আম্মোর রুটি
বিদ্যুৎ পাল
গরমের রাত। ছোট্টো বারান্দার কোণে বসে রুটি তৈরি করছে মা। অন্ধকারে উনুনের লাল আলোয় ম্লান দেখাচ্ছে মায়ের মুখটা। এমন মুখ আম্মোর ভালো লাগে না। ও চায়, মা এই ঘরে, যেখানে ও বইখাতা ছড়িয়ে বসে আছে, এখানে, আলোর কাছাকাছি বসে রুটি করুক। ও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মাকে অনেক কথা বলবে। আজ বিকেলে কার সঙ্গে ভাব হয়েছে, কার সঙ্গে আড়ি হয়েছে, কার বাড়িতে ইয়া মোটা একজন লোক এসেছে, বলবে। অনেক কথা জিজ্ঞেস করবে। বাবা কখন আসবে, কাকু কখন আসবে, কাকুর বন্ধুরা আসবে কিনা। আম্মো বইখাতা ফেলে রেখে উঠে গেল মায়ের কাছে।
পাশে এসে বসে পড়া আম্মোর দিকে একবার তাকাল মা। তারপর আবার উনুনের দিকে নজর দিল। তাওয়া নামিয়ে রুটিটা চিমটে দিয়ে ধরে উনুনের ওপর রাখল। গোল হয়ে ফুলে উঠল রুটিটা, পাশের বাড়ির বাবুয়ার চোখের মত – ভালুক দেখে যেমন গোল হয়ে উঠেছিল সেদিন। রুটিটা এক জায়গায় ফুটো হয়ে ভুস ভুস করে ভাপ বেরুল। উনুনের আলোয় লাল হয়ে উঠল ভাপের নরম পুঞ্জটা – আম্মোর হাসি পেল। কাকু বলে কিনা, “আম্মো, ওই দ্যাখ, যাঃ, রুটির সব পুষ্টি বেরিয়ে গেল! ধর, ধর, মুঠো করে ধর গিয়ে!” ভাপ কি ধরা যায়? বরং রুটিটা মুঠো করে ধরা যায়। গুড় দিয়ে মুড়ে খেতে হলে – আম্মোর জিভে জল এল।
বলে উঠল, “আমি রুটি করব। মা ওর কথায় কান দিল না। আম্মো আবার বলল, “আমি রুটি করব!” বলে আটার দিকে হাত বাড়াল। মা হাত সরিয়ে দিল, “আটা মাগনা আসে?” “মাগনা মানে?” জিজ্ঞেস করল আম্মো। মা কাজ থামিয়ে ওর মুখের দিকে তাকাল, “জ্বালিয়ে খেলি!” আটার একটা ছোট্টো দলা হাতে দিয়ে বলল, “যা পালা, হাতি ঘোড়া গড় গিয়ে, পড়ার সঙ্গে সম্পর্ক নেই, শুধু কুবুদ্ধি।”
‘কুবুদ্ধি’ কথাটা দু’একবার মনে মনে আউড়ে মাথায় টুকে রাখল আম্মো … পরে ব্যবহার করবে। তার পর আটার দলাটা দুহাতের চেটোয় থাপড়াতে শুরু করল। এমনিতে রোজ সন্ধ্যেবেলা এটা হয়। আম্মো রুটি করতে চায় আর মা হাতে আটার দলা দিয়ে ভাগিয়ে দেয়। কিন্তু ঘোড়া গড়ে দেখেছে আম্মো, সে ঘোড়া দৌড়োয় না, লেজও নাড়ে না, চিহিঁহিঁও করে না। পাখি গড়ে দেখেছে, দু’হাতে ধরে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলে থপ করে মাটিতে পড়ে যায়। অথচ আকাশে কত রকম পাখি কত আওয়াজ করে উড়ে যায় … আম্মোর চোখের খুব কাছে এসে কাপড় মেলার তারটার ওপর বসে, তারটা থেকে টুপটাপ বর্ষার জল ঝরে পড়ে।
আম্মো বরং রুটি করবে। মাঝরাত্তিরে কাকুর বন্ধুরা বাড়ি ফেরার সময় ওদের বাড়িতে খেয়ে যায় কোনো কোনো দিন। গোগ্রাসে গেলে, রুটি কাড়াকাড়ি করে খায়। আম্মোর খুব ভালো লাগে কাকুর বন্ধুদের। অন্য যাদের কাছেই আম্মো যায়, সকলেই ওকে গাল টিপে আদর করে, কোলে নিয়ে মাখামাখি করে, লজেন্স দেয়। ওর বিচ্ছিরি লাগে, ও কি এখনো ছোটো আছে? চার বছর বয়স হতে চলল ওর!
