Shadow

হাফ-সোলের কথা – তাপস দে

PC: Google

হাফ-সোলের কথা 

তাপস দে

হাফসোল কথার প্রথমভাগটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলে দেখা যাবে অনেক রকম হাফ রয়েছে আমাদের অস্তিত্ব জুড়ে। ছোটবলায় আমরা পরেছি হাফ-প‍্যান্ট। সাইকেল চালিয়েছি হাফ-প‍্যাডেল করে। রেশন নিয়েছি হাফ-কার্ডে। হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষায় বসেছি। এঁকেছি হাফ-সারকেল। তারপর খেয়েছি হাফ-চা, হাফ-চাওমিন বা হাফ-সিগারেট। কখনো হাফ-টিকিটে সফর করেছি রেলে। হাফ-টাইমে স্ট্র‍্যাটেজি ছকেছি। হাফ-জরিমানা মুকুবের আবেদন করেছি। হাফ-ছুটি নিয়েছি। অর্থাৎ একপ্রকার হাফাতে হাফাতে বড় হয়ে উঠেছি। এইসব হাফ বারে বারে আমাদের অপূর্ণতার দ‍্যোতনা দিয়েছে। আর ক্রমশঃ ছুটিয়ে চলেছে।
এবার সোলের কথায়।জুতোর সোলের কথা জানি। হেঁটে হেঁটে সেই সোল ক্ষয়ে অর্ধেক হয়ার কথাও। তাই হাফ-সোল মানে জীবনযুদ্ধে হয়রান হয়ে ঠেকে শেখার প্রথম পাঠের কথা মনে হয়েছিল। আবার যেহেতু হাফ ইংরেজি শব্দ তাই তার পিঠোপিঠি সোল (soul/sole) হল নিজের স্বত্তা বা অনন‍্যতা। তাই হাফ সোলের মানে হল আমার অর্ধেক জুড়ে কেউ। যে আমার ভালমন্দের ভাগীদার,প্রিয় সখা। কিন্তু  এসব যে নিছক থিওরি কপচানো আর কষ্টকল্পনা – বাস্তবিক তার আসল মানেটা কি তা আমার বন্ধু রামপ্রসাদের গল্প শুনলে বোঝা যাবে।
আমাদের ছোটবেলা ছিল অপার কৌতুহলে ভরা যার বিবিধ উত্তর খুঁজতে গুরু ধরতে হত। প্রদীপদা ছিল সেরকম একজন। কারণ সে এইমাঠে অনেক দিন ধরে খেলছে। তার প্রেমিকা ছিল বুলিদি। তারপর প্রদীপদা কোএড কোচিং ক্লাস খুলে ফেলল। ক্লাস টেনে রামপ্রসাদ সেখানে ভর্তি হল। সেখানে বিশেষ আকর্ষণীয় সিস্টেম ছিল মাঝে মাঝে ছাত্রছাত্রীরা একে অপরকে পড়াবে। সেভাবে দুজন করে একটা জুটি তৈরী হত। তারা একে অপরের ডাউট ক্লিয়ার করত। একজন অনুপস্থিত হলে অন‍্যজনকে নোটস দিত। লটারির মাধ্যমে জুটিটা তৈরী হত। রামের পার্টনার হল কমলা গার্লসের সোমা। সে খুব একটা তীক্ষ্ম ছিলনা। বার বার পড়া বোঝাতে হত। তবে দেখতে শুনতে ভালো ছিল।
তখন মেয়েরা ছিল রহস‍্যময়ী। দূর দ্বীপবাসিনী। তাই পটাপট ছেলেরা তাদের প্রেমে পড়তো। একটু তাকাতাকি হলেই যেন সেই রেশ একতরফা প্রেমের ঝর্ণাধারায় বয়ে যেত প্রেমিকের বুকে। তখন ছিলনা ফোন বা মেসেজ বিনিময়ের সুযোগ। সেইজন‍্যই ছিল অপেক্ষা আর অচেনার আনন্দ। সোমার জন‍্য অনেকটা সময় রামের চলে যেত। প্রচুর নোটস তৈরী করে দিত। বকাঝকা করত। মেয়েটি চুপ করে থাকত। ওর বাড়িতে রামের অনেকটা সময় কেটে যেত।