আত্মজ
ব্রতী ঘোষ
পাশের ফ্ল্যাট থেকে মাঝেমধ্যেই হাসির শব্দ ভেসে আসছে ৷ মায়া বসে আছে প্রতিমা দেবীর মাথার কাছে ৷ মাঝে মাঝে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ৷ “তুমি কাঁদছো ?”
“নারে মা !! বয়স হলে এমনিতেই চোখ দিয়ে জল পড়ে ৷”
মায়া বুঝতে পারে এই চোখের জলের কারণ ৷ আজ মাসিমার ছোট ছেলের জন্মদিন ৷ থাকে পাশের ফ্ল্যাটেই ৷ লোকজনের হাসি হুল্লোড়ের শব্দ ভেসে আসছে সেই সন্ধ্যে থেকে ৷ মুখে না বললে কি হবে মায়া জানে মাসিমা সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করে আছে কখন তার ছোট ছেলে আসবে মার সাথে দেখা করতে !!
আজ বছর চারেক হল মায়া প্রতিমাদেবীকে দেখাশোনার কাজ নিয়েছে ৷ সপ্তাহে এক দিন শনিবার সন্ধ্যা বেলা বাড়ি যায় আবার রোববার সকালেই ফিরে আসে ৷
“মায়া হাতটা একটু ধর তো !!”
মায়া সাবধানে হাতটা ধরে আরামকেদারায় বসিয়ে দেয় ৷
“জানিস !! যখন তোর মেসোমশাইয়ের সংসারে আমি আসি তখন আমার মাত্র ঊনিশ বছর বয়স ৷ সেই ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে পাঁচটা ভাই-বোনকে বুকে করে মানুষ করেছি ৷ তোর মেসোমশাই দেড়শ টাকা মাইনে পেত ৷ এখানে এসে দেখি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে মাতৃহারা ছোট ছোট দেওর ননদ গুলো ৷ ওদেরকেও নিজের সন্তানের মতই মানুষ করেছি ৷ আমি ছিলাম ওদের কাছে কখনো মা কখনো বৌদি কখনো বন্ধু ৷ তারপর একে একে দেওর ননদ দের বিয়ে দিয়েছি ৷ ওই কটা টাকা দিয়ে কিভাবে যে চালাতাম তা আমি ই জানি ৷ এরপর তোর দাদারা হল দিদি হলো, দেখতে দেখতে ওরা ও বড় হয়ে গেল ৷ অনেক চেষ্টা করেওআমি মেয়েটার জীবনে শান্তি এনে দিতে পারিনি ৷ জীবনের উপর অনেক অভিমান নিয়ে ও চলে গেল, যেন বলে গেল তুমি আমাকে এত তাড়াতাড়ি তোমার স্নেহচ্ছায়া থেকে সরিয়ে সংসার-সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে তাই আমিও তোমাকে ফেলে চলে যাচ্ছি ৷ তুমি থাকো একা ৷ ঠিক বলেছিস রে মা !! আজ আমি একা ৷ আমি একা বসে আছি এত বড় বাড়িতে ৷ ছেলে, ছেলের বউ নাতি-নাতনি সবাই আছে আমার !! কিন্তু দেখ্ আমি কিন্তু একা ৷ আমার ছেলের জন্মদিন অথচ সারাটা দিন একবারও আমার সাথে দেখা করার সময় পায় না ৷ সবাই তাকে শুভেচ্ছা জানাতে আসছে অথচ ওর মার কথা একবারও মনে পড়ে না ৷”
এই কথাগুলো মায়া রোজ একবার করে শোনে ৷
“প্রত্যেকটা মানুষের জীবন ই বোধহয় এক একটা গল্প ৷ সেই গল্পের শুরু আছে কিন্তু শুধু শেষটা যে কিভাবে হবে জানা নেই ৷ সারাটা জীবন সংসারের ঘানি ঠেলতে ঠেলতে নিজের সমস্ত ইচ্ছে অনিচ্ছে গুলোকে নিজের হাতে গলা টিপে মেরে ফেলতে ফেলতে আজ জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে কি দিতে পেরেছি জীবনকে ? কতটুকুই বা ফেরত পেয়েছি ? জীবন ঘুরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসে, বলে এই আশাতেই তো সবাই ঘুরে মরে আমার পেছনে তুমি ই বা যাবে কোথায়?”
