মাতৃত্বের চতুষ্কোণ
রেশমি দত্ত
কাল সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি অনুরাধা | সকাল হতেই একটা উবের ডেকে কোলকাতা এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিল ,আজ পাঁচ বছর পর তার একমাত্র মেয়ে রুমি দেশে ফিরবে | প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি তে পড়ার সুযোগ পেয়ে রুমি পাড়ি দিয়েছিল আমেরিকা | তারপর রোজ মায়ের সঙ্গে অনলাইনে কথা হতো,একদিনও মেয়ের ভুল হয়নি | অনেকক্ষণ কথা বললেও যখন বলতো,”মা! আজ রাখি তাহলে?” তখনই অনুরাধার মনে হতো,”আরো একটু কথা বল না মা |”
এই ভাবেই কেটেছে পাঁচটি বছর |
ফ্লাইট এসে পৌঁছোবে দশটায়,কিন্তু পাছে রাস্তায় জ্যাম হয় এই ভেবে অনুরাধা সকাল সাতটায় বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে | এক্সট্রিম সাউথ থেকে যাবে সে | ট্যাক্সিতে যেতে–যেতে অনুরাধার মনে পড়ছিল অনেক কিছু,সেই কোন ছোটবেলায়–তার বাবা–মায়ের কথা | অনুরাধার বাবা–মা “অনু” নামেই তাকে ডাকত | তখন কতই বা বয়স হবে? এই বছর পাঁচ কি ছয়,প্রতি রবিবার মা–বাবার ছুটির দিন,আর ছুটির দিন মানে অনুকে নিয়ে কখনো ভিক্টোরিয়া,কখনো চিড়িয়াখানা আবার কখনও সিনেমা দেখা | এভাবেই বেশ কাটছিল দিনগুলি |
হঠাৎ কি হল,বাবা বড় প্রমোশন পেয়ে বদলি হয়ে গেল দিল্লি আর মার অফিসেও এত কাজের চাপ বাড়ল যে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রতিদিন হয়ে যেত রাত দশটা এগারোটা | সারাদিন অনু বড় একলা | তারপর প্রায়ই ফোনে বাবা ও মায়ের ঝগড়া শুনতে পেত অনু | বাবা যখন আসত তখন তো এত অশান্তি হতো যে আস্তে আস্তে বাবাও আসা বন্ধ করে দিল | মার পক্ষে অনুকে দেখা সম্ভব হচ্ছিল না | তাই অনুর গন্তব্যস্থান হলো বোর্ডিং স্কুল |
বোর্ডিং এ ভর্তি করে আসার পর মাঝে মাঝে বাবা–মা দেখা করতে আসত কিন্তু ধীরে ধীরে সেটাও তারা বন্ধ করে দিল | শুধু বোর্ডিংয়ের খরচ পাঠিয়ে দায়িত্ব সারত | বাবা মায়ের প্রতি অনুর প্রগাঢ় অভিমান হল | সেও তাই আর বাড়ি ফিরতে চাইল না | এরকম করতে করতে অনু আঠারো বছরের তরুণী হয়ে উঠলো | তার স্কুলজীবন, বোর্ডিং এর দিন শেষ,এবার অনু ভর্তি হল কলেজে | ইতিহাস তার বড় ভালো লাগে তাই ইতিহাসে অনার্স নিয়ে শুরু হলো তার পরবর্তী ধাপ |
ছোট থেকে অনু একলা থাকতে থাকতে ভীষণ স্বাবলম্বী তৈরি হয়েছে,হৃদয়টা যেন অনেক কঠিন হয়েছে আর পাঁচটা মেয়ের তুলনায় | তার মনে হলো বাবা–মায়ের আর টাকা পাঠানোর দরকার নেই তাই সে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল তার সঙ্গে তাদের আর যোগাযোগ রাখতে হবে না | কোন এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় এর কাছ থেকে অনু জানতে পেরেছিল তার বাবা–মায়ের নাকি ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে | এখন অনু কলেজে পড়ে,টিউশন পড়ায় ও একটি বাড়িতে পেইং গেস্ট থাকে | অনু যখন এই বাড়িতে থাকতে এসেছিল,বাড়ির মহিলা অর্থাৎ কাকিমা ও কাকুর সঙ্গে তার অনেক কথা হয়,কথা হয় তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে | যাই হোক অনু কথায় কথায় জানতে পারে তাদের একটি ছেলে,বিদেশে পড়তে গেছে |
