স্বপ্ননীড়
ব্রতী ঘোষ
” শরত আলোর কমল বনে বাহির হয়ে বিহার করে,যে ছিল মোর মনে মনে !” – গুনগুন করে গানটা গাইতে গাইতে প্রজ্ঞা ঘরে ঢোকে ৷
-‘ উহ্! মা! কি হচ্ছে! সবে দশটা বাজে ৷ প্লিজ !
বিন্নি পাশ ফিরে চাদরটা টেনে নেয় ৷ প্রজ্ঞা চুপ করে যায় ৷ এখনকার ছেলেমেয়েদের এই বেলা করে বিছানায় শুয়ে থাকাটা একেবারে অসহ্য লাগে প্রজ্ঞার ৷ আজকে ছুটির দিনে যে গলা ছেড়ে একটু গান করবে-তার উপায় আছে ? ও ঘরে প্রবাল আর এ ঘরে বিন্নি ৷ দুজনেই শুয়়ে আছে ৷ আজ রবিবার – প্রবালকে ডাকা চলবে না ৷ প্রজ্ঞার স্কুলে এ সপ্তাহটা ছুটি ছিল ৷ তাই রবিবারটা একটু হাত পা ছড়িয়ে কাটাচ্ছে ৷ সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা প্রজ্ঞার বরাবরের অভ্যাস | তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের কাজ সেরে ও একটু নিজের মতো করে সময় কাটাতে ভালোবাসে বরাবরই ৷ কখনো একটু আধটু লেখা,কখনো বা গান-কখনো বা কোন বই পড়া-এই নিয়ে ওর সময়টা দিব্যি কাটে ৷ একটা সময় ছিল বিন্নির স্কুল,নিজের স্কুল, প্রবালের অফিস এই সব সামলাতে সামলাতে হিমসিম খেয়ে যেত ও। এখন বিন্নি কলেজে ৷ ওর পড়াশুনোটা ও নিজেই সামলে নেয় ৷ তবে নিজের মতো সময় কাটাতে চাইলেই বা দিচ্ছে কে ? এই যে ওর এখন এই গানটা ভীষণ গাইতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছে কই ? হারমোনিয়ামটা নিয়ে কোন্ ঘরে বসবে ও ? ড্রইংরুমে ? ওদের দুকামরার ফ্ল্যাট – একটা ওদের বেডরুম আর একটা বিন্নির রুম ৷ ওর নিজস্ব কোন ঘর নেই ৷ অথচ প্রজ্ঞা ছোট থেকে একটাই স্বপ্ন দেখতো ৷ ওর একটা ঘর থাকবে এক্কেবারে নিজের ৷ ঘরে পূবের জানালা দিয়ে দিনের প্রথম আলো ওর ঘরে এসে পড়বে ৷ দূরের নীল আকাশটা ওকে দেখে হেসে উঠবে ৷ বর্ষার মেঘ ভেসে যেতে যেতে টুক করে ওর ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইবে ওর মনের মানুষের কথা ৷ ঘরে পর্দার রঙটা হবে হাল্কা নীল,এক পাশের দেওয়াল জুড়ে থাকবে একটা বইয়ের র্যাক,তাতে ওর মনের মতো সব বইগুলো একের পর এক সাজানো থাকবে-ওর যখন যেটা পড়তে ইচ্ছে করবে তক্ষুণি সেটা বার করে পড়বে ৷ কিন্তু বিয়ের আগে ওকে পারমিতা,ওর বোনের সঙ্গে ঘর ভাগ করতে হতো আর এখন প্রবালের সঙ্গে ৷ আচ্ছা ! ওর কি এমন একটা মনের মতন ঘর থাকতে পারে না ? এটা কি খুব বেশি চাওয়া ?
