অনন্যা
দেবলীনা দে
আমি অভিলাষা,মডার্ন যুগের ইন্ডিপেন্ডেন্ট উওমেন। জীবনে কোনোদিনই কোনো কিছুর অভাব ছিলনা। কিন্তু অভিযোগ ছিল প্রচুর। চিরকাল আমার সব দাবিদাওয়া মা বাবা এককথায় মিটিয়ে এসেছে তাই নিজের বাইরে কাউকে নিয়ে খুব একটা ভাবার দরকার বোধ হয়নি কোনদিন। খুব সদ্যই চাকরি পেয়েছি। আমার কাছে এখন সিচুয়েশন অনেকটা হাতের কাছে চাঁদ পাওয়ার মত। এই আনন্দের মাঝে বাধ সেজেছিল কোভিড-নাইন্টিন। সব বন্ধ,আমার আউটিং বন্ধ,উইকেন্ড পার্টি করা বন্ধ,এমনকি পার্লারও বন্ধ। জীবনটা একটা ওয়ান বিএইচ কের এসি ঘরের মধ্যে শুরু আর শেষ হচ্ছিলো।
মহামারীর কবলে যখন গোটা দেশ উথাল পাতাল,তখন পৃথিবীর কোনো এক ছোট্ট কোণে এক বারো বছর বয়সী মেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি ভাবতে পারে তা আমার চিন্তার অতীত। এসি ঘরের বাইরেও যে একটা বড়ো পৃথিবী আছে তা হয়তো সেই শেখাতে পারতো আমায়। মেয়েটির বাবা মা পরিযায়ী। আমরা যেমন সারাজীবন একটা বাড়িকে সাজিয়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি,তাদের জীবন সেইরকম নয়। যেখানে কাজ,সেখানে নীড়।
মাল্টি ন্যাশনাল তে কর্মরত হওয়ার তাগিদে আমিও খানিকটা ওই ঘর থেকে দূরে। কিন্তু মাথার ওপর ছাদ আর ওয়ার্ক ফ্রম হোম দুইই ছিলো আমার। মাসের শেষে খরচের চিন্তা নেই,দিনের শেষে নিশ্চিন্ত ঘুমও আছে। সেই নিশ্চিন্ত ঘুমে একদিন ব্যাঘাত ঘটালো শ্রুতির ফোন-
” দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নিচে নেমে আয়,আমরা বেরোব।”
” করোনা কে দূর থেকে দেখে পছন্দ হচ্ছে না? কোথায় যাবি এই সময়?”,ঘুম ঘুম গলায় আমি বললাম।
” আরে বলেছিলাম না খাবার ডিস্ট্রিবিউট করবো। তুইও তো বললি যাব।” হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে বাস্তবে এলাম,বাইরে একটু বেরোনো হবে বলে ওদের কোথায় সায় দিয়েছিলাম।
” ও হ্যাঁ। যাব তো বলেছিলাম। কিন্তু এত সকালে কেন?”
” আর সময় নেই। ওরা তো বেরিয়ে পড়ছে।”
“কোথায় বেরিয়ে পড়ছে?”
“বাড়ি যাবে,হেঁটেই। তুই আর সময় নষ্ট করিসনা। তাড়াতাড়ি আয়। উই আর ওয়েটিং”
হেঁটে যাবে,মানে? বাস্তব আর স্বপ্ন যেন হঠাৎ করে গুলোতে লাগলো। ছোট মাথার ওপর আর বেশি জোর না দিয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
রাস্তায় তখন বেশ ভিড়। কিছু স্বেচ্ছাসেবীর দল খাবার বিতরণ করবে বলে আর পরিযায়ীরা বাড়ি ফেরার তাগিদে। ওদের দেখে আমার মনের মধ্যে কেমন একটা কিন্তু বোধ উঠলো। কার বাড়ি কোথায় কে জানে, এতটা পথ হাঁটা কি সম্ভব। কিন্তু আমি তখন নিজেতে মত্ত। ওদের মনের জোরের কথা আমার অজানা। আমি চিরকাল নিজেকে নিয়েই ভেবেছি। নিজের চাওয়া পাওয়া গুলো বুঝে নিতে নিতেই জীবন কেটেছে। না পাওয়ায় অভিযোগ আর পেয়ে আনন্দ এর বাইরে আমি সেভাবে কিছু নিয়ে ভাবতাম না।
আমাদের কাছে তখন পাঁচটা বস্তায় ভরা শুকনো কিছু খাবার আর জলের বোতল ছিলো। পরিযায়ীরা ছিলো রাস্তার মাঝে আর আমরা দুই ধারে। তারা একে একে এগিয়ে আসছিল,নিজেদের প্রয়োজন মতো জল খাবার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। ওদের দেখে আমার মনে হলো এই খাবার আর জল শুধু পেটের জ্বালা মেটানোর জন্য নয়। সেগুলো ছিলো বাড়ি ফেরার স্বপ্ন পূরণের খোরাক। এই অল্প পেয়েই তাদের জীবন যেন নতুন মানে পাচ্ছিল। আমি কে এফ সি,ডমিনোজ এর মানুষ। সেদিন তারা অনেকটা মায়ের মতো মনে করিয়ে দিলো অন্নের আসল মূল্য।
এই ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো গোলাপী জামা পরা বারো বছরের একটা মেয়ে। গা হাত ময়লা,অপরিষ্কার চুল কিন্তু মুখে অদ্ভুত একটা মিষ্টি হাসি। জানিনা কিসের টান তবুও তার কাছে না গিয়ে আমি পারলাম না। রাস্তার ধারে একটা বড়ো পাথরের ওপর বসে ছিলো সে। তাকে গিয়ে একটা প্যাকেট দিতেই উত্তর এলো ‘থ্যাংক ইউ’,সঙ্গে সেই হাসি। আমি একটু কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,”কোথায় যাবে তুমি?”
