Shadow

পর-ব্রহ্মাস্ত্র – মধুমিতা মিত্র

PC: Twitter

পর-ব্রহ্মাস্ত্র

মধুমিতা মিত্র

স্বর্গ সভায় আজ মহা কোলাহল। স্বয়ং বিষ্ণু ভয়ঙ্কর রকমের  চিন্তিত। খুব উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি সুখনিদ্রা ছেড়ে দৌড়েছেন মহেশ্বর সকাশে এবং ব্রহ্মার কাছেও।এই তিন শক্তি এক হয়েও তাঁরা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারছেন না,অত‌এব তিনজনে মিলেই এঁরা স্থির করলেন প্রথমে দেবরাজ ইন্দ্রকেই ডাকা যাক্ বৈকুণ্ঠে, তারপর তার সংগে শলাপরামর্শ করে না হয় পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। তলব গেল দেবরাজের কাছে,তলব পেয়েই তিনি হাজির প্রভু ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের সভা মধ্যে। এঁরা তিনজনাই নিজ নিজ কর্মে খুবই ব্যস্ত থাকেন। তাঁদেরকে একত্রে পাওয়াই বড়ো দুষ্কর। জরুরী অবস্থা ছাড়া এঁরা এক জোট হন কবে? তিনজনাকে একসাথে দেখেই ইন্দ্র বুঝতে পারেন নিশ্চয়ই কোনও গভীর সমস্যা উপস্থিত। ব্রহ্মা মহেশ্বর দু’জনাই মুখে কুলুপ এঁটেছেন। অগত্যা শ্রীবিষ্ণুই মুখ খোলেন।আজ সৃষ্টির সঙ্গীন অবস্থা, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর অনেক সাধ করে পৃথিবী গড়েছেন এবং তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠাও করেছেন এবং আরও সাধ করে জীবশ্রেষ্ঠ মনুষ্যজাতির সৃষ্টি করেছেন।
কিন্তু হায় রে হায়-এই জীবশ্রেষ্ঠ মনুষ্য‌ই যত কেলেঙ্কারির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্য সব প্রাণীদের যা নিয়ম,নীতি,ধর্ম দিয়ে এঁরা পাঠিয়েছিলেন কোন‌ওটাই লঙ্ঘন করার কোনও চেষ্টা  তারা করে নি। কিন্তু এই মনুষ্য কুল! যেহেতু বুদ্ধিতে এরা শ্রেষ্ঠ, তাই ঈশ্বর প্রদত্ত সব নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করে এরা স্থাপন করে চলেছে নিজেদের নিয়ম কানুন। তাতে অন্য প্রাণীদের ক্ষতি হয় তো হোক্-কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই তাদের। শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি হলেই হলো, এভাবেই তারা স্বেচ্ছাচারিতার চরমে এসে পৌঁছেছে। এদের ধর্ম,স্বভাব নীতি এতটাই অধোগামী সৃষ্টি কে রসাতলে পাঠালো বলে।এই মনুষ্য কুলকে ঠেকানোর জন্য‌ই দরকার এই বৈকুণ্ঠেই বোর্ড অফ ডিরেক্টর্স (বি.ও.ডি)র মিটিং। সেখানেই না হয় স্থির করা হবে কি করা যায়,তারপর ইন্দ্রসভায় না হয় এ্যানুয়াল জেনারেল মিটিং (এ.জি.এম) ডেকে সেই এ্যাজেন্ডা পাশ করানো যাবে।ইন্দ্র সব শুনে হতভম্ব, মৌনতাই সম্মতির লক্ষ্মণ বলে ধরে নিয়ে শ্রীবিষ্ণু বৈকুণ্ঠ হলে বি.ও.ডি-র দিন ক্ষণ স্থির করলেন।
