সতীপীঠ কিরীটেশ্বরী
প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
বৃষ্টির শব্দ, কড়কড় করে বাজের আওয়াজ, হ্যারিকেনের আলোয় এক গা ছমছম পরিবেশে দিদিমার কোলের ভেতর আরও একটু ঢুকতে পারলে মনে হয় ভালো হতো, এমন অবস্থায় দিদিমার মুখে অনেক অনেক গল্প শুনেছি তাঁর জীবনের। তার মধ্যে ঘুরেফিরে যে কথাগুলো বারেবারে এসেছে, তা হলো পুঠিয়া রাজবাড়ির কথা। রাজসাহী জেলার নাটোর মহাসড়কে অবস্থিত পুঠিয়া রাজবাড়ীর পাঁচআনা তরফের অন্যতম অংশীদার হিসেবে দিদিমার মুখে সেই সময়ের কথা শোনা খুব মনোগ্রাহী বিষয় ছিল।
দিদিমার কাছেই শুনেছি বাণগাছির জমিদার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় রঘুনন্দন তাঁর ভাই রামজীবনের নামে জমিদারি পত্তন করেন। শুরু হয় নাটোর রাজবংশের ইতিহাস। রঘুনন্দন ও রামজীবন যখন ভাতঝাড়ার বিলে নাটোরের রাজপ্রাসাদ তৈরি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন যে স্থান তাঁরা প্রাসাদের জন্য নির্বাচিত করেন, তা ছিল পুঠিয়া রাজবাড়ীর সম্পত্তি। পুঠিয়ার তদানীন্তন রাজা দর্পনারায়ণ নাটোরের নতুন রাজা কে সেই জমি ব্রহ্মোত্তর কল্পে দানপত্র করে দেন। সেখানেই ১৭০৬-১০ খ্রীঃ গড়ে ওঠে কবি জীবনানন্দের স্বপ্নসুন্দরী বনলতা সেনের শহর নাটোরের রাজপ্রাসাদ।
পুরনো ইতিহাস বেশ সুন্দর করে বলতেন দিদিমা, যাতে জীবনেও তা আর না ভুলি। তিনি বলতেন রামজীবন চৌধুরী কে জমিদারি তে কায়েম করে রঘুনন্দন মুর্শিদাবাদের বড়নগরে বসবাস শুরু করেন। রামজীবন তাঁর দত্তক পুত্র রামকান্ত-র সাথে আত্মারাম চৌধুরী ও তমাদেবী চৌধুরীর কন্যা ভবানীর বিবাহ স্থির করেন। রামজীবনের মৃত্যুর পরে রামকান্ত নাটোরের জমিদার হ’ন। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি রামকান্তের মৃত্যুর পর তৎকালীন নবাব আলিবর্দ্দী খাঁ-র নির্দেশে জমিদারির দায়িত্ব পান রামকান্তের স্ত্রী ভবানী দেবী। শুরু হয় নাটোরের মহীয়সী রাণী ভবানীর ইতিহাস।
রাণী ভবানী ও রামকান্ত চৌধুরীর পুত্র, নাটোরের রাজা রামকৃষ্ণ চৌধুরী ছিলেন সাধক। তিনি বড়নগরে বসবাস করতেন এবং কিরীটকণা গ্রামে অবস্থিত মায়ের মন্দিরে সাধনা করতে আসতেন। এই মন্দির নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।
উনবিংশ শতকে (১৮৩৪ খ্রীঃ) মালয়েশিয়ায় একটি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, যাতে লেখা ছিলঃ
অঞ্জনাচ্চীয়তে কর্ম জন্মনঃ কর্ম কারণ (ম)
জ্ঞানান্নচীয়তে (কর্ম কর্মাভাবান্ন জায়তে)
মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তস্য রক্তমৃত্তিকা বাস (ৎ ব্যস্য)
সর্বেণ প্রকারেণ সর্বস্মিণ সর্বথা স(র)ব সিদ্ধ যাত (রঃ) সন্তু।
এই শিলালিপি থেকে মহানাবিক বুদ্ধগুপ্ত এবং তাঁর বাসস্থান রক্তমৃত্তিকা বা আজকের রাঙামাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। পরবর্তীতে রক্তমৃত্তিকা বা রাঙামাটি এবং রাজবাড়ীডাঙা তে খনন করে রাজা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ আবিষ্কৃত হয়। রাজা শশাঙ্ক ধর্মান্ধ ছিলেন না। তিনি ধর্মান্ধ হলে তাঁর রাজত্বে প্রায় দশটি বৌদ্ধবিহার অবস্থান করতে পারতোনা। স্রেফ রাজনৈতিক কারণে তিনি বৌদ্ধবিরোধী হয়ে পড়েন। তার মূল কারণ ছিলেন কনৌজাধিপতি হর্ষবর্ধন। তিনি শৈব ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর বৌদ্ধধর্ম প্রীতি ব্রাহ্মণদের উষ্মার কারণ হয়ে ওঠে। তারা তীব্র প্রতিবাদ জানায় হর্ষবর্ধনের বৌদ্ধপ্রীতির বিরুদ্ধে। হর্ষবর্ধন ব্রাহ্মণ বিদ্রোহ কে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে দমন করেন এবং জীবিতদের উৎখাত করেন। ব্রাহ্মণদের কষ্টে বিচলিত রাজা শশাঙ্ক তাদের নিজরাজ্যে আশ্রয় দান করেন এবং বৌদ্ধদের কিছু স্তূপ এবং বিহার ধ্বংস করেন। সর্বোপরি তিনি বোধিবৃক্ষ সমূলে উৎপাটন করেন। হর্ষবর্ধনের অন্নে প্রতিপালিত বাণভট্ট এবং হিউয়েনসাং শশাঙ্কের নিন্দা করে লিখতে থাকেন।
