মূল্যায়ন
তপন চন্দ
নীলেন্দু আমার পাড়াতুতো ভাই, শান্ত স্বভাবের নম্র। মাঝারি গড়ন, চেহারার মধ্যে কোন চটক না থাকলেও, মোটের ওপর ভালোই দেখতে শুনতে। ভালো চাকরিও করে শুনেছি। আমার ওকে আর একটা কারণে ভালো লাগে, ওর অসাধারণ গানের গলার জন্য। গানটা ছেলেদের প্রেম করার ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে রাখে। কিন্তু প্রেম তো দূরে থাক বিয়েটাই করে উঠতে পারল না এখনও। নাই নাই করে বয়স ছুঁই ছুঁই চল্লিশ। এখনকার দিনে যদিও চল্লিশ তেমন কোন বয়স নয়, মেয়েরাই ফাইনাল ডিসিশন নিতে তিরিশে এসে পৌঁছয়। তবে পাড়ার মহিলা মহলে নীলেন্দু বেশ পপুলার। ওকে পেলেই সবাই এক সঙ্গে বিয়ে নিয়ে চেপে ধরে। উদ্দেশ্য একটাই, দু–একদিন সেজে গুজে গুছিয়ে আড্ডা।
সেদিন রাতে দোকান থেকে রুটি নিয়ে ফিরছিল, জিজ্ঞেস করায় বলল–
— মাম্মি বাপী দাদার কাছে মুম্বাই গেছেন।
আমি বললাম,
— আর কতদিন মা‘কে জ্বালাবে, এবার সিরিয়াসলি ভাবো।
পাড়ার সরস্বতী পূজো। পূজো শেষে দুপুরে খিচুড়ী খেয়ে প্রতি বারের মতো মহিলা পুরুষ চেয়ারে গোল করে বসে শুরু হয় আড্ডা। নীলেন্দুকে দেখে প্রসঙ্গ পাল্টে গেল। নীলেন্দু অবশ্য বসল না, কার বাড়ী যেতে হবে বলে চলে গেল। আমিও ছিলাম আসরে, লোভ সামলাতে না পেরে আলোচনায় অংশ নিলাম। আমি পঞ্চাশের পোড় খাওয়া পাবলিক, ওর সাথে আগে দু–একবার কথা বলে বুঝেছি,-ছোকরা তোমার কেন বিয়ে হচ্ছে না!
বিয়ের সম্বন্ধ যে হয়নি তা নয়, প্রায় চার–পাঁচ টা ভালো সম্বন্ধ এগিয়েও এগলো না। এ বিষয়ে লক্ষনীয় যা, তা হলো প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই একটা নির্দিষ্ট স্টেপ এর পর অপোনেন্ট সাইড থেকে সব চুপচাপ। এদিকে যতহোক ছেলের বাড়ী, তারাই বা আগ বাড়িয়ে খোঁচাবে কেন। ফলে যা হবার তাই, ইগো আর এগোতে দেয়নি। লাস্ট কেস টায়, মেয়েটিকে নীলেন্দুর মা‘র খুব পছন্দ ছিল। তিনি তো দেখে এসে বলেই ফেললেন, এ মেয়েকে বউ করে আনবই। মেয়ের বাড়ী থেকেও এক দফা ঘুরে গিয়ে, প্রাথমিক কথা বার্তার পর খুব উৎসাহ সহকারে এগোচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে ছেলে–মেয়েরা নিজেদের মধ্যে একান্তে কথা বলার সুযোগ পায়। এটা অনেকটা কম্পালসারি স্টেপ এর মতো, যেন আধ ঘন্টা ঘরে বা আধ বেলা বাইরে কথা বলে পরস্পরকে পুরোপুরি চিনে নেবে। প্র্যাকটিক্যালি, এ সব ক্ষেত্রে কেউ কারুর নেগেটিভ পয়েন্ট নিয়ে জিজ্ঞেস করে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পর্ব পজিটিভ নোট এর সাথে শেষ হয়।