“কি হলো ? কি হলো ?” মায়া চিৎকার করে ওঠে ৷ বিছানায় ঢলে পড়েছেন প্রতিমাদেবী ৷
দিন দশেক পরের কথা ৷ কলিং বেল বেজে ওঠে ৷ মায়া বুঝতে পারে ওই বোধহয় ছোড়দা মাসিমাকে নিয়ে এলেন ৷ অ্যাম্বুলেন্সের স্ট্রেচারেই ওনাকে নিয়ে এলো ঘরের ভেতর ৷ প্রতিমাদেবী এসে থেকে তার সমস্ত দেখাশোনার কাজ মায়া একনাগাড়ে করে যায় ৷ নাহ!! কি শরীর হয়ে গেছে !! একেবারে যেন বিছানায় লেগে গেছেন ৷ মাসিমার দিকে তাকিয়ে মায়ার দুই চোখ ছল ছল করে ওঠে ৷ “মাসিমা ! ও মাসিমা !”
অনেক ডেকে ও মায়া যেন আগের মাসিমাকে আর খুঁজে পায় না ৷ কিন্তু জ্ঞান আছে পুরোদমে !! সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে ৷ তবে কি আর উনি বাঁচবেন না? ভাবতেই মায়ার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নামে ৷ বেশতো ভালোই ছিলেন ! হঠাৎ যে কি হলো ! আজ দিন দশেক বাদে নার্সিংহোম থেকে ছেড়েছে অথচ এখনো ভালোভাবে সেরে ওঠেননি তবে কি ছোট্দা জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে এলো ?
কেন জানিনা মাসিমাকে দেখলে মায়ার ওর মার কথা বড্ড মনে পড়ে ৷ ওর মা টা বড্ড কষ্ট করে ওদের দুই বোনকে মানুষ করেছিল ৷ কষ্ট করে পয়সা জমিয়ে ওর আর ওর বোনের বিয়ে দিয়েছিল ৷ বর টা ভালোই ছিল, কিন্তু মায়া ভাবে ওর কপালটাই খারাপ না হলে আর রাজমিস্ত্রির ভারা থেকে পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে আজ চার বছর ঘরে শুয়ে থাকে, সেই থেকে ও এবাড়িতে আয়ার কাজ করছে | কত গল্প ই যে করতেন মাসিমা, আর সেই গল্প করতে করতেই যেন চলে গেলেন !! মানুষটার সবাই আছে অথচ কেউ নেই ! এই বোধ হয় ভাগ্য ! যার এতগুলো ছেলে তাকে কিনা চোখের জল ফেলতে হয় একবার ছেলের মুখে মা ডাক শোনার জন্য ৷ মায়া ভাবে আজ যদি ওর মা থাকতো তবে ও কি পারতো এভাবে মাকে ভুলে থাকতে?দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নামে ৷ আজ তিন দাদা ই মাকে দেখতে উপস্থিত হয়েছেন বাড়িতে ৷ মাসিমা যদি আজ জানতে পারতেন যে তিন ছেলেই মাকে দেখতে এসেছে তিনি কি খুশিই না হতেন ৷
“বড়দা ! তুমি কত দেবে ? ”
তিন দাদার জন্য ই চা করে নিয়ে এসে মায়া ঘরে ঢোকে ৷
“তুমি টাকাটা আজ দেবে তো ?” প্রশ্ন করে ছোটদা ৷
“হ্যাঁ !! আমি যা দেবার দেব ৷ তবে তুই তো মাকে দেখাশোনা করিস ৷ টাকাপয়সার হিসেব তো তুই রাখিস। মা যে বাবার পেনশন পান সেটা দিয়ে তুই হসপিটালের বিলটা মিটিয়ে দে না !” চমকে তাকায় ছোটদা বড়দার দিকে ৷
“তুমি একথা বলতে পারলে ? মার ঐ সামান্য কটা পেনশনের টাকা – সে কি থাকে নাকি ? মায়ার মাইনে দিতেই তো চলে যায় ৷ ওর মাইনে দিয়ে যা থাকে তাই দিয়ে মার ওষুধপত্র কেনা হয় ৷ ঐ তো কটা টাকা !!”
