Shadow

জলকন্যার উপাখ্যান – সাথী সেনগুপ্ত 

PC VerbNow

জলকন্যার উপাখ্যান

সাথী সেনগুপ্ত 

বাঘাদার সঙ্গে বাঘের কোন সম্পর্ক নেই,বাঘাদার ভাল নাম  কি ছিল,তাও আমাদের  জানা নেই। তবে আট থেকে আশি সকলেই তাকে বাঘাদা নামে ডাকে। পাড়ার মোড়ের ছোট খাট  চায়ের দোকানটা বাঘাদার দোকান নামেই সকলের কাছে খ্যাত।
জায়গাটা ঠিক শহর নয় বরং বলা যায় মফ:স্বল। ফলে এখানে পাড়া আছে,এর ওর ব্যাপারে নাক গলানো আছে,চায়ের দোকানের আড্ডাও আছে। আমি,তপা,দেবা আর বিশু চায়ের দোকানের নিত্য খদ্দের কাম আড্ডাবাজ। তবে দিন রাত আড্ডা দেবার মত শৌখিনতা কজন আর করতে পারে। ফলে আমরাও দিনরাত আড্ডা দেবার সময় পাইনা। আমি বছর দুয়েক আগে পাসকোর্সে একটা বিএসসি পাশ করেছিলাম। তারপর কম্পিউটার ক্লাসে দিনকয়েক যাতায়াত করেছিলাম,কোন ঠিক ঠাক চাকরি বাকরি না জোটায় বেশ কখানা টিউশনি করে বেড়াই। তপা মাধ্যমিক টা কোন রকমে পাশ করেছে,তারপর আর পড়াশোনা এগোয়নি। ওর দাদার গুঁতোগুঁতিতে ড্রাইভিং টা শিখেছিল। এখন মাঝে মধ্যে অন্যের অটো চালাচ্ছে। তবে ধান্দায় আছে লোন টোন নিয়ে একটা গাড়ি বের করার।
দেবার  আবার একটু সখি সখি ব্যাপার আছে। কবিতা টবিতা লেখে। কি একটা ছোটো কাগজের সঙ্গে যুক্ত ও আছে। বাজারে বাবার দোকানটা খারাপ চলেনা। ফলে ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নয়। আর বিশু অর্থাৎ বিশ্বনাথ আপাতত: ফুল টাইম,নির্ভেজাল বেকার। তবে কিছুদিন আগে পর্যন্ত ওই আমাদের মধ্যে একমাত্র স-কার ছিল। কারণ এখানকার এক ভুঁইফোড় ওষুধের কোম্পানির সেলসে কাজ করত। ফুলহাতা জামা আর গলায় টাই ঝুলিয়ে,ভারি ব্যাগ হাতে ডাক্তার দের চেম্বারে চেম্বারে ঘুরে বেড়াতো। কপালের নাম গোপাল। কিছুদিন হল ঐ ভুঁইফোড় কোম্পানি বিশুর চাকরি সহ ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ হয়ে গেল। সুতরাং বাঘাদার দোকানে আমাদের সক্কাল বেলাকার মৌরসিপাট্টা আড্ডা বাতিল করে কার সাধ্যি। সেখানে সকালে দু কাপ চা,চার কাপ বানিয়ে খাওয়া,ওখানে বসেই পেপার পড়া,রাজা উজির মারা,বিশ্বের যাবতীয় সমস্যা সম্পর্কে মতবাদ দেওয়া,বিনোদিনী বালিকা বিদ্যালয়ের ‘দুলিয়ে বেণী চলেন তিনি ‘দের প্রতি কৌতুক কটাক্ষ কিংবা তির্যক মন্তব্য-সবকিছুই সেরে নিতে হয়। বিশের অবশ্য ইদানিং একটু উদো উদো ভাব। কে জানে তার কর্মহীন অলস মস্তিষ্কে কোন ‘শয়তানী’ ভর করেছে কিনা। তপা বলছিল-ফর্সা,বোঁচা নাক,বড় চোখের মেয়েটি নাকি বিশের লক্ষ্য। ব্যাপারটা জানতে পেরে আমরা  অবশ্য বিশেকে খুব  উসকাচ্ছি। আমাদের  কোন স্বার্থ নেই শুধু একটা নতুন ক্যাচাল বানাতে পারলে দিনকতক একটু হ্যা হ্যা করা যাবে এই যা।