নীলেন্দুও মহুয়ার বাড়ীর সম্মতে মহুয়ার সাথে নন্দন–একাডেমী চত্বরে ঘন্টা চারেক কাটিয়ে ছিল। সিনেমা নাটক রেস্তোরায় খাওয়া সবই হল। নাটক বা সিনেমা নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রতি ক্ষেত্রে ছেলের সুরুচির সুস্পষ্ট ছাপ। হল থেকে বেরিয়ে বিষয়ের গভীরে গিয়ে গঠন মূলক সমালোচনা প্রগতিশীলতার পরিচয় দেয়। রেস্তোরাতেও মহুয়ার পছন্দ অগ্রাধিকার পায়। সবেতেই একটা “পহলে আপ্” গোছের অ্যাপ্রোচ। সীমিত কথা বলা এবং কথা শোনার ক্ষেত্রে একাগ্রতা বলার মতো। মোট কথা সামগ্রিক ভাবে “রেস্পেক্ট” ব্যাপারটার পদে পদে প্রতিফলন।
এই মিউচুয়াল রেস্পেক্ট ব্যপারটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ৷ এটা এ যুগে পাত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রায়োরিটি লিষ্টে একদম টপে জায়গা করে নিয়েছে। লঙ্ রান এ এর হাল কী হয় সে কথা না হয় থাক এখানে। এখনকার দিনে প্রায়োরিটি দ্রুত বদলায়, আগেকার দিনে প্রথম বিচার্য ছিল–ছেলে কি করে! সে যদি সরকারী চাকুরে হয় তো কথাই নেই, কারণ একটাই–নিরাপত্তা। এখন মেয়েরা নিজরাই নিজেদের সিকিউরিটি ব্যাপারটা বিয়ের আগে ভেবে নেয়। আমার মতো পুরনো পন্থী লোকের অবশ্য মিউচুয়াল রেস্পেক্ট এর সাথে সাথে মিউচুয়াল ডিপেন্ডেন্সি টাও সম্পর্ক কে শক্ত করে বলে মনে হয়। পুরুষ মানুষ আজন্ম নারী নির্ভর, তা সে যত বড় চাকুরে হোক না কেন। উল্টোদিকে, মেয়েদের এই অতি স্বনির্ভরতা সেই অর্থে অনেক সময় বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়।
সন্ধ্যেবেলা মহুয়া ফেরার পর থেকে মা আগ্রহ সহকারে তার গতিবিধি লক্ষ্য করছেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তার কোন ইঙ্গিত না পেয়ে নিজেই জিজ্ঞেস করলেন –
— কিরে কিছু বললি না যে?
কোন জবাব না পেয়ে আবার বললেন –
— নীলেন্দুকে কেমন লাগল?
এই বলে মেয়ের মুখটা দেখার চেষ্টা করছেন, মহুয়া তখন মা‘র দিকে পিছন ফিরে এটা–ওটা গোছাতে ব্যস্ত।
— ভালো
মহুয়া কাজের মধ্যে থেকে উত্তর দিল।
মা আরও কিছু কথা আশাকরে একটু অপেক্ষা করলেন, মহুয়া সে কথা বুঝেও আর কোনও কথা বলল না। আসলে যে বিষয়টা মহুয়াকে ভাবিয়েছে, সেটা খুব সহজে বোঝানও মুশকিল।
— আমরা তাহলে…
মা‘র কথা শেষ হওয়ার আগে মহুয়া বলে উঠল –
— না, এ ব্যাপারে আর কথা বলার দরকার নেই।
মহুয়া নিজের মেয়ে হলেও তার মন বোঝা মাঝে মাঝে দূরূহ ঠেকতো। মহুয়া উচ্চ শিক্ষিতা কিন্তু উচ্চাকাঙ্খী নয়। একটা নামী তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার মানব সম্পদ দপ্তরের ভার প্রাপ্ত আধিকারিক। মহুয়া তাদের একমাত্র সন্তান, সে নিজের পায়ে দাঁড়ালেও তার বিয়ের ব্যপারে সব বাবা মায়ের মতো তিনিও চিন্তিত। ওর বাবা বেঁচে থাকলে ভাবনাটা হয়ত ভাগাভাগি হয়ে যেত। এর আগেও দু–একটা সম্বন্ধ নাকচ করে দিয়েছে নির্দিষ্ট কোনও কারণ ছাড়া।
মা খানিক চুপ থেকে বললেন,
— আমাদের তো উনাদের কিছু বলা উচিত।
— কিছু না বললেও কিছু বলা হয়, আর সেটা বুঝতে কারুর অসুবিধা হওয়ার কথা নয় ..
— কারণটা আমাদের কি জানার অধিকার আছে?