কাকিমার মুখে সবসময় মেয়েদের যে সমাজে এখনো কি অবস্থা এবং তার জন্য যে মেয়েরাই দায়ী,ইত্যাদি অনেক কথা শোনা যেত,অর্থাৎ এক কথায় তিনি একজন ফেমিনিস্ট | অনেক সভা–ট্ভা করতেন | তা যাই হোক,সমাজে কিন্তু ছেলের মা আর কাকুর স্ত্রী বলেই পরিচয় জাহির করে গর্ব অনুভব করতেন | কাকু তো আবার পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারী ছিলেন আর ছেলে বিদেশ গেছেন |
যাইহোক,শুনেছি ছেলে নাকি হীরের টুকরো | সেই হীরের টুকরোর একদিন দেখা মিলল | পূজোতে বাড়ি এলেন তিনি,আলাপ হলো দুজনায় | তারপর কথা,ভালোলাগা–মন্দ তখন কিছুই লাগেনি,আর তাই মনের মধ্যে বাসা বাঁধলো ভালোবাসা | ছাদের ওপরে চিলেকোঠার ঘরে কত,গান কত কবিতা,এসব কাকিমা কাকুর চোখে পড়েনি বলে তো মনে হয় না | তবুও অনুর কিন্তু ভয় করত–যারা তাকে নিজের মেয়ের মতন দেখেন তারা তাকে মেনে নেবে তো? তবুও নবাবপুত্রের কথায় অনেক জোর,অনেক মনভোলানো ব্যাপার রয়েছে,তাই ভুলেও যায় অনু | পিতা–মাতার স্নেহ–ভালবাসা থেকে বঞ্চিত একটি মেয়ে,বহুদিন কারোর কাছ থেকে এরকম ভালোবাসা পায়নি–ভালবাসার কাঙাল সে | এদিকে সৌরভের আবার বিদেশ যাওয়ার সময় হয়ে এলো,হঠাৎ করে অনুকে বললে,”তোমাকে এভাবে ছেড়ে যেতে আমার মন চাইছে না,তুমি যদি আমায় ভুলে যাও? যদি অন্য কারো হয়ে যাও? চলো আমরা এক্ষুনি বিয়ে করবো,মানে রেজিস্ট্রি ৷” অনু হঠাৎ ভয়ে কেঁপে উঠলো | একি বলছে সৌরভ? কাউকে না জানিয়ে বিয়ে ! সৌরভ এখন রেজিস্ট্রি করে রেখে বিদেশ যাবে,তারপর ছুটি নিয়ে এসে বাবা মাকে রাজি করিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবাহ সারবে |
কি পৌরষত্ব সৌরভ এর ! অনু অমত করে সাধ্য কি?
তাই হল রেজিস্ট্রি | আর সেই দিন সন্ধ্যেবেলা চিলেকোঠার ঘরে আদরে ভরিয়ে দিল অনুকে,চলে গেল সৌরভ | মাসখানেক বাদ থেকে অনুর শুরু হলো একটা অস্বস্তি | অনু বুঝতে পারল সে মা হতে চলেছে | ফোন করল সৌরভকে,সৌরভ আসি আসি করে কাটিয়ে দিল তিন মাস,তারপর সত্যিই এল | অনু সৌরভ কে বলল ওর বাবা–মাকে জানাতে সব কিছু | তাদের নারীবাদী কাকিমা ছেলেকে যা পরামর্শ দিলেন তা হলো এই যে–বাচ্চাটিকে পৃথিবীতে আনার কোন প্রয়োজন নেই,আর তারা অনুর সারাজীবনের খরচের জন্য একটা পরিমাণ টাকা দিয়ে অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন | অনুর মত অজ্ঞাতকুলশীল একটা মেয়েকে তারা ঘরের বউ করবে ! আর সৌরভ ও বাধ্য ছেলের মত অনুকে বোঝাতে এল অনু যেন সেই মত কাজটা করে | শত হলেও মা বাবা কত কষ্ট করে তাকে মানুষ করেছে,তাদের কথা কি সে ফেলতে পারে? তার অবস্থা তো অনুর মত নয়–কোথায় অনুর বাবা–মা আর কোথায় তার | তাই এখন তাদের কথা মত অনুকে অন্য কোথাও থাকতে হবে | পরে সে বাবা মাকে বুঝিয়ে অনুকে ফিরিয়ে আনবে| অনু যেন কোনো কথা বলতে পারল না | শুধু পরেরদিন ভোরবেলা কাউকে কিছু না জানিয়ে কোনো ঠিকানা না রেখে শুরু করল আবার তার একলা পথ চলা | ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো অনুর চাকরি হয়ে গেল তার বোর্ডিং স্কুলে | ঠিক করল সে একাই মানুষ করবে তার সন্তানকে | মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল তার বাবা–মা দুজনে মিলে যা করতে পারেনি,এই সন্তানের বাবা সৌরভ যে দায়িত্ব থেকে পিছু হটে গেছে,একলাই বাবা ও মা দুই হয়ে সন্তানকে বড় করবে সে | এই সন্তান বড় হবে তার একার পরিচয়ে |তারপর রুমির জন্ম হলো |একটু একটু করে রুমি বড় হতে লাগল | কোনদিনও মাকে জিজ্ঞেস করেনি বাবার কোন কথা |একদিনের জন্যও জানতে চাইনি তার বাবা কোথায়,কি জানি বাবার অভাব বোধ করেনি বলে হয়তো!
