Shadow

দাঁত নিয়ে দাঁদড়ামি – গৌতম সরকার

 

p.c. Shutterstock

দাঁত নিয়ে দাঁদড়ামি

গৌতম সরকার

     ডিস্পেন্সারিতে ঢুকে আজকেও মেজাজটা ঘেঁটে গেল প্রহ্লাদবাবুর। ওয়েটিংরুমের এদিক-ওদিকে কম করে জনা পনেরো বসে, যদিও এদের মধ্যে রুগীর সাথে বাড়ির লোকজনও আছে। এই ডাক্তারবাবু সন্ধ্যে সাতটা থেকে রুগী দেখতে শুরু করেন। অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে চা-জলখাবার খেয়ে আসতে আসতে আটটা বেজে যায়। রিসেপশনিস্ট মেয়েটির কাছে গিয়ে নিজের নামটি বলতে, চোখ না তুলে লিখতে লিখতে নির্লিপ্ত কণ্ঠে জানালো ‘এগারো নম্বর, … … এখন চার নম্বর গেছে’। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসতে বসতে হিসেব কষতে লাগলেন প্রহ্লাদবাবু,একঘন্টায় ডাক্তারবাবু একঘন্টায় যদি চারটে রুগী দেখেন তাহলে তার টার্ন আসতে রাত পৌনে দশটা-দশটা হয়ে যাবে; আর যদি দয়া করে আজ দাঁতটা তুলে দেন তাহলে এগারোটা রোখে কে! দাঁত তুললে আরেক দফা হ্যাপা, ছেলেটাকে ফোন করে ডাকতে হবে। বাড়ির কেউ না থাকলে দাঁত তুলবেন না, এটাই নাকি দস্তুর। 

    ওয়েটিং রুমটা বেশ বড়। গদিওয়ালা সোফা, এছাড়াও দেওয়াল বরাবর কয়েকটা বেঞ্চির ব্যবস্থা আছে। রুগী আর বাড়ির লোকেরা আগে সোফায় বসতে চায়,প্রহ্লাদবাবু একটা বেঞ্চিতে বসলেন। বেঞ্চির অন্য প্রান্তে একটি বাচ্চা মেয়ে মন দিয়ে শুকতারা পড়ছে। প্রহ্লাদ বাবুর বেশ ভালো লাগলো,আজকের বাচ্চারা গল্পের বই, বিশেষ করে বাংলা গল্পের বই আর পড়ে না। এখনতো মোবাইলই তাদের ধ্যান-জ্ঞান। প্রহ্লাদবাবু বাচ্চাটির দিকে ভালো করে তাকালেন,বছর বারো-তেরো বয়স,চোখে পাওয়ারের চশমা,ঈষৎ কোঁচকানো চুল বার বার কপালে এসে পড়ছে,গায়ের রং বেশ ফর্সা। আশপাশে কোনও অভিভাবক চোখে পড়লো না। হয়তো বাইরে আছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায় মেয়েটি কিছু বুঝতে পারলো,বই থেকে চোখ তুলে প্রহ্লাদবাবুর দিকে তাকিয়ে আবার পড়ায় মন দিল। মেয়েটি তাকাতে প্রহ্লাদবাবুর মুখে হালকা হাসি খেলে গিয়েছিল,সেটা নিশ্চিত করার জন্য মেয়েটি আরেকবার তাকাতে দুজনেই হেসে ফেলল। হাসি মুখেই প্রহ্লাদবাবু জিজ্ঞাসা করলেন,

“তুমি গল্প বই পড়তে ভালোবাসো?”

মেয়েটি ঘাড় নাড়ে।

“বাংলা না ইংরেজি?”

“বাংলা বেশি, ইংরেজি কম।”

“তা, শুকতারায় মন দিয়ে কী পড়ছো? হাঁদা-ভোঁদা! বাঁটুল দ্য গ্রেট!”

মেয়েটি উত্তর দেয়, “না…ওগুলো তো এখন আর বেরোয় না।”

“তাই! কেন?”

“লেখক নারায়ণ দেবনাথ মারা গেছেন যে!”

“ও হ্যাঁ হ্যাঁ…” নিজের নির্বুদ্ধিতায় লজ্জা পেলেন প্রহ্লাদবাবু। জিজ্ঞাসা করলেন, “তাহলে তুমি কী পড়ছিলে?”

