Shadow

সাধুসঙ্গ – দেব মুখার্জি

p.c. উইকিপিডিয়া

সাধুসঙ্গ

দেব মুখার্জি

শহরে ঢোকার মুখে, কয়েক ঘর মানুষের বসতি,আশেপাশে নানান গাছগাছালি,পাখির ডাকাডাকি। তার পাশ দিয়েই সরু পাহাড়ি পথটা,এর পোষাকি নাম হিল রোড,বেশ খানিকটা চড়াই পেরিয়ে রাস্তাটা শহরে এসে মিশেছে। কদাচিৎ গাড়িঘোড়া চলে এই পথে। নির্জন এই বনপথ আমার বড়োই পছন্দের,একটু ঘুরপথ হলেও এইপথেই যেতে আমি ভালোবাসি। নিদা ফাজলিকে মনে রেখে বলি,“ রাহগুজর-The favorite pathway.”

এখানেই পরিচয় আমার সাধুর সঙ্গে,প্রায় সমবয়সী মানুষটা হাত বাড়িয়ে লিফ্ট চেয়েছিল একদিন। পরনে আধময়লা পোষাক, সিকিউরিটি গার্ডের,পায়ে তোবড়ানো ফুটোফাটা একটা জুতো। হাতে একটা থলি,অন্যহাতে চট দিয়ে মোড়া জলের বোতলটা। হেন লোকটাকে লিফ্ট ?  কি মনে হয় দাঁড়াই।বাবুজী একটু এগিয়ে দেবে চড়াইটা,হাঁফ লাগে বড্ড,চড়তে তাই“,হাতদুটো জড়ো করে সে।

হাবিবগঞ্জে পদ্মশ্রী অশোক চক্রধরকে শুনেছিলাম বলতে একটা কবিতা,মসলারাম। জঙ্গলের মজুর এই মসলারাম,একবার লরিতে সওয়ার হয়ে,ড্রাইভারের প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিল তার জীবনগাথা।

বিনা ওষুধে মা মারা গেছেন আর তার বৌ পড়শীর সঙ্গে পালিয়েছে,এমনকি মুরগীটাও পড়শীর মুর্গার সঙ্গে। লরি এগোয়,এগোয় কাহিনী।

সে সব মনে পড়তেই,কাহিনীর খোঁজে বাইকটা দাঁড় করাই আমি। নাম জিগ্গেস করি,বলে,সাধু। বাইকে বসে সে,একটু আড়ষ্ট হয়ে বসেছে নড়বড় করছে‌,অভ্যেস নেই তো,বুঝি। কাঁধটা ধরতে বলি,দ্বিধাবোধ করে,বলে তোমার সাদা জামায় নোংরা লেগে যাবে যে। ধীরে ধীরে বাইক  এগোয়,এবার গল্পও এগোয়,শহরের বাইরের মস্ত আবাসনে,লোটাস প্যালেসে সে নাকি সুরক্ষাকর্মী। সাড়ে আটটা থেকে  সাড়ে আটটা ডিউটি আওয়ারস,বারো ঘন্টায় তিনশো টাকা রোজি। 

মোড়ের মাথায় নামিয়ে দিই ওকে,”বাবুজী চা খাবে“,বড়োই কুন্ঠিত হয়ে বলে সে।আজ নয় অন্যদিন“,আমি এড়িয়ে যাই। আর তারপর আবার পরের দিন,সেই পথে আবার সাধু দাঁড়িয়ে,এই ভাবে বেশ অনেকদিন,বাইকে বসে সে রোজই নড়বড় করে,তবে পৌঁছনোর পরে চা খাওয়ার অনুরোধ করতে ভোলেনি কোনোদিনই,আর আমিও স্মিত হেসে এড়িয়েছি। 

তবে আজ সাধু অবাক হয়েছে,ওর চা খাওয়ার ডাকে সাড়া দিয়েছি। বেঞ্চে বসে কিছুটা উসখুস করে,ওকে বলেই ফেলি,কাল থেকে আমি আর এইপথে আসবোনা। অন্যদিকে কাজে যাবো,দেখা হবেনা আর,অন্য কেউ নিশ্চয়ই লিফ্ট দেবে,তোমার কাজে যেতে আশাকরি অসুবিধে হবেনা।

বাবুজী তরাক্কি হুই কেয়াখুশ খবরি জরুর কুছতো হোগা ।আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে,শুধুমাত্র চা নয় আজ চায়ের দোকানিকে বিস্কুটও দিতে বলে সে। দোমড়ানো পঞ্চাশ টাকার নোটটা দোকানিকে বাড়িয়ে দেয়। ওর শিক্ষা,আন্তরিকতা,সহমর্মিতা আমাকে অবাক করে,অপরের জন্যে এতো খুশি হওয়া এযে ভীষণ শক্ত।

এবার জড়িয়ে ধরি সাধুকে। এতোদিন পরে আমার কাঁধদুটোয় হাত দেয় সে।বাবুজী ভালো থেকো,মনে রেখো আমায়।অবাক বিস্ময়ে ওকে দেখি আর একবার,কালো চশমাটা দিয়ে চোখদুটো ঢেকে চেষ্টা করি চোখের জলকে বাঁধতে। 

সাদা জামাটায় এতো কালিঝুলি কি করে এলে“,বাড়ি ফিরতেই প্রশ্ন করেন তিনি

বলিসাধুসঙ্গ।
*******************************

লেখক পরিচিতি
চন্দননগরের দেব মুখার্জি,কর্মসূত্রে প্রবাসী বহুদিন ধরে। ভ্রমণ ছিল তাঁর পেশার অঙ্গ। এখন নেশায় দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে কাজে অকাজে ঘুরে বেড়িয়ে,সেই পথ চলার কিছু কথা,পথচলতি মানুষের কথা-অল্প কয়েক বছর আগে শখ করেই লিখেছিলেন ফেসবুকে। সেই লেখা পছন্দ করেন অনেকেই। লেখা চালিয়ে যেতে বলেন। উনি আর থামেন নি। মাঝে মধ্যে কয়েকটি লিটল ম‍্যাগাজিন,ই-বুক বা সংকলনগুলোতে কিছু লেখা ছাপাও হয়। সবাই প্রশংসা করে। ফেসবুকে পরিচিতি পেয়েছেন,ধারাবাহিক ভাবে লিখে গেছেন কয়েকটি ফেসবুক গ্ৰুপে দীর্ঘদিন। আজও তিনি নিয়মিত লেখেন ফেসবুকে তাঁর টাইমলাইনে। এবার বই হোক,মলাটবন্দী হোক সৃষ্টিগুলো-বন্ধু বান্ধব,পাঠক পাঠিকা আর শুভানুধ্যায়ীদের অনুরোধ,আবদার ছিল দীর্ঘদিনের। জনপ্রিয় কয়েকটি লেখা বেছে দিয়েছিলেন তাঁরাই। ছাপা অক্ষরে দেব মুখার্জীর প্রথম প্রচেষ্টা ‘পাড়ি’। আশা রাখি ভবিষ্যতে এরকম আরও অনেক  অপরিচিতই কাছের মানুষ হয়ে উঠবেন ওনার জীবনমুখী অরণ্য প্রেমের ছোঁয়ায়।

 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!