অবশেষে
জলি চক্রবর্তী শীল
‘চলো এবার বিয়েটা করে ফেলা যাক‘| অমিত্র ঘাসের ওপর শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে কথাগুলো বলে।
ডিসেম্বরের শেষ বিকেলের আলো তখন নিভু নিভু হয়ে আসছে| সামনের ঝিলের জলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ায় তিরতিরে ঠান্ডা মাঝে মাঝেই তীব্রভাবে অনুভুত হচ্ছে| একটা বছর যেন তালেগোলে কিভাবে কেটে যেতে চলল‚ আর কটা দিন পরেই শেষ হবে অভিশপ্ত বিষে বিশ বছরটি| যদিও করোনা আবহ পুরোপুরি কাটেনি‚ তবু পার্কের ভিতরের ভিড় দেখে কে বলবে যে এখনো চারিদিকে বিধিনিষেধ বহাল? মাস্ক ছাড়া পার্কে প্রবেশ নিষেধ ঠিকই‚ তবে পার্কে প্রবেশের পর অনেকের মুখেই মাস্কের বালাই নেই| সুপ্তি আজ দ্বিতীয়বার এই পার্কে এল অমিত্রর আহ্বানে সাড়া দিয়ে| এর আগে এসেছিল প্রিয় বান্ধবী রিঙ্কার সাথে| উত্তরাখন্ডে অমিত্র একটি কোম্পানীতে কাজ করে| দিনকয়েকের জন্য কলকাতায় এসেছে| উঠেছে রিঙ্কার বাড়িতে| রিঙ্কার বরের বন্ধু| ভিড় এড়িয়ে ওরা একটা ফাঁকা জায়গাতেই বসেছিল| হঠাৎ করেই অমিত্রর প্রস্তাবে একটু অবাকই হয় সুপ্তি| বছর দুয়েক আগে অমিত্রর সাথে পরিচয় হলেও‚ সুপ্তি বরাবরই এড়িয়ে গেছে অমিত্রকে| এর আগেও একাধিকবার অমিত্র ফোন করেছে‚ দেখা করতে চেয়েছে‚ সুপ্তি কৌশলে এড়িয়ে গেছে| না হলে‚ একটা মেয়ে খুব ভালো করেই জানে একটা ছেলে কি উদ্দেশ্য নিয়ে বারবার দেখা করতে চায়‚ কথা বলতে চায়| আজকেও আসত না যদি না তার প্রিয় বান্ধবী তাকে জোর করে এখানে আসতে বাধ্য করত।
সুপ্তি জানে আর পাঁচটা মেয়ের মত তার জীবনটা নয়‚ কোনদিন ছিল না| ছাব্বিশটা বসন্ত সে পার করে ফেলেছে| একটু একটু করে শীতের জড়তা তার শরীরে ভর করছে| আশেপাশের বাড়ি থেকে প্রায় দিন কেউ না কেউ প্রশ্ন করে সুপ্তির মা অপর্ণাকে‚ ‘কি গো এবার মেয়ের বিয়ে দাও‚ বয়স তো হল|’ অপর্ণা কখনও এড়িয়ে যায়‚ কখনও বলে‚ ‘ এই দেব‘| কিন্তু সুপ্তি জানে বিয়েটা যদি হয় সেটা অমিত্রর সাথে হবে না আর যার সাথে হবে তাকে সে ঘৃণা করে| অমিত্রর সাথে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখা| প্রেম বলতে যা বোঝায় মোটেই সেই সম্পর্ক এখন গড়ে ওঠেনি| তাই এর মধ্যেই অমিত্রর প্রস্তাব সুপ্তিকে একটু অবাকই করে| আবার একটা ভালো লাগাও ছুঁয়ে যায়|
‘প্রস্তাবটা কি মনপসন্দ হল না?’ সুপ্তির কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে অমিত্র সোজা হয়ে বসে প্রশ্নটা করে|
‘তোমার সাথে আমার সম্পর্ক এমন নয় যে তুমি বিয়ের প্রস্তাব দিলেই আমাকে সেটা পছন্দ করতে হবে?’
‘যেদিন তোমাকে প্রথম দেখি সেদিনই তোমাকে আমার ভালো লেগেছিল| তারপর কতবার তোমাকে জানাতে চেয়েছি‚ দেখা করতে চেয়েছি| কিন্তু তুমি সেই সুযোগ দাওনি| তাই আজ বলেই ফেললাম| উইল ইউ ম্যারি মী?’