                    যাক্ গে,আমাদের  কথা তো বললাম,এবার  বাঘাদার  কথা একটু বলি। প্রথমে বলে রেখেছি বাঘাদার আসল নাম কি,আমরা কেউ জানি না। বাঘাদা এ অঞ্চলের লোক  নয়,কোথাকার লোক সে নিয়েও আমাদের স্পষ্ট কোন ধারণা নেই। বাঘাদার বয়স এখন কত তাও এখন বলতে পারব না। কারণ ওরকম পাঁকতেড়ে,সিঁটকে চেহারার লোকেদের  বয়স কিছু বোঝা যায় না। যবে থেকে বাঘাদাকে দেখছি সেই থেকে একই চেহারা দেখে আসছি। তবে মোটামুটি মধ্য বয়স হবে। দোকানের পেছনদিকে এক চিলতে ঘর মত আছে তাতেই সে থাকে। দোকানের চায়ের উনুনে দুপুরের দিকে বাঘাদার ভাত ফোটে। বিয়ে থা করেনি। কোনভাবে করবার সম্ভাবনাও নেই। জীবন সম্পর্কে কোন আশা যেমন নেই তেমন নৈরাশ্যরও ধার ধারেনা। এভাবে ‘হলেই হল’ করে দিন কাটিয়ে দিতে পারলেই বাঘাদা খুশি। আমরা অবশ্য বাঘাদার ওপর প্রচুর হাঙ্গামা করি। চায়ের দাম তো ধারস্য ধার হয়েই চলে। বাঘাদা কিছু বলেনা। আমরাই মায়া দয়া করে মাঝে মধ্যে একটু আধটু হাত উপুড় করি। বাঘাদা তখন গোনা গুনতি না করে নিয়ে নেয়। তবে হ্যাঁ,আমরা যা করি করি বাঘাদাকে ভাল মানুষ পেয়ে অন্য লোকে যাতে বাঘাদার মাথায় হাত বুলিয়ে না ঠকাতে পারে সে ব্যাপারে আমরাই সজাগ থাকি। দেবা বসে বসে তার কবি কবি হাতের লেখায় দোকানের  দেয়ালে লিখে দিয়েছে-‘ধার চাহিয়া লজ্জা দিবেন না।’ আর ‘আজ নগদ কাল বাকি।’
        এছাড়াও হুজ্জোত আছে,মাঝে মধ্যে রাত্তিরে বাঘাদার দোকানের পাট উঠে গেলে ঐ উনুনেই মাংস রেঁধে ফিস্টি করি। বাঘাদা কিছু বলেনা। শুধু বলে রেখেছে জিনিস পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে নোংরা করে রাখা চলবেনা আর মদ আর মেয়েমানুষ নিয়ে আসা চলবে না। আমরাও  জিভ কেটে কান ছুঁয়ে দিব্যি কেটেছি-‘মাইরি কি বলব তোমায় বাঘাদা,আমরা ভদ্দর ঘরের ছেলে। আমরা কি ওসব করতে পারি? আর যতই বল ও দুটো ম-কারের পেছনে আরো একটা ‘ম’ মানে ‘মাল্লু’ লাগে। মালকড়ি না ফেললে শ্যাওড়া গাছের পেতনিও কাউকে পাত্তা দেয়না। আমরা সব কাঠ বেকার অত পয়সা পাব কোথায় শুনি?’ তা বাঘাদা আর কিচ্ছু বলেনা। বরং মাংস রাঁধবার জোগাড় যন্তর  করে দেয়। নিজে অবশ্য খুবই স্বল্পাহারী। আমরা দেদার চাপাচাপি করলে সামান্য একটু চেখে দেখে হয়ত।
                     এরকমই একটা দিনে আমরা সবাই ফিস্টির জোগাড় করছি। সেদিন  আবার ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে মেনুও অন্যরকম। মাংস ফাংসর ঝামেলা নেই। বরং খিচুড়ি ডিমভাজা,পাপড়ভাজা এইসব খাওয়া হবে। আমাদের মধ্যে বিশে বেশ রান্না বান্নাটা বোঝে। অন্যদিন সেই খুন্তি নাড়ে। কিন্ত সেদিন যে কি হল,সন্ধে থেকেই বাঘাদার দোকানে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে,আর কি যেন মনে মনে গুমরাচ্ছে। মাঝে মাঝেই ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছাড়ছে। তপা আর দেবা রাত আটটা,সাড়ে আটটা মধ্যে উপস্থিত। আমারই জল কাদার মধ্যে পালবাবুর ছেলেকে পড়িয়ে আসতে রাত সাড়ে নটা বেজে গেল। অন্যদিন এর মধ্যে বাঘাদার দোকান শেষ হতে হতে আমাদের জোগাড় যন্তর শুরু হয়ে যায়। দশটা নাগাদ রান্না চাপিয়ে দেওয়া হয়।