ও আজই প্রবালকে বলবে ৷ ওরা একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট কিনবে ৷ আর তাতে ওর একটা ঘর থাকবে – একদম নিজের ৷
-‘ কই ! চা দেবে ?’ – প্রবাল উঠেছে এতোক্ষণে ৷
প্রজ্ঞা একেবারে চা নিয়ে শোবার ঘরে ঢোকে ৷
-‘ এই নাও – ‘
-‘ আজ কি বিকেলে সুবিনয়দার বাড়ি যেতে হবে ?’
-‘হ্যাঁ ! সে তো কথা হয়েই আছে ৷ ‘
-‘ ছুটির দিনগুলো এই ভাবে গল্প করে নষ্ট করার কোন মানে হয় ? ‘
-‘ তার মানে ? তুমি যাবে না ? ‘
-‘ যাবো ৷ তবে অনিচ্ছায় ৷ ‘
-‘ বেশ তাহলে যাবো না ৷ সুবিনয়দাকে বলে দিচ্ছি ৷’
-‘ দেখো ! রাগ কোর না ‘ – প্রজ্ঞা প্রবালের পাশে এসে বসল ৷
– ‘আমার একটা কথা ছিল ৷ ‘
-‘ বলে ফেলো ! ‘
-‘ শোন না ! আমাদের একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট কেনো না গো !! এই ফ্ল্যাটটা বেচে দাও ৷ ‘
প্রবাল ঘুরে তাকায় প্রজ্ঞার দিকে !
-‘আমার একটা ঘর চাই – একেবারে নিজস্ব ৷ আমি গান করতে পারি না – পড়াশুনো করতে পারি না ৷ এ ঘরে তুমি – ও ঘরে বিন্নি ৷ ‘
-‘ তোমার কি মাথা খারাপ হলো ? বিন্নির পড়াশুনো, এই ফ্ল্যাটের ই এম আই – আমার নাভিশ্বাস উঠছে ৷ তুমি পারো বটে ! ‘
-‘ আমার যা জমানো টাকা আছে, আমি সব দিয়ে দেবো ৷ ‘
-‘ এসব ভূত মাথা থেকে তাড়াও ! বুঝলে ! ‘
*************
কল্যাণীর আজ সব বাড়ি কাজ করে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল ৷ ওর ছেলে কার্তিকের বউ, রত্না দুবেলা ই রান্নাটা করে। তাই সে নিয়ে চিন্তা নেই ৷ বাড়ি ফিরেই খেতে পায় ।
-‘মা তাড়াতাড়ি চান করে চলে এস – তোমার ছেলের খাওয়া হয়ে গেছে ৷ ‘ ‘হ্যাঁ রে মা ! এই যাই আর আসি ৷ ‘
চান করে ধূপটা জ্বেলে লক্ষ্মীর আসনে মাথা ঠেকিয়ে শাশুড়ি, বৌমা খেতে বসে,’ কার্তিক কোথায় বৌমা ?’