‘তোমাকে আমার পছন্দ কিনা সেটা জানলে না‚ সোজাসুজি বিয়ের প্রস্তাব রাখছ?’ স্মিত হেসে প্রশ্ন করে সুপ্তি|
‘অপছন্দ করার মত আমার কিছু আছে বলেই আমি মনে করি না| আমি টল‚ ডার্ক‚ হ্যান্ডসম‚ রোজগেরে পুরুষ| নিজের দায়িত্ব নিতে জানি‚ যাকে বিয়ে করতে চাই‚ মানে তোমাকে তোমার যাবতীয় দায়িত্ব আমি নিতে চাই| তাহলে আমাকে অপছন্দ করার কোন কারণ তোমার আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না|’
‘এটাকে ওভার কনফিডেন্স বলে অমিত্র| নিজের সম্পর্কে এত উচ্চধারণা তোমার থাকতেই পারে‚ তাতে আমার কোন সমস্যা নেই‚ কিন্তু তার মানে এই নয় তোমাকে আমি পছন্দ করব?’
‘তার মানে আমাকে তোমার পছন্দ নয়‘| একটু দমে যায় অমিত্র|
‘চল‚ উঠি| সন্ধে হয়ে গেছে| বাড়ি ফিরতে হবে‘| সুপ্তি এড়িয়ে যায় অমিত্রর প্রশ্ন|
‘বেশ চল| একটা কথা‚ আমি কিন্তু আশাবাদী| তোমার যেটা আমার ওভার কনফিডেন্স মনে হচ্ছে‚ সেটা আমার বিশ্বাস| আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস‚ আমার ডাকে সাড়া তুমি দেবেই| আর সেদিন আমি আবার প্রস্তাব রাখব‚ উইল ইউ ম্যারি মী?’
…
নিজের ভিতরে একটা টানাপোড়েন চলছে অহরহ সেটা টের পাচ্ছে সুপ্তি| অকারণেই রেগে উঠছে| আবার কখনও কখনও চোখের ভিতর কড়কড় করে উঠছে‚ কখনও মনখারাপ লাগছে| এসবের সঠিক কারণটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না সে| তবে এসব কিছুই ঘটছে অমিত্রর সাথে সেদিনের সন্ধেটা কাটাবার পর| রিঙ্কা তো জানত‚ তাও কেন যে অমিত্রর সাথে দেখা করতে বাধ্য করল ! অন্যমনস্ক হয়ে যায় সুপ্তি|
অপর্ণা সব দেখে‚ সব বোঝে‚ মা তো| সেও চায় সুপ্তির একটা সুন্দর সংসার হোক| কিন্তু সেটা এত সহজ নয়| কিছু একটা পথ তাকে বার করতেই হবে| কিছু একটা তাকে ব্যবস্থা করতেই হবে| এইভাবে মেয়েটাকে চোখের সামনে তিলে তিলে শেষ হতে দেখতে পারবে না সে|
‘বলছিলাম কি‚ অমিত্রকে একবার বাড়িতে ডাকলে হয় না?’
‘বাড়িতে ডেকে কি হবে?’
‘ছেলেটাকে তো তোর পছন্দ হয়েছে| সোজা–সাপ্টা কথা বলে যখন ওর সাথে সোজাসাপ্টা কথাই বলব‘|
‘কি জানাবে মা? যে আমাকে এনক্যাশ করেই তোমার সংসার চলে? এসব শোনার পর কেউ আমায় বিয়ে করবে বলে তোমার মনে হয়?’
এমনভাবে কথাগুলো বলছিস যেন তোকে আমি গর্হিত কোন ব্যবসার সাথে যুক্ত করেছি?’ অপর্ণা ছিটকে যায়| বড্ড রূঢ় হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা|
‘গর্হিত নয়? যে লোকটাকে আমি পছন্দই করি না‚ আমার প্রায় বাবার বয়সী‚ সেই লোকটা তোমার কাছে ঘুরঘুর করে আমাকে বিয়ে করবে বলে| আর লোকটাকে তুমি প্রশয়ও দাও| কেন দাও মা? টাকার জন্য‚ আমি কি সেসব কিছু জানি না ভেবেছ? ঐ লোকটার ছুঁড়ে দেওয়া অর্থেই কি চলে না আমাদের সংসার? এর চেয়ে আমার মরে যাওয়াই অনেক ভালো মা| এতদিন অমিত্র বলে কেউ ছিল না জীবনে‚ আমি চাইওনি এমন কেউ থাকুক| কিন্তু এখন আছে| মা, আমি কি করব মা?’
