।। সংস্কার ।।
সোনালী গুহ
আজ সকাল থেকেই মুখুজ্জে বাড়িতে দারুণ হইচই। ঊষা মুহূর্তে দেহ রেখেছেন বাড়ির অশীতিপর গিন্নি।
মৌশল গ্রামের একদা জমিদার ছিলেন রাধারমণ মুখুজ্জে। এই গ্রামে তাঁদের প্রায় দশ পুরুষের বাস। অনেক জায়গা,ধানি জমি,পুকুর নিয়ে তাঁদের সাম্রাজ্য। বাড়িতে নিষ্ঠা ভরে পালা,পার্বণ সবই হয়। বড় করে হয় শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে মনসা পূজা। মন্দির আছে স্বতন্ত্র। এছাড়া দুর্গা দালানেই সব পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সারা গ্রাম ভেঙে পড়ে। একটাই দুর্গাপূজা গ্রামে। পুরো গ্রামের মানুষ নিজেদেরই পূজা জ্ঞানে সব কাজকর্মে হাত লাগায়। আগে পিছে প্রায় একমাস এই বাড়িতেই সকলের পাত পরে দুইবেলা। সে এক এলাহী ব্যবস্থা। আলাদা সব বাঁধানো জায়গা আছে,রান্না,খাওয়ার। সকলে হাতে হাতে কাজ করে। সেও এক আনন্দ। কর্তা মশাই দেহ রাখার পর রাধারমণ বাবু বাড়ির কর্তা। গিন্নিমা শয্যাশায়ী ছিলেন বেশ কয়েক বছর ধরেই। আজ ভোরে তিনি পরলোকগমন করেন।
সারা গ্রামে এই দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলোনা। যে যেমন অবস্থায় ছিল,দৌড়ে এলো। নানান জনে নানান কথা বলে বিলাপ করতে লাগলো। বৈঠক খানা ঘরে রাধারমণ বাবু বসে আছেন আরাম কেদারায়,মাথায় হাত রেখে। মা ছিলেন এই সংসারের মূল মানুষ। শুয়ে শুয়ে ও তিনি বৌমা হেমলতা এবং রাধারমণ বাবু কে সব নির্দেশ দিতেন। স্পষ্টতই তিনি বেশ বিভ্রান্ত।
“রাধা,চুপটি করে বসে থাকলে হবে? বাবা! তোর তো মাতৃদায়। ওঠ বাবা! দেখ,কি ব্যবস্থা হচ্ছে। মা ঠাকুরুণের শেষ ইচ্ছা কিছু ছিল নাকি? তবে সেটাও তো বিবেচনা করতে হবে। বামুনের ঘরের নিষ্ঠাবতী বিধবা। তাঁর শেষ যাত্রার আয়োজনে যেন কোনো ত্রুটি না হয়,সেটা দেখতে হবে তো!”….. বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন গ্রামের নিতাইজ্যাঠা। তিনিই এই মুহূর্তে গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি।তাঁর মতামতের দাম আছে।
রাধারমণ বাবু তবুও চুপ।জ্যাঠা বললেন,”শোক করার অনেক সময় পাবে বাবা,এখন যে কর্তব্য করার সময়।” এবারে মাথা তুললেন রাধারমণ বাবু। ধরা গলায় বললেন,”জ্যাঠা মশাই,মায়ের নির্দেশ তাঁর দেহ দান করতে হবে।”…ঘরে বাজ পড়ল যেন। কী!!! বামুনের বিধবা মারা গেলেন,তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া হবে না? দাহ করা যাবে না? অসম্ভব। গ্রামস্থ সমাজপতিরাও আঁতকে উঠলেন। না না এই কাজ ঘোর অন্যায়। সভা বসলো উঠোনে। সেখানে নানা বাকবিতণ্ডার পরে রায় হল,এই ইচ্ছার কোনো শাস্ত্রীয় বিধান নেই, অতএব,মানার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু জমিদার বাবু তো কোনোদিন মায়ের কথার অন্যথা করেননি,আজ কী ভাবে সেটা করেন!!! কিন্তু হেমলতার দোলাচল মন অনেক কষ্টে কঠোর হল। তিনি চিকের আড়াল থেকে নির্দেশ দিলেন,প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে। রাধারমণ বাবু খবর দিলেন স্থানীয় ডি এম অফিসে। সেখান থেকেই খবর গেলো কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। যথা সময়ে গাড়ি এলো। লোকে লোকারণ্য!!! গরদের সাদা থান কাপড় পরিয়ে,চন্দনে সুসজ্জিত করা হল গিন্নিমাকে। সারা গ্রামের মানুষ চোখের জলে বিদায় জানালেন তাঁকে।