নির্ধারিত ‌দিনে এবং সময়ে দেবরাজ অন্য সব ডিরেক্টরস্ তথা দেবতাদের নিয়ে হাজির বৈকুণ্ঠের হলে।রুদ্ধ দ্বার কক্ষে শুরু হল বৈঠক,বাইরে জ্বলছে লাল বাতি। ইন্দ্র সহ ডিরেক্টরস্ তথা অন্য দেবতারা প্রথমেই আর্জি জানালেন প্রভু যখন‌ই সৃষ্টিতে অধর্মের প্রাবল্য দেখা গেছে তখনই তো আপনি যুগবতার রূপে অবতীর্ণ হয়ে অধর্মের হাত থেকে ধর্ম কে রক্ষা করেছেন এবং সেই বাণীই তো শ্রীমৎ ভগবৎ গীতায় আপনি বিশেষ ভাবে বলেই রেখেছেন। তাহলে এখন আর দ্বিধা কেন?-রুখে দাঁড়ান,ধ্বংস করুন অধর্মকে- স্থাপন হোক ধর্মের। চেয়ারম্যান অফ দ্য কমিটি তথা ভগবান বিষ্ণু খানিক চুপ থেকে তাঁর আপন অসামর্থের কথা অকপটে ব্যক্ত করলেন।বস্তুতঃ, মানুষ জাতিটি এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে স্বয়ং ভগবানের‌ও তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করা সাধ্যাতীত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগের সমস্ত যুগ সন্ধিতে মনুষ্য জাতির অবতরণ ঠিক এতটা নিম্ন মানের ছিল না। এখন চলছে পৃথিবী ব্যাপী আগ্ৰাসনের নীতি,দুর্বলকে দুর্বলতর করে তোলা, অসহায়কে আরও অসহায় করে দেওয়া,নিরন্তর মানুষের মুখ থেকে তার জল হাওয়া টুকু ও কেড়ে নিয়ে তাকে আরও রিক্ত করে দেওয়া।ধর্ম-নীতি বিশ্লেষণের বিকৃতি,মানবতাই সব ধর্মের সেরা নির্যাস সে কথা ভুলে গিয়ে-মুছে দিয়ে নিজেদের মধ্যে হানাহানি, খুনোখুনি এ সবই এখন পৃথিবী ব্যাপী মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের আধিপত্য বিস্তারের জন্য যে কোনো মূল্যবোধের অবতরণ কাউকে এতটুকু কাঁপায় না,সোজা কথা মিথ্যার জয়জয়কার চতুর্দিকে সর্বস্তরে।স্বয়ং শ্রীভগবান‌ও চিন্তা করছেন কিভাবে সুর শক্তি দিয়ে এই অসুরকে দমন করা যায়। তিন মাথা সহ ব্রহ্মার শিরশ্চালন বেড়ে গেল, শতগুণ। শিব তো এমনিতেই ব্যোম ভোলা, কিন্তু ক্ষেপে গেলে!? তিনি তো রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন, পৃথিবীর বুকে নানা জায়গায় দুলে উঠলো ভূ-স্তর,হতে লাগলো ভূমিকম্প। তাতেও নিস্তার নেই সেই রাগের চোটেই সাগর বক্ষে উঠলো সুনামী,ধেয়ে এল আইলা, ফণী, আমফান, ইয়াস।
শ্রীবিষ্ণু শিবের ক্রোধকে বিলক্ষণ ভয় করেন। তাড়াতাড়ি সভা মধ্যেই মহেশ্বরকে প্রশমিত করার জন্য বুদ্ধিমান শ্রীনারায়ণ তাঁর স্মিত হাস্যমুখে একটি প্রস্তাব পেশ করলেন। তিনি বললেন মানুষের মধ্যেকার এই অসুর প্রবৃত্তি অসুর দিয়েই বধ করতে হবে। মহিষাসুরকে বধ করবার সময় সব দেবতারা যেমন তাঁদের শুভ শক্তি দিয়ে কাত্যায়নীকে সৃষ্টি করেছিলেন তেমনি এবার পৃথিবীময় মানুষের মধ্যেকার এতগুলি অসুরকে বধ করার জন্য আবার আমরা তৈরি করবো সে রকমই আর এক শক্তি তবে তা মাদুর্গার মত শুভ শক্তি হবে না, এ তো খালি একজন মহিষাসুর নয়,এ তো কোটিতে কোটিতে অসুর,সমগ্ৰ পৃথিবীতে ছেয়ে আছে। এদেরকে বধ করতে হবে অসুর দিয়েই-মানে এবারের ফর্মুলা হল বিষে বিষক্ষয়।