
অদ্ভুতুড়ে
মধুমিতা মিত্র
কলকাতার একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে খুব বনেদী অভিজাত অঞ্চলের পুরো সরকারী এক স্কুল,বি–রা–ট এক ক্যামপাসে বিশাল বিশাল ময়দান,ব্রিটিশ আমলের একাধিক সর্বাঙ্গ অভিজাত ইমারৎ—অনেক অনেক মহীরুহ,নানান গাছ গাছালি,কেয়ারি–সুন্দর সুন্দর স্বর্গীয় সাজানো বাগান এই নিয়ে ছোট্ট পিউলির অনেক বড়ো বিদ্যালয়। ব্রিটিশ আমলের সেই যে বড়ো উঁচু বাড়ি,তার মধ্যে একটিতে ই পিউলিদের স্কুল বসে। পিউলির বাড়ি আবার স্কুল থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে।পিউলির মা,পিসিরা সবাই শিক্ষিকা–তাই পিউলিকে স্কুলে নিয়ে আসা–যাওয়ার দায়িত্ব পালা করেই মা পিসিরা নিয়ে থাকেন। এ যে সময়ের গল্প সে সময়টা কিন্তু আজকের নয়–সে প্রায় আজ থেকে পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছর আগের কথা। তখনও এ মহানগরীতে যাতায়াত এমনটা সহজ ছিল না।মহানগরীরই এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় আসা যাওয়া বেশ সময় সাপেক্ষ ছিল। পিউলির বাড়ি থেকে স্কুল পৌঁছানো সে এক মহা ব্যাপার ছিল। এমনি তে প্রাইমারি সেকশনে পিউলির স্কুল ছিল সকাল বেলা,সেদিন ছিল স্কুলের কোন বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,ফাংশান শেষ হতে হতে বেশ সন্ধে সাতটা সাড়ে সাতটা বেজে গেল।স্কুলে ক্যাম্পাসের অডিটোরিয়ামেই ওদের অনুষ্ঠান ছিল। পিউলি তখন তৃতীয় কি চতুর্থ শ্রেণী। সেদিন ফাংশানে পিউলির বাড়ি থেকে তার ছোট পিসির আসার কথা ছিল,কিন্তু শেষ মুহূর্তে ছোট পিসির খুব জরুরী কাজ পড়ে যাওয়ায় আসতে পারলেন না।পিউলি তার পাড়ায় থাকে স্কুলের এমন এক বন্ধু এবং তার পরিবারের সঙ্গে এলো ফাংশান দেখতে।কথা ছিল তাদের সঙ্গে ই পিউলি আবার বাড়ি ফেরৎ যাবে। অনুষ্ঠান শেষে পিউলির বাথরুম যাবার দরকার পড়ল–ছোট্ট পিউলি ঐ অডিটোরিয়ামের বাথরুমে গিয়ে কেমন করে আটকা পড়ে গেল। কিছুতেই বাথরুমের ছিটকিনি খুলতে পারে না–ওদিকে বন্ধু দলেরা পিউলিকে যাবার সময় খুঁজে না পেয়ে খানিক অস্হির হয়ে বাড়িমুখো হল। আসলে পিউলির পাড়াস্হিত স্কুলের এই বন্ধু পরিবারটি ছিল খানিকটা স্বার্থপর,সুবিধাবাদী গোছের।পরের ব্যাপারে দায়িত্বজ্ঞানের এদের খুবই অভাব ছিল। নেহাৎ একান্ত পাশাপাশি থাকত,ছোট্ট পিউলির জেদে–পিউলির মা পিসির একান্ত অনুরোধ ফেলতে পারে নি বলেই প্রোগ্ৰামের জন্য এরা পিউলিকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। এবার পিউলির আসতে দেরী দেখে এরা সময় নষ্ট না করে এটুকু নিজেরাই ভেবে নিল যে পিউলি হয়তো’ বা তার বাড়ীর লোক অথবা অন্য কারোর সঙ্গে বাড়ী ফেরৎ গেছে–কিন্তু ঘটনাটা যে একেবারেই তা নয় এটুকু ভেবে নেওয়ার মতো দায়িত্বপরায়ণতা তাদের মোটেও ছিল না।
পিউলি তো আটকে রয়ে গেল সেই অডিটোরিয়ামের বাথরুমে। বাথরুম বলতে সেই ব্রিটিশ আমলের রাজপুরুষের বাথরুম। অনেক উঁচু সিলিং,পিউলি দের বাড়ীর শোবার ঘরের মতোই আয়তনে এবং আকারেও তেমনই আয়তাকার এক বিশাল বাথরুম–তার একদিকে বড়ো একটা বাথটাব। ব্রিটিশ দের সময়ে যেমন ছিল প্রায় তেমনিভাবেই সে বাড়ীর রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে চলেছে,তেমন কোনো পরিবর্তনই হয় নি। যেহেতু পুরোপুরি সরকারি ব্যাপার তাই সে সময়ের সরকার বাহাদুর সযত্নেই ঐ সব বাড়ি–ক্যাম্পাস সব কিছু যথোচিত মর্যাদায় রক্ষা করতেন।