“–পাণ্ডব গোয়েন্দা।”

“তাই! কিন্তু ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ও তো মারা গেছেন।”

মেয়েটি উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, ওনার লেখাটা ‘ফিরে দেখা’ বিভাগে বেরোচ্ছে।”

মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে খুব ভালো লাগলো প্রহ্লাদবাবুর।। ফোলা গাল আর যন্ত্রণায় মুখটা পেঁচার মত করে চুপ করে বসে থাকা বা মোবাইলে হাবিজাবি দেখার চেয়ে বাচ্চাটার সাথে আলাপ করতে বেশ ভালো লাগছে। প্রহ্লাদবাবু আলাপ জারি রাখতে জিজ্ঞাসা করলেন,

“ও আচ্ছা আচ্ছা, তা তোমার নাম কি? কোন ক্লাসে পড়?”

মেয়েটি নাম আর ক্লাস বলে। প্রহ্লাদবাবু জিজ্ঞাসা করেন, “তুমি কি একলা এসেছ? তোমারও কি দাঁতের সমস্যা?”

মেয়েটি ঘাড় নেড়ে পাল্টা প্রশ্ন করে, “তুমিও তো একলা? তুমি কি দাঁত তুলবে?”

প্রহ্লাদবাবু দুহাতের একপ্রকার ভঙ্গি করে বলে ওঠেন, “কে জানে! একমাত্র ওপরওয়ালাই  জানেন….!”

“কেন, ওপরওয়ালা কেন! তুমি কেন জানোনা?”

ডাক্তারবাবুর বন্ধ দরজার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মেয়েটির দিকে আরেকটু সরে বসেন প্রহ্লাদবাবু। তারপর ফিসফিস করে জানান…”এই ডাক্তারটা কী যে খারাপ কী বলবো? নেহাত বিপদে পড়েছি, তাই আসছি। তুমি জানো, আজ নিয়ে চারদিন হল আসছি, প্রতিবার ঘুরিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে যন্ত্রণায় আমার প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এরকম দয়ামায়াহীন পাষন্ড ডাক্তার আর জীবনে দেখিনি।”

    এবার মেয়েটিও প্রহ্লাদবাবুর দিকে সরে আসে। সেও ষড়যন্ত্রীর দৃষ্টিতে চেম্বারের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে প্রহ্লাদবাবুর মত গলা নামিয়ে প্রশ্ন করে, “চার…বার! কেন, চারবার ফিরিয়ে দিল কেন?”

“আর কেন! প্রথমবার দেখে কয়েকটা ওষুধ লিখে প্রেসক্রিপশন হাতে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। এক সপ্তাহ পরে এলুম, বললেন, হাঁ করুন….

হাঁ করলাম, পাঁচ সেকেন্ড কি দেখে গম্ভীর গলায় বললেন, আজ হবেনা, ওষুধ চলবে, সাতদিন পরে আসুন। সাতদিন পরে এসে দেখি ডিস্পেন্সারি বন্ধ। শুনলাম শালীর মেয়ের বিয়েতে কেষ্টনগরে খেতে গেছে। তারপর এই আজ… জানিনা আজ কপালে কি আছে!”

মেয়েটি মনে হল ইন্টারেস্টিং টপিক পেয়ে গেছে, এবার বইটা বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করলো, “তা তুমিই বা এই ডাক্তারের পিছনে পড়ে আছো কেন? অন্য ডাক্তারের কাছে যেতে পারো নি!”

“আর… অন্য ডাক্তার…তাদের গল্প শুনবে? গিয়েছিলুম… গেল হপ্তায় ব্যথা সহ্য করতে না পেরে গিয়েছিলুম, আট হাজার টাকার টেস্ট দিল। আমি মাইনেই পাই সাকুল্যে দশ হাজার টাকা। দাঁতের পিছনে আট হাজার টাকা খরচ করলে, খাবো কী? অগত্যা কি আর করা!”

আরেকবার ডাক্তারবাবুর বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে পাঁচন খাওয়া মুখে বলে ওঠে, “কি অসভ্য ডাক্তার তুমি কল্পনা করতে পারবে না! প্রেসক্রিপশনের ওপরে বড় বড় করে ফোন নাম্বার লেখা আছে, কিন্তু ফোন করলে কিছুতেই তুলবে না। পরশুদিন আমার গিন্নি অন্তত পনের বার ডায়াল করে অবশেষে একবার পেয়েছে, তাও উনি নন ওনার মিসেস তুলেছেন। গিন্নি বলল, মিসেস মানুষটা ভালো, তাকেই অনুরোধ করেছে ডাক্তারবাবুকে বলে যেন আজকেই দাঁতটা তোলার ব্যবস্থা করে দেন।”

