দেবী দুর্গা – দুটি ভিন্ন সত্তার প্রকাশ
ডঃপর্ণশবরী ভট্টাচার্য্য
বঙ্গদেশে আশ্বিন মাসের গুরুত্ব শুধুমাত্র শারদোৎসবে, যার কেন্দ্রে আছেন দেবী দুর্গা। প্রচলিত বিশ্বাসে তিনি বাঙ্গালীর ঘরের মেয়ে, যাঁর শ্বশুরালয় কৈলাস এবং যিনি বছরের এই বিশেষ ঋতুটিতে স্বামী শিবকে ছাড়াই চার সন্তান সহ মর্তে অর্থাৎ পিত্রালয়ে আসেন। সুদূর কৈলাসবাসিনী মেয়ের পিতৃগৃহে ফেরা ও তদপুলক্ষে বাঙ্গালীর দুর্গাপূজার আড়ম্বর উদযাপন শুধুমাত্র উৎসব নয়, এক চিরন্তন ঐকান্তিক আবেগের দ্যোতনা যা বর্তমানে সর্বজনীন।
বঙ্গদেশে দেবী দুর্গা পূজিতা হন মহিষাসুরমর্দিনী রূপে যার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মার্কন্ডেয় পুরাণে। মূলতঃ দানবদলনের জন্যই দেবতাগণ তাঁকে সৃষ্টি করেন এবং তাঁর দশ হাতে দশ প্রহরণ দান করে তাঁকে মহিষাসুর বধের উপযোগী করে তোলেন। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন বা অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে শুভ শক্তির জয়–দেবী দুর্গার অসুরবধ মূলতঃ এই বার্তা বহন করলেও দুর্গা কিন্তু শস্যদেবী। অর্থাৎ তিনি ক্ষেত্র বা ভূমি ও কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিতা। ঐতিহাসিক রমাপ্রসাদ চন্দের মতে এই শস্যদেবীর দানবদলনী হয়ে ওঠা অনেকাংশেই প্রতীকী অর্থাৎ মহিষ, শুম্ভ, নিশুম্ভ, দুর্গম প্রভৃতি অসুরেরা যাদের যাদের দেবী বধ করতেন তারা অনাবৃষ্টি বা খরার রূপক।
পৃথিবীর বহুস্থানের ধর্মীয় ইতিহাসে দেখা যায়, অতি প্রাচীন সমাজে রীতিনীতি, প্রথা, সংস্কৃতি সবকিছুরই কেন্দ্রে ছিল নারী। নারীর প্রজনন শক্তি এবং প্রত্যক্ষভাবে তার সন্তানের জন্মদানের জন্য তাকে জীবনসৃষ্টির প্রতীক মনে করা হত। কৃষিক্ষেত্রে শষ্য উৎপাদনের সঙ্গে নারীর জনয়িত্রী রূপটি একীকৃত হয়েছে, মানবিক ও প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতা সমীকৃত হয়েছে, প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানে যা পাওয়া যায়, সাহিত্যিক উপাদানেও যার উল্লেখ আছে। নবাশ্মীয় যুগে, সিন্ধু সভ্যতায় ও তার পরবর্তীকালেও পাথর, মাটি, হাড়ের দ্বারা নির্মিত অজস্র মাতৃকামূর্তি পাওয়া যায়। হরপ্পায় পোড়া মাটির তৈরি প্রচুর মাতৃকামূর্তি পাওয়া গেছে যেগুলির পূজা হত। এরকমই একটি মূর্তি পাওয়া গেছে হরপ্পার একটি শীলে, যেখানে একজন নারীর শরীর থেকে একটি চারা গাছ নির্গত হওয়ার চিত্র আছে। মনে করা হয়, এটি পুরানে উল্লিখিত দেবী শাকম্ভরীর একটি আদিরূপ, যিনি পরবর্তীতে দেবী দুর্গার সঙ্গে অভিন্না। পৃথিবীর উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে নারীর উৎপাদিকা শক্তিকে অভিন্ন করে দেখার রীতি সর্বত্রই পাওয়া যায়। সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত মাতৃকামূর্তিগুলির পিছনেও আদিম উর্বরতামূলক বিশ্বাস ছিল। কৃষি নির্ভর উপজাতিদের মধ্যে ‘Mother Earth’ বা ভূমি দেবীর গুরুত্ব সর্বাধিক। সৃষ্টির ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা একেবারেই প্রত্যক্ষ না হওয়ার কারণে নারী symbol of generation রূপে গণ্য হয়েছে। ক্ষেত্রগত উর্বরতা এবং শস্য উৎপাদনের সঙ্গে নারীর প্রসূতি-চরিত্রটিকে প্রাকৃতিক এবং সমাজগত ভাবে সমদৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। রবার্ট ব্রিফল্ট এর মতে,“The Mother and the soil are alike”।
দেবী দুর্গাকে ঘিরে প্রচুর myth বা পুরাকথা আছে যার প্রধানতম হল মহিষাসুর বধ। এছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে দেবীর রূপ কল্পনার প্রকারভেদ দেখা গেলেও তিনি যে মূলতঃ শস্যদেবী বা agricultural deity তা বোঝা যায় তাঁর পূজার্চনার রীতিনীতি বা আচার অনুষ্ঠান গুলির মধ্য দিয়ে। দুর্গাপূজায় একটি বিশেষ আচার হল ‘নবপত্রিকা পূজা’। নবপত্রিকা মূলতঃ নয়টি উদ্ভিদের সমাহার–রম্ভা, কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বিল্ব, ডালিম, অশোক, মানক বা মান এবং ধান্য। নবপত্রিকা পূজার একটি বিশেষ রীতি আছে। মাটিতে ‘সর্বতোভদ্রমন্ডল’ আঁকা হয়, যা একটি তন্ত্রোক্তচিত্র, যা নারীর প্রজননাঙ্গের প্রতীক। একটি মৃন্ময় পূর্ণকুম্ভ বা পূর্ণঘট যা পরিপূর্ণ মাতৃগর্ভের প্রতীক তা ঐ চিত্রটির মধ্যস্থানে রাখা হয়। একটি শিশুর পূর্ণাবয়ব চিত্র (সিন্দূর পুত্তলি) পাশে আঁকা হয়। পূর্ণঘটের খোলা মুখটিতে পাঁচ ধরনের পাতা এবং একটি সিন্দূররঞ্জিত নারকেল রাখা হয়। এটি একটি সাধারণ উর্বরতামূলক আচার যার মাধ্যমে গাছগুলিকে নারীর চিত্রাঙ্কিত প্রজনন অঙ্গের সংস্পর্শে আনা হয় যার উদ্দেশ্য হল বহুপ্রসূতা–ক্ষেত্রজ এবং অঙ্গজ। নবপত্রিকার প্রতিটি উদ্ভিদের সঙ্গে একজন করে দেবী সম্পর্কিতা–রম্ভার সঙ্গে ব্রহ্মানী, কচুর সঙ্গে কালিকা, হরিদ্রার সঙ্গে দুর্গা, জয়ন্তীর সঙ্গে কৌমারী, বিল্বর সঙ্গে শিবি, দালিমের সঙ্গে রক্তদন্তিকা, অশোকের সঙ্গে শোকরহিতা, মানক বা মানের সঙ্গে চামুন্ডা, এবং ধান্যের সঙ্গে লক্ষ্মী। সব গাছগুলিকে একটি অপরাজিতা লতার সঙ্গে বেঁধে নদীতে স্নান করিয়ে পৃথকভাবে পূজা করা হয়।
রাজস্থানে ভূমি বা শস্যদেবী হিসাবে গৌরীর পূজা হয়ে থাকে এবং এই উপলক্ষে একটি নকল কৃষিক্ষেত্র তৈরী করা হয় (garden of Adonis)। ওঁরাও ও মুণ্ডা উপজাতিদের মধ্যে কৃষিকার্যের সূচনায় এরকম একটি নকল কৃষিক্ষেত্র তৈরি করে দেবীর পূজা করা হয়। উত্তর পশ্চিম ভারতে হিমালয় অন্তর্গত জেলা-সমূহেও শিব পার্বতীর পূজাস্থলে এই নকল কৃষিক্ষেত্র নির্মান করা হয়। ভারতবর্ষের আরও অন্যান্য অঞ্চলে দুর্গাপূজার একটি অত্যাবশকীয় অঙ্গ এই —— বাগান যা প্রাচীন কৃষিজীবী মানুষের ফসল ফলানো ধরিত্রী বক্ষের সঙ্গে শস্যের অধিষ্টাত্রী দেবীর একটি কাল্পনিক সমীকরণ।