যাক্! পিউলি তো আটকা পড়ে রয়েছে,প্রথমটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভয়ে সে একশা। ভয় আরও জাঁকিয়ে বসলো বাইরে থেকে বাথরুমটির তালা বন্ধের আওয়াজে–চীৎকার করেও শোনার লোক নেই কারণ প্রাণপণে চীৎকার করেও তো সে এক ফোঁটা আওয়াজ ও গলা থেকে বের করতে পারছে না,কে যেন তার গলা চিপে ধরে কন্ঠ রোধ করে রেখেছে। অসহায়তা–আতঙ্কে ছোট্ট পিউলির ছোট্ট চেহারাখানা থরথর করে কাঁপতে লাগলো,কাঁপতে কাঁপতে সে বসে পড়লো বাথরুমেরই মেঝের ওপরে।বসেই মনে হল এতক্ষণে বাড়ীতে তো হৈ হৈ পড়ে গেছে,রূপা আর কাকিমারা তো বাড়ীতে ফেরৎ গেছে কিন্তু তাদের সঙ্গে তো পিউলি নেই–বাবা,মা,মনা,ছোটপিসি,ভাইটি ওরা এখন তবে ওকে না পেয়ে কি করছে? কোথায় তাকে খুঁজতে যাচ্ছে?সে কি আর বাড়ী ফেরৎ যেতে পারবে?ভয়ে,দুঃখে পিউলির পাগলপারা অবস্হা।আস্তে আস্তে মনে হল সে যেন অন্ধকার এক কুয়োর মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। হঠাৎ খটখট ঝমঝম কি শোরগোল বাইরে?-এত লোক জনের আওয়াজ কেন?তবে কি তার খোঁজে সবাই এসে পৌঁছালো এখানে? কিন্তু নাহ্,এ তো উদ্বেগের আওয়াজ নয়!এ যে আমোদের হুল্লোড়!উঠে দাঁড়ানোর শক্তি টুকুও নেই ছোট্ট পিউলির।ঘামে জবজবে শরীরে অবসন্ন ,মূর্ছাগতপ্রায় হয়ে শুনতে থাকলো বাইরের দাপাদাপি। হঠাৎ প্রবল শব্দে বাথরুমের দরজা গেল খুলে–পিউলির হৃদযন্ত্র তখন বুকের কাছে—মা বাবা কি এল?ওম্মা! এ কি এ’ত গত শতকের কোন্ এক সাহেব,হাত ধরে টেনে ছেঁচড়ে আনছে এক মেম সাহেবকে!তারপর চুলের মুঠি ধরে সে কি মার!!! পিউলি যে ওদের সামনেই বাথরুমের এক কোণায় বসে থরথর করে কাঁপছে সে দিকে দৃকপাত ও নেই! মেমসাহেব কে বেধড়ক মারধোর করে সাহেব বেরিয়ে গেল বাথরুমের দরজা ঠাস করে বন্ধ করে। বাইরে থেকে হুড়কো বন্ধ করার আওয়াজ পেল পিউলি,আর মেম সাহেব! সাহেব বেরিয়ে যাওয়া মাত্র নিজের পরনের বসন খুলে সিলিং এর হুড়কো তে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়লো।পিউলি এমনটাই গল্পে শুনেছিল না? সর্বোচ্চ পদাধিকারী রাজপুরুষ এমনি করেই অত্যাচার করত তার স্ত্রীকে আর তার স্ত্রী অমন করেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল। এই নাটকই অভিনীত হল পিউলির চোখের সামনে?-সে কথা মনে পড়তেই পিউলির হাত পা শিউড়ে উঠল,শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেল শীতল স্রোত—আবারও ঘন অন্ধকারে ডুবে গেল সে।
দূর থেকে ফিকে কোলাহল যেন কানে বাজছে পিউলির,আস্তে আস্তে সে আওয়াজ বাড়তে লাগলো। আতঙ্কে পিউলির চোখ বন্ধ,এই ছোট শরীরে আর কত নিতে পারে সে?-কিন্তু বন্ধ চোখেই যেন আলোর ছটা পড়েছে।সে আলোয় চোখ সামান্য পিটপিট করতেই শুনতে পেল গুঞ্জন “এই তো জ্ঞান ফিরছে“–তাকিয়ে দেখলো মা বাবা পিসীদের মুখের সঙ্গে আরো কতগুলি অচেনা মুখ পিউলির মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। পিউলি,’মা !’ বলে চীৎকার করে নিজের আতঙ্কের বোঝা মায়ের আশ্রয়ে সমর্পণ করলো….
*************************
মধুমিতা মিত্র: পেশা–স্বপ্ন দর্শন,স্বপ্ন গুলো ই বাঁচিয়ে রাখে,
নেশা–আনন্দ চয়ন,জীবন পথের সমস্ত জঞ্জাল,বোঝা,দুঃখ সব দূর করে ফেলে দিয়ে আনন্দ কুড়িয়ে বেড়ানো,
প্রেম-রবীন্দ্রনাথ,উদয়শঙ্কর,উত্তমকুমার। সাম্প্রতিকতম প্রেম শ্রীকৃষ্ণ..
আহা … কী ভালো লাগল … সেই সময়ে ফিরতে চাই …।