    ডিস্পেন্সারির দরজা খুলে গেল, একজন ভদ্রমহিলা ফুলো গালে হাত চেপে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে রিসেপশনিস্ট চেঁচিয়ে উঠল, “বাবলু সামন্ত, আট নম্বর৷”  ঘরের অন্য কোণ থেকে একটা সিড়িঙ্গে লোক উঠে দাঁড়ালেন, আর তার পিছন পিছন যে মহিলা চেম্বারে ঢুকলেন তাঁকে একমাত্র গন্ধমাদনের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। প্রহ্লাদবাবুর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, ঘড়িতে 

নটা বাজবো বাজবো করছে।

ডিস্পেন্সারির ভিতর:

   ডাক্তার মণিময় ঘোষাল দেখলেন এক বিশালবপু মহিলা একটা শুঁটকো তালঢ্যাঙা লোকের হাত ধরে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন। মোটা মহিলা দুচক্ষে দেখতে পারেন না মণিময়, এই লরেল-হার্ডির কম্বিনেশন দেখে রাগে মাথা বনবন করে ঘুরতে লাগলো। এমনিতে তিনি খুব স্পেশাল কেস ছাড়া পেশেন্ট পার্টিকে ভিতরে ঢুকতে দেন না, আর এই মহিলা বিনা অনুমতিতে শুধু ভিতরে ঢোকেন নি, ইতিমধ্যে একটা টুল টেনে বসেও পড়েছেন, স্বামীটা বোকার মতো জুলজুল করে চারদিকে তাকাচ্ছে। এইবার মণিময় ডাক্তারের মনে পড়ল, সপ্তাখানেক আগে এই লোকটা এসে দেখিয়ে গেছে, তখন এই গন্ধমাদন সঙ্গে ছিলো না। আজ মক্কেল এসেছে দাঁত তুলতে। কিন্তু ভদ্রমহিলাকে কড়া করে বাইরে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে কি জানি কি মনে হল, চুপ করে গেলেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট মেয়েটি ইতিমধ্যে লোকটিকে শুইয়ে, মুখ কুলকুচি করিয়ে যন্ত্রপাতি রেডি করতে শুরু করেছে। মণিময় রাগ রাগ চোখে একবার মহিলার দিকে তাকিয়ে অ্যাম্পুল থেকে সিরিঞ্জে ওষুধ ভরতে লাগলেন, এটা দেখেই লোকটার মুখচোখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে বউয়ের হাতটা ধরতে চাইলো। ডাক্তারবাবু সঙ্গে সঙ্গে ‘ উহুঁ উহুঁ’ করে পেশেন্টের দিকে কড়া চোখে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলা হাউহাউ করে বলে উঠলেন, 

“ডাক্তারবাবু, মানুষটা খুব দুব্বল, আবার ভীতুও বটে, কিছুতেই আসতে চাইছিলো না। জোর করে নে এসেচি। আমি পাশে না থাকলে ও দম আটকে মরেই যাবে।” 