আত্মম্ভরী কোটি কোটি মানুষকে জব্দ করতে রক্তবীজের ফর্মুলায় হবে এই অসুরের সৃষ্টি। এক অনু ফোঁটা থেকে তৈরি হবে লক্ষ সহস্র অসুর,তারা রে-রে করে ধেয়ে যাবে মনুষ্য শরীরের দিকে এবং মনুষ্য শরীর রূপী মন্দিরটিকে তারা ঝাঁঝরা করে দেবে। নে, এবার তোরা বুদ্ধি দিয়ে কত শয়তানী করবি কর্! কিন্তু এটা করে কি ভাবে কি করে সৃষ্টি রক্ষা সম্ভব তাই ভেবে গোটা বি.ও.ডি তথা সমস্ত দেবতারা হয়রান। এঁদের চিন্তার সেই মাতলামি দেখে শ্রীবিষ্ণু তো মিটি মিটি হেসেই যাচ্ছেন, তিনি তো আবার অন্তর্যামী; এক লহমাতেই দেবতাদের চিন্তার সেই ধন্দ ধরেই ফেলেছেন। তিনি আবার ও এক মুখ হেসে জবাব দিলেন যে এভাবেই যদি মনুষ্যকুলের মধ্যে ভয় ঢোকানো যায় (ভয় মানে সংক্রামক রোগ এবং সেই রোগজনিত মৃত্যুর ভয়) তবেই যদি মানুষ আপন স্বার্থ রক্ষার্থেই অমানবিকতার চাষ থেকে নিবৃত্ত হয়। ভয়ের গুঁতো যদি এই মানুষরূপী অমানুষ গুলিকে পরিবর্তন করতে পারে তবেই রক্ষা পেতে পারে এই সৃষ্টি। দেবতারা সহজ সরল প্রকৃতির। জটিলতা প্রায় নেই বলেই তাঁরা দেবতা। আমোদ প্রমোদেই মূলতঃ তাঁদের সময় কাটে। অমন জটিল সমস্যার এমন সরল সমাধানে এঁরা সবাই বেশ প্রসন্ন হলেন। এবার কথা উঠল এই যে সমবেতভাবে অশুভ শক্তি প্রয়োগ করে অসুরের তারা জন্ম দিতে চলেছে তার নাম কি হবে! এবার ব্রহ্মা তাঁর মুখটি খুললেন কারণ তিনিই তো মূল সৃষ্টি কর্তা।ব্রহ্মার তিনটি মুখগহ্বর থেকে একযোগে যে নামটি নিঃসৃত হল তা হলো ‘করোনাসুর’। প্রত্যেকেই মহানন্দে সেই নামটিতে সম্মতি দান করলেন। কিন্তু এ তো সবে শেষের শুরু! শুধুমাত্র বি.ও.ডি মিটিং এ পাস করলেই তো চলবে না, এখানে তো কতিপয় দেবতা! তেত্রিশ কোটির বাকীদের এবং অবশ্যই এই বি.ও.ডির সদস্যদের ও আহ্বান করা হল‌ এ.জি.এম এ স্বয়ং ইন্দ্রের রাজসভায়।
বহুদিন পর তেত্রিশ কোটি দেবতা একত্রিত এ.জি.এম এ-বেশ একটা উৎসব উৎসব সৌরভ বেরোচ্ছে। সভা শুরু হলে দেবরাজ মর্তের সভায় এবং তার সমাধানের উপায় সবিস্তারে আলোচনা সারলেন।দেবতারা সর্বসম্মতিক্রমে ‘করোনাসুরের’ প্রস্তাবে ইতিবাচক রায় দিলেন।এখন প্রশ্ন হলো করোনাসুরের জন্ম সময় এবং তার মর্তে অবতীর্ণ হবার সময়ের। যেহেতু ব্যাপারটা বিষে বিষক্ষয় সেজন্য ঠিক হলো ২০১৯ এর শেষের দিকে ওকে ভূমিষ্ঠ করা হোক। ২০২০ সালে এ তবে নবকলেবর বৃদ্ধি করে নিজের প্রতাপ বিস্তার করতে পারবে।
সর্বসম্মতিক্রমে সেই প্রস্তাব পাস হলো।
