Shadow

আপনজন – বিশ্বজিৎ দে

PC Printerest

আপনজন

বিশ্বজিৎ দে

বাগবাজারের এক সাবেক বাড়ির দারোয়ানের পাশের ঘরে পারুলদি থাকেন। আছেন প্রায় বছর সাতেকের বেশি। ওই বাড়ির মেজকত্তার একমাত্র ছেলের একমাত্র কন্যা মিঠুর দেখাশোনা করেন। ওই যেদিন মেজকত্তার গিন্নি নাতনি হওয়াতে আটকৌরের দিন কুলো বাজিয়ে আর খই ছড়িয়ে নাতনির জন্য লাড্ডু বিতরণ করলো, তার ঠিক দুদিনের মাথায় পারুলদি এলো ওই বাড়িতে। দারোয়ান রাম সিংহের দূর সম্পর্কের কে যেন একটা হয়! সে যাইহোক এখন পারুলদি আর নাতনি মিঠুর এই এতগুলো বছরে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে ভারী মিঠে।
শীতের রোদে লুডো খেলার সঙ্গী হোক বা পড়ার পরে কার্টুন দেখার বন্ধু। মিঠুর সব আবদারের একমাত্র দাবিদার পারুলদি। স্নানের শেষে ভিজে মাথা মোছানো, যখন তখন নুডলস খাবার বায়না মেটানো, বারান্দায় রান্নাবাটি খেলার সঙ্গী কিংবা ঘুমের সময় গল্প বলা, সবই পারুলদি দক্ষ ভাবে সামলান। মিঠুর মা স্কুল শিক্ষিকা এবং বাবা একটি বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করেন। দুজনের কাজের ফাঁকে যতটুকু মেয়েকে সময় দেবার দিয়ে থাকেন ঠিকই, কিন্তু সময়ের ফাঁকেও তো আরও সময় থাকে ! আবদারের মাঝেও তো আর অবদার বাকি থাকে ! মিঠুর জীবনের পারুলদি হল সেই শূন্যস্থান পূরণের মানুষ। শূন্য সময়কে যত্নে আর লালনে আগলে রাখার মানুষ।
প্রতিবছর গরমের ছুটির সময় পারুলদি দেশে যান। মিঠুর খুব আনন্দ হয় এই সময়টা এলে। ওই দিন পনেরোর ছুটি কাটিয়ে পারুলদি যখন আবার বাগবাজার আসেন তখন সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তাদের দেশের মুড়ি, গুড় আর মুড়কি। মিঠু ওই মুড়ি আর মুড়কি একসাথে মেখে খেতে বড় ভালোবাসে। তার কাছে ওই সারি সারি ঠোঙ্গা ভর্তি মুড়ি আর মুড়কি বিরাট উপহার। তার ছোট্ট আর সরল জীবনে দামি পাওনা। দত্তপুকুর থেকে আরো কিছুটা ভেতরে পারুলদির বাড়ি। ভাই, ভাইয়ের বউ আর ছেলে ছাড়া পারুলদির দুনিয়ায় আর কেউ নেই। মিঠু আর মিঠুর বাড়িটাই সব, তাই ওই দিন পনেরোর বেশীদিন পারুলদিও শহরের সব কিছু ছেড়ে থাকতে পারেননা, বলা ভালো চাননা।
স্কুলের গরমের ছুটি পড়েছে। পারুলদির দেশে যাবার দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেছে। মিঠুর খুব আনন্দ পারুলদি এবার ফিরলে আবার তার জন্য সেইসব পহার নিয়ে আসবে। ভোরের ট্রেন ধরতে হয় পারুলদিকে তাই আগের রাতে মিঠুকে আদর করা সেরে রাখলো। দিন পনেরো কেটে গেল। প্রাকবর্ষার বৃষ্টি শুরু হয়েছে কিছুটা আর মিঠুর স্কুলের ছুটিও শেষ হতে চলল। কিন্তু এবার পারুলদি আর ফিরছেনা। এক এক করে দিন যায়। মিঠুর বাবা মা সবাই যোগাযোগ করার চেষ্টা করে কিন্তু ওই মোবাইল নম্বর সুইচড অফ। তাও চেষ্টা চললো পারুলদির সাথে যোগাযোগ করার। পেরিয়ে গেল আরো দিন দশেক দিন। মিঠুরও এবার মন খারাপ হতে শুরু করলো।
মিঠুর স্কুল খুললো। পারুলদির সব কাজ মিঠুর মাকেই করতে হচ্ছে ইদানিং। নিজের কাজ, মেয়ে সামলানো সব নিয়ে উনি নাজেহাল। এমনই এক প্রাকবর্ষার সন্ধ্যেতে বিরাট বারান্দায় বৃষ্টির এসে পড়ছে অনায়াসে। মিঠুর পড়া চলছে মায়ের কাছে। হঠাৎই দরজার দিকে মিঠুর চোখ যায়।
‘মা পারুলদি !’ আনন্দে বলে উঠলো মিঠু।
মিঠুর মা পারুলদি কে জিজ্ঞেস করলো “কি হয়েছিল ওর ? ফোনে পাওয়া যাচ্ছেনা ? যোগাযোগ করা যাচ্ছেনা! কি সমস্যা ছিল ?”
পারুলদি বলতে শুরু করলো সবটা। ওর ভাই সব টাকা নিয়ে নেয়, যা কলকাতা থেকে জমিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এর কিছুদিন পরে প্রায় জোর করে পারুলদির নামে যে দু’ফসলি জমি ছিল তাও লিখিয়ে নেয় এবং বলে ওদের সংসারে থাকতে হলে ওদের মত করে চলতে হবে। শহর থেকে টাকা পাঠাতে হবে ওদের ছেলের জন্য। এই সব ঘটনার পর পারুলদির শরীর ও মন দুই ভেঙে যায়। জ্বর আসে। একটু ঠিক হতেই কাউকে কিছু না বলে বাগবাজার চলে আসে।
পারুলদি বলতে থাকে ‘বৌদি আমি আর কোনোদিন দেশে যেতে চাইনা। আমার যারা ছিল এতদিন, আসলে তারা আমার কেউ নয়। দেশের ঘর বলতে কিছু আর রইলো না। মিঠু, মেয়ে আমার….এবারে তোমার জন্য মুড়ি আনতে পারলামনা মা। পরে হয়তো…..!’
মিঠু বলে উঠলো ‘পারুলদি তুমি আমার ঘরে থেকো। মুড়ি তোমায় আর আনতে হবেনা। ওটা না হয় বাবা আমায় কিনে দেবে।’
*****************************************
লেখক : বিশ্বজিৎ দে
পরিচিতি : রেডিও উপস্থাপক ও লেখক

1 Comment

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!