হ্যাঁ,অনু বিন্দুমাত্র বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি রুমিকে | সে একাধারে মা ও একাধারে বাবাও | সেই রুমি আজ দেখতে দেখতে আঠাশ বছরে পা দিয়েছে | অনু ভাবে এবার রুমিকে বিয়ের কথা বলবে,এইতো বিদেশ ঘুরে আসছে যদি কাউকে পছন্দ হয়ে থাকে তার আপত্তি নেই | এইবার সে জিজ্ঞাসা করবেই | এইসব ভাবতে ভাবতে এসে গেল এয়ারপোর্ট,গাড়ি থেকে নেমে অপেক্ষা করতে থাকলো অনু | আশেপাশে সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারদের ভিড়,সবাই রুমির জন্যই অপেক্ষা করছে সেখানে |
প্রিন্সটন এ সে মাতৃত্বের উপর যে বক্তৃতা দিয়েছে তাঁর গবেষণাপত্রের উপর ভিত্তি করে,যা নিয়ে খবরের কাগজ,জার্নালে এত লেখালেখি | কিন্তু এত ভিড়ের মধ্যে অনু ঠিক কোনখানে দাঁড়াবে? মাকে সে দেখতে পাবে তো? এই সব ভাবতে ভাবতে প্লেন এসে গেল ৷ অত ভিড়ের মধ্যে অনু যেন হারিয়ে যাচ্ছে,সবাই তাকে ঠেলে পিছনে সরিয়ে দিচ্ছে | কিন্তু মেয়েকে এক ঝলক দেখতে পেয়েছে অনু ! মেয়ের মুখটা ঝাপসা দেখছে সে |
মেয়ের দৃষ্টি যেন কাকে খুঁজছে,সবাইকে উপেক্ষা করে,ভিড় ঠেলে,মেয়ে এগিয়ে আসছে তারই দিকে | জড়িয়ে ধরেছে মাকে | আজ অনুর চোখে প্রথম জল এলো,বুকের মধ্যে যে মেঘ জমাট বেঁধে ছিল,তা গলে শ্রাবণের ধারার মতো ঝরে পড়ছে চোখ দিয়ে | থামছে না কিছুতেই ৷ সবার সামনেই মাকে দুই হাতে কোলে তুলে নিল | বাড়ি ফিরল তারা | রাতে অনু মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললে,”এবার তুই একটা বিয়ে কর,সংসার কর ৷ “রুমি বলল,”মাগো,কত শিশু আছে যাদের মা নেই,তারা মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত,আগে তাদের বাঁচাই | তাদের নিয়ে চলো না আমরা সংসার পাতি ৷” অনু ভাবল সত্যিই তো ! যদি সেই ছোটবেলায় যখন তার মা তাকে বোর্ডিংয়ে রেখে এসেছিল,তখন কতবার মাকে পেতে চেয়েছিল সে | নিজেকে কতবার হতভাগ্য বলে মনে হয়েছে,আর সৌরভ তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল একলা ও সংসার পাতা যায় |
তাই মেয়ের ভাবনায় তার গর্বে বুক ভরে গেল,মেয়ের কপালে স্নিগ্ধ চুমু খেলো সে |
***********************************************************
লেখিকা–রেশমি দত্তঃ
জন্ম ও পড়াশোনা কোলকাতায় ৷ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর-পেশায় শিক্ষিকা রেশমির অবসরের বিনোদন হলো বইপড়া ৷ শৈশব থেকে বাবার অনুপ্রেরণায় গল্প ও কবিতা লেখার শুরু ৷ শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং ভ্রমণ ওর প্রিয় বিষয় ৷