এবার করোনাসুরের জন্মলগ্নে সব দেবতা একত্রিত। মন নিবিষ্ট সেই সম্মিলিত শক্তির প্রয়োগে। জন্ম নিলো করোনাসুর—কিন্তু এ কেমন কলেবর!- এ’কে তো নিরীক্ষণ করাই যায় না! এর এত শক্তি আসবে কোথা থেকে? ভগবান বিষ্ণু তো মৃদু মৃদু হেসেই যাচ্ছেন!,উত্তরে তিনি বললেন এই ক্ষুদ্র পরমাণু-সম কণাই তো ঘটাবে বিস্ফোরণ! মনুষ্য দৃষ্টির বাইরে গিয়ে তবেই তো এ ছারখার করবে মনুষ্য শরীরকে, রক্তবীজের বংশধরের মতো লক্ষ লক্ষ আরও করোনা র জন্ম দিয়ে নিভিয়ে দেবে মানুষের প্রাণের দীপ আর সংক্রমন করে এবং সংক্রমণের বিভীষিকা তৈরি করে বিধ্বংস করবে মানুষের তৈরি সভ্যতা যা নিয়ে মানুষের এত গর্ব,এত অহঙ্কার! একে পরাস্ত করতে নাজেহাল হবে মনুষ্যকুল।
করোনাসুর নত মস্তকে প্রণতঃ তার জন্মদাতাদের সামনে,সবাই একযোগে তাকে আশীর্বাদ করলেন। শ্রীবিষ্ণু বললেন মর্তে অবতীর্ণ হ‌ও করোনা—তবে তুমিই হলে কল্কি অবতার । শায়েস্তা করো ঐ মানবদের যারা ধরিত্রীর ভারসাম্য ছারখার করছে-যারা মুখের ওপর অদৃশ্য মুখোশ পড়ে শয়তানীর মহড়া দিয়েই চলেছে,তাদের সেই অদৃশ্য মুখোশকে দৃশ্যমান করো;যাতে ওরা নিজেদেরও না চেনা দিতে পারে-না অন্যকেও চিনতে পারে। এত হিংসা,এত দ্বেষ,এদের মধ্যে সৃষ্টি করে ফেল দুরত্ব। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং এ এরা যেন বাধ্য হয়। ক্রমশঃ শুধু অন্যকে কেন নিজের হাত,পা কেও যেন এরা বিশ্বাস করতে না পারে। এমনি ভাবে ভেঙে দাও এদের আত্মবিশ্বাস,সর্বদা মৃত্যু আশঙ্কায় এরা যেন ছটফট করতে থাকে। বুঝুক ওরা,প্রকৃতি বিরুদ্ধ হ‌ওয়ার কত মজা, অমানবিক হবার কি পরিণাম! করোনাসুর সর্বান্তকরণে সমস্ত নির্দেশাবলী শুনে ঝাঁপিয়ে পড়লো পৃথিবীর বুকে মনুষ্যকুলকে শায়েস্তা করবে বলে।
শুধুমাত্র ভবিষ্যতের গর্ভেই সেই উত্তর নিহিত র‌ইলো করোনাসুর কতটা শায়েস্তা করতে পারলো অমানবিক এই মনুষ্যকুলকে।।
******************************************************

madhumita_mitra_picমধুমিতা মিত্র পরিচিতি
পেশা–স্বপ্ন দর্শন, স্বপ্ন গুলোই বাঁচিয়ে রাখে, নেশা–আনন্দ চয়ন, জীবন পথের সমস্ত জঞ্জাল, বোঝা, দুঃখ সব দূর করে ফেলে দিয়ে আনন্দ কুড়িয়ে বেড়ানো,প্রেম-রবীন্দ্রনাথ, উদয়শঙ্কর, উত্তমকুমার। সাম্প্রতিকতম প্রেম শ্রীকৃষ্ণ ..

2 Comments

  • Brati Ghosh

    পৌরাণিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রাসঙ্গিক একটি বিষয়কে নিয়ে লেখা রম্যরচনাটি খুবই সুন্দর ও লেখিকার দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত প্রশংসাযোগ্য ৷

    • Madhumita Mitra

      থ্যাংকিউ গো ব্রতী, তোমাদের ভালো লাগাই আমার অনুপ্রেরণা।সমস্যা গুলোকে একটু অন্যভাবে ভেবে যদি সেই সমস্যাগুলো কেই একটু বিনোদন মূলক করে তোলা যায় তবে ক্ষতি কি?

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!