কোমল ধৈবত
মণি ফকির
।। পূর্বরাগ।।
শহরের এই অংশে ভিড় অপেক্ষাকৃত কম। প্রতিটি বাড়ি সবুজ ছায়ায় আদরে সযত্নে লালিত। তার মধ্যে একফালি একটি বাড়ি,অস্তগামী সূর্যের কোমল আলোর মত রঙ তার। পুরনো ধাঁচের কাঠের দরজার বাইরে বড় করে সাদা অক্ষরে লেখা “পুরিয়া ধানেশ্রী”। বাড়িটি থেকে ভেসে আসছে এক মিহি কণ্ঠে রেওয়াজ এর সুর। ছয় বছর বয়সী তিতাস আকুল হয়ে গাইছে বেলা শেষের রাগ। তানপুরা ধরে বসে আছেন তার গুরু মা। মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁর ছোট্ট শিষ্যার গান শুনছেন। ছাদের এই ঘরটিতে পড়ন্ত বিকেলের আলো এসে এক মায়াবি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আশে পাশের বাড়ির সবাই এই অলৌকিক পরিবেশের শরিক। অনতি দূরে কেউ নিজের অঙ্কের খাতার এক কোণে রাখলো লিখে “তিতাস একটি নদীর নাম।”
———X——–
।। উত্তরাঙ্গ ।।
– শুনছেন?
– হ্যাঁ বলুন।
– আপনি তো মঞ্জরী।
– না। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি মঞ্জরী নই।
– ওহ্। কিন্তু…. আপনার নাম তো তাই হবার কথা। মঞ্জরী মানে জানেন?
– না।
– আচ্ছা আপনি কি এখন কোনো ইন্টারভিউ দিয়ে বেরোলেন?
– তা জেনে আপনি কি করবেন?
– বিরক্ত হয় তিতাস। অদ্ভুত গায়ে পড়া লোক তো। একবার ভাবে একরোখা হয়ে,মনস্থ করে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দেবে। কিন্তু লোকটার চোখ দুটি অদ্ভুত ভাসা ভাসা। চেষ্টা করেও খারাপ কিছু বলতে পারা যায়না। তাকিয়ে থাকলে মন কেমন করে। সে চোখ সরিয়ে নিল।
তিতাস এগিয়ে যেতে থাকে। সে বুঝতে পারে সেই মানুষটি তার পেছন পেছন আসছে। সে এড়িয়ে গিয়ে,একটা সিগারেট ধরিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে।
– আচ্ছা,তুমি.. সরি,আপনি কাল রাতে অনেক রাতে ব্যালকনিতে কেন বসে ছিলেন একা একা? মন খারাপ-তাই না কদিন ধরে? মনের ডাক্তার অসুখ টা ধরতে পারেনি। আসলে কি জানেন তো?
– কি?
– ভালবেসে মানুষের শুধু অসুখটাই রটে।
তিতাস চমকে গিয়ে থামতে বাধ্য হল। চকিত ঘুরে গিয়ে বলল,
– আপনি কি আমায় স্টক করছেন নাকি?
– ওমা একি! কোথায় উবে গেল লোকটা। এক্ষুনি কথা বলল। সে এদিক ওদিক দেখল। কিন্তু কোথাও কেউ নেই।
ক্যাবে বসে তার মাথায় ঘুরতে লাগলো শেষ কথাটা “ভালবেসে মানুষের অসুখটাই রটে”। কি অদ্ভুত কথা বলে গেল সে। কোথায় যেন শুনেছিল,কিন্তু মনে করতে পারল না। যাক গে। ব্যাপারটা কাটিয়ে দিল সে।
…..………………………………..
।। বিস্তার ।।
_____________
মহানগর এর একটি জনপ্রিয় পানশালা। শব্দে, আলো তে জমজমাট। সবাই এখানে জীবনের নেশায় মাতাল। অনেকদিন পর আজ সে একটু হাল্কা বোধ করছে। ও অনেক দিন থেকেই বলছিল। কিন্তু সে কাটিয়ে দিত। আজ ওর জন্মদিন তাই না বলতে পারলোনা। আ ট্রিপি ডেট আফটার আ লং টাইম। হাল্কা করে শরীর এলিয়ে তারা একে অপরের হৃদয় ঘেঁষে বসে আছে। বেশ ভালো লাগছে। একটা জয়েন্ট খেতে ইচ্ছে করছে। সে বাইরে বেরোলো।
– ভালো আছেন?