অথচ কাকুর বন্ধুরা কিচ্ছু করে না। কাকুর বন্ধুরা বসে চেঁচিয়ে কথা বলে, বলতে বলতে হঠাৎ চারদিকে তাকায়, তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করে। বেশিক্ষণ না, আবার গলা চড়ে যায়। আম্মো খাটের ওপর কাকুর পাশ ঘেঁষে চুপ করে বসে থাকে, ওরা কেউ ভ্রুক্ষেপও করে না। নিজের মনে ওরা কথা বলে, আম্মো বড় মেয়ের মত মুখ গম্ভীর করে বসে শোনে। বোঝে না কিছুই, তবু নিজেকে বেশ বড়সড় গোছের মনে হয়। মাঝে মাঝে ওরা হেসে উঠলে আম্মোও খিলখিল করে হেসে ওঠে। বরুণকাকু, কাকুর বন্ধু হাসতে হাসতেই বলে, “ওটি আবার হাসছে কোন দুঃখে?” কাকু ওর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ধমক দেয়, “এ্যাই, তুই যা তো এখান থেকে!” আম্মো তবু গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে।
মা ঘরের ভিতরে গিয়েছিল কিছু বার করে আনতে। আম্মো সেই ফাঁকে মায়ের মত পিঁড়িতে বসে আটার দলাটায় শুকনো আটা মাখিয়ে চাকির ওপর রাখল। তারপর বেলনটা কোনো রকমে ছোটো ছোটো আঙুলে ধরে বেলবার চেষ্টা করল। রুটিটা গোল হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখা গেল না। মাঝখানে বেশি চাপ পড়াতে এত পাতলা হয়ে গেল যে আদ্ধেকটা বেলনের সাথে উঠে এল। বাকি আদ্ধেকটা পড়ে রইল চাকিতে। আম্মো দুটো অংশ একসাথে করে দলা পাকিয়ে গোল করল। ঠিক গোল হল না। আটায় ডুবিয়ে আবার চেষ্টা করল বেলতে।… কান্না পেল আম্মোর, কিছুতেই হচ্ছে না।
এমনি সময় পিছন থেকে মায়ের গলা পাওয়া গেল, “হয়েছে, হয়েছে, ওঠ্, আমায় কাজ সেরে নিতে দে।” আম্মো ঘাড় ফিরিয়ে অসহায়ভাবে মায়ের দিকে তাকাল। তবু ওঠার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। ওর অসহায় মুখ দেখে মায়ের হাসি পেল। মায়ের স্নেহময় হাসি। ওর পিছনে বসে পড়ে, ওর কাঁধের দুপাশ দিয়ে হাত নিয়ে গিয়ে মা আটার দলাটাকে আবার গোল্লা পাকাল। তারপর শুকনো আটা মাখিয়ে চাকিতে ঈষৎ চাপ দিয়ে রাখল। দলাটা চেপটে গেল আর তাতে মায়ের তিনটে আঙুলের ছাপ ফুটে উঠল। আম্মো লক্ষ্য করে দেখে নিল – রুটি করতে গেলে ওমনি তিন আঙুলের ছাপ পড়তে হবে। আম্মো বেলনটা আবার চেপে ধরে পেড়ার মত চ্যাপ্টা, গোল আটার দলাটার ওপর রাখল। মা ওর হাতের মুঠোর ওপর হাত মুঠো করে বেলনটা চালাতে চেষ্টা করল। আম্মোর হাত আড়ষ্ট – মুঠো শক্ত হয়ে থাকে। বেলনটা নড়তেই চায় না। মা বিরক্ত হয়ে বলল, “আহ, ঢিলে কর মুঠোটা!”