” মা বলেছে নতুন বাড়ি যাবো।”
” নতুন বাড়ি?”
” আমাদের অনেক গুলো বাড়ি।একটা নতুন বাড়ি যাবো।”
আমি সুখী মানুষ। ছোটবেলায় মা বাবা আগলে রেখেছিলো আর এখন নিজেকেই নিজে রাখি। জীবনে বড়ো সংঘর্ষ না করলেও কোনো যুদ্ধের সম্মুখীন হইনি বললে ভুল বলা হবে। যদিও আমার যুদ্ধ অন্য রকমের। এম এন সিতে নয়ঘন্টা কাজ করা, এখন নিজে সব কাজ করা ইত্যাদি ইত্যাদি সবই আমার কাছে পাহাড়সম মনে হয়। কিন্তু সব শেষে আমি জানতাম আমাকে কোথায় ফিরতে হবে। মাথার ওপর ছাদ ছিলো, খাবার জন্য ভাত। কিন্তু এই বয়সে যে এখনও ঘরের মানেই ঠিক করে জানে না তার জন্য কী এই সংঘর্ষের কোনো দরকার ছিলো।এমন কতদিন গেছে যেখানে কতবার নিজের ‘সো কলড’ জীবনের সাথে অন্যের আলোকিত জীবনের তুলনা করেছি। কিন্তু জীবনে এগিয়ে যাবার মতো রসদ যে আমার বরাবরই ছিলো তা আমি সেইদিন অনুভব করলাম। আমি যখন মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে এইসব ভাবছি তখন হঠাৎ তার কর্কশ হাত আমার হাতে স্পর্শ করলো। মিষ্টি হাসি হেসে বললো,”আমাকে জলটা দেবে?”
জলের বোতলটা হাতে দিয়ে আমি তাকে প্রশ্ন করলাম,”তোমাকে তো অনেক দূর যেতে হবে। তুমি এতটা পথ হাঁটতে পারবে?”
শুনে সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো,যেনো আমার প্রশ্ন তার কাছে খুবই অস্বাভাবিক কিছু।
” কেনো পারবনা,আমি সব পারি।”
আমার হাতের ওপর রাখা তার হাতটা যখন আমি উল্টে দেখলাম আমার সব প্রশ্নের উত্তর এক লহমায় পেয়ে গেলাম। যে বয়সে এই হাতে আমি পেন পেনসিল ধরেছি,পুতুল নিয়েছি, সেই একই বয়সে এই হাতে ইঁট,পাথর,বালির ইতিহাস। ছেঁড়া কাটা হাতে শৈশবের হাতছানির ছাপ স্পষ্ট।
“কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?”
” পড়িনা,পড়তাম। একবছর হলো আর যাইনা স্কুলে।”
আমিও বোকার মতো জিজ্ঞেস করে ফেললাম,
“কেন?”
মেয়েটি হেসে বললো,”আরে স্কুলে গেলে কাজ করব কখন। আমাদের তো অনেক বাড়ি,কখন কোথায় থাকি ঠিক নেই। তাই মা বলেছে স্কুলে না গিয়ে কাজ করতে।”
” তোমার ভালো লাগে স্কুলে যেতে?”