ডাক্তারবাবু বললেন, “কিন্তু আপনারা ডিস্পেন্সারির মধ্যে হাত ধরাধরি করে এক্কা-দোক্কা খেলতে চাইলে আমি আমার কাজটা করবো কী করে! যান আপনি ওই টুলটায় যেমন বসেছিলেন বসুন গিয়ে।” ভদ্রমহিলা একটু পিছিয়ে গেলেন, কিন্তু টুলে বসলেন না। উদগ্রীব নেত্রে ডাক্তারবাবুর কাজকর্ম দেখতে লাগলেন। ডাক্তারবাবু যখন মাড়িতে অবশ করার ইনজেকশন দিচ্ছিলেন, ভদ্রলোক আঁ আঁ করে উঠলেন, ভদ্রমহিলা তাই দেখে চোখ বুজে ‘শ্রীহরি, শ্রী হরি’ নাম জপ করতে লাগলেন। এরপর যখন ডাক্তারবাবু একহাতে সাঁড়াশি আর অন্যহাতে ফরসেপ নিয়ে পাক্কা খুনির মত আস্তে আস্তে হাঁ করা মুখের দিকে এগিয়ে গেলেন তখন ভদ্রমহিলার ‘শ্রীহরি’ একশো মাইল প্রতিঘন্টা গতিবেগে ছুটতে লেগেছে। সেই আওয়াজ শুনে মণিময় ডাক্তারের মেজাজ বাড়তে বাড়তে মাথার মধ্যে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হওয়ার মত অবস্থা হল। এক ধমকে চেম্বারের বাইরে পাঠানোর ইচ্ছে হলেও, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা এককথায় আয়তনের কথা ভেবে কেন জানি কিছুই বলতে পারলেন না। মনে মনে বিড় বিড় করে উঠলেন, শালা, ইচ্ছে করছে পোকাধরা দাঁতের সাথে শালার চার-পাঁচটা ভালো দাঁতও তুলে দিই। কিন্তু সেটা আর করতে হলোনা। পোকা দাঁতটা তুলতে গিয়ে যেইমাত্র দাঁতের গোড়া দিয়ে একটু রক্ত বেরোতে শুরু করেছে, মণিময় একটা ‘আঁ আঁ’ আওয়াজ পেলেন, পিছন ফিরে দেখার আগেই চেম্বারের মধ্যে একটা অগ্নুৎপাত ঘটে গেল। কাটা কলাগাছের মতো আড়াইমনি মহিলা মণিময়ের সাধের কাঁচের আলমারির ওপর পড়লেন, মুহূর্তের মধ্যে ঝনাৎঝন্ শব্দে কাঁচের আলমারি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গোটা চেম্বারে ছড়িয়ে পড়লো। সেই আওয়াজ শুনে বাইরে থেকে রিসেপশনিস্ট সমেত পেশেন্টরা দৌড়ে ভিতরে ঢুকে এলো। এদিকে ভাঙা কাঁচে যাতে কারোর পা না কাটে তাই অ্যাসিস্ট্যান্ট মেয়েটা ভেতর থেকে চেঁচাতে লাগলো। সে এক হৈ-হুহুক্কার ব্যাপার। ভদ্রমহিলা চিৎ হয়ে চোখ উল্টে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন, নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। সেই দেখে ভদ্রলোক অপারেশন টেবিল থেকে লাফিয়ে উঠে হাউমাউ করে মড়াকান্না শুরু করে দিলেন আর ওই ল্যাকপেকে শরীরে অ্যাটল্যান্টিক  সাইজের বউকে ওঠাতে চেষ্টা করতে লাগলেন। সেটা দেখে উপস্থিত জনতার চেতনা ফিরলো। সমবেত চেষ্টায় ভদ্রমহিলা উঠে বসলেন, জ্ঞানও ফিরলো। গায়ে আষ্টেপিষ্টে পশমের পোশাক থাকায় ওনার শরীরে কাটাছেঁড়ার আঁচ পর্যন্ত লাগেনি। এদের মধ্যে বাচ্চা মেয়েটি এবং প্রহ্লাদবাবুও উপস্থিত। ডাক্তারবাবু কটমট করে বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বাঘের গলায় গর্জন করে উঠলেন, “যাও! বাইরে যাও!” এতে শুধু মেয়েটিই নয়, সবাই চমকে উঠে চেম্বারের বাইরে পালাতে পারলে বাঁচে, এমনকি সেই ভদ্রমহিলাও। সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তারবাবু করুণ চোখে ইজিপ্ট থেকে ভাগ্নির পাঠানো মমির দাঁতের রেপ্লিকার ভাঙাচোরা অবস্থা দেখে মন খারাপের দীর্ঘনিঃশ্বাস গোপন করলেন।

ডিস্পেন্সারির বাইরে:

“দেখলে! কাণ্ডজ্ঞানটা একবার দেখলে! এটা একটা ডাক্তার না জল্লাদ! কিরকম করে ধমকালে? আর তুমি একটা বাচ্চা মেয়ে, সঙ্গে বাবা-মা নেই, তাকেই তুমি ধমকে তাড়াচ্ছ? আরে সে তো আর এমনি এমনি যায়নি! তুমি ডাক্তার হয়ে সার্কাস দেখাতে পারো, আর আমরা দেখতে গেলেই দোষ!”  

   মেয়েটি চুপ করে থাকে। মেয়েটির নীরবতায় আরও উৎসাহ পেয়ে প্রহ্লাদবাবু বলতে থাকলেন,

“ওনার তোমার মত একটা মেয়েও আছে। সেদিন ফোন করেছি, দুবার তিনবারেও কেউ ধরলো না। চারবারের বার কেউ একজন ধরলো, মনে হল কোনও কাজের লোক, বাব্বা! কি চোপা! প্রথমেই জেরা, কে আপনি? কেন ফোন করছেন? এত বার একনাগাড়ে ফোন করছেন কেন! জানেন না কেউ ধরছেনা মানে, অসুবিধা আছে। এক নিঃশ্বাসে এসব বলার পর তারপর তার সময় হলো আমি ফোন করেছি কেন সেটা জানার। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলতে চাই জেনে এককথায় নাকচ। সোজা বলে দিল, “ডাকদারবাবু এখন কথা বলতে পারবে নে, তিনি এখন মেয়েকে ইঞ্জিরি পড়াচ্ছেন।”

মেয়েটির চোখটি উৎসাহে গোল গোল হয়ে গেল, জিজ্ঞাসা করলো, “তারপর?”