এখানে উল্লেখ্য, বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের অত্যাচার একটা সময়ে অস্বাভাবিক অবস্থায় পৌঁছেছিল। সম্ভবত তারই ফলশ্রুতি পীঠস্থানের বুদ্ধরূপ ভৈরব মূর্তি। মতান্তরে তৎকালীন হিন্দুসমাজ বুদ্ধদেব কে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে পূজার্চনা করা শুরু করে দিয়েছিল। তারই ফলশ্রুতি পীঠস্থানের ভৈরব বুদ্ধদেব।
ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়ের মতানুযায়ী খ্রীঃপূঃ ৪০০ বছর থেকে একান্ন পীঠের অন্যতম (মতান্তরে উপপীঠ) এবং মুর্শিদাবাদ জেলাস্থিত একমাত্র পীঠস্থান কিরীটেশ্বরীর মাহাত্ম্য বিস্তৃতি লাভ করে। এখানে দেবীর কিরীট অর্থাৎ মুকুটের অংশ পড়েছিল বলে কথিত। কারো কারো মতে সতীর দেহাংশ পড়েনি বলে কিরীটেশ্বরী উপপীঠ হিসাবে পরিগণিত হয়ে থাকে। রেনেলের তৈরি কাশিমবাজার দ্বীপের ম্যাপে টিরেটকোনা নামক যে জনপদের উল্লেখ আছে, সেই টিরেটকোনা গ্রামই আসলে কিরীটকণা, দেবীর কিরীট থেকে যে নামের সৃষ্টি। তন্ত্রচূড়ামণির মতানুসারে কিরীটপাতের কারণে কিরীটকণা মহাপীঠ এবং দেবী বিমলা ও ভৈরব সম্বর্ত্ত।
ভুবনেশী সিন্ধ্রিরূপা কিরীটস্থা কিরীটতঃ।
দেবতা বিমলানাম্নী সম্বর্ত্তো ভৈরবস্তথা।
মহানীলতন্ত্রে দেবী কিরীটেশ্বরী নামে সুস্পষ্ট ভাবে উল্লিখিত হয়েছেন।
কালীঘট্টে গুহ্যকালী কিরীটে চ মহেশ্বরী।
কিরীটেশ্বরী মহাদেবী লিঙ্গাখ্যে লিঙ্গবাহিনী।
দেবীগীতায় অবশ্য দেবী কে মুকুটেশ্বরী নামে অভহিত করা হয়েছে।
কুরণ্ডলে ত্রিসন্ধ্যা স্যান্মাকোটে মুকুটেশ্বরী,
তৎকালীন নথি তে ভবানী থান নামে এই মন্দির কে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সময় এই জায়গা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। বঙ্গাধিকারী মহাশয়গণ ছিলেন ভবানী থানের দেখভালের দায়িত্বে। পরবর্তীতে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে বঙ্গাধিকারীগন জায়গীর প্রাপ্ত হন, যার মধ্যে ভবানী থানেরও উল্লেখ আছে। বঙ্গাধিকারী দর্পনারায়ণ জঙ্গলাকীর্ণ ভগ্নপ্রায় ভবানী থানের সংস্কার করে তার হৃত বৈভব ফেরানোর চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে রাজা রাজবল্লভ সেখানে তিনটি শিবমন্দির স্থাপন করেন এবং পুষ্করিণী খনন করেন। নাটোরের রাজা রামকৃষ্ণ রায় এখানে সাধনা করতেন, যার চিহ্ন আজও বিদ্যমান।
পরিশেষে আসি সম্বর্ত্তের কথায়। বর্তমানে সম্বর্ত্তের মূর্তি কিরীটেশ্বরী তে নেই। কথিত আছে বর্গী হামলার সময় কিরীট ও সম্বর্ত্ত কে লুকিয়ে ফেলা হয়। পরবর্তীতে কিরীট পুণঃপ্রতিষ্ঠা করলেও সম্বর্ত্ত কে ফিরিয়ে আনা হয়নি। বর্গীহানা কে ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় গল্প কথা বলে উল্লেখ করে বলেন, রাজা রাজবল্লভ ও তাঁর সকল পুত্র কে মীরকাশেমের আদেশে যখন মুঙ্গেরে গঙ্গাগর্ভে নিক্ষেপ করা হয়, তখন বিগ্রহ সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এই বিষয়ে প্রামাণ্য কোন নথি না থাকায় আমরা ধরে নিতে পারি যে বিগ্রহের ওপর হামলার ভয়ে তা সরিয়ে ফেলা হয়।