             আমি এসে দেখি এ কিরে বাবা,চাল ডাল ঠোঙার মধ্যেই পড়ে আছে,আলু,পেঁয়াজ,ডিম সব গড়াগড়ি খাচ্ছে। শুনলাম বিশের খুব মনখারাপ। বাঘাদা খদ্দের সামলাতে সামলাতে দু কাপ চা খাইয়েও চাঙ্গা করতে পারেনি। তারপর সবাই মিলে জোরসে চেপে ধরাতে জানা গেল বিশে নাকি গতকাল বিকেলে বিনোদিনী বালিকার ছুটি হবার সময় মিস বিনোদিনী অর্থাৎ বোঁচা নাক,বড় চোখকে চিঠি দিয়েছিল। আজ সকালে নাকি মিস বিনোদিনীর কাকা সেই চিঠি হাতে করে বিশের বাড়ি বয়ে এসে বিশেকে খুব চমকে দিয়ে গেছে। সেই কাকা নাকি বেশ মাস্তান মত,পার্টি অফিসে খুব যাতায়াত। এদিকে বিশু বেচারার মুহুর্মুহু প্রেমে পড়ার বাতিক থাকলেও নিতান্তই নিরীহ। পার্টি ফার্টি কোনভাবেই করেনা। বাড়ি এসে চেল্লানোর দরুণ বিশের বাড়ির লোকেরাও বেজায় চটেছে বিশের ওপর। দাদা বাড়ি ছিলনা,কিন্ত বড় বৌদি বিশের বেকারত্ব নিয়ে খোঁচা দিয়ে কথা শোনাতে ছাড়েনি। দাদা ফিরলে আরেক প্রস্থ হবে হয়ত।
           আমরা বিস্তর ছ্যা ছ্যা করলাম। আজকালকার দিনে চিঠি ফিটি দেওয়ার মত কাঁচা কাজ কেউ  করে নাকি। তাও আবার হাঁটুর বয়সী একটা ইস্কুলের মেয়েকে। তপা বিশের পিঠে একটা থাবড়া মেরে বলল-‘আরে,মেয়েরা হল বাঘাদার দোকানের চায়ের খুড়ির মত,খুড়ি করে চা খাও তাপ্পরেই ফেলে দাও। আবার চা খেতে গেলে নতুন খুড়ি। তোর নাক চেপটাকে দেখে ভাল লাগছিল। দেখছিলি। বেশ করছিলি। এ চলে গেলে আরেকটা সরু নাককে দেখবি। চিঠি ফিঠি মারতে গেছিস কোন কম্মে। তাকেও কি শালা দেবার  বাতিক ধরল?’
দেবা প্রবল ভাবে আপত্তি জানায়-‘আমি মোটেও মেয়েদের চিঠি লিখি না। তবে আমি মেয়েদের ভালবাসি। মেয়েরা আমার ইন্সপিরেশান মানে অনুপ্রেরণা। আমি কোন মেয়েকে ভালবাসলে তাকে নিয়ে কবিতা লিখি। তুই  আমায় বললি না কেন বিশে,আমি তোর জন্যও কবিতা দিতাম।’
‘শালা, চাঁদু আমার।’ – আমি আর না বলে পারি না। -‘ ভাল করেছিস বিশে,তুই যে দেবাকে দিয়ে কবিতা লেখাসনি। আমি দেবার কবিতা পড়েছি। সে সব সবার সামনে পড়া যায় না। ঐ সব যদি বিনোদিনীকে লিখতিস তবে ওর কাকা তোর পিন্ডি পাকিয়ে দিত।’
দেবা কটমট করে ভষ্ম করা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল।
এবারে বাঘাদা চেঁচিয়ে উঠল। – ‘এই তোরা থামবি? কি এক ব্যাপার নিয়ে সন্ধে থেকে পড়েছিস। বাবা বিশ্বনাথ,এসব ছোট খাট ব্যাপার নিয়ে মন খারাপ করার মানে আছে?’