স্তব্ধ হয়ে যায় অপর্ণা| সত্যি তো কি করবে তারা?
‘আমার কোন আশা–আকাঙ্ক্ষা থাকতে নেই মা| আমার কাউকে ভালোবাসতে নেই মা। আমি এই পাঁকেই আজীবন পড়ে থাকতে থাকতেই একদিন দেখবে মরে গেছি|’ কাঁদতে থাকে সুপ্তি| অপর্ণা সরে আসে|
এ অদ্ভুত যাপন তাদের| কিন্তু আর না এই যূপকাষ্ঠে আর বলি হতে দেবে না মেয়েটাকে| এখনও খুব একটা কিছু ক্ষতি হয়নি| এখনও সামলে ওঠা যাবে| ঐ লোকটাকে আর বরদাস্ত নয়| এবার সত্যি সত্যি বেরিয়ে আসতে হবে ঐ লোকটার নোংরা মানসিকতা থেকে|
….ফোনটা সমানে রিং হয়ে যাচ্ছে| এই নিয়ে বেশ কবার সকাল থেকে রিং করল অপর্ণা| কিন্তু ওপ্রান্তে ফোনটা ক্রমাগত বেজে বেজে থেমে যাচ্ছে| আজকে কথা বলতেই হবে| অপর্ণা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে| অনেক হল আর না‚ এবার হয় এসপার নয় ওসপার| মেয়েটাকে বাঁচাতেই হবে| অপর্ণা নিজের যোগ্যতানুযায়ী একটা কাজ খুঁজে নিয়েছে| একটা পেট ঠিক চলে যাবে| আফশোস এতদিন কেন নিজে চেষ্টা করেনি? তাহলে হয়ত অনেক আগেই ঐ ঘৃণ্য লোকটার খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসা যেত! এক বিবাহিত পুরুষকে ভালোবেসে পালিয়ে মন্দিরে বিয়ে সেরেছিল| তারপর জীবন গড়িয়েছে জীবনের রীতিতে‚ একসময় হারিয়ে গেছে অপর্ণার আকর্ষণ লোকটার কাছে| তারপর একদিন ছেড়ে চলে গেছে লোকটা| এমন একটা সন্ধিক্ষনে পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল অতুল বিশ্বাস‚ ঐ লোকটারই বন্ধু|অতুল বিশ্বাসকে অন্যরকমভাবে চিনত অপর্ণা| ভদ্র–সভ্য একজন ভালোমানুষ| অযাচিত আত্মীয়ের মত যেখানেই জল পড়েছে‚ সেখানেই ছাতা ধরেছে অতুল বিশ্বাস| অপর্ণার কোন রোজগার ছিল না‚ কি করে সংসার চালাবে‚ ঘরভাড়া দেবে‚ কি করে মেয়েটাকে মানুষ করবে ভেবেই আকুল হয়ে উঠেছিল| অতুল বিশ্বাস নিকট আত্মীয়ের মত পাশে দাঁড়িয়ে সব সামলেছে| কেন করছেন উনি এত? এ প্রশ্ন মনে স্থান যে পায়নি তা নয়‚ কিন্তু প্রয়োজনটাও তো অস্বীকার করতে পারেনি অপর্ণা| নিজেরও তখন অল্প বয়স আর মেয়েটা তখনো কৈশোর পার করেনি| চারিদিকে লোভীমানুষের মাঝে নিজেরাও সুরক্ষিত ছিল ঐ অতুল বিশ্বাসের জন্যই| একটু একটু করে জিতে নিয়েছে অপর্ণার আস্থা| অপর্ণার মনে হয়েছিল মানুষটা দেবতা| দেবতার পায়ে সবকিছুর বিনিময়ে নিজেকে অঞ্জলি দিতেও কুন্ঠাবোধ ছিল না তার| কিন্তু অপর্ণা নয়‚ সুপ্তি ছিল লোকটার টার্গেট| সুপ্তি যত বড় হয়েছে লোকটার লোলুপতা তত প্রকট হয়েছে| সোজাসুজি একদিন প্রস্তাবও পেরেছে সুপ্তিকে বিয়ে করার| মা হয়ে কি করে তা হতে দিতে পারে অপর্ণা? কৃতজ্ঞতানামক যূপকাষ্ঠে বাধ্য হয়ে কি বলি দিতে হবে মেয়েটাকে? লোকটার কাছ থেকে হাত পেতে এতদিন নানা সাহায্য নিয়েছে অপর্ণা| কিন্তু এখন নিতে ঘৃণা হয়‚ এখন কেমন যেন লোলুপ দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকায়‚ যেন সমগ্র দৃষ্টি দিয়ে চাটছে মেয়েটার সর্বাঙ্গ| আর সেই লোলুপতার বিনিময়ে দিচ্ছে টাকা| মেয়েটা সংকুচিত হয়ে থাকে লোকটা এলে|না‚ আর নয়‚ এবার সব শেষ করবে অপর্ণা|
আবার নাম্বারটা রিং করে অপর্ণা| রিং হয়ে যাচ্ছে| ‘অমিত্র ফোনটা তোলো‘‚ মনে মনে বলে অপর্ণা|
‘হ্যালো‚ কে বলছেন?’
