বিশিষ্ট লেখকের কলমে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
অগ্নিমিত্র ভট্টাচার্য্য
স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনীমূলক লেখার প্রতি আমার আগ্রহ চিরকালের। তার প্রধান কারণ এই যে, বহু অজানা সত্যঘটনা ও তথ্যের আকর এই লেখাগুলি। তবে সাধারণ পাঠকেরা এই জাতীয় বইয়ের চেয়ে ছোটগল্প, নভেল,নাটক বা উপন্যাসকেই বেশিমাত্রায় পছন্দের তালিকাভুক্ত করে থাকেন আর সেই কারণেই বহু গ্রন্থ পাঠের পরেও,তারা “মহাজীবনের মণিকণা” থেকে সততই বঞ্চিত থাকেন। এই অজানা “মণিকণা” গুলি এক পরিচিত বিশিষ্টজনের চরিত্রের এক অপরিচিত দিককে সহসা উন্মোচিত করে, চমকিত ও পুলকিত করে তোলে পাঠকের হৃদয়।
আজ এই রকমেরই একটি ঘটনার বিবরণ দিতে চলেছি আমাদের অতি পরিচিত লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবুক,আত্মমগ্ন চরিত্রের। তবে এই ঘটনার বর্ণনা করেছেন বাংলা সাহিত্যের আর এক মহীরুহ। আসুন আমরা তাঁর বয়ানেই জেনে নিই এক অপরিচিত বিভূতিভূষণকে;
“ভাগলপুরের এই সভা-সমিতি প্রসঙ্গে একটি অদ্ভুত স্মৃতি আমার মনে আঁকা আছে। সেটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বন্ধে। মনে পড়িতেছে না এ কাহিনী আমি আর কোথাও লিখিয়াছি কি না। তবু আবার লিখিতেছি। ইহাতে বিভূতি-চরিত্রের একটি বিশিষ্ট পরিচয় আছে। ভাগলপুর কলেজে সভা হইতেছে। বিরাট সভা। বিভূতি সভাপতি,আমি প্রধান অতিথি। এ সব কলেজের সভায় ছাত্র-ছাত্রীরা প্রথমে নিজেদের রচনা পাঠ করে।গান হয়, আবৃত্তি হয়। সব শেষে সভাপতির অভিভাষণ। বিভূতি দেখিলাম কেমন যেন একটু উসখুস্ করিতেছে।আমার ভাগলপুরে আসিবার কয়েক বছর আগে বিভূতি কিছুদিন ভাগলপুরে ছিল। কলিকাতার কোন ধনী জমিদারের ম্যানেজার রূপে কাজ করিত। ভাগলপুরে বুঢ়ানাথ শিবমন্দিরের নিকট যে ‘বড় বাসা’ আছে সেখানেই থাকিত বিভূতি। বাড়ীটি ঠিক গঙ্গার উপরেই। প্রকাণ্ড ছাদ ছিল একটি। ছাদের এক কোণে একটি ঘরও ছিল। শুনিয়াছি, বিভূতি এই বড় বাসায় বসিয়াই ‘পথের পাঁচালী’ লিখিয়াছিল। বিভূতি নিজেই এ কথা বলিয়াছিল আমাকে। গঙ্গার ওপারে জমিদারি—সেখানেও সে গিয়া মাঝে মাঝে থাকিত। তাহার এই অভিজ্ঞতার ফল—‘আরণ্যক’ বইটি। মোটকথা ভাগলপুর সম্বন্ধে তাহার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। চেয়ারে কিছুক্ষণ উসখুস্ করিয়া বিভূতি অবশেষে আমার কানে কানে বলিল— আমি একটু বাইরে যাব। সঙ্গে সঙ্গে একটি ছেলেকে ডাকিয়া বলিলাম—ইহার সঙ্গে যাও। ছেলেটিকে লইয়া বিভূতি সভা হইতে চলিয়া গেল। কিন্তু গেল তো গেলই,আর ফেরে না। যখন আধঘণ্টা উত্তীর্ণ হইয়া গেল তখন আমি একটু উদ্বিগ্ন হইলাম। তখন সভায় প্রবন্ধপাঠ চলিতেছে,তাহার পর একটি আবৃত্তি এবং তাহার পরই সভাপতিকে ভাষণ দিতে হইবে। প্রবন্ধপাঠ শেষ হইয়া আবৃত্তি শুরু হইল তখনও বিভূতির দেখা নাই। মহা চিন্তিত হইয়া পড়িলাম। এ অবস্থায় কি করা উচিত ভাবিতেছি। এমন সময় দেখিলাম বিভূতি হন্তদন্ত হইয়া আসিতেছে। আমার কাছে আসিয়া কানের কাছে মুখ রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিল—‘কতদূর হল?’