তপা এবার বলে উঠল-‘এটা ঠিক না বাঘাদা,এটা মোটেও ছোট খাট ব্যাপার নয়,এটা বিশের জীবন মরণ প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় কথা শুধু বিশেরই মরণ বাচন নয় সেইসঙ্গে আমাদের ও। আমাদের সবারই এ ব্যাপার নিয়ে সময় কাটত। এটাকে যদি তুমি ছোটখাট ব্যাপার ধর তাহলে বড় ব্যাপার কোনটা?’
              আমি তপার দিকে একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালাম তারপরই বাঘাদাকে চেপে ধরলাম-‘তপা ঠিকই বলেছে,বড় ব্যাপার কোনটা? তোমাকে বলতেই হবে।’
বাঘাদা অবাক হয়ে বলল-‘আমি আবার কি বলব? আমার বলার কিছু নেই। বলছিলাম সময় নষ্ট না করে রান্না বান্নায় মন দে। বিশে,আর নখরা না করে এবার কাজে হাত  লাগা।’
হৈ চৈ করতে করতে রান্না বান্না শেষ হল। তারপর খাওয়ার পালা। খেয়ে দেয়ে উঠতেই বাইরে,নতুন করে প্রবল বেগে বৃষ্টি নামল। এইরে সেরেছে। যদিও বাড়িতে সবাই জানে আজ আমাদের ফিস্টি আছে বাঘাদার দোকানে। রাত করেই ফেরার কথা। আমার বাড়িতে কেউ হাঁ করে বসে থাকবেনা। আমি বাইরের ঘরের চাবি নিয়ে এসেছি। যতই রাত হোক চাবি খুলে বাড়ি ঢুকে যাব। দেবার ও আমার সঙ্গে রাত্তিরটা থাকার কথা। বিশে বাড়িতে ঝামেলা করে এসেছে,বিশের মা ভাবতে পারে। বিশের মায়ের হাতে ফোন নেই যে জানিয়ে দেবে। তবে ফিস্টের কথাটা বোধ হয় এর আগে কখনও বলেছিল। আর তপার রাত করে ফেরাটা কোন ব্যাপার নয়। অনেক সময় রাতের সওয়ারি থাকলে গাড়ি রেখে বাড়ি ফিরতে রাত হয়েই যায়।
             সুতরাং বৃষ্টি পড়ছে,পড়ুক। আমরা সবাই বাঘাদার চিলতে ঘরের চৌকির ওপর পা উঠিয়ে বসে পড়লাম। আমার মাথায় ঘুরছে বাঘাদাকে চেপে ধরার কথা। বিশের  মত মাকড়াকে নিয়ে সারারাত ভ্যাজর ভ্যাজর করার কোন মানে নেই। তার চেয়ে বাঘাদাকেই একটু বাজিয়ে দেখা যাক।
   _ ‘আচ্ছা বাঘাদা,তুমি কি যেন সব বড় সড় ব্যাপারের কথা বলছিলে?’
   _ ‘আমি আবার  কখন কি বললাম ?
   _ ‘আরে বাঘাদা,তুমি তাহলে ছুপা রুস্তম?
