Shadow

বাসা – চিন্ময় চক্রবর্তী

PC: zee news

বাসা

চিন্ময় চক্রবর্তী

চড়ুই পাখিটা বহুদিন হলো বাসাছাড়া। কোথায় বাসা ছিলো তাও মনে নেই আর। শুধু এটুকু মনে আছে যে সেটা ছিলো একটা বিশাল পোড়োবাড়ীর একটা ঘুলঘুলিকি সুন্দর ছিলো জায়গাটা। ওর বাবা কোথা কোথা থেকে মুখে করে খড়ের টুকরো নিয়ে আসতো। কিছু সবুজ সবুজ ঘাসও। তারপর গোল গোল করে ঘুরে ঘুরে বাসা বুনতো।ওর মা আবার সেগুলো পরিস্কার করে নিজের উষ্ণতা দিয়ে আরাম আরাম করে দিতো ঘরটাকে। কি ভাল লাগতো! কি সুন্দর একটা গন্ধ ছিলো তাতে।ঘুলঘুলির সাথে একদম সেঁটে থাকত সেই বাসাটা। বাবা খাবার জন্য যখন ঠোঁটে করে পোকামাকড় নিয়ে আসতো,কি আনন্দ। ছোটো ছোটো পোকা,কেঁচো আরও কত কি।মা খাইয়ে দিত মাঝে মাঝে। নিজের ঠোঁটে করে। চড়ুইটাতো তখনো বেশ ছোটো। ডিম থেকে বেরিয়েছে বেশী দিন হয়নি।
বেশ ছিল দিনগুলো। ঘুলঘুলি দিয়ে রোদ্দুরের আলোও ঢুকতো মাঝে মাঝে আর যখন বৃষ্টির ছাঁট আসতো,মা জোর করে স্নান করিয়ে দিত। চড়াই পাখিটা বায়না করত।স্নান করতে চাইত না একদম। কিন্তু এখন ভাবলে বেশ মজা লাগে আবার কষ্টও লাগে। কি সুন্দর ছিল সেই সময়টা। কত আদর করত বাবা মা। চড়াই পাখিটা খুব আদুরে ছিল না?একটা বিচ্ছিরি দেখতে পাখি মাঝে মাঝেই চলে আসত। খুব জ্বালাত চড়াই পাখিটাকে। দেখতে বেশ বড়। কুচকুচে কালো রঙের। গলার আওয়াজটাও বাজে।একদম ভাল লাগত না ওর। চড়াই পাখির বাবাও ওকে পছন্দ করত না। কিন্তু লড়াই করতে যেত না অনেক বড় না ও? বাবা বলতো বাসাটাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে। ঘুলঘুলিটার দিকে ওই কালো পাখিটার নজর পড়েছে। ওরা বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো।
তারপর এলো সেই ঝড়টা। প্রথমে বৃষ্টির ছাঁট, তারপর সোঁসোঁ শব্দে বাতাস। তারপর পাগলের মত ঝড়। চড়ুইটা আর ওর মা ওর বাবাকে চেপে ধরে বসে ছিল বাসায়। বাবা তার দুটো ডানা দিয়ে প্রানপনে আগলে রাখছিল ওদের। ঘুলঘুলির সামনে বসে রইলো যাতে ঝড়ের ঝাপটা ওদের দুজনের ওপর না লাগে। সে কি ভয়ঙ্কর দিন। খুব কাঁদছিল চড়ুই পাখিটা। কেউ শুনতে পাচ্ছিল না। আকাশের গায়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল বড় বড় গাছের ডাল,পাতা গুড়ুম গুড়ুম করে আওয়াজ হচ্ছিলো। আর চড়াৎ চড়াৎ করে আগুনের হল্কার মত আলো। বাবা আর পারলো না আগলাতে। একটা গাছের ডাল এসে লাগলো বাবার মাথায়। তারপর আর মনে নেই।বাসাটা উড়ে গেল হাওয়ায় আর ওরা দুজন কোথায় উড়ে গেল। তারপর কখন ঝড় থেমেছে চড়ুই পাখিটা জানে না। আকাশে আবার নীল মেঘ,রোদ্দুর। সব আবার আগের মত। কিন্তু বাবা আর মা কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। সেই থেকে চড়ুই বাসাছাড়া। শুধু উড়ে বেড়াচ্ছে। এখন। নিজে নিজেই খাবার সংগ্রহ করে। পোকামাকড়,কেঁচো। কিন্তু তেমন স্বাদ আর লাগে না মুখে। কিন্তু কি আর করবে? খিদে পায় যে!