চমকে উঠে দেখল আরে এতো ঐ লোকটা।
– আপনি এখানে? আবার!
– কেন আসতে নেই বুঝি?
– না। এখানে কেন কোথাও আসতে নেই।
– কেমন লাগছে আপনার? ভালো লাগছে? সাফোকেটেড ফিল করছেন না?
– আপনি কে বলুন তো? আর এসব পার্সোনাল কথা কেন জানতে চান? মতলবটা কি? গলার সুর চড়ল।
মানুষ টা অদ্ভুত ভাবে শান্ত গলায় বলল,
– তুমি আমায় ভুলে গেলে মঞ্জরী?
– আমি মঞ্জরী নই। তিতাস।.. গলার সুর কঠিন হল। মুখের ভাবও।
– সে তো একটি নদীর নাম। নদী তো বয়ে চলে। ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ভেসে যাচ্ছ কেন?
– আপনার নাম কি?
– সেটা তো তোমার জানার কথা। তাই না? এবার একটু অস্বস্তি লাগছে। তোমার ইচ্ছে মত বয়ে চলায় বাঁধ দিওনা। তবে সব নদীর একটা একান্ত ব্যক্তিগত ঝর্ণা আছে।
– একটা কথা বলি?
– বলুন।
– তুমি এখন অজ্ঞাতবাসে আছো,আন্ডারগ্রাউন্ড যাকে বলে। মনের দরজা খুলে দাও আর চিৎকার করে বল…..
– কি??
– তুমি জানো। একদিন তুমিই বলেছিলে…ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলি,আমি…..। আমায় একা ছেড়ে দিন প্লিজ।
– আচ্ছা আজ আসি। পাহাড়ে দেখা হবে একদিন।
আরে তাইতো,কতদিন পাহাড়ে যায়নি সে। একটা ট্রেক প্ল্যান করতে হবে। তিতাস ভাবে।
…………………………..
বহু মাস কেটে গেল। তিতাস আবার আগের মত হয়ে গেছে। খুব ভালো লাগছে তার নতুন করে শুরু করা চাকরি জীবন। অফিস,পার্টি,সংসার,পুরোনো বন্ধুদের সাথে টুকটাক ডেটস/ ফ্রিক আউট – দিস ইস কল্ড লাইফ ।
ভাল কথা। ঐ রহস্যময় মানুষ টার সাথে তার আর দেখা হয়নি। বাঁচা গেছে। উফ্। এসব হ্যান্ডেল করা খুব চাপের ব্যাপার।
………………………………..
আরো অনেক মাস পরের একদিন। দিন ফুরিয়ে এসেছে। গোধূলি আসন্ন। এক অলৌকিক আলোয় ভরে আছে বিশ্ব চরাচর। চারদিকে এক অদ্ভুত স্থবির প্রশান্তি। যোশিমঠ এর এক আশ্রমের উপাসনালয়। বসে আছে ধ্যানস্থ তিতাস। গভীর খুব গভীর তার অন্তর্দৃষ্টি। আশেপাশের কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। হঠাৎ সেই মানুষটির মুখ ভেসে উঠল তার মানসপটে। চমকে গেল সে। চোখ খুলে ফেললো। ধবধবে সাদা পোষাকে সে দাঁড়িয়ে আছে। এক আলোকিত মানুষ। অস্তগামী গৈরিক আলো কোমল দৃষ্টিতে। ভালো করে চোখ মেলে সে দেখল, সেই মানুষটি দাঁড়িয়ে। চমকে গেল তিতাস। এ কি করে সম্ভব। এতদিন পর,এখানে,এভাবে। অবিশ্বাস্য।…..
– ভালো আছ মঞ্জরী? অনেকদিন পর দেখা হল। তোমার খেয়াল নেই,এখানেই আমাদের দেখা হয়েছিল প্রথম। সেদিন ও আজকের মতই…..
– তুমি? মানে আপনি এখানে?