“তাহলে দেখ মার কিছু গয়না গাটি আছে কিনা ? সেগুলো বিক্রি করেই এবার টা হসপিটালের বিলটা মিটিয়ে দে ৷”
“কি বলছিস তুই মেজদা ? গয়না বিক্রি করে মার চিকিৎসার বিল মেটাবো ?”
“তোর যখন এতই দরদ তুই দে না !! আমার দুই মেয়ে তাদের পড়াশোনা, ফ্ল্যাটের ই এম আই – আমার পক্ষে দশ হাজার টাকার বেশি দেওয়া সম্ভব নয় ৷”
“বড়দা তুমি কিছু বলো ৷”
আমি কুড়ি হাজার দিচ্ছি এর বেশি আমার পক্ষে সম্ভব না ৷”
তাহলে এক লাখের মধ্যে তোমরা দুজনে মিলে তিরিশ হাজার আর বাকি সত্তর হাজার আমার ?”
“তোকে তো প্রথমেই বলেছিলাম নার্সিংহোমে দিস না ৷ কোন সরকারী হাসপাতালে দে ৷ তুই শুনলি ?” বড়দার প্রশ্নের উত্তরে ছোটদা নির্বাক ৷ “তাছাড়া এই মাসে মায়ার এখনো মাইনে দেওয়া হয় নি ৷” – কোনরকমে বলে ছোটদা ৷
“সে কি ? আবার এটাও বাকি ! মায়াকে ছাড়িয়ে দে ৷ ওর মাইনে দেওয়া আর সম্ভব নয় ৷ মার ব্যাঙ্কের পাশবই টা বার কর ৷ যা টাকা আছে হসপিটালের বিলটা তো আগে চুকানো যাক ৷”
মায়া আর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না ৷ দু চোখ ভরা জল নিয়ে চলে আসে মাসীমার কাছে ৷”
“ও মাসি !! এ তোমার কেমন ছেলে গো সব !! তুমি আবার এদের জন্য চোখের জল ফেলতে ? এদের মানুষ করা নিয়ে গব্ব করতে ?”
আজ নার্সিংহোম থেকে আসা পর্যন্ত একটা কথা ও বলেননি প্রতিমাদেবী ৷ সকাল থেকে হেঁচকি উঠেই চলেছে ৷ মায়ার মনে কু ডাকে ৷ রাত একটা হবে ৷ বাড়িতে ও ছাড়া আর কেউ নেই ৷ টাকাপয়সার হিসেব করতে করতে যে যার বাড়ি চলে গেছেন দাদারা ৷ মাসিমার বিছানার পাশে ঠায় বসে থেকে কখন যেন দুচোখের পাতা লেগে এসেছে ৷ ঘরে টিউবলাইটা জ্বলছে ৷ হঠাৎ সমস্ত শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে কে যেন মায়াকে ডাকে ৷
“মায়া !!”
“হ্যাঁ মাসিমা !!”
“ওরা চলে গেছে ?”
“হ্যাঁ মাসিমা !! ওদের কাউকে ডাকবো ?” “জল দে ৷” – কাঁপা গলায় ক্ষীণ উত্তর আসে ৷
মায়া চামচ করে জল নিয়ে গালে দেয় ৷ “আমি আমার মেয়ের হাতে জল খেয়ে গেলাম,ওদের বলিস । তুই আমায় কথা দে”- একটি শীর্ণ হাত এগিয়ে আসে মায়ার দিকে ৷
“বলো মাসিমা!! বল !!”