-‘সভা শেষ হয়ে এসেছে। এবার তোমাকে ভাষণ দিতে হবে।
-‘কি বলব বল দেখি—-‘
-‘সাহিত্য বিষয়ে কিছু বল—‘
বিভূতি মিনিট পাঁচেক কিছু বলিল। সভা শেষ হইয়া গেল।
তাহাকে একা পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম,’এতক্ষন ছিলে কোথা?’
সে যাহা বলিল তাহা বিস্ময়কর। সে বলিল—‘এই কলেজের কাছে রেললাইনের ধারে একটি ডিস্টান্ট সিগনাল আছে। তাহার তলাটি সিমেন্ট দিয়া বাঁধানো। আমি যখন ভাগলপুরে ছিলাম তখন প্রায়ই ওই ডিস্টান্ট সিগনালের তলায় আসিয়া বসিতাম। উহারই তলায় বসিয়া অনেক সূর্যোদয়,অনেক চন্দ্রোদয় দেখিয়াছি। উদার আকাশে মেঘ দেখিয়াছি,সন্ধ্যার পর নক্ষত্র উঠিতে দেখিয়াছি। স্থানটি আমার বড়ই প্রিয় ছিল। সভায় আসিয়া সেই ডিস্টান্ট সিগনালের কথা মনে পড়িল। সে যেন আমাকে বার বার বলিতে লাগিল—তুমি এতদিন পরে এত কাছে আসিয়াছ,আমার সাথে দেখা করিয়া যাইবে না? আমি ভাই সেই সিগনালটি দেখিতে গিয়াছিলাম। তাহার তলায় মাত্র পাঁচ মিনিট বসিয়াছি। বিশ্বাস কর পাঁচ মিনিটের বেশী বসি নাই। কিন্তু জায়গাটা যত কাছে ভাবিয়াছিলাম তত কাছে নয়। এখান হইতে প্রায় এক মাইল। আসিবার সময় আমি মাঠামাঠি আসিয়াছি।’
দেখিলাম তাহার কাপড়ে অনেক চোরকাঁটা লাগিয়া রহিয়াছে। পা ভর্তি ধুলো। বিভূতি অপ্রস্তুত মুখে অপরাধীর মতো আমার দিকে চাহিয়া রহিল। আমি এক নতুন বিভূতিকে দেখিলাম।”
নতুন ভাবে ‘বিভূতি-দর্শন’ যাঁর লেখনীতে সম্ভব হল তিনি আর কেউ নন,বাংলা সাহিত্যের দিকপাল বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় অর্থাৎ ছদ্মনামে “বনফুল”। আজ উনিশে জুলাই তাঁর ১২২ তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবার এই সুযোগটুকু হাতছাড়া করলাম না।
(লেখাটি বনফুলের পশ্চাৎ পট গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত)।।
*******************************************************
অগ্নিমিত্র ভট্টাচার্য্য পরিচিতিঃ
জন্ম, স্কুল, কলেজ সবই কলকাতা। কর্মজীবন কেটেছে অবশ্য বিশাখাপত্তনম, অন্ধ্র প্রদেশে। সঙ্গীত প্রিয় ও রবীন্দ্রানুরাগী!