মা গলায় অভিমানের সুর মিশিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মহুয়া তা বুঝতে পেরে চুপ করে রইল।
মা এতে কাজ হলো না দেখে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কারণ টা ঠাওর করতে না পেরে মা ভাবলেন, বাবুয়ার বউকে দিয়ে একবার শেষ চেষ্টা করবেন–আপত্তিটা কোথায় জানার। বাবুয়া মহুয়ার পিসতুতো দাদা। তার বউকে বলাতে তিনি গর্বিত সহকারে রাজি হয়ে গেলেন। ভদ্রমহিলা পঞ্চাশের দোরে কড়া নাড়ছেন, পুরুষ মানুষ চিনতে তাঁর জাস্ট দু–মিনিট সময় লাগে। তাঁর নিজের ইচ্ছে ছেলের সাথে একবার কথা বলার, কিন্তু তার আগে মহুয়ার সাথে কথা বলা দরকার। তিনি এলেন,সন্ধ্যেবেলা চা নিয়ে মহুয়ার সাথে বসলেন। বৌদিকে খুব একটা পছন্দ না করলেও, বয়সের অনেকটা ফারাক থাকার জন্যে সরাসরি কোনও কিছু ইগনোর করতে পারে না।
বৌদি বিশেষ একটা ভূমিকায় না গিয়ে কথায় ঢুকলেন।
— তোরা এতোক্ষণ কাটালি কোথায়, কি সিনেমা দেখালো, কোন রেস্তোরায় খেলি?
বৌদি ঠিক কোন জায়গা টা ফোকাস করতে চাইছেন বোঝা গেল না।
— চিত্রাঙ্গদা
মহুয়া অনিচ্ছা সহকারে সংক্ষেপে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল।
— মানে ঋতুপর্ণ ঘোষের সেই বৃহন্নলাদের নিয়ে……
এই বলে আর কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে সটান উঠে গেলেন। মা‘কে গিয়ে কনফিডেন্টলি বলে দিলেন,-মহুয়া সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে, এ ছেলের নিশ্চয় কোনও দোষ আছে।
মহুয়া নিজের ঘর থেকে সব শুনতে পেল। ঋতুপর্ণ ঘোষ ওর প্রিয় পরিচালকের একজন। চিত্রাঙ্গদা ট্রান্সজেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের ইচ্ছা–অনিচ্ছার গল্প। তার মনে হয় এই ছবির যথার্থ মূল্যায়ন হতে সময় লাগবে। তাই এ ছবি সকলের জন্যে নয়। বুঝতে অসুবিধে হল না, বৌদির অনুমান টা রঙ নিয়ে নতুন আকারে আত্মীয় স্বজনের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। এই ভেবে ঠিক করল, তার আগেই ব্যাপারটা পরিস্কার হওয়া দরকার। কারণ মহুয়া কোন ভাবেই চায় না ওর জন্যে কারুর সম্বন্ধে একটা ভুল ধারণা বাইরে যাক।
পরেরদিন সকালে জল খাবারের সময় নিজেই কথা টা উত্থাপন করল …
— মা, আগেও বলেছি, নীলেন্দু খুব ভালো ছেলে, কিন্তু একটা ব্যাপারে অত্যন্ত রক্ষণশীল। কোন ভাবেই যেন তার থেকে বেরোতে পারে না।
মা সবটা শোনার অপেক্ষা না করে বলে উঠলেন..
— একজন মানুষের সব কিছু ভালো হয় না, রক্ষণশীলতার মধ্যে খারাপ কি থাকতে পারে আমার মাথায় আসছে না।
— খারাপ তো একবার ও বলিনি, এটা ঠিক করে বোঝান মুশকিল বলে বলতে চাই নি।
এই বলে দু একটা কথা হুবহু যে রকম শুনেছে সে রকম বলার চেষ্টা করল।
— খেতে বসে, এই পদ টা মা‘র মতো কেউ পারে না, অমুক নায়ক মাম্মির খুব প্রিয়।
অবাক হলাম যখন শুনলাম, তার দাদার হানিমুন ট্যুর এ তার মা সশরীরে সামিল ছিলেন।
মা ভাবলেন, এই কারণে এত ভালো সম্বন্ধটা হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। তিনি পুরো কথায় না গিয়ে শুধু শেষ অংশের জবাবে বললেন,
— এই ব্যাপারটা তো কথা বলে ঠিক করে নেওয়া যায়…
— মহুয়া খানিক চুপ থেকে শান্ত ভাবে বলল..