ঘরের ছেলের মত হয়ে গিয়েছিল।সে কতক্ষণ পড়বে কি রুটিন হবে সব রাম তৈরী করে দিত।ওকে সারাক্ষণ আগলে রাখত। মনে হত ওর ভালো মন্দ সবের ভাগীদার  একমাত্র সেই । ওর অভিমানী চোখটা সবসময়ে ভেসে উঠত। এইভাবে বছর ঘুরে গেল। রামের রেজাল্টটা ততটা ভাল হলনা কিন্তু আশাতীতভাবে সোমারটা খুবই ভালো হল। রাম ওকে কনগ্রাচুলেট করল। ও একটা বড় নামী কোএড স্কুলে ভর্তি হল। রামপ্রসাদ পুরনো স্কুলেই রয়ে গেল।
ভাল রেজাল্ট করার জন‍্য তারপর একদিন ওর বাবা মা বাড়িতে একটা পার্টি  দিলেন। তার সাজ সরঞ্জাম হল সব রামের পরিকল্পনায়। সেদিন সকাল থেকেই সে ওদের বাড়িতে  পড়ে রইল। দুপুরের দিকে নিজের বাড়ি এসে আবার সন্ধের দিকে গেল আটপৌরে জামা কাপড়ে হাতে একটা বই নিয়ে। দেখল অনেক নতুন বন্ধু। তাদের পরণে দামী পোশাক হাতে দামী গিফট। তাদের মুখে অন‍্যরকম ভাষা। হাব ভাবে বড়লোকি। সোমার চোখ তখন তাকে ভুলে ষেই কয়েকজনের মুখে আটকে গেছে। সে নিজেও পরেছে খুব রিভিলিং একটা ড্রেস। মুখে মেক আপ। অনুজ ভাই বলে একজন লম্বা চওড়া ছেলে যার গলায় আর হাতে সোনার চেন সে পার্টি আলো করে সোমাকে জড়িয়ে নাচছে।
সেদিন রামপ্রসাদ হৃদয়ের খেলায় প্রথম ধাক্কা অর্থাৎ হাফসোল খেল। মানে প্রেমের পীচে কড়া প্রতিদ্বন্দ্বীর গুগলি বলে  আউট হয়ে গিয়ে আলোর দিকে পিঠ  করে হাল ছেড়ে দিয়ে প‍্যাভিলিয়নে ফিরে এল। এক বুক কষ্ট যন্ত্রণা অভিমান নিয়ে।
তবে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সেই সোমা মেয়েটির দুদুটো বিয়ে ভেঙে এখন অত বড় বাড়িতে একা থাকে আর ফেসবুকে রামপ্রসাদের পোস্টে ছবিতে হৃদয়ের ইমোজি,কমেন্ট দেয়। রামপ্রসাদ কোন উত্তর দেয়না। এখন তার সেই ভাঙা হৃদয়ের অর্ধেকটা অর্ধাঙ্গিনী আসার পর নাকি জুড়ে গেছে।
*****************************************

তাপস দে পরিচিতিঃছোটবেলা থেকে গল্পের বই খেলাধূলো আর সংস্কৃতির কল্পরাজ‍্যে বাস। পেশায় বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার। দেশের নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি কাজের সূত্রে। কোভিডের সময়ে লেখালেখির আঙিনায় পুনঃপ্রবেশ। গল্প কবিতা রম‍্যরচনা নিবন্ধ লেখায় সন্ধান মানবিক মুখ ও দৃষ্টিভঙ্গির। দৈনন্দিন অফিস কাছারির ফাঁকফোকরে চালিয়ে যাচ্ছেন ডিজিটাল মাধ‍্যমে ও পত্রপত্রিকায়  ফিচার জাতীয় লেখার কাজ।  

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!