Shadow

অন্তঃসলিলা – মধুমিতা মিত্র

অন্তঃসলিলা 

মধুমিতা মিত্র

“শ্বশুর বাড়ির এত পাওনা গয়নার মধ্যে শুধু মাত্র এ ক’টিই জুটলো আমার ফুলশয্যার সাজে”? বৌভাতের রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করতে করতে নতুন বৌয়ের চাপা স্বগতোক্তিতে স্তব্ধ নিখিলেশ দরজার ছিটকিনি লাগাতেও যেন ভুলে গেল!
ভোরের আলো তখনও অস্ফুট,শেষ বৈশাখের ছোট রাত্রি তার শেষ প্রহর কাটাচ্ছে, ভৈরবীতে সানাইয়ের তান ঘুম ভাঙিয়ে দিল নিখিলেশের। ভৈরবীর মোচড় কেমন বুকে এক বেদনার সুর তুললো,তার‌ একলার জীবন জুড়তে চলেছে অন্য আর এক অদেখা জীবনের সঙ্গে। সারা বাড়িও তখন দধিমঙ্গলের আয়োজনে মত্ত। যৌবনের আঙিনায় পদার্পণ করতে না করতেই নিখিলেশের খুব সচেতন বাবা মা বিয়ের ব্যবস্হা সেরে ফেলেছেন এক রকম নিখিলের মতামতের তোয়াক্কা না করেই। লোকমুখে শুনছে নিখিলেশ, বৌ নাকি পরমাসুন্দরী;তপ্ত গৌরী,হরিণ আঁখির এক অপরূপা,আসছে নিখিলের জীবন আলো করতে।
ছাদনা তলায় প্রথম দেখা,ভ্রমর চোখের সলাজ চাহনি বুকে দোলা লাগিয়ে দিল। রবীন্দ্র প্রেমী বাবা, ঠাকুর বাড়ির আদলে মেয়ে বেছেছেন গরীব ঘর থেকে। এক রকম গরীব ঘরের সুন্দরী কন্যা উদ্ধার আর কি। গড়ে পিটে নেবেন নিজেদের মত করে।
মধুযামিনীর প্রথম ক্ষণেই অভিযোগের,বিরক্তির সুরেই ফুল শয্যার রজনীগন্ধার গন্ধ ফিকে হয়ে গেল, সানাইয়ের বেহাগের তান বেসুরো করে দিল। এর আগেই অবশ্য গন্ডগ্রামের বিবাহ বাসরের আতিথেয়তায় খানিক তাল কেটেছিল,বরযাত্রীর স্বাভাবিক সৌজন্যমূলক আপ্যায়ন থেকেও বঞ্চিত ছিল বরপক্ষ,তাদের জন্য যেমন ছিল না আবাহন, তেমনই না ছিল ভদ্রতা মূলক কোনো বিসর্জন। দারিদ্র্যের সাথে দম্ভের কেমন এক অদ্ভুত মেল বন্ধন। বেড়াল পার করে দেওয়ার মত‌ই বিয়ের আয়োজন, তবু যেন দেমাকের গন্ধে ঢুলুঢুলু বিবাহ বাসরের পরিবেশ। দরিদ্র জেনেই তো বৈবাহিক সম্পর্কের স্হাপনা, কিন্তু তার মধ্যে আন্তরিকতার অভাব, তাচ্ছিল্যের ভাব থাকবে কেন? যাক্ গিয়ে, সে সব উপেক্ষা করে তো নিখিলেশের বাবা বাড়ির বড়ো ব‌উকে মা লক্ষ্মীর সমাদরে নিয়ে এলেন ঘরে। ভাল‌ই হলো নতুন ছাঁচে ঢালবেন তিনি তাঁর আদরের বৌমাকে। সবাই তো বৌমার রূপে মুগ্ধ। সবচেয়ে বেশী মুগ্ধ নিখিল,কিন্তু চার দেওয়ালের মধ্যে প্রথম রাতের সৌরভের মধ্যেই বুঝতে পারলো যে বুদ্ধিমান বাবার এ এক বড়ো ভুল হয়ে গেছে যা আর শোধরানোর কোন‌ও উপায় নেই।
