সম্পাদকীয়
কুলায়ফেরার বিহানবেলায় ৫
প্লিজ ফাসন্ ইয়োর সীট বেল্ট। ল্যান্ডিং প্রসেস্ হ্যাজ্ বীন স্টার্টেড ….।” বিমান যাত্রায় এই ঘোষণার মতন মধুর ঘোষণা সম্ভবত: আর হয়না। এক ঘন্টা হোক বা বারো–চোদ্দ ঘন্টার দীর্ঘ বিমানযাত্রা,যাই হোক না কেন,মাটি ছোঁয়ার জন্য মন কিন্ত আনচান করে। তারপর,নীচে,আরও নীচে নামতে নামতে ছোট্ট ঝাঁকুনীটা যেন একরাশ খুশি নিয়ে আসে,কুলায় ফিরে আসার আনন্দ নিয়ে আসে। সুনীতা যেন প্রতি পলে এই কুলায় ফেরার সুখ উপলব্ধি করেছে। নাসার মহিলা মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়ামস এবং বুচ মহাকাশে গিয়েছিলেন আট দিনের জন্য। মহাকাশে ভারশূণ্য অবস্থায় বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা সেরে ঘরে ফেরার কথা। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টা মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে জলভাত। কিন্তু তা হলো কই? আট দিনের বদলে তাঁরা মহাকাশ স্পেস স্টেশনে বন্দী থাকলেন প্রায় নয় মাস। বাড়ী থেকে মাত্র চারশো কিলোমিটার উঁচু থেকে বাধ্য হয়েই তাঁরা ৪,৫৭৬ বার নীল গ্রহের সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখতে বাধ্য হয়েছেন। এই ন‘মাস দীর্ঘ সময়ে পৃথিবীর বর্ষার সেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি,সবুজ পাতার সরসর শব্দ,বসন্তে ফুলের বাহার,শীতে (ওদের দেশে) বেলচা দিয়ে বরফ সরানো,অথবা পূর্ণিমার মৃদু আলো,এসবের কথা কী মনে পড়তো না? জীবনসঙ্গী,সন্তান,পোষ্য এগুলোর কথা? পৃথিবী তে ফিরে আসার কথা? নিশ্চয়ই মনে হতো। মহাকাশবিজ্ঞানী হলেও সুনীতা বা বুচ কিন্ত যন্ত্র নন,মানুষ। ন‘মাস পর ঘরে ফিরে তাঁদের মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
সূর্যাস্তের সময় আকাশে পাখির ঝাঁক কিচিরমিচির করে ব্যস্ত আপন নীড়ে ফিরতে। শোফায়র চালিত বিএমডব্লিউ চেপে এসির ঠাণ্ডায় হেডরেস্টে মাথা রেখে যিনি সারাদিন কাজে ব্যস্ততার শেষে ঘরে ফিরছেন,তাঁর সঙ্গে বনগাঁ লোকালে দম আটকানো গরম আর ভীড়ের মধ্যে কোনও রকমে এক হাতে হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পর ধাক্কাধাক্কি করে ঘেমে নেয়ে ঘরে ফিরে আসার আনন্দ ও শান্তি কিন্ত একই রকম। একথা সত্য,পাখি হোক বা মানুষ,ঘরের আশ্রয়ে ফিরতে সকলেরই সমান আগ্রহ। সমান শান্তি। এই বিশ্ব,এই নীল গ্রহ,এ জগতের সকল প্রাণের চাওয়া হলো আপন আলয়ের পরশ।
পাখির নীড়,অতল সমুদ্রের তল,ঝুপড়ি থেকে বহুতল সকলেরই শুধু শারীরিক আশ্রয় নয়,মানসিক আশ্রয় স্থলও স্বীয় বাসস্থানের নিরাপদ আশ্রয়। গুরুদেব তাঁর প্রেম পর্যায়ের গান
“আমার কন্ঠ হতে গান কে নিল ভুলায়ে
সে যে বাসা বাঁধে নীরব মনের কুলায়ে” …
দাদরা / খেমটা তালে বাউলাঙ্গ খাম্বাজে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ইট কাঠ লোহা পাথরের তৈরি অথবা প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা শরীরের আশ্রয়ই শুধু বাসস্থান নয়। মনের আশ্রয়ও আপনার নীড়! কুলায় ফেরার অর্থ আশ্রয়ে ফিরে আসা। এখানে মাতৃভাষার মাধ্যমে মাতৃ ক্রোড়ে ফেরা,ফিরে আসা। সে কারণেই এই হৃদয় ভরানো,দূরদর্শী নামকরণ। “কুলায়ফেরা“এক এবং একক আন্তর্জাতিক এবং আন্তর্জালিক,সাংস্কৃতিক সংকলন। আমাদের নিজেদের ঘরে ফেরাচ্ছে।
নববর্ষ সংখ্যা ‘বিহান বেলার‘এবার পঞ্চম বর্ষ। অনেক শ্রম,ত্যাগ,দীর্ঘ চিন্তার পর প্রকাশ হলো ‘বিহানবেলায়‘। যে কোনও মহৎ ক্রিয়া কর্ম নির্ভুল হবে,এটা কেউ দাবি করতে পারেনা। এই সঙ্কলনেও ভুল থাকতে পারে। বিহানবেলায় অংশ নেওয়া সকল কবি,গল্পকার,প্রাবন্ধিক এবং শুভাকাঙ্ক্ষী,সকলকে শুভেচ্ছা। কম্পিউটারের পিছনে বসে বিনিদ্র রাত কাটানো,সম্পাদকীয়তে সহযোগিতা করা পর্দার আড়ালে থাকা ব্যক্তিদেরও শ্রদ্ধা। আপন কুলায় ফিরতেই হবে সে শারীরিক বা মানসিক,যাই হোক না।
১৪৩১ চলে গেল। ১৪৩২ এলো। সকলে সুস্থ থাকুন। আনন্দে থাকুন। কুলায়ফেরার সঙ্গে থাকুন |
সকলকে শুভ নববর্ষের প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই !
দেবদত্ত বিশ্বাস
সম্পাদক, কুলায়ফেরা
১ লা বৈশাখ,১৪৩২