   _ ‘তপা,ভাল হচ্ছে না। গুরুজনের সঙ্গে ওভাবে কথা বলবে না।’
দেবা এবার মুখ খোলে-‘মাইরি বাঘাদা,তুমিও যদি ওরকম গুরুজন টুরুজনের ঝামেলায় চলে যাও তবে আমরা কোথায় যাব বল? তুমি হলে গিয়ে আমাদের ফ্রেন্ড। যদি কিছু থাকে তো বলেই ফেলনা। বাইরে বাইরে যতই কাঠখোট্টা হও,কোন না কোন দিন তো কাউকে ভাল লেগেছে।’
আমরাও সকলে মিলে দেবার কথায় সায় দিই। এমনকি বিশুও দেখি শোক তাপ ভুলে আমাদের গা ঘেঁষে বসেছে।
           বাঘাদা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তপা কি একটা বলতে যাচ্ছিল। আমি থামিয়ে দেই। বাঘাদা ভাবছে কিছু। যেন ডুবিয়ে মত ভাবনার অতল থেকে তুলে আনছে কিছু। বাঘাদার দোকানের টিনের চালে বৃষ্টির আওয়াজ সুর তরঙ্গ সৃষ্টি করছে।
          আস্তে আস্তে বাঘাদা বলতে থাকে। -‘সে অনেক কাল আগের কথা। আজ আমায় তোরা যেমন দেখছিস আমি কিন্তু তেমন ছিলাম না। আমি নামী বংশের ছেলে। বাপ ঠাকুরদার ধন সম্পত্তিও ছিল কিছু। সেসব আজ চুলোর দুয়ারে গেছে,বলে আর লাভ নেই। তোদের মত খানিকটা পড়াশুনাও করেছিলাম। …তাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম,তখন আমার বয়স ষোল,সতেরো  হবে। সেদিন আমাদের গ্রামের সঙ্গে পাশের গ্রামের ফুটবল ম্যাচ ছিল। ফুটবল খেলে দল বেঁধে বাড়ি ফিরছি। ততক্ষণে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে আসি আসি করছে। গ্রীষ্মের দিন,ফলে সারা বিকেল মাঠ দাপিয়ে খেলে খুব গরম লাগছে। বাড়ির কাছাকাছি লিচু বাগানের কাছে এসে বন্ধুদের বললাম-‘আমার তাড়া আছে,আমি লিচু বাগানের মধ্য দিয়ে শর্টকাট মারছি।’
ওরা বলল-‘এই সাঁঝবেলায় আবার জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতে যাবি কেন?’
আমি পাত্তা দিলাম না। বাগানের মধ্যিখানে রয়েছে মস্ত বড় দিঘি। আমরা বলতাম নয়ান দিঘি। গাছপালা ছায়ায় দিঘির জল কালো হয়ে থাকত। ভাবলাম বাড়ি যাবার পথে দিঘিতে একটা ডুব দিয়ে যাই। বাঁধানো ঘাট বেয়ে কয়েক পা নামতেই নজরে পড়ল তাকে। আধো সন্ধ্যার আবছা আলোয় প্রথম দেখা। সেদিন বোধ হয় শুক্লা চতুর্দশী হবে। গাছপালার ফাঁক ফোকর গলে রূপো রূপো জোছনা ঝরে পড়ছে। তার মধ্যে পিঠময় একঢাল এলো চুল ছড়িয়ে,কোমর পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে,চিবুক তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছে। পরণে ডুরে শাড়ি। অপরূপ লাবণ্যময়। আমার  কেমন ঘোর লেগে গেল। অবাক হয়ে তাকে দেখে যাই । চেনা মুখ নয়,গাঁয়ের কোন মেয়ে বলে তো মনে পড়ছে না। হঠাৎ সচেতন হয়ে গলা খাকারি দিতেই মেয়েটি ঝুপ করে ডুব দিল। তারপর ডুব সাঁতার দিয়ে কোথায় যে গেল জানিনা। স্নান করা হল না। ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে আসি। মনের মধ্যে আঁকা হয়ে গেছে তার ছবি। দিনরাত মেয়েটির কথা মনে পড়ে। কাউকেই বলতে পারছি না। চুপি চুপি দু চার বার নয়ান দিঘির আসে পাশে সময়ে অসময়ে ঘুরে এসেছি। কিন্ত তার আর দেখা পাইনি।