কিন্তু একটা জিনিস বেশ অবাক লাগে। ঘুলঘুলির বাইরের পৃথিবীটা যে এত্তো বড় সেটা সে কোনোদিনও বোঝেনি আগে। কি বিরাট উড়ে বেড়ানোর আকাশ। কত গাছ,আরো ওর মত কত পাখি! এগাছ ওগাছ এডাল ওডাল করে উড়ে বেড়ায় চড়ুই। কোনো সময় কোনো বাড়ির এঁটোকাটাও খেয়ে নেয় সানন্দেতারপর রাত্তির হলে বড় একা হয়ে যায় পাখিটা। এগাছের কোটর,ওগাছের কোটর করে কাটিয়ে দেয় মনে পড়ে মায়ে তৈরী করে দেয়া নরম বাসার বিছানার কথা। বাবার কথা মনে পড়ে,কি লড়াই না লড়েছিল বাবা ওদের বাঁচানোর জন্য শেষ অব্দি। আর কাউকে দেখতে পাবে না। মা’ও নিশ্চই ওকে খুঁজে বেড়ায়। ভাল কোনো খাবার পেলে নিশ্চই ওকে খাওয়ানোর কথা ভাবে!
চড়াই পাখিটা আকাশে গোল গোল হয়ে ঘুরছে। এই অনেক উঁচুতে,আবার নীচে। এই গাছের মগডালে,আবার বাড়ীর উঠুনে। সে যে কি করে এত ভাল উড়তে শিখলো,সে নিজেও জানে না। কিন্তু বেশ লাগে উড়তে। ওর একটা বন্ধু হয়েছে আজকাল। মানে বান্ধবী। মাঝে মাঝেই চলে আসে ওর কাছে। ওর নাম নাকি চিম্পি। আচ্ছা চড়াই পাখিটার নিজের নাম কি? ওর একদম মনে নেই। আসলে বাবা মার কাছে তো শুধু আদরই খেয়েছে সে। যার যখন যা নাম ইচ্ছে হতো,সেই নামেই ডাকতো তাকে। তারপর তো কতদিন কেউ ওকে ডাকেই নি। চিম্পু বললো,ওকে কিছু একটা নামে ডাকবে। কি নামে ডাকা যায়? ঠিক হলো,টুমকু বলে ডাকবে। কেন? তা জানে না। কিন্তু খুব বন্ধু হয়ে গেল ওরা।
চিম্পু অনেক গল্প করে। ওর বাবা মার গল্প,নতুন নতুন পোকার গল্প,অমুক বাগানে কি ফুল ফুটলো তার গল্প,কোন বদমাশ পাখিটা তার কাছে ঘেঁসতে চায় তার গল্প,সব। টুমকু শুধু শোনে। তার তো অত গল্প নেই। সে ভাবে,বাবা মার চলে যাবার পর তার বোধহয় সব গল্প শেষ। তাই সে শুধু শোনে আর অবার চোখে দেখে চিম্পিকে। চিম্পি বলেছে একদিন টুমকুকে নিয়ে যাবে ওর বাবা মার কাছে। কিন্তু  যেতে চায়না। ভাল লাগে না ওর।
চিম্পু কিন্তু বেশ সুন্দর গান গাইতে পারে। টুমকু চেষ্টা করেছিলো,কিন্তু পারেনি।  খালি পারে উড়ে বেড়াতে। মনে মনে ভাবে,কবে যে পুরো আকাশটা  উড়তে পারবে,কত্ত বড় ওই নীল আকাশটা। টুমকুর ডানার জোর এখন অনেকটাই বেশী। ওর মনে পড়ে ওর বাবার শক্ত মসৃণ ডানাদুটোর কথা। কিভাবে কত প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আটকে রাখতো তাদের। ওর ইচ্ছে ওর ডানা হোক এতটাই শক্তিশালী। সেও বড় হয়ে আগলাবে। কিন্তু কাকে?