‘তুমি কি অমিত্র বলছ?’
‘অমিত্রই বলছি‚ কিন্তু আপনি কে?’
‘আমি সুপ্তির মা| তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার| একবার দেখা করতে পার আমার সাথে?’
‘আমি আসলে রুমে ছিলাম না| আপনি অনেকগুলো কল করেছেন আমি দেখলাম| ভাবছিলাম আপনাকে কল করব‚ তার আগেই আপনি কল করলেন| কোথায়‚ কখন আসব আপনি বলুন আন্টি‚আমি পৌঁছে যাব|’
‘দেখ অমিত্র‚ সরাসরি বলছি‚ বাড়িতে কথা বলার অসুবিধে আছে| তাই তুমি বিকেল চারটে নাগাদ গঙ্গার ঘাটের কাছে পলাশবাগানে চলে এসো| ওখানে আমরা কথা বলতে পারি|’
‘সুপ্তি থাকবে তো?’
‘সুপ্তি থাকবে না‚ কিন্তু সুপ্তিকে নিয়ে তোমার ভাবনার আভাস আমায় সুপ্তি দিয়েছে| সেই সব নিয়েই কথা আছে|’
‘কিন্তু আন্টি..’
‘আমি জানি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন ‚ সেগুলোর জবাব তুমি পাবে| চলে এসো সময় মত| আমি এখন ছাড়লাম|’ অপর্ণা ফোনটা কেটে দেয়| মনে মনে নিজেকে আরও একবার তৈরি করে নেয়| অপেক্ষা করতে থাকে কখন চারটে বাজবে|
…
দিনের আলো মরে এসেছে| লাল টমেটোর মত সূর্যটা আকাশের কোণায় কোণায় রঙ ভরে দিয়ে একটু একটু করে ডুবে যাবার জন্য তৈরি হয়েছে| গঙ্গার জলেও সেই আলোর প্রতিবিম্ব| ঝুপ করে ডুবে যাবে সময় না দিয়ে| এই মুহুর্তটা যেমন মোহময় তেমনি মনখারাপী| একটা বিনবিনে কান্না যেন ভিতরে পাক দিয়ে ঘোরে| ঘাটের ইতিউতি লোক ছড়িয়ে|
‘আন্টি‘?
‘তোমাকে সবকিছু খুলে বললাম অমিত্র‚ এবার সিদ্ধান্ত তুমি নেবে|’
‘সুপ্তি রাজী থাকলে আজই আমরা বিয়ে করতে পারি| উইল ইউ ম্যারি মী?’
অপর্ণা না চাইলেও অমিত্র সুপ্তিকে খবর দিয়েছিল তার মা দেখা করতে চেয়েছে| সুপ্তি সেই খবর পেয়েই চলে এসেছে|
‘এত কিছুর জানার পরও তুমি আমায় বিয়ে করতে চাও অমিত্র?’ সুপ্তির চোখের জল গড়িয়ে পড়ে|
‘হ্যাঁ চাই সুপ্তি| যেদিন তোমায় প্রথম দেখেছিলাম সেদিন তোমায় ভালো লেগেছিল| সেখান থেকেই বলতে পার একটু একটু করে তোমাকে ভালোবাসা| সেদিন তোমার সম্পর্কে কিছু জানতাম না‚ সেদিনই ডিসিশন নিয়েছিলাম বিয়ে করলে তোমাকেই বিয়ে করব| আজ জানি| তাতেও আমার ডিসিশন বদলাবে না|’
‘আর তোমার বাড়ির লোকজন?’