নিখিলেশদের বাড়ির উল্টোদিকেই বিবি বেগমদের বাংলো বাড়ি,বিবি নেহাৎই ছেলেমানুষ কিন্তু বিবির দিদি বেগম এঁকেছিল নিখিলের মনে মানসীর এক রূপ ছায়া। বেগমের স্নিগ্ধ রূপ এবং ব্যক্তিত্ব, সংগীত প্রেম, সাহিত্য প্রীতি,নম্র আচরণ,জানার ইচ্ছা,উন্নত-রুচিশীল জীবন যাত্রার প্রতি আগ্রহ সব কিছুতেই নিখিল থাকত আবিষ্ট। দুই বাড়ির খুব ঘনিষ্ঠতার সঙ্কোচে সেই মানসীকে মনের চিত্রপট থেকে আর জীবনের যাত্রাপথে সঙ্গিনী করে তোলা হয় নি নিখিলের। ঐ রূপরেখার আদলেই তিল তিল করে গড়ে তুলেছিল নিখিল তার তিলোত্তমাকে, প্রতিষ্ঠিত করেছিল জীবনের বেদীতে। সে স্বপ্ন যে চূর্ণবিচূর্ণ তা বিবাহিত জীবনের প্রথম পর্বেই নিখিলের কাছে পরিষ্কার। বড়ো সাধ ছিল জীবন সঙ্গীনি তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে,হাতে হাত রেখে জীবনের যুদ্ধে সহযোদ্ধা হবে। সে আশায় পড়লো ছাই। স্কুল পেরোনো তরুণী বধূটিকে শ্বশুর মশাই কলেজে ভর্তি করতে চাইলেও গৃহকর্মের দায় দায়িত্বের অজুহাতে বৌমা এড়িয়ে গেল শ্বশুর মশাইয়ের সে সাধ। শাশুড়ি মা ও ব্যর্থ বৌমাকে দিয়ে রুচি সম্পন্ন দিন যাপনে। গৃহকর্ম শুধুমাত্র‌ই মোটা দাগের;রুচি, সূক্ষ্মতা এসব যেন ধর্তব্যের মধ্যেই নয়।
সাংসারিক নিয়ম মেনে পুত্র সন্তানের জনক জননী হলো নিখিলেশ-দোলনচাঁপা। সেই সুবাদে দোলনের অহঙ্কারের মাত্রা আরও যেন বৃদ্ধি পেল। গরীব ঘরের মেয়ে হলেও শুরু থেকেই পার্থিব সুখ সুবিধা, আশা, আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা বড্ড বেশীই  ছিল। আজ এই শাড়ীর বায়না,কাল পাশের বাড়ীর দিদির গয়না গড়ানোর উদাহরণ,পরশু বেড়াতে না নিয়ে যাবার অভিযোগ।নিখিল আর পেরে ওঠে না। পরিমিত আয়ে চারিদিক গুছিয়ে চলাও যে জীবনের এক সুষমা তা বোঝায় কাকে? নিখিলেশের মনে হতো যেন সংসারের প্রতি দোলনচাঁপার দায়বদ্ধতার কোনো বোধ‌ই নেই, শুধু মাত্র পেতেই সে এসেছে, বিন্দুমাত্র দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। দায়িত্ব পালন করে নয়, অন্যের ওপর দায়িত্বের বোঝা চাপানোই তার প্রধানতম সাংসারিক কর্তব্য।
হায় রে! কোথায় গেল সেই সুরুচিসম্পন্না মানসী। এর খালি আকাশ ছোঁয়া প্রত্যাশা,কেবল দাবী আর দাবী,স্হূল রুচি-মোটা চাহিদার মধ্যে বাঁধা পড়েছে জীবন।
-“কোথায় বিয়ের পর একটু সাধ, আহ্লাদ করবো, কোথায় ঘুরবো ফিরবো, তা না শুধু সংসারের কাজ আর কাজ”!!
নতুন জীবনের গোড়া থেকেই এই উষ্মা আর অভিযোগ পাগল করে তোলে নিখিলকে। যে মা বাবা বুক দিয়ে আগলে পরিবার গড়ে তুলেছেন সেই মা বাবার প্রতিও নেই কর্তব্য বোধের লেশ মাত্র। পিতৃদত্ত অসভ্যতা আর দেমাকের কুৎসিত এক সমন্বয়। শ্বশুর বাড়ির দীনতা,অভদ্রতা নিখিলেশের‌ই বিড়ম্বনা,লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শহরের নানা মানী গুণী মানুষের সাথে নিখিলের বিশেষ যোগাযোগ। নিখিল চায় এদের সংস্পর্শে এনে দোলনকে মানসিকভাবে উন্নত করার, সাংস্কৃতিকভাবে সচেতন করার, কিন্তু দোলনের যে কোনো ইচ্ছা,কোনো চেষ্টাই নেই। চাকরির বাইরের সময়টা ক্রমশঃ নিখিলের কাছে দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। আশে পাশের পরিচিত,আত্মীয়,বন্ধুদের মাঝে পোশাক নির্বাচন-সাজগোজের স্হূলতায়, কথাবার্তার বিষয়ে এবং ধরন ধারনে দোলনকে বড়ো অসহ্য লাগে। অগ্নিসাক্ষী করা স্ত্রী,তাকে ফেলে কি করে? তার ওপর তার‌ই সন্তানের জননী। দায়িত্ব আর দায়বদ্ধতার নাগপাশে আবদ্ধ নিখিলের দম বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু এ ব্যথা বলে কাকে? এ যন্ত্রণার ভাগ নেবে কে? বাবা মাকে বললে তাঁদের অ-সুখ, দুশ্চিন্তার ভার বাড়বে শত গুণ,বন্ধু বান্ধবের কাছে খোলসা করলে সম্মান হানির সম্ভাবনা, পৌরুষের সৌষ্ঠবে আঁচড় লাগার ভয়!
দিন গড়িয়ে যায়, নিখিলের মনের পাথর ক্রমশঃ ভারী হয়ে উঠতে থাকে। মাথার ভারে,মনের যাতনায় নিখিলেশ জর্জরিত। ছোট বেলা থেকেই নিখিল বড়ো আদরের,স্নেহের ভালবাসার মুখাপেক্ষী। সেই মনশ্ছায়া বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গেই পরিণত হয়েছে এক প্রেয়সীর আকাঙ্ক্ষায়,যে প্রেয়সী তার ভালোবাসার আঁচল বিছিয়ে মুছিয়ে দেবে জীবনের ক্লান্তি, বেদনা, গ্লানি। কিন্তু জীবন দেবতার অদৃশ্য খেলায় সে বাঁধা পড়েছে এমন এক নারীর সাথে যার অধিকার আর দাবী শুধুই আকাশ ছুঁয়ে যায়,মমত্বের,ভালোবাসার বাণী তার অধরা। এমন নারীর সাথে জীবন কাটানো বড়ো দুঃসহ। তবুও সমাজ সংসারের নিয়ম মেনে এ থেকে মুক্তি ও নেই,নেই যন্ত্রনা উপশমের কোনো ওষুধ‌ও। কি করে!! কি করে!-পাগল নিখিল তখন চোখ মেলে বহির্বিশ্বে,দেখে সুখের, ভালবাসার আনন্দের কোনো অভাব নেই তো সেখানে। অনেক নারীই তাঁদের স্বাভাবিক ভালবাসার সুধায় জারিত। নাই বা হল তাদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক,নাই বা থাকলো আইন সিদ্ধ কোনো বন্ধন! হৃদয়ের রাস্তা তো সেখানে আটকায় না, সেখানে কোনো সমাজসিদ্ধ আইন তো কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে না। জীবন যখন তার যথার্থ সঙ্গিনীর ভাগ্য থেকে বঞ্চিত করেছে,তখন সে বঞ্চনার এই তো হতে পারে সঠিক জবাব। নিজেকে ভালো রাখাও জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দাবী, জীবন দেবতা সে অর্চনার অধিকারী। তবে কেন সে নিজেকে বঞ্চিত রাখবে এমন সুখ থেকে? সুখ যদি সরাসরি না পাওয়া যায়, লুকিয়ে চোরা পথে আসুক না সে সুখ। মনের বোবা কান্না তো মুখ লোকানোর জায়গা পাবে কোথাও। ব্যর্থ, অসহনীয়,দুর্ভার দাম্পত্য জীবনের কোথাও একটু মুক্তির রাস্তা থাকবে! শালীন ভাবে কোনো মহিলাকে মানস সঙ্গী করে নেবার বাধা কোথায়? সমাজ নিন্দিত পথে না গেলেই হলো,তবু তো অন্তরের নিরন্তর সে কান্না শুকিয়ে না যাবার মরুদ্যান পাবে কোথাও।