“তারপর আর কি! আক্কেলটা দ্যাখো….! দেশে এত মাস্টার-প্রফেসর আছে….তারা কি করবেটা শুনি! তুমি ডাক্তার মানুষ তুমি ডাক্তারিটা ঠিকঠাক করে করো। মেয়েকে পড়ানোর জন্য একগণ্ডা মাস্টার রেখে দাওনা কেন! আসলে কি বলতো? একনম্বরের রাম কিপটে…. মাস্টারের টাকাটাও বাঁচাতে চায়। এদিকে রুগীগুলো তাঁর অত্যাচারে যন্ত্রণায় মরতে বসেছে।”

মেয়েটি উত্তেজনায় ফুটছে, জোর গলায় বলে উঠলো, “ঠিক বলেছ, এই কথাগুলো আচ্ছা করে শুনিয়ে দিলে না কেন?”

“আরে শোনাবো কি করে! কথাগুলো শুনিয়েই তো ঝনাৎ করে ফোনটা রেখে দিল।” আবার প্রহ্লাদবাবুর চিরতার জল খাওয়া মুখটা ফিরে এলো।

মেয়েটি আক্ষেপের সুরে বলল,

“ইস! তুমি আবার একবার ফোন করে কথাগুলো বলতে পারলে না!”

“তা হয়তো পারতুম….কিন্তু এই ডাক্তার আমাকে আর দেখতো না। অন্য ডাক্তারদের গল্প তো শুনলে। এমনিতে যাই হোক এত কম পয়সায় চিকিৎসা আজকের যুগে কোনও ডাক্তার করবে না…তাই সব সহ্য করে এখানেই পড়ে আছি।”

ওয়েটিং রুম আস্তে আস্তে খালি হয়ে আসছে। ঘড়ির কাঁটাও সাড়ে নটার ঘর ছুঁতে চললো। চারদিক একবার চোখ বোলালেন প্রহ্লাদবাবু। এখন আশেপাশে কেউ নেই, গলা অতটা না নামালেও চলবে।

“এদের ছেলেমেয়ে কিন্তু একটাও মানুষ হবে না, এই তোমায় বলে দিলাম।” 

মেয়েটি চোখ গোলগোল করে বলে, “তাই! কি করে জানলে?”

“আরে কম তো দেখলাম না…এমনি এমনি বাহান্ন বছর পার করিনি। এইসব পয়সাওয়ালা লোকেদের বাচ্চারা ছোটবেলা থেকে এত আদর-কদর, ভোগ-ভালোবাসা পেয়ে বড় হয়, যে বড় হয়ে বাঁদর হওয়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা থাকে না।” মেয়েটির মুখটি এক মুহূর্তের জন্যে ম্লান হয়ে গেল, পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে প্রশ্ন করে, “তাহলে তারা কি করে?”

“কি আর করে? বাপের পয়সার শ্রাদ্ধ করে! যত রাজ্যের বদ নেশা ধরে! বখাটে বন্ধুর দল জোটে। তারপর পয়সার গরমে যা নয় তাই করে!” 

অবাক চোখে বাচ্চাটি প্রশ্ন করে, “তাই! তাহলে কি হবে?”

“কি আর হবে? বাপের পয়সা থাকলে কিছুই হয়না! সে তুমি মানুষ মারো… কিংবা জন্তু-জানোয়ার।”

মেয়েটি আঁতকে ওঠে। ঠিক সেইসময় চেম্বারের দরজা খুলে যায়। তাদের দুজনকেই অবাক করে দিয়ে ডাক্তারবাবু নিজেই বেরিয়ে আসেন। চিৎকার করে ডাকেন,

“প্রহ্লাদ পুততুন্ড!” 

ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ান প্রহ্লাদবাবু। নাম ডাকার পর আরও কয়েক সেকেন্ড জ্বলন্ত চোখে প্রহ্লাদবাবু আর মেয়েটির দিকে চেয়ে থাকেন। সেই দৃষ্টি দেখে প্রহ্লাদবাবুর বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। কি মনে করে ছেলেকে ফোন করে আসতে বলে দুরু দুরু বুকে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন।

    ভিতরে ঢোকার পর আবার সেই সিংহগর্জন, “হাঁ করুন!” কি দেখলেন কে জানে! আবার গর্জন, “সঙ্গে কে আছে?” সেই ধমকে প্রহ্লাদবাবু তোতলা হয়ে যান, “আ….মা..র   ছে… ছে…৷” তাঁকে ধমকে থামিয়ে ডাক্তার বললেন, “শুয়ে পড়ুন।” এদিক ওদিক তাকিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট মেয়েটির ইশারায় সামনের দোলনা-কাম-খাটিয়ার মত বেডটায় শুয়েই চোখ বন্ধ করে ফেললেন। আধঘন্টা ধরে ডাক্তার কুস্তি লড়াই করে যখন কষের দাঁতটাকে বাগে আনতে পারলেন তখন এই এসি রুমেও ডাক্তার-রুগী দুপক্ষই ঘেমে নেয়ে একশা। বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, বাচ্চা মেয়েটি ছাড়া ওয়েটিং রুম পুরো ফাঁকা। ওকে দেখেই মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো। পাশ দিয়ে যেতে যেতে মিষ্টি হেসে ভিতরে ঢুকে গেল।

  “ওই শুঁটকো, টেকো লোকটা তোকে কি বলছিল রে?”

গালটা ফুলে গেছে, মুখের মধ্যে অ্যানাস্থেসিয়ার ঘোর এখনও কাটেনি, সেই অবস্থায় কষ্ট করে জিজ্ঞাসা করলো, “কোন লোকটা?”

“আরে যে লোকটা তোর পাশে বসেছিল, যার প্রায় হাত ধরে চেম্বারের মধ্যে ঢুকেছিলি?”

“ও কিছুনা!”

“কিছু না মানে! কিছু তো বটেই! কি বলছিল?”

মেয়েটি একটু চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করে, 

“তুমি ওকে চার চারবার ঘুরিয়েছো কেন?”

“ইস!… ইল্লি আর কি! চার কি ওকে চল্লিশবার ঘোরানো উচিত ছিল!”

“কেন?”, মেয়েটির জিজ্ঞাসা।

“কেন নয়? প্রেসার একশো ষাট, সুগার সাড়ে তিনশো, সারা মুখে ইনফেকশন! শালার দাঁত তোলার শখ!”

মেয়েটি বিরক্তি গোপন না করে ধমকে ওঠে, “বাবা!” তাই শুনে আরও জ্বলে ওঠেন মণিময় ডাক্তার, “এরপর এলে দেবো শালা ভালো দাঁতগুলোকে পটপট করে তুলে!”

এমন সময় মেয়েটি দাঁতের যন্ত্রণা ভুলে চেঁচিয়ে ওঠে,

“আঙ্কল! বাড়ি যাচ্ছ? সাবধানে থাকবে….গুড নাইট!” বলতে বলতে তাদের রিকশা দুটো লোককে পেরিয়ে চলে গেল। মণিময় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন লোকটার থুড়ি তার পেশেন্টের অবাক হওয়া মুখের হাঁ টা এত বড় হয়ে গেছে যে শত বকুনি দিয়েও চেম্বারে এর অর্ধেক হাঁ-ও করাতে পারেননি।
**************************************

গৌতম সরকার পরিচিতি :
জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার পিয়াসাড়া গ্রামে ৷ উচ্চশিক্ষা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৷ অর্থনীতি বিষয় হিসাবে বেছে নিলেও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা শৈশব থেকে ৷ যেকোনো মননশীল রচনার একনিষ্ঠ পাঠক ৷ তবে লেখার ব্যাপারে চুড়ান্ত আলস্য বোধ করেন ৷ ফেসবুকের বাইরে লেখা শুরু করোনাকালীন ঘরবদ্ধ সময়ে ৷ পছন্দের বিষয়: ভ্রমণ কাহিনী, বিশ্ব অর্থনীতি এবং রাজনীতি বিষয়ক  প্রবন্ধ, রম্য রচনা, গল্প, এবং দৈবাৎ কবিতা, যা বিভিন্ন পত্রিকা এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে ৷ দেশ-বিদেশ ভ্রমণ এবং সাহিত্যচর্চা প্রধান বিনোদন ৷

 

                                         

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!