             ইতিমধ্যে আমাদের জীবনে এল দুর্যোগ। একদিন দুপুরে রান্না করতে করতে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন মা। মাস দুয়েক বাদে মারা গেলেন বাবা। কোর্টের কাজে বাবা কোলকাতা এসেছিলেন,সেখানেই বাস অ্যাক্সিডেন্টে হঠাৎ মৃত্যু। পরপর দুটো মৃত্যু আমাকে একেবারে ধ্বসিয়ে দিল। আমি নাবালক বলে আমাদের সমস্ত সম্পত্তির দায়িত্ব নিলেন কাকা। তিনি ধীরে ধীরে আমাকে সম্পত্তি থেকে বাদ দিতে চাইলেন। আমার বড় দাদা ছিল উন্মাদ। তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হত। তার তো কোনকিছু পাবার কথাই নয়। তখন অবশ্য আমি অত কিছু বুঝিনা। কিন্ত পাড়া প্রতিবেশীরা কিছু কিছু বোঝাবার চেষ্টা করত। পুরোনো চাকর বদ্রীনাথ আমাকে খুব দেখাশোনা করত।
সে খালি বলত-‘দাদাবাবু,তাড়াতাড়ি নিজের জিনিস পত্তর দেখে নিতে শেখ।’
আমার এসব বিষয় আসয় ভাল লাগত না। খালি মনে মনে ভাবতাম সেই সাঁঝবেলার জলকন্যেকে। মাঝে মাঝে স্বপ্নও দেখতাম। পাগলের মত হয়ে এখানে ওখানে খুঁজে বেড়িয়েছি অনেক। কিন্ত কোথাও তাকে পাইনি। বদ্রীদা রাগ করত-‘কী দিনরাত ভাব এত বলত? আমার তো মনে হয় ভাবতে ভাবতে শেষটায় তুমি তোমার দাদার মত না হয়ে যাও।’
কাকা ধীরে ধীরে আমার অংশের সমস্ত জমি জায়গা আমাকে দিয়ে সই সাবুদ করিয়ে বিক্রি করতে লাগলেন। সে টাকার ভাগ আমি কিছুই পেলাম না। অবশেষে আমার বিয়ের বয়স হল। পাঁচ জনের পাঁচ কথা বলে তাই কাকা আমার  বিয়ের খোঁজ করলেন। কাকিমা সম্বন্ধ করলেন তাঁর ভাইঝির সঙ্গে। আমি হ্যাঁ না কিছুই করিনি কারণ আমার কিছুতেই কিছু যায় আসে না। এমন এক দিনে আবার তার সঙ্গে আমার দেখা।
               বদ্রীনাথের সঙ্গে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম ভিন গাঁয়ের এক পুকুরে। দুপুর থেকে ছিল ফেলে বসে আছি তো আছিই। মাছ তেমন কিছুই ধরতে পারিনি। হঠাৎ মাঝ পুকুরে দেখতে পেলাম তাকে। রোদ্দুরের আলোয় ঝক ঝক করছে রূপ। রূপোলি জলে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে হলদে লালে ডুরে শাড়ি পরা সোনালি এক মাছ। চারদিক ভুলে চেঁচিয়ে উঠলাম। -‘ওই তো,ওই তো। এতদিন পরে আবার।’ বদ্রীনাথ ছিপ ফেলে ছুটে এসে বলল-‘কি হল,চেঁচাচ্ছ কেন দাদাবাবু? মাছ তো সব পালিয়ে যাবে।’ আমার তখন মাছ টাছ মাথায় উঠেছে। আমি শুধু বলছি-‘ওই তো,ওই তো।’ এই বলতে বলতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম জলে। সাঁতার জানিনা এমন নয় অথচ কি যে হল,টের পেলাম কি এক টানে,অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। ওদিকে সেই জলকন্যেও উধাও। বদ্রীনাথ সব ব্যাপার দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও আমাকে ডুবে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। কোনরকমে টেনে দিয়ে উদ্ধার করে আমাকে। এদিকে আমি বেহুঁশ। জল খেয়ে আমার পেট ফুলে ঢোল। বদ্রীনাথ অনেক কায়দা কানুন করে জল বার করে আমার জ্ঞান ফেরায়।
             জ্ঞান ফিরলে বদ্রীনাথ বলে-‘কি দেখে অমন ঝাঁপিয়ে পড়লে দাদাবাবু?’
আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে  থাকি। তারপর কোনরকমে বলি-‘জলকন্যে।’
বদ্রীনাথের ভুরু কুঁচকে যায়। ‘তোমারেও কি বংশের রোগে ধরল? নইলে দুককুর বেলায় জলের মধ্যি মচ্ছকন্যে দেখতিছ। থাক,আর মাছ ধরে কাজ নেই। বাড়ি চল।’
          বাড়ি ফিরে আবার দিন রাত চোখের সামনে সেই জলকন্যে ভেসে বেড়ায়। কোন কিছুতে মন দিতে পারি না। এদিকে বিয়ের কথাবার্তা পাকা হতে চলেছে। সেই সময় ঘটল সেই দারুণ দুর্যোগ। আমাদের গাঁয়ের মরা নদীতে সেবার ভয়ংকর বান এল। গোটা গ্রাম ভেসে গেল। আমাদের বাড়িতেও জল উঠল। আমরা কোন রকমে প্রাণ বাঁচালাম। মারা গেল আমার পাগল দাদা। ঘরে জল ঢুকে শেকল বাঁধা অবস্থায় সে মারা যায়। বাড়ির বিরাট অংশ বন্যায় নষ্ট হল।
          আমার মন উঠে গেল সব কিছু থেকে। মনে হল ওই জলকন্যেই আমার নিয়তি,আমার প্রেম,আমার ধ্বংস। ওকে যখনই দেখব,তখনই আমি নিঃস্ব হব,নিঃশেষ হব। কিন্ত ওকে ছাড়া আমার গতি নেই।
           কাকা সম্পত্তির ব্যাপারে আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে চাইলেন। আমি বললাম ‘আমার কিছু চাই না। আমি এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে চাই। আমি বিয়েও করব না।’
কাকী বলল-‘কোনদিন যে তোমার মত বদলাবে না তাই বা কে জানে?’
কাকা বললেন- ‘ঠিক  আছে,আমি তোমায় কিছু টাকা দিয়ে দিচ্ছি,তুমি তোমার অংশ আমায় লিখে দাও।’
তাই দিলাম। তারপর চলে এলাম গ্রাম ছেড়ে। অনেক দিন নানা জায়গায় ঘুরে ফিরে এখানে এসে দোকান খুললাম। বেশ কিছু বছর তো হয়ে গেল। চলে যাচ্ছে কোন রকমে। আমার তো কিছু চাই না। আমি শুধু অপেক্ষায় আছি। ওকে শেষ দেখা দেখবার।
          আমরা স্তব্ধ হয়ে থাকি। টিনের চালে অবিরাম বৃষ্টি ঝরে পড়ে। দেবা নীরবতা ভাঙে-‘এ তুমি কী গপ্পো শোনালেন বাঘাদা,একি প্রেমের গপ্পো না ভূতের গপ্পো,কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।’
এর পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। আমরা এ গল্প কাউকেই বলিনি। এমনকি বাঘাদার কাছেও দিনের বেলা আড্ডা মারার সময় হাসি ঠাট্টার ছলে এ প্রসঙ্গ তুলিনি। কিন্ত মাস দুয়েক বাদে এক সকাল বেলায় একটা খবর শুনে আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম।…বোস পুকুরে ভেসে উঠেছে বাঘাদার মৃতদেহ। এটা দুর্ঘটনা কি আত্মহত্যা তাই নিয়ে প্রচুর জল্পনা কল্পনা চলছে। শুনলাম আগের দিন দুপুরের দিকে বাঘাদা শহরে গিয়েছিল মালপত্র কিনতে। হয়ত ফেরার পথে বোসপুকুরের ধার হয়ে ফিরছিল। …আমরা কোন হৈ চৈ আলোচনায় অংশ নিলাম না। কারণ একমাত্র আমরাই জানি প্রকৃত সত্য কি।
************************************

সাথী সেনগুপ্ত পরিচিতি:
প্রায় দু দশকের ওপর ছোটগল্প লিখছেন। প্রকাশিত হয়েছে দেশ,সাপ্তাহিক বর্তমান,উনিশ কুড়ি,ফেমিনা বাংলা,তথ্যকেন্দ্র,আনন্দমেলা,সন্দেশ,শুকতারা প্রভৃতি বিখ্যাত বানিজ্যিক পত্রিকায় এবং বিভিন্ন অবানিজ্যিক ছোট পত্রিকায়। প্রকাশিত গল্প সংকলন দুটি। সুহা এবং গুপি চোরের কান্ড। ব্যক্তিগত জীবনে শিক্ষকতা করেন। শখ-আবৃত্তি চর্চা,বইপড়া,ভ্রমণ এবং অবশ্যই লেখালেখি।

 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!