আজকের আধুনিক যুগের প্রযুক্তিতে পৃথিবী হয়ে এসেছে অনেক ছোট। ব্যক্তি পরিচয়কে ঢেকে নিজের মনকে খোলা যায় অন্তর্জালে। নিখিল সে রাস্তাই খুলে নিল। অন্তর্জালে অদেখা,অচেনা মানুষের সাথে গড়ে তুললো নিবিড় বন্ধন। অদৃশ্য প্রতিটি মানুষই হয়ে উঠলো নিখিলের প্রতিটি ক্ষণের নিত্যসঙ্গী। একজন নয়, কত নারী যে একসাথে হয়ে উঠলো তার মানসী সে ইয়ত্তা নেই। অপরিণত বয়সের প্রেমের উত্তেজনার মতো নিষিদ্ধ এইসব সম্পর্ক‌ই যেন অবরুদ্ধ নিখিলের সঞ্জীবনী সুধা। নিখিলের মনের হাজার দুয়ার খুলে হৃদয়ের আলোয় নিখিল থাকে ঝলমলে,অন্তরের কান্নার স্রোত পথ ভোলে ল্যাপটপের স্ক্রীণে। আনন্দ তার হাজার বাতির ঝাড় জ্বালিয়ে দেয় ঝলমল ক’রে। কোনো একজন সম্পূর্ণ নারীকে না-ই বা পাওয়া হলো জীবনে,খন্ড খন্ড রুচির অসম্পূর্ণারা সম্পূর্ণা হয়ে ধরা দিল নিখিলের কাছে।
কেউ বা অসামান্য সুন্দরী,নানা আবেদন ভরা ছবি আসে নিখিলের কাছে,তাতে কিছুটা হলেও তৃপ্ত হয় তার আদিম বাসনা; কোনো নারী আবার হাস্যরস পরিপূর্ণা; কেউ বা সংগীত মুখর; কেউ বা সাহিত্য নির্ভর; কেউ বা শুধুই রুচিশীলা। সবার‌ই অন্তরঙ্গতা নিখিলের মনের মধ্যে তৈরী করে অদ্ভুত সুন্দর এক আমেজ, ভালোলাগার পরিপূর্ণতায় আবেশিত নিখিলের মন-মেজাজ।
সেদিন সোশ্যাল মিডিয়ার নোটিফিকেশনে টুং করে বেজে উঠলো কোনো নতুন পোষ্টের আগমন ধ্বনি। পাতা খুলে নিখিল দেখে, তার‌ই প্রিয় এক ভার্চুয়াল বান্ধবীর নতুন কিছু ছবির পোষ্ট। আগ্রহী নিখিল ছবি দেখে খুঁটিয়ে। বান্ধবীটির স্বামীর সাথে অন্তরঙ্গ ছবি গুলির মধ্যে ফুটে উঠেছে তাদের সম্পর্কের উষ্ণতা,নির্ভরতা, পারষ্পরিক ভালোবাসা। নিখিলেশের মনের মধ্যে বেজে ওঠে বেহাগ রাগের সেই স্বত্তা,মুচড়ে ওঠা কান্নার সুর,মন জুড়ে তাকিয়ে থাকে ছাদনা তলায় দেখা সেই হরিণ চোখের দৃষ্টি,যে দৃষ্টির বহিরঙ্গই শুধু মায়া ভরা, সুন্দর, গভীরে গেলে কেবল বালুচর, মায়া-মমতা ভালবাসার কোনো চিহ্ন নেই সেখানে। খালি দাবী আর না পাওয়ার অভিমান আর অভিযোগ। বিধাতার এ কেমন সৃষ্টি? কেমন এ বিচার তার‌ই প্রতি! ব্যথায় ভরে ওঠে নিখিলের সর্বান্তকরণ,গুমরে ওঠে মন। নিখিলেশের বয়ে চলা কান্নার অন্তঃসলিলা স্রোত দুকূল ছাপিয়ে বাঁধ ভাঙে।
**************************************
মধুমিতা মিত্র পরিচিতি
পেশা–স্বপ্ন দর্শন, স্বপ্ন গুলোই বাঁচিয়ে রাখে, নেশা–আনন্দ চয়ন, জীবন পথের সমস্ত জঞ্জাল, বোঝা, দুঃখ সব দূর করে ফেলে দিয়ে আনন্দ কুড়িয়ে বেড়ানো,প্রেম-রবীন্দ্রনাথ, উদয়শঙ্কর, উত্তমকুমার। সাম্প্রতিকতম প্রেম শ্রীকৃষ্ণ ..
madhumita_mitra_pic

1 Comment

  • Dilip Kumar Mitra

    দারুণ। শেষে কেন নিখিলেশকে আবার মনমরা করে দিলেন? ওকে অনেক অনেক আনন্দ খুঁজে নিতে দিন।

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!