আস্তে আস্তে আলতো চাপে বেলনটা অল্প অল্প পাক খেতে খেতে সামনে পিছনে চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকল রুটিটা – যেন চাঁদ উঠছে। ভেজা ভেজা। ‘মায়ের হাতটা কী গরম!’ আম্মোর হাতে শিশুর রক্ত, স্বভাবতঃই চঞ্চল, উষ্ণ, তবু এতক্ষণের উত্তেজনায় ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। মায়ের হাত কাজ করতে করতে গরম হয়েছে! … আর মায়ের হাতের মধ্যে ওর হাতটাও ধীরে ধীরে গরম হয়ে মায়ের প্রাণে সাড়া জাগাল। মা ওর কানের কাছে চুমু খেল আলতো করে। রুটিটা বেলা হয়ে গেছে। মা উঠে পড়ল, “চুপটি করে বসে থাক্; আমি তরকারিগুলো ধুয়ে আসছি, তারপর সেঁকে দেব। উনুনে হাত দিবি না।” বলে চলে গেল।
আম্মোর তর সইছিল না। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আম্মো দুহাতে তাওয়ার হাতলটা চেপে ধরে কোনো রকমে উনুনে চাপাল। কিন্তু রুটিটা হাতের চেটোয় ওঠাতে গিয়ে এক জায়গায় টেনে লম্বাটে হয়ে গেল। মায়ের হাতের বড় পাঞ্জায় পুরো রুটিটা গোল ভাবে আসে। আম্মোর ছোটো পাঞ্জায় সেটা লেপটে গেল। কোনো রকমে ছাড়িয়ে তাওয়ায় রাখতে গিয়ে ছ্যাঁকা লাগল হাতে। “উফ” করে উঠল আম্মো। কলতলার দিকে আড়চোখে তাকাল। মা শুনতে পায় নি।
রুটিটার নরম ভেজা লালচে রঙ উত্তাপে ধীরে ধীরে সাদা, উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। মা কোনো কোনো দিন সাজলে পরে যেমন দেখায় – ভাবল আম্মো। মায়ের দেখাদেখি চিমটে দিয়ে ধরে রুটিটা উল্টোতে গিয়ে আবার খুবলে গেল চিমটের খোঁচায়। কোনো রকমে তাওয়া নামিয়ে রুটিটা চিমটে দিয়ে ধরে রাখল উনুনের গনগনে আঁচের ওপর। ধীরে রুটিটা গোল হয়ে ফুলে উঠছে …। আম্মোর বুকের কাছে ওই রুটির মতই কী যেন একটা ফুলে উঠে ওর ঠোঁট দুটোকে ফাঁক করে দিল। নিঃশব্দে দাঁত খিলখিলিয়ে হেসে উঠল আম্মো।
চিমটে দিয়ে ধরতে গিয়েই ফুটো হয়ে গেল রুটিটায়। ভুস ভুস করে ভাপ বেরুতে শুরু করল। তার সাথে ধুঁয়ো, রুটিটা পুড়তে শুরু করেছে। আম্মো চিমটা দিয়ে কিছুতেই ধরতে পারছে না … বার বার পিছলে যাচ্ছে। দপ করে আগুন ধরে গেল রুটিটায়, পুড়ে ছাই হয়ে গেল। অসহায় আম্মোর দম আটকে আসছিল পোড়া রুটির গন্ধে।
মা দৌড়ে এসেছিল পোড়া গন্ধে – আম্মোর হাত থেকে চিমটেটা কেড়ে নিল। “বেশ হয়েছে” আম্মোকে পিঁড়ির ওপর থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “মানা করেছিলাম না উনুনে হাত দিতে?” একটু পরে আম্মোর হাতটা টেনে নিল মা, “দেখি, কোথায় কোথায় ছ্যাঁকা লাগিয়েছিস!”