“তুই ওদের বলবি আমার শ্রাদ্ধ যেন ওরা পয়সা খরচা করে না করে ৷ আমি ওদের দেওয়া জল খাব না ৷ তুই আমাকে জল দিবি ৷ কথা দে,কথা দে ৷” মায়া বুঝতে পারে আজ সন্ধ্যেবেলা দাদাদের কথা সবই মাসিমার কানে গেছে ৷
“কিন্তু মাসিমা ওরা যে তোমার ছেলে ৷”
“কথা দে” দু চোখ স্থির হয়ে যায় ৷
মায়া মাসিমার দুই হাত আঁকড়ে ধরে ৷ আস্তে আস্তে হাতটা খসে পড়ে বিছানায় ৷ এতক্ষণে খেয়াল হয় ছোট বৌদিকে ডাকতে হবে ৷ সকালবেলার আগে দাদারা আসবেন না ৷ সারাটা রাত মাসিমার পাশে বসে থাকে মায়া ৷ আর ভাবতে থাকে এই তাহলে মানুষের নিয়তি; যে ছেলেরা ওঁনার বুকের ধন তাদের কাছ থেকে মানুষটা শ্রাদ্ধের অধিকার কেড়ে নিলেন !! আর ওকে কিনা সে দায়িত্ব দিয়ে গেলেন ৷ ওকে মাসিমার এই শেষ ইচ্ছে পালন করতেই হবে, আজ যে দ্বিতীয়বার ও মাতৃহারা হলো ৷
ভোর হয় ৷ একে একে সব দাদারাই উপস্থিত হয় বাড়িতে ৷ ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনিরা সবাই উপস্থিত | সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে এই বুড়ি মানুষটা চলে যেতে ৷ পাড়ার লোকেরাও উপস্থিত ৷ স্নান করিয়ে শেষ যাত্রার জন্য তৈরি করিয়ে দেয় মায়া ৷ এখনো যে আসল কাজ টাই বাকি ৷ মাসিমাকে দেওয়া শেষ কথাগুলো এখনো বলা হয়নি | প্রতিমাদেবীর খাটের পাশে বসে মায়া বলে ,”ছোটদা !! মাসিমা তোমাদের শ্রাদ্ধ করতে মানা করে গেছে ৷ তোমাদের হাতে জল উনি খাবেন না, আমারে জল দিতে বলে গেছে ৷” বাড়িতে যেন সশব্দে বোমা ফাটে । আত্মীয় স্বজন কারো মুখে কোন কথা নেই ৷ দাদারা চেয়ে আছে ওর দিকে ৷ মায়ার গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ৷
“আমি পেরেছি মাসিমা! তোমার চোখের জলের দাম আমি দিতে পেরেছি ৷ যে কষ্ট তোমাকে তোমার ছেলেরা দিয়েছে তার শোধ আমি নিতে পেরেছি ৷ তুমি যেখানেই থাকো আমারে আশীর্বাদ করো, আমি যেন তোমার মুখে জল দিয়ে তোমার আত্মারে শান্তি দিতে পারি ৷”
****************************************************
ব্রতী ঘোষের পরিচিতি
জন্ম,পড়াশোনা সবই কলকাতায় ৷ তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা। সঙ্গীত অনুরাগী মানুষটি এখন ভালোবাসেন লিখতে ৷ এই পত্রিকাতেই তার লেখার পথ চলার শুরু।
বাহ্ বাস্তব উঠে এসেছে তোমার লেখনীর হাত ধরে❤️
চেষ্টা করছি ৷ তোমাদের উৎসাহ পেলে ভালো লাগে ❤️❤️
ক্রমশই ডালপালা মেলছে লেখনী।দারুন।লিখে যাও।
চেষ্টা করে যাচ্ছি সুরজিৎদা !!
খুব আন্তরিক লেখা।আর সংবেদনশীলও। আরো লেখো।
খুব ভালো লাগছে শ্রীপর্ণা ৷ উৎসাহিত হলাম ৷
আমার চোখে জল এসে গেল। এখনো জলে ভেজা চোখে আপনাকে লিখছি। এই বিষয়টা বহুলব্যবহৃত। কিন্ত আশ্চর্য হলাম যে আমার একবারও মনে হয়নি এটা কোনো বাঁধাধরা গতে লেখা। আপনার লেখার হাতের তারিফ না করে পারছি না। আপনার লেখার বাঁধুনি খুব ভালো। অনেক লিখুন। আমার শুভেচ্ছা জানাই, আরো যেন অনেক গল্প পড়তে পাই। আমার এক সতীর্থ শ্রীমতী চন্দ্রা মিতঁর ঘোষের সংগে আপনাদের আলাপ করিয়ে দেব। তিনি অত্যন্ত ভালো লেখিকা। নামী দামি পত্রিকায় অনেকবার লিখেছেন। তাঁর লেখা আপনাদের ভালো লাগবে।
খুব ভালো লাগছে শ্রীপর্ণা ৷ উৎসাহিত হলাম ৷
অনেক ধন্যবাদ দীপনবাবু 🙏🙏 ৷ আপনার সাথে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবো ৷