‘এ জগতে আমার নিজের বলতে কেউ নেই| একটা অ্যাকসিডেন্টে ছোটবেলাতেই বাবা–মা দুজনেই মারা যায়| একটা অনাথালয়ে আমি বড় হই| পড়াশোনায় ভালো ছিলাম তাই পাশ করে একটা চাকুরী জোটাতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি| ইদানীং খুব একাকীত্বে ভুগি‚ নিজের কথা বলার মত কাউকে পাই না| তুমি কি সেই জায়গাটা পূরণ করবে সুপ্তি? উইল য়্যু ম্যারি মী?
‘ইয়েস‚ আই উইল|’ ফিসফিস করে বলে সুপ্তি| আলোছায়া অন্ধকারে আকাশের বুক থেকে ক্রমশ মুছে যাওয়া সিঁদুরে রঙের আভায় লজ্জারুণ হয়ে ওঠে সুপ্তি| ঝুপ করে চরাচর জুড়ে নেমে আসে অন্ধকার| একটা একটা করে রোড লাইট জ্বলে ওঠে‚ কাছেই একটা মন্দিরে তখন উচ্চারিত হচ্ছে বিয়ের মন্ত্র ‚ ‘ যদিদং হৃদয়ং মম‚ তদস্তু হৃদয়ং তব‘|
অপর্ণা এগিয়ে এসে দুজনের হাতের ওপর হাত রেখে বলে‚ ‘অমিত্র নিয়ে যাও সুপ্তিকে| বিয়ে করে সুখী হও তোমরা|আজই রওনা হয়ে যাও|
‘কিন্তু মা…’
‘কোন কিন্তু নয়‚ এস তোমরা‘| আদেশের সুরে বলে অপর্ণা ধীর গতিতে এগিয়ে যায় গঙ্গার ঘাটের দিকে| আলোকিত ঘাটে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে থাকা মন্দিরে তখন সন্ধ্যারতি চলছে| হয়তো প্রতারণা হয়ে গেল‚ তবু প্রাণ থাকতে মেয়েটাকে অতুল বিশ্বাসের হাতে তুলে দিতে পারবে না| একবার পিছন ফিরে তাকায়| না‚ নেই ওরা চলে গেছে| অপর্ণাও চলে যাবে নতুন কাজটা নিয়ে অনেক দূরে| ব্যাগ থেকে দুটো মোবাইল বার করে একটা সুপ্তির একটা নিজের| সুপ্তি হয়ত খুঁজছে ওর মোবাইলটা| অমিত্র না হয় নতুন একটা কিনে দেবে| দুটো মোবাইলই অন্ধকারমত একটা জায়গা থেকে গঙ্গার জলে বিসর্জণ দিয়ে পার থেকে উঠে আসে| সিমকার্ডগুলো আগেই খুলে নিয়েছিল| এবার ওগুলোকে মুচড়ে ভেঙ্গে ফেলে| বেশ ভারমুক্ত লাগে নিজেকে| কেউ আর খুঁজে পাবে না তাদের| কারও সাথে আর যোগাযোগ রাখবে না সে| একটা লঞ্চ ঘাটে এসে দাঁড়ালো| সোজা হাওড়া যাবে ওতে চড়ে তারপর ট্রেন ধরে অনেক দূরে যেতে হবে তাকে|
**************************************************
জলি চক্রবর্তী শীল পরিচিতিঃ
পেশাগতভাবে একজন কম্পিউটার অপারেটর একটি সওদাগরী আপিসে। নেশা বই পড়া এবং কিছু লিখতে চেষ্টা করা। জলির লিখতে ভালো লাগে সেইসব প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে, জীবন যাদের কাছে প্রাত্যহিক লড়াইয়ের নাম। এক টুকরো রুটি বা এক থালা ভাতের কদর যেখানে সবচেয়ে বেশি সেইসব মানুষদের সুখ–দুঃখ–বেদনা–ভালোবাসার দৈনন্দিন গাঁথাই জলির লেখার উপজীব্য।