Shadow

অচিন পাখি – ব্রতী ঘোষ

PC facebook

অচিন পাখি 

ব্রতী ঘোষ

নীলাদ্রিশেখর যবে থেকে ওর মেয়ে মোহিনীর রিলেশনশিপের কথা স্ত্রী শিপ্রার মুখে শুনেছেন তবে থেকেই দুর্ভাবনায় একেবারে মুষড়ে পড়েছেন | মাত্র আটমাস হল মোহিনী আঠেরোতে পা দিয়েছে সোশিওলজি তে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি করিয়েছেন কত আশা করে | আর তার মাঝেই এই খবরটা হঠাৎই শিপ্রা শোনালো এটা কি একটা রিলেশনশিপে জড়ানোর বয়স
আর ওর পড়াশোনা করতে হবে না |সব ছেড়ে এবারে বিয়ে করতে বল।” 
শিপ্রা জানেন যে কত দুঃখে নীলাদ্রির বুকের ভেতর থেকে কথাগুলো উঠে আসছে মোহিনী ওর চোখের মণি | তবে মোহিনীর একটা গুণ হল যে কোন কথা এখনো পর্যন্ত মাকে গোপন করে না অচিনের সঙ্গে আলাপ হওয়ার প্রথম দিন থেকেই মাকে সব কথা বলেছে | তবে শিপ্রা মেয়েকে কখনোই বাধা দেয়নি। জানে বাধা দিলে এই বয়সে ছেলে মেয়েরা আরও বেঁকে বসে। এরপর যেদিন অচিনের সঙ্গে মোহিনী আলাপ করিয়ে দিল সেদিনই বাড়ি ফিরে নীলাদ্রিকে সব কথা জানায় একথাও জানায় যে ওরা ওকে কথা দিয়েছে পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবেই ওরা যা করার করবে | কিন্তু নীলাদ্রি কিছুতেই মন থেকে এসব মেনে নিতে পারছেন না | বাবা মেয়ের কথাবার্তা প্রায় একপ্রকার বন্ধ। অথচ কদিন আগে পর্যন্ত শিপ্রার সুখের সংসারে মৃদুমন্দ বাতাস খেলে বেড়াতো এক এক সময় শিপ্রা নিজের বোকামির কথা ভেবে আফসোস করে যে কেন সাত তাড়াতাড়ি সব কথা বলতে গেল নীলাদ্রিকে !
এই ভাবেই দিন কাটতে থাকে | সপ্তাহের বাকি দিনগুলো যেমন তেমনভাবে কেটে গেলেও রবিবার বা ছুটির দিনগুলো একেবারে অসহ্য হয়ে ওঠে শিপ্রার কাছে যেমন আজকে এই রবিবারের দিনটা যে কিভাবে কাটবে তা ভগবানই জানেন। অন্য দিনগুলোতে নটার মধ্যে নীলাদ্রি আর মোহিনী দশটার মধ্যে কলেজে বেরিয়ে যায়। কিন্তু আজ দুজনেই বাড়িতে বাজার থেকে ফিরেই নীলাদ্রি চা নিয়ে বসেছেন বারান্দায় চা খেতে খেতেই রবিবারের পত্রিকার আদ্যোপান্ত পড়া ওর অভ্যাস | রান্নাঘর থেকে মাছটা কড়াইতে দিতে দিতেই শিপ্রা তাকায় নীলাদ্রির দিকে | রবিবাসরীয়তে চোখ রেখে বসে আছেন বটে কিন্তু ওর মনের ভেতরে যে তোলপাড় চলেছে তার অনুরণন শিপ্রার বুকে এসে ব্যথা হয়ে বড় বাজছে  | অনেক অভিমানে বাবা যে মেয়ের সঙ্গে কথা বন্ধ রেখেছে সে কথা শিপ্রার থেকে ভালো আর কেই বা জানে ! নীলাদ্রির মুখের দিকে তাকাতে পারে না  | ওর নিজেকেই যেন দোষী বলে মনে হয় মেয়েটাকে এতটা স্বাধীনতা না দিলেই বোধহয় ভালো হত কিন্তু এটাও তো বুঝতে হবে যে মেয়েটা কোন কথা গোপন না করে মাকে সব কথা খুলে বলেছে , ওতো ইচ্ছা করলে নাও বলতে পারতো !
আচ্ছা ! নীলাদ্রি ওর আর শিপ্রার কথা কি ভুলে গেল ? ওরাও তো ভালোবেসে বিয়ে করেছিল | সেই কলেজে পড়ার সময় থেকে দুজনের জানাশোনা | সেই একই প্রেসিডেন্সি কলেজে | জুলজি তে অনার্স পড়ার সময় থেকেই ভালোবাসার সূত্রপাত এরপর একসাথে এমএসসি পড়া,নীলাদ্রি ডক্টরেট করতে করতেই দুজনের সংসারে প্রবেশ এরপর মোহিনী এলো ওদের কোল আলো করে | কই ? ওদের তো পড়াশোনায় কোন ক্ষতি হয়নি | বরঞ্চ দুজনে একসঙ্গে পড়াশোনা করাতে আরো ভালো রেজাল্ট হয়েছিল | শিপ্রা তো এসব ভেবেচিন্তেই মেয়েকে কিছু বলতে পারে না | কিন্তু নীলাদ্রি যে এভাবে রিয়াক্ট করবেন সেটা শিপ্রা ভাবতেও পারেনি | প্রথমদিকে নীলাদ্রি দিন দুয়েক চেষ্টা করেছেন মেয়েকে বোঝাতে যে এই অল্প বয়সে প্রেম শুধুই কিছুটা আবেগ আর কিছুটা শারীরিক আকর্ষণ | কিন্তু শত চেষ্টা করেও মেয়েকে তা বোঝাতে পারেননি। শেষমেশ  পরিণতি হল দুজনের বাক্যালাপ প্রায় বন্ধ
দুপুরে খেতে বসে বাবা মেয়ে একেবারে বোবার মত খেয়ে যেতে লাগল | শিপ্রার একেবারে অসহ্য ঠেকে পরিস্থিতিটা একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে

আচ্ছা ! আজ মাছটা কেমন হয়েছে বললে না তো ? ” 

 নীলাদ্রির ভাবলেশহীন মুখটার দিকে তাকিয়ে এবার প্রশ্ন করে মোহিনীকে

কিরে ? তোকে আরেক পিস মাছ দিই ? ইলিশ মাছ তো তুই ভালবাসিস | বাবা কত কষ্ট করে নিয়ে এলো তোর জন্য | ” 

আমি তো আর আনতে বলিনি | ” 

নীলাদ্রি মেয়ের দিকে না তাকিয়েই শিপ্রা কে উদ্দেশ্য করে বলেন,” ওকে বলে দাও। জোর করে খাবার দরকার নেই | ” 

কথাটা শোনামাত্রই মোহিনী সোজা ঘরে চলে যায় ভাতের থালা ফেলে রেখে

দেখলে তো ! এসব বলার কি দরকার বুঝিনা এখনকার মেয়ে,সবকিছু কি আর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় ? তুমি বোঝো না কেন ? ” 

আমি বুঝবোও না বোঝার প্রয়োজন নেই | ” , বলেই নীলাদ্রি উঠে পড়েন খাবার ফেলে রেখে | শিপ্রার ইচ্ছা করে দেওয়ালে মাথা খুঁড়তে কি চেয়েছিল আর কি হলো

সামনেই মেয়েটার জন্মদিন | প্রত্যেক বছর নীলাদ্রি নিজের হাতে এই দিনটিতে বাড়ি সাজান | মেয়ের বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেন | কোন কাজ রাখেন না কলেজেও যান না সারাটা দিন মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকেন ফুল কিনে আনেন মেয়ের পছন্দমত এবারে যে কি হবে সে কথা মনে এলেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে শিপ্রার | মনে মনে কাঁটা হয়ে আছে । দেখতে দেখতে সামনেই এসে গেল দিনটা | নীলাদ্রি যে মনে মনে অস্থির তা ওকে দেখলেই অনুভব করতে পারে শিপ্রা | বাবা মেয়ের এই টানাপোড়েনে পড়ে বড় অসহ্য লাগে এক এক সময় | রাতে খাবারদাবারের পাট চুকে গেলে মেয়ের ঘরে আসে শিপ্রা দেখে ঘর অন্ধকার করে মেয়ে শুয়ে আছে খাটে ঘরের নিকষ কালো অন্ধকার ওর মনের গহীন অন্ধকারের তুলনায় যেন অনেক বেশি ফিকে | মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত রেখে টের পায় ওর চোখ দিয়ে বইছে জলের চোরা স্রোত | বুকের মাঝখানটা চিনচিন করে ওঠে |

 মোহিনীকে বলে,” হ্যাঁ রে,এবার জন্মদিনে অচিন কে ডাক | বাবার সঙ্গে বরঞ্চ ওর পরিচয় করিয়ে দিই |”  

তোমার কি মাথা খারাপ হলো ? মাআমি চাইনা অচিনের অপমান হোক | “

শিপ্রা মেয়ের মাথাটা বুকে টেনে নেন

উনিশে এপ্রিলআজ মোহিনীর জন্মদিন | সকাল থেকেই নীলাদ্রির যেন ফুরসত নেই | কাজ সে কাজ করে নিজেকে ব্যস্ত করে রেখেছেন | একবারও মেয়ের জন্মদিনের কথা উচ্চারণ করছেন না | শিপ্রা দূর থেকে শুধু নজর রেখে চলেছে। আজ অন্যদিনের থেকে একটু বেশি তাড়াতাড়িই কলেজে চলে যান নীলাদ্রিশিপ্রা একটা কথাও বলে না মেয়ের জন্মদিনের ব্যাপারে | যেন ভুলেই গেছে

 নীলাদ্রির কথা

যেদিন মোহিনী জন্মালো সেই দিনটার কথা বারে বারে যেন আজ ওর মনে হচ্ছে সে কি টেনশন | শিপ্রা কে নিয়ে আগের দিন রাতেই হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিল | তারপরে সারাটা দিন যে কি টেনশনে কেটেছে ! এরপর সন্ধ্যাবেলা অপারেশন করাতে হলো | টি থেকে ডাক্তারবাবু বেরিয়ে এলেন মোহিনীকে হাতে নিয়ে | নীলাদ্রিকে দেখিয়ে বললেন,”এই যে আপনার মা লক্ষ্মী এসেছেন |” 

সত্যিই যেন মা লক্ষ্মী, মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল,চোখ দুটো টানা টানা আর ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা মুখে ঢোকানো। দেখেই দুচোখে জল এসে গেল আনন্দে | এরপর এতগুলো বছর যে কোথা দিয়ে কেটে গেল | আর একটু বড় হতেই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে বসলো | ক্লাস নিতে নিতেই নিজের অজান্তে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নীলাদ্রির | বাড়ি ফেরার পথে অনেক আগুপিছু ভেবে মেয়ের প্রিয় ম্যাঙ্গো কেকটা নিয়ে এলেন ভেবেছিলেন আজ দেরি করে বাড়ি ঢুকবেন কিন্তু বাবার মন তো

 গেটের কাছে পৌঁছেই শুনতে পেলেন এক অপূর্ব গানের সুর ভেসে আসছে ঘরের ভেতর থেকে,” খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়তারে ধরতে পারলে মরণবেড়ি দিতাম পাখির পায় | ” 
আহা ! আহা ! কি অপূর্ব গলা ! নীলাদ্রির মনটা যেন আবেগে মোথিত হয়ে এলো | পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকে দেখলেন একটি অল্প বয়সী ছেলে, মুখে একগাল দাঁড়ি , মোহিনীর বয়সই হবে,চোখ বুজে গিটার বাজিয়ে গানটি গেয়ে চলেছে শিপ্রা এগিয়ে এসে কেকটা ওর হাত থেকে নিয়ে নিলেন | ইশারায় চেয়ারে বসতে বললেন | গানের সুরে আর ভাবের মাদকতায় নীলাদ্রির চোখ বুজে এলো | আহা কি অপূর্ব গলা ছেলেটার ! মোহিনী যদি এই ছেলেটিকেও পছন্দ করত তবে এককথায় রাজি হয়ে যেত | তা না , কি সব খেলাধুলা করে | হ্যাঁ! তিনি নাকি ক্রিকেট খেলেন | ক্রিকেট খেলে দেশ উদ্ধার করবেন | এই ধরণের গান গিটার বাজিয়ে গাইছে আজকের প্রজন্মের ছেলে, ভাবা যায় না | গান শেষ হয় | সমস্ত ঘর স্তব্ধ | সুরের জাদুতে সকলে বাকরুদ্ধ নীলাদ্রি উঠে এসে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরলেন। ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বড় আরাম অনুভব করলেন মনে হয় এর মত ভাল ছেলে আর হয় না আরো কয়েকজন আমন্ত্রিত রয়েছে ঘরে | সকলে নীলাদ্রির এই ব্যবহারে অবাক | শিপ্রাও একই রকম ভাবে হতচকিত | মোহিনী পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বাবাকে প্রণাম করে বলে,” বাবা ! অচিন। ” 
ওর মনে ভয় এরপর কি হবে
সকলকে অবাক করে দিয়ে নীলাদ্রি মোহিনীর মাথায় হাত রাখেন |
বলেন,” তোর পছন্দ আছে কোন ভুল হয়নি | ”
******************************************
This image has an empty alt attribute; its file name is --150x150.jpeg
ব্রতী ঘোষের পরিচিতি
জন্ম,পড়াশোনা সবই কলকাতায় ৷ তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা। সঙ্গীত অনুরাগী মানুষটি এখন ভালোবাসেন লিখতে ৷

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!