” হ্যাঁ। খুব ভালো লাগতো।” আমার বর্তমান আর তার বর্তমান, মাঝে যেন হাজার হাজার মাইলের দূরত্ব। “কিন্তু কাজ না করলে হয় বলো। কাজ না করলে খাবো কি।”
“আচ্ছা তুমি বড়ো হয়ে কি হতে চাও,কি করতে চাও?”,জানিনা কেন তার ভবিষ্যৎ নিয়ে হঠাৎ কপালে ভাঁজ পড়ল আমার।
আমার দেওয়া খাবার মুখের মধ্যে নিয়ে সে অস্পষ্ট স্বরে উত্তর দিলো,“কিছু না। মা বাবার মত কাজ করবো।”
নিজের বোকামিতে কিছুটা হাসি আর অনেকটা খারাপ লাগা অনুভব হলো। সত্যিই তো,যে পৃথিবীতে একবেলার ভাত শেষ হলে অন্য বেলার খাওয়ার চিন্তা বলিরেখার মতো কপালে উঁকি মারে,সেই পৃথিবীতে কাজ করে বেঁচে থাকাই একমাত্র স্বপ্ন হতে পারে। মেয়েটির কথা শুনে নিজের সব চাওয়া পাওয়ার সমীকরণের উত্তর শূন্য বলে মনে হচ্ছিল। জীবনে আমারও অনেক না পূরণ স্বপ্ন ছিল যার জন্য কত অভিযোগ ছিল।আজ হঠাৎ মনে হতে লাগলো এই তো বেশ ভালো আছি। বিলাসিতা আর প্রয়োজনের তফাৎটা আর হয়তো গুলিয়ে যাবে না। মেয়েটি তখন খাবারে মন দিয়েছে। আমিও আর কিছু না বলে চলে আসছিলাম তখনই আবার সেই হাতের স্পর্শে থমকে গেলাম। মেয়েটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি ওই কন্ট্রাক্টর কাকুর মত বড়ো মানুষ হতে চাইতাম।”
“বড়ো মানুষ?”
“হ্যাঁ। ধুলোর কাজ ভাল লাগে না।”
“চাইতাম? এখন আর চাও না?”
একটু বিষণ্ণ হয়ে সে উত্তর দিলো,”না। মা বলে তারজন্য স্কুলে যেতে হয়,কিন্তু আমি স্কুলে গেলে কাজ করবে কে। তাই আর চাইনা।”
নিমেষের মধ্যে যেন তার চোখে মুখের বিষণ্ণতা মিলিয়ে গেলো,ফিরে এলো এক আত্মতুষ্টির হাসি।
এইটুকু বয়সেই যেন সে মেনে নিতে শিখেছে,বুঝতে শিখেছে।আমার হাত থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে হঠাৎ সে দৌড় দিলো তার মা বাবার পিছনে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম সেই এক জায়গায়। আমার অবস্থানের পরিবর্তন না হলেও অবস্থার পরিবর্তন কিছুটা হলেও অনুভব করলাম। মেয়েটি চললো দূরে,তার ভবিষ্যতে। আমি পরে রইলাম তার আর আমার বর্তমান ও ভবিষ্যতের মাঝে,কোথাও একটা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। মেয়েটি হঠাৎ একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে মৃদু হাসি হেসে আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা দিয়ে গেলো। আমি তো আজ পর্যন্ত অভিযোগের অন্ধকারেই ডুবে ছিলাম। কিন্তু যার কাছে কিছুই নেই,হবার আশাও নেই তার মুখে বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই। সত্যিই হয়তো স্বপ্ন ভাঙ্গা আর গড়ার মধ্যে পরিসর খুব সামান্য। স্বপ্নের ভেলা পার করার জন্য হয়তো সবচেয়ে বেশি মনের জোর লাগে,যা ওই বারো বছরের মেয়ের মধ্যে উপচে পড়লেও আমার মধ্যে হয়তো অভাব। ও বাস্তবকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে আর আমি স্বপ্ন দেখি স্বপ্নকে নিয়ে,কিছুটা ঘুমিয়ে। আমারটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর ওরটা বাঁচবার স্বপ্ন,বাঁচবার লড়াই যা ও রোজ হাসি মুখে করে। আমি ওর মতো হতে পারবো কিনা জানিনা,কিন্তু সেদিন থেকে অভিযোগের পালা শেষ।
মেয়েটির নাম আমি জানিনা। কিন্তু আমার কাছে সে অনন্যা। সে সাধারণ কিন্তু হয়তো সাধারণের মধ্যেই অনন্যতা লুকিয়ে থাকে। শুধু তাকে খুঁজে নিতে হয়।
******************************************
দেবলীনা দে পরিচিতিঃ জন্ম কলকাতা শহরে কিন্তু বড় হয়ে ওঠা হুগলী জেলার এক গ্রামে। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজি সাহিত্যে M.A. কল্পনার জগতে গল্পের মালা গাঁথা অবসর সময়ের শখ ও ভালবাসা দুইই। পড়াশোনার পাশাপাশি সুরের ভক্ত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও রবীন্দ্র সঙ্গীত নিয়ে চর্চা বেশ কয়েক বছরের।