হাতটা ছাড়িয়ে নিল আম্মো। দেখাবেনা, কোথায় কষ্ট পেয়েছে ও। ছলছল চোখে ও উনুনের দিকেই তাকিয়েছিল। “রুটিটা খেয়ে নিল? খারাপ ছেলে কোথাকার!” উনুনটাকে হাতের খেলনা কেড়ে নেওয়া খারাপ ছেলের মতই মনে হচ্ছিল ওর।
“আচ্ছা! দেখাচ্ছি!” আম্মো মায়ের পিঠের কাছে ঘেঁষল। মায়ের কাঁধে হাত রাখল। কাল আবার একটা রুটি করতে আটার দলা চাইবে মায়ের কাছে।
………………
এভাবেই একদিন মা ভরসা পেলেন যে রুটি করা শিখে গেছে আম্মো।
“নে আম্মো, বাকি রুটিগুলো করে রাখ তো দেখি!” বলে, ঘরে ঢুকে গেলেন। বিছানার ওপর ছড়ানো একটা ছেঁড়া সোয়েটার নিয়ে বসে গেলেন মেরামত করতে – শীত আসছে। একটা চোখ রইল ঠিক তাঁরই মত করে পিঁড়িতে বসা মেয়ের ওপর।
নাঃ, বেশ গোলই হয়েছে মেয়ের প্রথম রুটিটা। বড়দের মত করে দু’হাতে ওলট-পালট করতে করতে তাওয়ার ওপর দিল। আম্মো জানে যে মায়ের মত তাড়াতাড়ি – একটা সেঁকা হচ্ছে ততক্ষণে আরেকটা বেলতে – সে পারবে না। তাই ওই একটা রুটিই সেঁকতে লাগল চিমটে দিয়ে উল্টে-পালটে। তারপর তাওয়া নামিয়ে উনুনের ওপর দিল।
“বাঃ”, মা মুখে কিছু বললেন না। গোল হয়ে ফুলে উঠল রুটিটা। চিমটে দিয়ে নামিয়ে রাখল আম্মো চাকির ওপর। “ও কি করছে মেয়েটা?” মা সোয়েটার রেখে উঠে গেলেন বারান্দায়।
ততক্ষণে ওই রুটিটা দলা-মোচড়া করে আম্মো ছুঁড়ে দিয়েছে উনুনে, “নে খা!”
ও কি করলি?
আমায় রুটি তুলতে দিত না, খেয়ে নিত। তাই এবার আমিই খেতে দিলাম ওকে।
************************************************************
বিদ্যুৎ পাল পরিচিতি
জন্মতারিখ ২৪শে জুলাই ১৯৫২। জন্মস্থান পাটনা (বিহার)। পড়াশুনো সবটাই পাটনায়। চাকরি ব্যাঙ্কে, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। সারাদিনের ব্যস্ততায় শামিল নিজের লেখালিখি, পড়াশুনো, বিহার হেরল্ডের সম্পাদনা, দেশবিদেশের সঙ্গীত শোনা, বইপত্র সম্পাদনা। বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ (প্রবন্ধটা অবশ্য বাংলা, হিন্দী এবং ইংরেজি, তিন ভাষাতেই লিখতে হয়) প্রকাশিত। আপাততঃ ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘বিহার হেরল্ড’এর সম্পাদক, ও বিহার বাঙালি সমিতির মুখপত্র ‘সঞ্চিতা’র যুগ্মসম্পাদক।