– আমি তো এখানেই থাকি গো।
– তাহলে কি করে শহরে আপনার সাথে দেখা হল? এ হতে পারেনা। আপনি মিথ্যা বলছেন।
– হয়নি তো। শহরে আমাদের কখনোই দেখা হয়নি। এখানেই হয়েছে। তুমি শহরে যাওইনি তো। তিতাস কখনো শহুরে নদী হতে পারেনা।
তিতাস বিভোর হয়ে,চুপ করে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে আসে। সে বাকরুদ্ধ। এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার শরিক। এত স্পষ্ট,এত বাস্তব এই মুহূর্ত। কিন্তু বিশ্বাস করা খুব কঠিন।
– তোমার কাছে আমি আজ কিছু চাইতে এসেছি।
– বল।
– তোমার একটা ছবি আঁকতে চাই। মত আছে?
– হ্যাঁ। ধরা গলায় বলে তিতাস। মানুষ টি ক্যানভাস ও সরঞ্জাম নিয়ে এল। ঐ তুলি,ক্যানভাস, রঙ,সব কিছুই তিতাসের ভীষণ চেনা লাগে। কিন্তু সে মনে করতে পারেনা। আকুলতা বাড়তে থাকে। মানুষটি আঁকতে শুরু করে।
দূর থেকে মন্দ্রস্বরে আলাপ ভেসে আসে। কোমল ঋষভ,কড়ি মা, ও কোমল গান্ধার এর আবেশে তখন খুব সন্তর্পণে সন্ধ্যা নেমে আসছে।
….…………………………..
।। আরি ।।
এর পর অনেকদিন কেটে গেছে। তিতাস নিজের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে। ঐ মানুষটার সাথে আর দেখা হয়নি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও লাভ হয়নি। তিতাস তার কথা ভাবতেও চায়না। তার মত মেয়ে আটকে থাকতে শেখেনি। এগিয়ে যেতেই হবে। সে কোনো কিছুকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারবেনা। অনেক উঁচুতে উঠতে হবে। কত কাজ বাকি।
…………………………………….
।। পিয়ারী ।।
যোশিমঠ থেকে ফিরে তিতাস এক মনোবিদের কাছে গিয়েছিল। তিনি বললেন এটা একধরনের বিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন। তিতাসের বর,বন্ধুরা,বাবা সবাই বলল-তোর ওটা ডিলিউশন ছিল।
মা বললেন ছোটো থেকেই তুই খুব কল্পনাপ্রবণ। ছাদের চিলেকোঠার ঘরে তোর কত অদৃশ্য কাল্পনিক বন্ধু ছিল। যাদের সাথে তুই গল্প করতিস রোজ। তোর ঠাকুমা ভাবত তোর ওপর কারো ভর হয়েছে ৷ ভুলে যা ব্যাপারটা। ঝেড়ে ফেল মন থেকে।
তিতাস মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। কিন্তু সে জানে ঐ অদ্ভুত মানুষ টা নিছক কাল্পনিক ছিলনা।
গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে,সে সন্তর্পণে পোর্ট্রেটটা বের করল লুকোনো জায়গা থেকে। মোড়ানো কাগজ খুলে টেবিলে দাঁড় করাল।
মধ্য যামিনীর রহস্যময় আলো পড়েছে সেই ক্যানভাস এ। একটা বিশাল দিঘি। জল টলটল করছে। যেন তাকালেই তল পাওয়া যায়। তার মাঝামাঝি ভেসে উঠেছে একটি সদ্য বিসর্জিতা দেবী মূর্তির কাঠামো। সমস্ত রং,মাটি গলে গেছে। শুধু মুখটা এখনো অবিকৃত। আর মুখ খানি তার। আবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে রইল তিতাস।
নীচে এক কোণায় ছোট্ট করে লেখা,”মঞ্জরী কে। যার ভালোবাসা কখনো অসুখ হয়ে রটেনি”
ইতি,
চিত্রকর।।
****************************************
মণি ফকিরের জন্ম শিল্পনগরী বার্ণপুরে। সাহিত্য চর্চার অভ্যাস ছাত্র জীবন থেকেই। অনুপ্রেরণা মা ও মামার কাছ থেকে। প্রথম কবিতার বই *মণি ফকিরের পদাবলী* প্রকাশিত হয় ২০১৮ পূজোয়। গল্পকারের মূল বৈশিষ্ট্য তার গল্প বোনার ও বলার সাবলীল ধরন। গল্পের শেষে কিছু না বলা কথার প্রচ্ছন্ন ঈঙ্গিত মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে।।