জমি, কৃষি, শস্য অর্থাৎ ক্ষেত্রগত উর্বরতার সঙ্গে সম্পর্কিত এই দেবী দুর্গাই আবার বিভিন্ন শিকারজীবী উপজাতিদের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। কাত্যায়নী আদিতে ছিলেন কাত্য – উপজাতির দেবী। দেবী বিন্ধ্যবাসিনী পর্বতগুহায় শবর, বর্বর পুলিন্দদের দ্বারা পূজিতা, যিনি অ-পর্ণা অর্থাৎ বিবসনা। হরিবংশে দেবির বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘শবরৈ বর্বরৈশ্চৈব পুলিন্দৈশ্চ সুপূজিতা’। মহাভারতের দুর্গাস্তোত্রে দেবীকে বিন্ধ্য পর্বত নিবাসিনী বলা হয়েছে যিনি মদ্য মাংস পশু প্রিয়া রূপে কল্পিতা অর্থাৎ উপজাতি সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। মহাভারতে শিব ও দেবী কিরাত ও কিরাতিনীর ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন। পেরিপ্লাসে যে কন্যাকুমারীর নাম পাওয়া যায় তাঁর পূজাও বিভিন্ন উপজাতিরা করত। এই সব দেবীই দুর্গার নামভেদ ও রূপভেদ।
ঔপজাতীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে দেবী দুর্গার নৈকট্যের একটি উদাহরণ হল শারদোৎসব, অর্থাৎ শবর উপজাতিদের দুর্গোৎসবের একটি অনুষ্ঠান যা পালিত হয় বিজয়া দশমীর দিন। যার কথা জীমূতবাহনের কালবিবেক গ্রন্থে পাওয়া যায়। এছাড়াও বাকপতির গৌড়বাহোতে বলা হয়েছে এই দেবী শবর ও কোলদের দ্বারা পূজিতা। সুবন্ধুর বাসবদত্তায় শবরদের দেবী, কাত্যায়নী ও ভগবতীর উল্লেখ আছে।
সুদূর অতীতের মাতৃপ্রধান সমাজ থেকে যে প্রকৃতিপ্রাধান্যের উদ্ভব হয়েছিল পরবর্তীকালে ধর্মভাবনায় তা মাতৃকেন্দ্রিক দেবীর স্থান লাভ করে। দুর্গা, উমা, গৌরী, কালিকা পরবর্তীকালে শক্তি দেবী রূপে প্রকাশ পান। দেবীমাহাত্ম্যে যে পৃথিবী দেবীর উল্লেখ আছে তাঁর থেকেই সীতা, জগদ্ধাত্রী, শাকম্ভরী প্রভৃতি শস্য দেবীরা জন্ম নেন। শাকম্ভরী পরবর্তীতে অন্নদা বা অন্নপূর্ণায় পরিণত হন। শক্তি ধর্মের বিকাশের পরে এই দেবীদের অনেকেরই চরিত্র ও রূপের পরিবর্তন হয় এবং ভিন্ন নামে তাঁরা দেবী মন্ডলীর-অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান।
গ্রন্থপঞ্জী:
R.P.Chanda, Indo Aryan Races (Ed. N.N.Bhattacharya, 1969)
J.N. Banrejea, Puranic and Tantric religion, 1966
N.N.Bhattacharyya, Ancient Indian Ritual and its social Content 1975
N.N.Bhattacharyya, The Indian Mother Goddess, 1970
***********************************************************
ডঃ পর্ণশবরী ভট্টাচার্য্য পরিচিতিঃ
এসোসিয়েট প্রফেসর, ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশন (কলেজ), কলকাতা
অনেক কিছু জানলাম। ধন্যবাদ।