টুমকুর তো তেমন কেউ নেই যাকে  আগলে রাখবে। আচ্ছা,চিম্পু তো আজ এখনো এলো না। সকাল হলেই আজকাল চিম্পির কথা মনে হয়। কখন যে  আসবে! চিম্পি কিন্তু বেশ মিষ্টি। একটু বেশী কথা বলে। তা বলুক। টুমকুর তো তেমন কিছু বলার নেই। সে অনেক কিছু ভাবে। কেমন যেন উদাস হয়ে যায় মাঝে মাঝে। তখন কিচ্ছু ভাল লাগে না তার। দিনের বেলা বেশ গরম,কিন্তু বিকেলের দিকটা বেশ লাগে। বেশ সুন্দর বাতাস বয়। কোকিল ডাকে। বেশ লাগে মাঝে মাঝে।
মেজাজ খিঁচড়ে থাকলেও কোকিলের ডাক কানে আসে। ডাকটায় একটা সুর আছে বটে,তবে একঘেয়ে। মাঝে মাঝে ভালই লাগে,তবে মেজাজটা ভাল থাকলে। কিছু একটা আটকে আছে মাথায় যেন। মাথায়? না,গলার কাছে। ভাল লাগছে না কিছু। এই ভাল না লাগাটা বেলার সাথে বাড়ে। খিটখিটে লাগে নিজেকে। চিম্পু আসছে। এসেই শুরু করবে ওর গল্প। টুমকুর নিজের যে কোনো গল্প নেই কেন,কে জানে? খুব সাধারণ ঘটনাও চিম্পু বেশ মিষ্টি করে বলে আর হাসে। বেশ লাগে। খিটখিটে মেজাজটা চলে যায়। কোকিলের ডাকটাও ভাল লাগে।
আকাশে উড়তে উড়তে চড়ুই পাখিটা,মানে টুমকু অনেক কিছু শিখে গেছে। কত রকমের পাখি দেখেছে আকাশে। কতরকমের খাবার পোকামাকড় চিনেছে। কোথায় গেলে বেশী খাবার পাওয়া যায় টুমকু জানে। কয়েকটা পাখিকে দেখেছে তারা কি সুন্দর শিস্ দিয়ে গান করে। একটা সবুজ রঙের পাখি আবার কেমন নকল করতে পারে মানুষ নামের একটা জন্তুর ডাক। অনেক কিছু শিখেছে সে। ঝড় আসার আগেই সে বুঝতে পারে এখন। তাড়াতাড়ি কোটরে ঢুকে যায়। টুমকু এদিন দেখে একটা বাঁশের খাঁচার মধ্যে অনেক পাখি। ওই মানুষ নামের জন্তুটা ওদের নিয়ে কোথায় যাচ্ছে।
টুমকুর কেমন যেন ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল ওই জন্তুটা সেই কালো পাখিটার থেকেও খারাপ। জন্তুটার চোখে কেমন যেন লোভ। বাবার কাছে মাঝে মাঝে মানুষদের গল্প শুনেছে টুমকু। মানুষ কাছে আসলেই নাকি উড়ে যেতে হয়। ওই জন্তুটা যে পাখিগুলোকে খাঁচায় নিয়ে যাচ্ছিল ওরা মনে হয় উড়তে পারে না। ওদের ডানায় জোর নেই।
টুমকুর হঠাৎ চিম্পুর জন্য মন খারাপ করলো। ওকে দেখতে ইচ্ছে করলো। ভয় হলো চিম্পুকে নিয়ে।  যদি কোন বিপদে পড়ে। অবশ্য ওর বাবা আছে যদিও,তবু। কি মনে হলো,টুমকু একটা একটা করে খড় যোগাড় করতে লাগলো। ঠিক বাবা যেমন করতো। তারপর একটা বড় বটগাছের সুন্দর কোটর খুঁজে তাতে জমাতে লাগলো সেগুলো। চিম্পুর তা দেখে কি আনন্দ। সেও লেগে গেল কাজে। তার ছোট্ট ঠোঁট দিয়ে গাঁথতে লাগল সব খড়,সুতো,ঘাস। কদিন পরে তৈরী হল কি সুন্দর একটা বাসা। টুমকু তাকিয়ে দেখছে আর কি যে খুশী হচ্ছে,চিম্পু টুমকুর চারিদিকে ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগলো। আর বলতে লাগলো যে সেও টুমকুর সাথে এখন থেকে ওই বাসাতেই থাকবে।