-‘ এই তো রবিদার বাড়ি গেল ৷ বললো এক্ষুণি আসছে ৷ ‘
রবিবার দুপুরবেলাটা ছেলে বৌমাকে ওদের একটিমাত্র ঘর ছেড়ে দিয়ে কল্যাণী বারান্দায় শোয় ৷ গরমকালেও একই ব্যবস্থা ৷ তবে শীতকাল আর বর্ষাকালে কার্তিক ওর মাকে বারান্দায় শুতে দেয় না ৷ দুদিন বাদে আর একজন সদস্য বাড়তে চলেছে ঘরে | সে ও থাকবে একই ঘরে | কি যে হবে – মা ষষ্ঠীই জানেন ৷ কল্যাণী অনেক চেষ্টা করে – কিছু টাকা জমানোর ৷ এই বেণী কলোনীতে পঁচিশ বছর কাটিয়েছে ৷ আর না !! এবার ও টাকা জমিয়ে একটা জমি কিনবে ৷ হোক না একটু গ্রামের দিকে ৷ তাতে ক্ষতি নেই ৷ এই দেড়কাঠা জমি হলেই হবে ৷ তাতে দুটো ঘর তুলবে ৷ একটা ওর ঘর আর একটা কার্তিকের ৷ ওর বড় শখ – একটা বড় করে লক্ষ্মীর আসন পাতবে তাতে ৷ একটা ছোট টিভি কিনবে ৷ কাজ থেকে ফিরে সন্ধেবেলায় আর মঙ্গলার ঘরে যাবে না ৷ নিজের ঘরে খাটের ওপর বসে টিভি দেখবে তেলে ভাজা মুড়ি খেতে খেতে ৷ সবই মায়ের ইচ্ছা ৷ মা গো ! নাতি নাতনিটা ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক ৷ তারপর জমিটা কিনবে ৷ ভুবন বাবুকে বলে রেখেছে আর ছেলেকে না জানিয়ে কিছু টাকা দিয়েও রেখেছে ৷
**************
মাস ছয়েক পর –
কল্যাণী কাজ নিয়েছে প্রজ্ঞার বাড়িতে – তা প্রায় মাস ছয়েক হলো ৷ এসে থেকে শুনে আসছে বৌদির মুখে – যে বৌদি একটা ফ্ল্যাট কিনবে ৷ ওকে বলেওছে কোথাও কোন ভালো ফ্ল্যাট পেলে বলতে ৷ প্রজ্ঞা বৌদির সঙ্গে ওর এই ব্যাপারে ভারি মিল ৷ দুজনেই একটা মনের মতো মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে চলেছে | জমিটা একবার কিনতে পারলেই ধার দেনা করে ও ঠিক দুটো ঘর তুলে নেবে টিনের ছাউনি দিয়ে ৷
দিন দুয়েক পরের কথা –
প্রজ্ঞা ওদের পাশের পাড়ায় একটা ফ্ল্যাটের খোঁজ পেয়েছে এক কামরার ৷ প্রোমোটার হলো সুজিত – ওর বন্ধু মহুয়ার ভাই ৷ ওদেরই বসত বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাট হচ্ছে ৷ সেটারই তিনতলায় একটা এক কামরার ফ্ল্যাট, কিচেন ডাইনিং, দুটো বাথরুম সমেত কুড়ি লাখ পড়বে ৷ এই মুহূর্তে পাঁচ লাখ দিয়ে বুকিং করতে হবে ৷ প্রবাল প্রথম দিকে আপত্তি করলেও এখন প্রজ্ঞার মরিয়া ভাব দেখে নিমরাজি হয়েছে বাধ্য হয়েই ৷ মাঝে মাঝে ও এখানে এসে থাকবে ৷ এখানে একদম নিজের মতো করে সময় কাটাবে ৷ মনের মতো করে ফ্ল্যাটটাকে সাজাবে, ঠিক যেমনটি ও স্বপ্ন দেখে এসেছিল ছোট থেকে ৷ আগামীকাল প্রবাল আর বিন্নিকে নিয়ে ও ফ্ল্যাট দেখতে যাবে ৷
সপ্তাহ খানেক পর প্রজ্ঞার বাড়িতে –
কল্যাণীর বেল শুনে প্রজ্ঞা ফ্ল্যাটের দরজাটা খুলে দিয়ে সোফায় এসে বসে ৷ কল্যাণী বৌদির মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারে আজ কিছু একটা হয়েছে ৷ তবে চট্ করে প্রজ্ঞাকে কিছু বলতে ও ভয়ই পায় ৷ দিদিমণি বলে কথা – কত কিছু জানেন উনি ৷ মনে মনে বেশ ভক্তিই করে ওকে ৷ অনেক আশা ছিল মেয়েটা পড়াশোনা করে ইস্কুলের দিদিমণি হবে ৷ তা সে কপালে থাকলে তো ! সাত তাড়াতাড়ি বে করে এখন সে দু বাচ্চার মা – পোড়া কপাল ৷
