দাদা,ওই সবে আমার কাজ নেই,ফুল আপনার কাছেই রাখুন।”,বলেই পাশ কাটিয়ে হনহন করে রুবি বাড়ির পথে পা বাড়ালো।
“অত দেমাক ভালো নয় রুবি,তোর মা কি করে সব জানি আমি। তবুও…!”
“বেশ তো,আমিও জানি আমার মা কি!”
মায়ের সঙ্গে গল্প করছে রুবি,”মা আমার রেজাল্ট হয়ে যাবে আজকালেই। এর পর কি করবো?”
“কেন? কি করবো মানে?”
“তোমার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। তুমি আর কত খাটবে,আমি বরং একটা কাজ খুঁজবো।”
“একদম নয়,তোমার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে,তোমাকে না বড় হতে হবে? তুমি পারবে না মা?”
“তোমার জন্য আমাকে পারতেই হবে মা”,বলেই দুই হাতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে রুবি।
“ঠিক আছে ছাড়,আমার হাতের কাজটা করে নিই।”
“আমরা এসেছি ‘গ্রামের খবর’ চ্যানেলের পক্ষ থেকে। আপনার সাক্ষাৎকার নিতে চাই।”
“কিরে রুবি কি বলছেন ওনারা? কিসের জন্য এই সব কান্ড?” রুনাদেবী চেঁচিয়ে উঠলেন।
আমরা বুঝিয়ে বলি,”আপনার মেয়ে রুবি রায় উচ্চমাধ্যমিকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে জেলায় প্রথম হয়েছেন। কিভাবে সেটা সম্ভব হলো যদি একটু বলেন আমাদের।“
“সে আমি কি করে বলবো,রুবিই ভালো বলতে পারবে।”
“আমরা যতটুকু জানি রুবির বাবা নেই,মানে আপনিই ওর বাবা-মা। আপনিই ওর সমস্ত কাজের প্রেরণা।”
“আমি শুধু আগুনে পোড়া সলতের মতো জ্বলে গেছি,সেই আলো ওর চোখে মুখে পড়ে একটু আলোকিত হয়েছে। বাকিটা ওর নিজের চেষ্টা।”
“বেশ খুব ভালো লাগলো,”আপনার সঙ্গে কথা বলে। আপনি মেয়েকে কি হিসাবে দেখতে চান?”
রুনাদেবী হেসে উঠলেন। আমাদের গরীব ঘরে মেয়েকে নিয়ে আর কিসের স্বপ্ন দেখবো? ওর কপালে যা আছে তাই হবে।”
“আপনি এতদূর যখন পেরেছেন,বাকীটাও হয়ে যাবে আশাকরি। এই যে রুবি রায়, আপনার কেমন লাগছে প্রথম হয়ে?”
“খুব ভালো,আমি যে মায়ের লড়াইয়ের মান রাখতে পেরেছি সেটাই আমার কাছে অনেক। আমার মা আজ অপরাজিতা।”
“আপনি অসংখ্য ছাত্রছাত্রীদের কি মেসেজ দিতে চান?”
“আমি শুধু বলবো,চেষ্টার কোন বিকল্প নেই। আর মায়েরা কোন অংশে কারোর থেকে কম নয়। আমরা নারী,আমরাও পারি।“
চ্যানেলের লোক সবাই ধীরে ধীরে চলে গেল। মা-মেয়ের চোখের জলে ধুইয়ে গেল
লজ্জা অপমানের যত গ্লানি……!
“মা কি ভাবছো অত আকাশ পাতাল? রান্না চাপাও,না হলে আমার দেরী হয়ে যাবে।”
“অপরাজিতায় কত ফুল এসেছে দেখেছিস রুবি…?”
*******************************************************
নাজির হোসেন বিশ্বাস পরিচিতিঃ-
নাজির হোসেন বিশ্বাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর। পেশায় রাজ্য সরকারের স্কীম, স্বামী বিবেকানন্দ স্বনির্ভর কর্মসংস্থান প্রকল্পের, প্রকল্প সহায়ক। লেখালেখি সেই স্কুল জীবন থেকে। পত্রপত্রিকায় কিছু কবিতা গল্প প্রকাশিত হয়েছে। ভালো গল্প কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক।