
জবাব
বিদ্যুৎ পাল
প্রদ্যুম্ন সিং গর্বের সাথে হেসে বললেন,“একটা প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারলেন না প্রফেসর-সাহেব!”
সবাই চুপ করে আছে দেখে নিজেই এগিয়ে নিয়ে গেলেন কথাটা,“তার মানে কী? তার মানে হল ওঁর সিদ্ধান্তগুলো ভুল!…আরে একটা হিড়িক লেগেছে! যাকে দেখ সেই নতুন অর্থের বিন্যাস খুঁজছে! খোঁজো! তাবলে ক্লাসিকে হাত দিতে যেওনা! তাঁরা সব প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী! চেষ্টা কর আবার প্রথম থেকে পড়ে তাঁদের বুঝতে!”
- তা,উনি হয়ত সেই চেষ্টাই করছিলেন! আবার থেকে পড়ে যা মনে হল সেটাই বলছিলেন! অবশ্য আমরা তাঁর লেখাটাও পড়িনি আর আপনার প্রশ্নগুলোও জানি না। পড়লেও বুঝব সেরকম জ্ঞানগম্যি আমাদের নেই।
- বুঝতে চেষ্টা করার মানে কী? মূল সিদ্ধান্তগুলো পালটে দেওয়া?
- পালটে দিয়েছিলেন?
- ঠিক পালটে দেননি। তবে,তার মাঝে মাঝে নিজের সিদ্ধান্ত ঢোকাচ্ছিলেন।
প্রদ্যুম্ন সিং নিজেও স্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের প্রফেসর। আমাদের সাথে ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে মাঝে মধ্যেই আমাদের ইউনিয়ন অফিসে আসেন,চা-টা খান,গল্পগুজব করেন। যাঁর কথা বলছিলেন তিনি দেশের এক নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসেরই প্রফেসর ছিলেন। এখন অবসরপ্রাপ্ত। বিদ্বান বলে সারা দেশে তাঁর সুনাম আছে। আমরা সবাই তাঁর নাম জানি,তাঁকে রীতিমত শ্রদ্ধা করি। কাজেই প্রদ্যুম্ন সিংএর কথাটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না।
কিছুদিন পরেই একটা সুযোগ এসে গেল। একটা সেমিনার হবে। প্রধান বক্তা হিসেবে অনেক চেষ্টা করে সেই অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর সাহেবের সময় নেওয়া গেল। রাজধানীর টিকিট এখান থেকেই করে ইমেলে পাঠিয়ে দেওয়া গেল। এলেন। হোটেলে ওঠানো হল। বিকেলে সেমিনার। প্রদ্যুম্ন সিংও এলেন। দুজনে একসাথেই বসলেন মঞ্চে। স্থির করা হল যে প্রদ্যুম্ন সিং প্রফেসর সাহেবের পরিচয় করিয়ে দেবেন শ্রোতাদের সাথে। বিষয়ের ওপর এপ্রোচ পেপারটাও তিনিই রাখবেন। তারপর প্রফেসরসাহেব বলবেন।
প্রদ্যুম্ন সিং অবশ্য ভদ্র ভাবেই পরিচয় দিলেন। প্রশংসাসূচক অনেক কথা বললেন। তাঁর ওঠানো প্রশ্ন এবং তার জবাব না দিয়ে প্রফেসর সাহেবের নীরবতা অবলম্বন…এসব নিয়ে একটা কথাও বললেন না।
এর পর প্রফেসর সাহেবের পালা। প্রফেসরসাহেব পোর্ডিয়ামে এসে,পিছনের ব্যানারটা একবার দেখে নিয়ে ঈষৎ ম্লান হেসে বললেন,“আজ যে বিষয়ে আমাকে বলতে বলা হয়েছে,সে বিষয়েই আমি বলব। তবে তার আগে দু’একটা কথা বলতে চাই। গতবার যখন এই শহরে এসেছিলাম,প্রফেসর প্রদ্যুম্ন সিং সাহেবের সাথে হোটেলে বসে অনেক কথা হয়েছিল। উনি অনেক প্রশ্ন করেছিলেন,যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন,কিন্তু আমি সে প্রশ্নগুলোর কোনো সদুত্তর দিতে পারিনি।”
প্রদ্যুম্ন সিং,দেখলাম মঞ্চের চেয়ারে নড়েচড়ে বসলেন।
প্রফেসরসাহেব তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন,“আসলে প্রদ্যুম্নবাবু,সব প্রশ্নের উত্তর তৎক্ষণাৎ দেওয়া তো সব সময় সম্ভব নয়! এখনও যে আমি কথাগুলো বলব তা থেকে অনেক প্রশ্ন জাগবে আপনাদের মনে। যদি না জাগে তাহলে সেটা বক্তা হিসেবে আমার চুড়ান্ত অসফলতা। কিন্তু সেসব প্রশ্ন,যা আমার বক্তব্যের শেষে,প্রশ্নোত্তর পর্যায়ে আপনারা করবেন,আমার জন্য উত্তর দেওয়ার মত হবে কি? হতেও পারে, নাও হতে পারে। …কথাটা ওঠালাম এই জন্য যে এই মঞ্চ থেকে প্রদ্যুম্নবাবুকে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই। তাঁর প্রশ্নগুলো অবলম্বন করেই আমি একটি নতুন গবেষণার কাজ সদ্য শেষ করেছি। আগামী মাসে সেটি বইয়ের আকারে প্রকাশিত হবে। বইয়েও আমি প্রদ্যুম্নবাবুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। আজ এখানে সামনাসামনি কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ পেলাম। …এবার আমি বিষয়ের দিকে যাই।” বলে নিজের নোটপ্যাডটা খুলে পাতা ওল্টাতে লাগলেন।
কিছুদিন পর রোববারে আমাদের ইউনিয়নের কমিটির বৈঠক ছিল। প্রদ্যুম্ন সিং সকালেই এলেন ইউনিয়ন অফিসে। বৈঠক শুরু হতে দেরি হবে। যাহোক, উনিও বুঝে পরে আসার কথা বললেন। আমরাই বরং আটকালাম যে অন্ততঃ একসাথে এক কাপ চা খেয়ে নেওয়া যাক।
কেউ ওনাকে ক্ষ্যাপাবার জন্য কথাটা ওঠাল,“এটা কী হল প্রদ্যুম্নবাবু? প্রশ্নগুলো আপনার। আর বই লিখে ফেললেন উনি!”
- আরে,সব বড় শহরের বুদ্ধিজীবী। মাসে মাসে বই লেখেন,বিদেশি প্রকাশকেরা ছাপে আর ওনারা টাকা কামান। প্রশ্নগুলো পেলেন আর ব্যস,হয়ে গেল একটা বই!
- কিন্তু,প্রশ্নগুলো যখন আপনার মনে জেগেছিল তো আপনি চুপ করে বসে রইলেন কেন? আপনিই তো করতে পারতেন গবেষণাটা। আপনার সুনাম হত,যশ পেতেন!
- আরে,আমরা অত যশ আর খ্যাতির পিছনে দৌড়োই না।
প্রদ্যুম্নবাবু চলে গেছেন। বসে আছি আমরা সবাই আর আমাদের দুজন নেতা। বৈঠক দুঘন্টা চলে দুপুরের খাওয়ার জন্য বন্ধ আছে। আবার শুরু হবে।
- এ শালা,বিহারী নেচারটাই এমন। বিরাট পন্ডিত সব লোক, বিরাট বিরাট কাজ কিন্তু কোথাও পৌঁছোনো নেই। কিছুদূর গিয়ে … শেষ। ভরে আছে এমন মানুষ এখানকার কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে। জ্ঞানের পাহাড় কিন্তু রিচিং নো-হোয়্যার!
- মানে?
- এই প্রদ্যুম্নবাবু!
- এতে বিহার-ইউপির কথা কোত্থেকে আসছে?
- আপনি দেখুন না…(কড় গুনতে গুনতে) নাম নিন। বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ। নেহরুর থেকে কম বিদ্বান ছিলেন? শেষ মূহুর্তে সাইড কাট। প্রেসিডেন্ট করে বসিয়ে দিল,প্রধানমন্ত্রী হতে পারলেন? রাহুল সাংকৃত্যায়ন। বৌদ্ধশাস্ত্রের মহাপন্ডিত,কম্যুনিস্ট পার্টির জন্য জেল খাটলেন অত বছর,জনে জনে ছড়াল তাঁর বই…একদিনের জন্যও পার্টির সেক্রেটারি হতে পারলেন? বশিষ্ট নারায়ণ সিং,এত বড় গণিতজ্ঞ,পাগল করেই ছেড়ে দিল তাকে। তারপর …
- এসব কী হচ্ছে? ফাজলামি? সবাই প্রধানমন্ত্রী হবে? সবাই পার্টি সেক্রেটারি হবে? আর কোনো কাজ নেই? কাজের ক্ষেত্র-বিচার নেই? একটা আইডিয়া তৈরি করে নিলেই হল?…
যিনি ধমকটা দিচ্ছিলেন, দুই নেতার জুনিয়র,সিংহেশ্বর প্রসাদ,সিংহেশ্বরদা,তিনি থেমে একটু দম নিলেন। তারপর বললেন,“মাথায় প্রশ্ন জাগলেই তো হয় না! প্রশ্নটাকে নিজের করতে হয়। পাড়ায় একজনের মেয়ে রাতে বাড়ি ফেরেনি। অমুকের মেয়ে বাড়ি ফেরেনি কেন? একটা প্রশ্ন। তুমি শুনলে,কয়েকটা ‘ইস’,‘আহা’,‘উহু’ তে সামাজিকতা সারলে তারপর নিজের ঘরে ঢুকে টিভি খুলে বসলে। আরেকজন দেখবে,সেই মেয়ের বাড়ি গেছে,মেয়ের বাপকে নিয়ে জোর করে থানায় গেছে,রাতভর জেগে থেকেছে তাদের সাথে। … প্রশ্ন তো অনেক জাগতে পারে মাথায়। কিছু প্রশ্ন অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে ওঠে। যেমন তার হয়ে ওঠে যার মেয়ে রাতে বাড়ি ফেরেনি। প্রদ্যুম্ন সিং বিদ্বান মানুষ। কিন্তু উনি যে নানান প্রশ্নে কাউকে জেরবার করতে পারেন,সেটাই ওনার অহঙ্কার। অথচ কোনো প্রশ্নকে নিজের করতে চান না বা পারেন না। উনি আর ওই প্রফেসরসাহেব কিন্তু একই সামাজিক শ্রেণীর মানুষ। কিন্তু ওই প্রফেসর সাহেব নিজের চেতনার প্রসারে মানুষের বেশি কাছের এবং কাজের হয়ে উঠতে চান। তাই ওই সব প্রশ্নগুলো ওনার জন্য নতুন গবেষণার চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।”
তখনই একজন পরিচিত ছেলে ঢুকল। অন্য একটি ইউনিয়ন অফিসে কাজ করে। ছেলেটি শিল্পী। খুব ভালো গণসঙ্গীত গায়। কিন্তু বেকার | সমস্যার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল দেখে ওই ইউনিয়ন তাকে সামান্য মাইনেতে রেখে নিয়েছে। ছেলেটিও অভিজ্ঞ হয়ে গেছে এতদিনে। ইউনিয়ন অফিসেও লোক চিনে কাউকে হাত তুলে সেলাম করে কাউকে জোড়হাতে নমস্কার করে। একটা চিঠি দিল সিংহেশ্বরদার হাতে।
চিঠিটা পড়ে সিংহেশ্বরদা শান্ত চোখে আমাদের দিকে তাকালেন,“একটা সমস্যা এসেছে। ওদের ইউনিয়নের কোনো সাথী, কেরল থেকে এখানে এসেছিল বেড়াতে। হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় ইউনিয়নকে খবর দেয়,ওরা ওকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। ওর রক্ত চাই। খুব কমন গ্রুপ–বি পজিটিভ। কার আছে? কে যাবে?”
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। নারায়ণ হাত ওঠাল,“আমি যাই? আমার বি পজিটিভ। তবে তারপর আর এখানে আসতে পারব না। জানেন,আমার বাড়ি দূরে।”
- আসতে হবে না তোমায়। যাও,সাবধানে যেও।
বৈঠক শেষ হওয়ার আগে দেখি সিংহেশ্বরদা মোবাইলটা কানে লাগিয়ে মুখের ওপর হাত রেখে চাপা গলায় কথা বলছেন। মুখটা চিন্তান্বিত। ফোন রেখে মুখে একটা স্মিত ভাব এনে তাকালেন আমাদের দিকে,“মাঝে মধ্যে এমন দিনও আসে। আরো রক্ত দরকার। ওই, বি পজিটিভ।
- কার?
- আমার ব্যক্তিগত পরিচিত একজনের।
কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে ভেবে ফোন তুলে বাইরে গেলেন। ফিরলেন হাসি মুখে।
- হয়ে গেছে ব্যবস্থা। চল,আমরা বৈঠকটা শেষ করে নিই।
বৈঠক শেষ হওয়ার পর শেষ চা চলছিল। সিংহেশ্বরদা আদেশের সুরে বললেন,“তোমাদের কার কী ব্লাড গ্রুপ একজন লিখে নাও তো। দরকারে তোমাদেরও ডোনার খুঁজতে হবে তো। আমার বি নিগেটিভ,লিখে নাও। আর এখানে ফাইলে থাকবে কাগজটা।”
লেখার পর সিংহেশ্বরদা দেখছিলেন কাগজটা। হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন,“দেখলে তো,আমাদের মধ্যেও একজন মাত্র ওই প্রফেসরসাহেব,আর ছ’জন প্রদ্যুম্ন সিং।”
- মানে?
- সাতজনের ব্লাডগ্রুপ বি পজিটিভ ছিল। কিন্তু কেরলের কমরেডকে রক্ত দেবে কে,এই প্রশ্নটাকে মাত্র একজন নিজের প্রশ্ন করে তুলল।
আমরা অধোমুখে খানিকক্ষণ বসে জিজ্ঞেস করলাম,“আর ওই যে বললেন নিজের ব্যক্তিগত পরিচিত?”
- বাকি ছ’জনের একজনও তো হাত ওঠাল না। তখন মনে হল,আমি নিজের বাড়িকে বাদ দিচ্ছি কেন? তাই ছেলেকে বললাম। (একটু গর্বের সুরে বললেন) ছেলে সঙ্গে সঙ্গে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল। হ্যাঁ,আরেকটা কথা। প্রশ্নটাকে নিজের তো করতেই হয়। তারই সাথে এটাও মনে রাখার,যে সব প্রশ্নের জবাব কথায় হয়না। কিছু প্রশ্নের জবাব কাজেই দেওয়া যায়।
************************************
বিদ্যুৎ পাল পরিচিতি
জন্মতারিখ ২৪শে জুলাই ১৯৫২। জন্মস্থান পাটনা (বিহার)। পড়াশুনো সবটাই পাটনায়। চাকরি ব্যাঙ্কে,বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। সারাদিনের ব্যস্ততায় শামিল নিজের লেখালিখি,পড়াশুনো,বিহার হেরল্ডের সম্পাদনা,দেশবিদেশের সঙ্গীত শোনা,বইপত্র সম্পাদনা। বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা,গল্প ও প্রবন্ধ (প্রবন্ধটা অবশ্য বাংলা,হিন্দী এবং ইংরেজি,তিন ভাষাতেই লিখতে হয়) প্রকাশিত। আপাততঃ ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘বিহার হেরল্ড’এর সম্পাদক,ও বিহার বাঙালি সমিতির মুখপত্র ‘সঞ্চিতা’র যুগ্মসম্পাদক।