
প্রকৃত বন্ধু কখনো হারায় না
মহাশ্বেতা ব্যানার্জী
অলকা, মধুমিতা,করবী, সুচরিতা ও দেবযানী এই পাঁচজন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় খুব ভালোভাবে উত্তীর্ণ হবার পর ভৌত বিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে কলকাতার একটি বিখ্যাত গার্লস কলেজে ভর্তি হল। পাঁচজনের যখন নিজেদের মধ্যে পরিচয় হল দেখা গেল ওদের মানসিকতায় খুব মিল। আস্তে আস্তে ওরা পাঁচজনে পরম বন্ধু হয়ে গেল।
পড়াশোনার সাথে সাথেই কলেজ ক্যান্টিনে, রেষ্টুরেন্টে নানা আলোচনা, ছুটির দিনে সিনেমা, পিকনিক ইত্যাদির মাধ্যমে ওদের দিনগুলো রঙিন হয়ে উঠতে লাগলো। কিন্তু শুধু আনন্দ নয় পরস্পরের দুঃখ কষ্টও তারা ভাগ করে নিত। এই রকম ভাবে দেখতে দেখতে তিনটে বছর যে কোথা দিয়ে কেটে গেল সেটা ওরা টেরই পেল না।
গ্রাজুয়েশন ফাইনাল পরীক্ষার পর ওদের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। ওরা পাঁচজনে ঠিক করল কখনও ওরা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে না। প্রতি মাসে ওরা কোনো জায়গায় একত্রে মিলিত হত। তখন মোবাইল ফোনের দাপট ছিল না।তাই মনের টান আরো বেশি ছিল। এরপর পরীক্ষায় সবাই ভাল ভাবে উত্তীর্ণ হয়ে গেল।
সুচরিতার আগে থেকেই বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল |তাই ওর বিয়ে হয়ে গেল। বাকি চারজন উচ্চ শিক্ষার জন্য নানা জায়গায় ভর্তি হল। ওদের পথ আলাদা হলেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক অটুট ছিল। উচ্চ শিক্ষার পর কেউ চাকরি করতে গেল, কারোর বিয়ে হয়ে গেল ভিন্ন দেশে। তখন চিঠি লিখে ওরা যোগাযোগ রাখত। আস্তে আস্তে সকলের বিয়ে হয়ে গেল । পরিস্থিতির চাপে এবার সত্যি যোগাযোগ রক্ষা করা কষ্টকর হয়ে উঠলো । যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও মন থেকে কেউই কাউকে সরাতে পারেনি। মানুষের জীবন পরিবর্তনশীল এই সত্য মেনে নিয়ে যে যার নিজের জীবন কাটিয়ে যেতে লাগল। নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে সকলেই জীবনের গোধূলি বেলায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু এখনও তাদের সেই কিশোর বেলার স্মৃতি আনন্দ দেয়। প্রত্যেকেই ভাবে তাকে হয়ত অন্য বন্ধুরা ভুলে গেছে। নানা সামাজিক মাধ্যম দ্বারাও তারা অন্য বন্ধুদের খোঁজার চেষ্টা করে কিন্তু খুঁজে পায়না।
- হঠাৎ একদিন রাতে মধুমিতার কাছে সুদূর কানাডা থেকে এক মহিলার ফোন আসে। মহিলা জানায় সে মধুমিতার বন্ধু অলকা। মধুমিতা বিশ্বাস করতে পারে না। অনেক স্মৃতিচারণ করার পর সে বুঝতে পারে কানাডা বাসিনী মহিলা সত্যি ই অলকা। দু’জনের চোখের জল বাধা মানেনা। এবার দুই বন্ধু পণ করল বাকি তিনজনকে ওরা খুঁজে বের করবে। ওদের চেষ্টা সফল হল।
যেদিন ওরা পাঁচ বন্ধু ফোনে আবার একসাথে কথা বলতে পারল সেদিন রাতে কেউ ঘুমোতে পারল না। এখন ওরা আবার প্রতি সপ্তাহে এক দিন করে ফোনের মাধ্যমে একত্রে সেই কলেজ জীবনে ফিরে যায়। মনে হয়না যে চার দশক পেরিয়ে গেছে। সকলেই বয়স্ক এবং এক জায়গায় থাকেনা।তাই সকলের ইচ্ছে একবার যেন ওদের চাক্ষুষ মিলন হয়।
এভাবেই দিন কাটতে থাকে। এবারে ওরা বুঝতে পারে ওদের দেখা হওয়া উচিত। মধুমিতা ও অলকা কলকাতা এসে পৌঁছায়। বাকিরা কলকাতাতেই ছিল।ওরা ঠিক করে একটি নির্দিষ্ট দিনে এক নির্দিষ্ট জায়গায় ওরা মিলিত হবে। এই দিনটির জন্য ওরা কতদিন অপেক্ষা করেছে।তাই ওদের উৎসাহ সীমাহীন। প্রত্যেকেই ভাবে ঐ দিনটিকে কিভাবে স্মরণীয় করে তুলবে।
নির্দিষ্ট দিনে প্রত্যেকে বন্ধুদের জন্য উপহার নিয়ে হাজির হয়। পুনরায় মিলনের আনন্দে ওরা উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। এবার উপহার বিনিময়ের পালা। সবাই নিজের পছন্দের উপহার পেয়ে খুব খুশি। কিন্তু হঠাৎ ওরা লক্ষ্য করে মধুমিতা ওদের জন্য কিছু আনেনি। ওরা ভাবে মধুমিতা হয়ত ওদের পছন্দের কথা ভুলে গেছে। সবাই চুপ করে আছে এমন সময় মধুমিতা আস্তে আস্তে ব্যাগ থেকে একটা খাম বার করে টেবিলের উপর রাখে। ওরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে খামটা খোলে। খামের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ওদের পাঁচজনের একটি সাদা কালো গ্রুপ ফটো। সেই কলেজ জীবনের তোলা আর কয়েকটা জন্মদিনের কার্ড যেগুলো ওরা হাতে এঁকে মধুমিতাকে সেই চার দশক আগে দিয়েছিল। কতদিন আগের জিনিস কিন্তু ভালবাসায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। ওরা অভিভূত হয়ে যায়। সবাই মিলে মধুমিতাকে জড়িয়ে ধরে। ওরা তো কেউ এভাবে বন্ধুদের জিনিস আগলে রেখে দেয়নি। মধুমিতার বন্ধুত্বের কাছে ওরা হার স্বীকার করে নেয়।
**********************************
মহাশ্বেতা ব্যানার্জী – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ভৌত বিজ্ঞানে) স্নাতক ও বি.এড ডিগ্রী থাকলেও বাংলা সাহিত্যের প্রতি অদম্য আগ্রহ। শৈশব থেকেই স্কুলে ও কলেজের ম্যাগাজিনে কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তী জীবনে কিউ ম্যাথ শিক্ষিকা হলেও স্থানীয় ম্যাগাজিনে অনেক বাঙলা কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে । প্রিয় বিষয়-বন্ধুত্ব ও বাঁচার উৎস-প্রকৃত মানুষ ।