অদ্ভুত ভাবে দেবীর ভৈরব সম্বর্ত্ত ধ্যানীবুদ্ধ। যে কোনো পীঠস্থানের ভৈরব চারিহস্তে বিদ্যমান। একমাত্র পালযুগে প্রতিষ্ঠিত বটুকভৈরব দ্বিহস্ত হলেও শূল ও দণ্ডধারী। তাই, সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয় যে এই সম্বর্ত্ত মূর্তি পাল বংশীয় রাজা, যারা দীর্ঘকাল এই অঞ্চলে রাজত্ব করেছেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠিত, না বঙ্গাধিকারী দর্পনারায়ণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। যেহেতু, তৎকালীন হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞগণ বুদ্ধদেব কে বিষ্ণুর অন্যতম অবতার হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, সেহেতু বঙ্গাধিকারীগণ সম্বর্ত্ত মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে থাকতেই পারেন। বঙ্গাধিকারীগণের শ্রী লোপপ্রাপ্ত হওয়ায় নাটোরের রাজা রামকৃষ্ণ রায় কিরীটেশ্বরী মন্দির সংস্কার করেন। পরবর্তীতে কাশিমবাজারের দানশীল মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী এই মন্দিরের সংস্কার করেন।
বর্তমানে তিনটি ভিন্ন মন্দির কিরীটেশ্বরী মন্দির বলে দাবী করে থাকে। বর্গী হামলা অথবা মীরকাশেমের ভয়ে বিগ্রহ স্থানান্তরের পরে ভৈরব অন্তরালেই রয়ে গেলেও কিরীট পুণঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু, তা গুপ্তমন্দিরেই করা হয় বা অন্যত্র করা হয়, এ বিষয়ে কোনো প্রামাণ্য নথি না থাকায় পুণ্যলোভাতুর ভক্তকুল বিভ্রান্ত হয়ে তিন জায়গায় পূজা দিতে বাধ্য হন। বর্তমানে উদ্যোগী কিছু মানুষের পরিশ্রমে ও সদিচ্ছায় ভগ্নপ্রায় মন্দিরগুলির সংস্কার হচ্ছে, এটুকুই সুখের কথা।
তথ্যসুত্রঃ
রাজবাড়িডাঙ্গা ১৯৬২ ~ সুধীর রঞ্জন দাস
ভারত ও ইন্দোচীন ~ প্রবোধচন্দ্র বাগচী
মহানাবিক বুদ্ধগুপ্ত ~ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
মুর্শিদাবাদের ইতিহাস ~ নিখিলনাথ রায়
*****************************************************
প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচিতিঃ
ফরিদপুর কাউলিপাড়ার শেষ জমিদার নন্দমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বংশের বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধি প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ও নিবাস ইতিহাস প্রসিদ্ধ মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে। ১৯৬৫-তে তাঁর জন্ম হয় ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পরিবেশে এমন এক পরিবারে, যেখানে ভারতবিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞদের যাতায়াত ছিলো অবারিত। কৈশোরে কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্যানুরাগের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে জেলার ইতিহাস নিয়ে গবেষণামূলক কাজে নিজেকে জড়িয়েছেন। বাড়িতে সঙ্গীতাবহে বড় হয়ে ওঠায় সঙ্গীতের প্রতি প্রসেনজিৎ যথেষ্ট অনুরক্ত। ব্যাঙ্ক কর্মচারীর গুরুদায়িত্ব সামলিয়েও তিনি ইতিহাস,সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রতি তাঁর অনুরাগ যে এতোটুকুও নষ্ট হতে দেননি,তার প্রমাণ তাঁর এই প্রবন্ধ।
গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।
লেখা পড়ে – সম্বৃদ্ধ হলাম ৷
সমৃদ্ধ হলাম। তথ্য নির্ভর লেখনী। প্রসেনজিৎ বন্দোপাধ্যায় একজন গুণী ব্যক্তিত্ব, সেটা তার ক্ষুরধার লেখার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। উনাকে আমার সশ্রদ্ধ সম্মান জানাই।
বিশেষ সম্বৃদ্ধ হলাম এতো সুন্দর তথ্য সম্বল রচনা পড়ে। ভবিষ্যতে এরকম আরও পাওয়া র অপেক্ষায় রইলাম।
বহু অজানা তথ্য জানলাম।সত্যি এক কথায় অসাধারণ লেখা।
অসাধরন হয়েছে।। অনেক পুরনো তথ্য জানতে পারলাম।। খুব ভালোলাগলো।।