এবারেও রাধারমণ বাবু অন্তঃপুরের নির্দেশই মেনে চললেন। ষাটের দশকের গ্রাম বাংলায় লোকাচার,কুসংস্কারের বেড়া জাল ভেঙে হেমলতা আরেকটি ঘোষণা করলেন,”আজ থেকে কোনো অশৌচ পালন ও করা হবে না। মায়ের নির্দেশ ছিল।” একটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হল গ্রামে। নিন্দার ঝড় উঠলো। কিন্তু মুখুজ্জে পরিবারের সিদ্ধান্তে কোনো বদল ঘটলো না। শ্রাদ্ধ শান্তি হল,কিন্তু দারিদ্র্য নারায়ণ সেবা ই হল বেশি করে। মায়ের নামে জমিদার বাবু একটা স্কুল,হাসপাতাল গঠন করলেন। সেবামূলক কাজে নিয়োজিত করলেন শ্রাদ্ধের বরাদ্দের বিপুল অর্থ। সমালোচনার ঝড় উঠলো। সংস্কারকামী মানুষ যোগ দিলেও বেশির ভাগই এড়িয়ে চলতে লাগলো রাধারমণবাবুকে।
এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর গ্রামের নিতাই জ্যাঠা,একদিন অনেক দ্বন্দ্ব দ্বিধা উপেক্ষা করে ধীর পায়ে এসে হাজির হলেন জমিদারবাড়ির বৈঠকখানা ঘরে। তখন সবে সকালের প্রাতরাশ শেষ করে জমিদার রাধারমণবাবু প্রস্তুতি নিচ্ছেন বৈঠকখানায় যাবেন বলে। খবর এলো নিতাইজ্যাঠা দেখা করতে এসেছেন। শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন জমিদারাবাবু। আবার না জানি কোনো বিধান দিতে এলেন জ্যাঠা! হেমলতা আশ্বাস দিলেন,”এত ভাববার কি আছে? গিয়েই দেখো উনি কি বলেন!”…. স্ত্রীর কথায় পায়ে পায়ে রাধারমণবাবু উপস্থিত হলেন বৈঠকখানায়। জ্যাঠাকে প্রণাম করে তিনি বললেন,”তা জ্যাঠামশাই,আপনি আজ হঠাৎ কী মনে করে? সব কুশল তো?”… নিতাইজ্যাঠা ধীরে তাঁকে আশীর্বাদ করে বললেন,”বাবা রাধা! তোমার কাছে আমি আজ এক বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি।”… “বলুন জ্যাঠামশাই”…জমিদারবাবু জানতে চাইলেন।
নিতাইজ্যাঠা বেশ ইতঃস্তত করে,বেশ কিছু সময় নিয়ে বললেন,”বাবা রাধা! আমার বয়স হয়েছে প্রায় চার কুড়ি। জীবনে অনেক দেখলাম। তবে সত্যি বলছি,পুঁথিগত বিদ্যা আমার তেমন নেই। পাঠশালার পণ্ডিত যেটুকু শিখিয়েছেন,আর আমাদের চণ্ডীমন্ডপের পুরুত ঠাকুরের কাছে যা শুনেছি শাস্ত্রের বচন। তাই নিয়েই আজীবন বড়াই করে চললাম । গাঁয়ের মোড়লগিরিও কম করলাম না। কিন্তু,তোমার মায়ের সিদ্ধান্তের কথা আমি আগে কোনদিনও শুনিনি। এমনও যে করা সম্ভব কোনোদিন ভাবিই নি। তাই প্রথম কথাটি শুনে খুবই অবাক হয়েছিলাম। মুহূর্তে আমার ভেতরের মোড়লটি জেগে উঠেছিল। বাধা দিয়ে কাজটি পন্ড করতে উঠে পড়ে লেগেছিলাম। কিন্তু বৌমার দৃঢ়তার কাছে মাথা নত করতেই হয়,বাবা। ওইরকম পরিস্থিতিতে,গ্রামের সকলের বিরোধিতা করে তিনি গিন্নি মায়ের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিলেন। অনেক ভাবলাম পরে আমি। সত্যি তো,কবর দাও,কি চিতায় পোড়াও মরলে সবই মাটি। তাই যদি হবে,তবে আগামীর ডাক্তারদের জন্য দেহটি দান করে যাওয়ার মত মহৎ কাজটি কেন করিনা!!! ঠিকই করেছো তোমরা।”… একটু দম নেন নিতাই জ্যাঠা। জমিদারবাবু নির্বাক শ্রোতা যেন। কোনোদিন যে তিনি এইরকম কথা শুনবেন সেতো ছিল ভাবনারও অতীত। নায়েববাবু পাশেই ছিলেন। এক গ্লাস জল এগিয়ে দেন জ্যাঠার হাতে। জল পান করে জ্যাঠা বলেন,”এবারে আসল কথায় আসি,বাবা রাধা,তুমি তোমার মায়ের মত আমার মৃত্যুর পর দেহ দানের ব্যবস্থাটি করে দিও,বাবা। এই আমার ঐকান্তিক ইচ্ছা। শেষ ইচ্ছাও বলতে পারো।”… জমিদার বাবুর দুটো হাত ধরে জ্যাঠা আকুল আকুতি জানান। ক্ষণিকের বিহ্বলতা কাটিয়ে রাধারমণবাবু উঠে দাঁড়ান। প্রণাম করেন নিতাইজ্যাঠাকে। “নিশ্চয় জ্যাঠা মশাই। আজ আমি সত্যি সত্যি মাতৃদায় মুক্ত হলাম। আজ মনে হচ্ছে,কুসংস্কার মুক্ত একটা জগৎ আসতে চলেছে। আজ আমার মায়ের ছেলে বলে খুব গর্ব হচ্ছে।”
অন্তঃপুরে শঙ্খ বেজে উঠলো। হেমলতা পূজার ঘরে মাথা ঠেকালেন ঠাকুরের শ্রীচরণে।।
*************************************
সোনালী গুহ পরিচিতি
পেশায় শিক্ষিকা। মাতৃভাষায় কিছুটা মনের আনন্দে লেখালিখি করেন। অত্যন্ত অমায়িক, সবার সাথে মিলেমিশে,সবাইকে নিয়ে চলতে স্বস্তি অনুভব করেন।
বিপ্লবের বাস্তব কাহিনী 👍
চমৎকার বিপ্লবাত্মক কাহিনী 👍