রান্নাঘর থেকে ও দাদা বৌদির কথা শুনতে পায় ৷
-‘প্রজ্ঞা – বোঝার চেষ্টা করো ৷ মা অসুস্থ ৷ প্রতীক টাকা পাঠাতে বলছে বার বার ৷ তুমি যদি এখন কিছু টাকা না দাও তাহলে কি করি বলো তো ! আমার হাত একদম খালি ৷ বিন্নিকে কলেজে ভর্তি করাতে কতোগুলো টাকা লাগলো বলো ! তখন চেয়েছি তোমার কাছে ? ‘
প্রজ্ঞা সব বোঝে ৷ বোঝে প্রবাল হয়তো বা ঠিকই বলছে ৷ কিন্তু এই সপ্তাহেই অ্যাডভান্সের পাঁচ লাখ টাকা না দিলে ফ্ল্যাটটা ও কিছুতেই পাবে না ৷ ওর সমস্ত স্বপ্ন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে ৷ চোখের জল কিছুতেই বাঁধ মানছে না ৷
কাজ সেরে যাবার সময় কোন রকমে বৌদিকে আসছি বলে কল্যাণী হাঁটা দেয় ৷ বৌদির ভেজা চোখের ছবি ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে বারবার | বৌদির কষ্টটা ও যেন বুঝতে পারে পুরোপরি ৷
ঘরে ঢুকে দেখে কার্তিক বসে আছে ৷
‘ কি রে বাবু ? আজ এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি দোকান থেকে ? ‘
‘ওমা ! একটা কথা বলবো ? তুমি রাগ করবে না বলো ৷ ‘
কল্যাণী হেসে ফেলে কার্তিকের কথা বলার ধরনে ৷ মনে পড়ে ছোট থেকে ছেলেটা এমন করেই ওর কাছে বায়না করতো সে বন্দুক কেনার জন্যই হোক বা গুলতি কেনার জন্যই হোক ৷
‘ বল ! বল ! ‘
‘ মা – শিবু ওর বাইকটা বিক্রি করে দিচ্ছে ৷ তুমি টাকা দিলে আমি ওটা কিনবো ৷ পঞ্চাশ হাজার চেয়েছে ৷ এতটা পথ সাইকেলে করে যেতে আসতে কতো সময় লাগে বলো ! রাতে কতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারবো ৷ রত্নারও খুব ইচ্ছে মা ৷ দাও না মা ! দাও না ! আমি কিন্তু শিবুকে কথা দিয়ে দিয়েছি ৷’
কিছুক্ষণ আগে বৌদির স্বপ্নটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে দেখেছিল কল্যাণী ৷ তখন ও জানতো না-তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর স্বপ্নটাও এভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে ৷
রাতে বিছানায় শুয়ে কল্যাণী ভাবে – মেয়েদের নিজের ঘর হয় না ৷ ওর শ্বশুরের মুখে অনেকবার শুনেছে কথাটা | কথাটা কি ভীষণ সত্যি ! তাই বলে কি মেয়েদের একটা নিজের ঘরের স্বপ্নও দেখতে নেই ! !
সে প্রজ্ঞা বৌদিই হোক বা কল্যাণী সব মেয়েদের হয়তো একটা নিজের ঘরের স্বপ্ন বুকে নিয়েই সংসারে মুখ বুজে থাকতে হয় ৷ তবে একদিন নিশ্চয়ই আসবে যেদিন প্রজ্ঞা বা কল্যাণী শুধু স্বপ্নই দেখবে না – স্বপ্নটাকে সত্যি হতেও দেখবে – সেদিনটা হয়তো খুব বেশি দূরে নেই ৷।
************************************
ব্রতী ঘোষের পরিচিতি
জন্ম,পড়াশোনা সবই কলকাতায় ৷ তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা। সঙ্গীত অনুরাগী মানুষটি এখন ভালোবাসেন লিখতে ৷
অ-ধরা স্বপ্ন যা কোনো দিনও সত্যি হয় না, সত্যি জীবনের গল্প…