টুমকুর ভাল লাগলেও একটু অস্বস্তিও হলো।  তো একা একা দিন কাটায়। চিম্পুকে নিয়ে কি করে থাকতে হয়,তা তো জানে না সে। সে যে শক্ত ডানায় ভর করে আকাশে আকাশে ঘুরে বেড়ায় ক্লান্ত হলে ঘুমিয়ে পড়ে যেখানে সেখানে। চিম্পুর কথা ভাবে আর কোকিলের গান শোনে। বাসার মধ্যে সারাদিন সে থাকবে কি করে? চিম্পু তো কোনো কথাই শোনেনা। কোত্থেকে এক রঙিন শাড়ীর টুকরো নিয়ে নতুন বাসাতে হাজির। টুমকু তাকিয়ে দেখছে। মনে পড়ছে তার বাবা মার কথা। চিম্পুর গায়ে কেমন যেন মা মা গন্ধ। টুমকুর ভাল লাগতে লাগলো। বাসার ভিতর থেকে উঁকি মেরে আকাশটা দেখলো। কেমন জানি অন্যরকম। চিম্পুর খিদে পেয়েছে। এক দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এলো কিছু খাবার। চিম্পুকে খাওয়ালো,নিজেও খেলো।
তারপর তাদের একটা ছোট্ট ডিম হলো। নিজেদের ডিম। তেলা মসৃণ তার গা। তার ওপর হালকা খয়েরি ছোপ ছোপ। ওরা খুব আদর করলো ডিমটাকে। খুব খুউব। টুমকুর ডানাগুলো বাসার দরজা আগলে রাখলো আর চিম্পু বসে রইলো ডিমটাকে কোলে নিয়ে। নাওয়া খাওয়া ভুলে ওরা ডিমটাকে পাহারা দিতে লাগলো।ওই কালো পাখিটাকে অথবা ওই দুপেয়ে জন্তুটাকে খুব চেনে টুমকু। কিছুতেই ওদের কাছে আসতে দেবে না। আর বাসাটাকে ঠেলতে ঠেলতে গাছের কোটোরটার একদম ভিতরে নিয়ে গেল সে। যাতে ঝড় এলেও কিচ্ছু হয় না চিম্পু বা ওই ডিম ফোটা ছোট্ট বাচ্চা পাখিটার। টুমকু তাকিয়ে দেখে বাচ্চা টাকে।  আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। রোজ ওর বড় হওয়া দেখে ওরা দুজনে মিলে। ওরা ওর নাম দিয়েছে চিকলু। টুমকু ওকে আকাশের গল্প শোনায়। চিম্পি শোনায় গান। টুমকু তার ডানার জোর দেখায় ওকে। চিম্পি ওকে চেনায় রঙ।
ওদের বাসায় এখন একটা প্রজাপতি আসে মাঝে মাঝে। চিকলু ওকে পাখি ভেবে বন্ধু করতে চায়। টুমকুর এখন অনেক অনেক গল্প। সব শোনায় চিকলুকে। খুব ইচ্ছে করে মা যদি একবার খুঁজে পেতো ওকে! বাবার কথাও খুব মনে পড়ছে আজ।।
*************************************


চিন্ময় চক্রবর্তী পরিচিতি
জন্ম ১৯৬৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি চন্দননগরে।রসায়নে সাম্মানিকের পর পরিবেশ বিজ্ঞানে স্নাতোকোত্তর। তারপর কর্মসূত্রে নানান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার বুড়ি ছোঁয়া। তার মধ্যে আই আই এম কলকাতা উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম প্রথম সারির বহুজাতিক সংস্থায় পূ্র্বভারতের বাণিজ্যিক কর্ণধার। কবিতা রাজ্যে বিচরণ করা নিজের মনের জানালা খোলা রেখে। ইতিমধ্যেই চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত: আমার আকাশ,ভেঙেছে আকাশ,মেঘের ওপারে তারার খোঁজে এবং সাঁঝবেলার আগুনপাখি ।।

 

 

 

 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!