— মা, শর্ত দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন করা ভুল, পরবর্তী কালে তাকে টিকিয়ে রাখা গেলেও বাঁচিয়ে রাখা সহজ নয়।
মা–বাবা সকলের প্রিয়, তাদের প্রতি ছেলে–মেয়েদের দায়িত্ব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা এইভাবে পালন করতে হবে! আমি পারব না।
মা কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলেন, মহুয়া সে কথা না শুনে বলে চললো..
— আমি দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কথা বলছি না। প্র্যাকটিক্যালি এই দায়িত্ব শান্তিপূর্ণ ভাবে পালন করা যায় বাবা মায়ের থেকে দূরে থেকে। আর তা যদি না যায়, তবে একটা মেয়েও তো তার মা বাবার থেকে দূরে গিয়ে একই দায়িত্ব পালন থেকে বঞ্চিত হবে।
— তুই কি ওর সাথে বেরোনোর আগে এই আশা করে বেরিয়েছিলি যে, ও এত বড় বাড়ী ছেড়ে এসে অন্য কোথাও তোর সাথে ঘর বাঁধার প্রস্তাব দেবে?
মহুয়া মা‘র এই নাছোড়–বান্দা অ্যাটিটিউড এ একটু বিরক্ত হলেও তার বহিঃপ্রকাশ না করে বলল..
— তা না হলেও, যা শুনলাম তাও তো ভাবিনি, আর যদি ভাবি একটা ছেলে নিজের থেকে এই রকম কিছু ভাবে বা বলবে, সেটা ভাবা কি অযৌক্তিক না অন্যায়। তোমাদের কাছে এ সব বেমানান লাগতে পারে। এখন দিন বদলেছে, একটা সময় বিয়ের ব্যাপারে পাত্র পক্ষের এক তরফা দাবীর কোন শেষ ছিল না। এটা তো কোনও দাবী নয়, এটা একটা ভ্যালুস সময়ের সাথে সম্পর্ক যেমন রিডিফাইন্ড হয়, তাকে জড়িয়ে থাকা মূল্যবোধ গুলোও তাই। এই পরিবর্তন গুলো ছেলেরা মানতে না পারলে আর যাই হোক প্রোগ্রেসিভ মাইন্ডেড বলে দাবী করতে পারে না। আজ কাল তো প্রায় সব বাড়ীতেই একটি করে সন্তান, ছেলে মেয়ের যখন সমান অধিকার–দায়িত্ব টাও সমান। আজ যেটা বেমানান কাল সেটা মানলেই মানান। সমাজের অনেক পরিবর্তন তো পুরুষের হাত ধরে এসেছে নারীর কল্যাণে, এটাও আসুক না!
মা এর কোন জবাব খুঁজে পেলেন না, তাঁর সমস্যা যেন যেখানে ছিল সেখানেই রইল। বৌদি মা‘র দিকে একবার তাকিয়ে কিছু না বলে চলে গেলেন।
মহুয়া কোন মন্তব্যের অপেক্ষা না করে অফিসের জন্যে উঠে দাঁড়াল।
ঘর থেকে বেরিয়ে গাড়ীতে বসে অফিস যাওয়ার পথে “মা” উড়াল পুল থেকে নির্মীয়মান “The 42” তে চোখ পড়ল। মহুয়া আপন মনে ভাবলো — কত বড় বাড়ী, কত বড় ঘর, যায় কী তা মাপা নজরে! আসল ঘর তো দুটো মানুষের ভেতরে !!
প্রায়োরিটি লিস্টএ প্রথম স্থান টা আবার বদলে গেছে, নীলেন্দু দের মতো এলিজেবল ব্যাচেলরদের এটাকে বুঝতে হবে….
আমি শুধু ভাবছি, কাকা–কাকিমা, পিসি–মাসির মতো সম্বোধন গুলো যেমন লুপ্তপ্রায়, তেমনি “শ্বশুর বাড়ী“র মতো মিষ্টি কথাটাও অচিরেই সেই তালিকায় জায়গা নেবে। কিছুদিন পরে একটা দিন আসবে, যেদিন কোনো মিনিকে কোনো কাবুলিওয়ালা আর কোনদিন বলবে না,-“খুকু তুমি শ্বশুর বাড়ী যাবে?”
*******************************************************