Shadow

আবরণ – রমা চ্যাটার্জি

PC Westend 61

আবরণ

রমা চ্যাটার্জি

         “মনীশদা, দেখো দেখো অঙ্কন প্রতিযোগিতার কাগজপত্রগুলো কর্তৃপক্ষ পাঠিয়ে দিয়েছে।” মনীশের বিরক্তি ভরা উত্তর, “দেখছিস না , ডান্স কম্পিটিশন এর সার্টিফিকেট গুলো গুছিয়ে রাখছি ,আমাকে একটা একটা করে কাজ সারতে দে। আবার দশ দিনের মধ্যে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুরু হতে চলেছে সুতরাং বুঝতেই পারছিস আমার নাওয়া-খাওয়া সব মাথায় উঠবে!
        মনীশ এই পাড়ায় বছর চারেক হল  একটা ওয়ান রুম ফ্ল্যাট কিনে থাকে। চালচলন বেশভূষায় সবই খুব সাধারণ কিন্ত ব্যবহারটা অমায়িক আর সব সময় হাসি ও গান করেই সারাটা দিন কাটিয়ে দেয়। সকলেই মনে করে মনীশের জীবনে কোন দুঃখ সমস্যা কান্না কিছুই নেই ,আছে শুধু প্রাণ-খোলা-হাসি আর গান।সব সময় তার গলায় সুর ওঠে খেলা করে ‘এমনি করে যায় যদি দিন যাকনা’ । অনেকে তো জিজ্ঞেসই করে বসে” মনীশ, তুমি সব সময় সব বিষয়ে এত কেয়ার ফ্রি থাক কী করে?”মনীশ একটা রহস্যময় হাসি হেসে সব প্রশ্নের উত্তর সুন্দরভাবে এড়িয়ে যায়।
        পাশাপাশি চারটে পাড়ার ক্লাব এর মধ্যে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হবে,এ পাড়ার ক্লাবের কোচ মনীশ। ছেলেদের তৈরি করার জন্য কি পরিশ্রমটাই না করে, যার যেখানে খামতি, বারবার অনুশীলন করিয়ে সেই ভুলগুলো শুধরে দেবার চেষ্টা করে। গত বছর এ পাড়ার ক্রিকেট দল খুব খারাপ ভাবে হেরে গিয়েছিল, সেই জন্য মনীশ এবার আদাজল খেয়ে লেগেছে পাড়ার হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে। ফাইনাল খেলার শেষে টুর্নামেন্টে জিতে ট্রফি কাঁধে নাচতে নাচতে এসে সবাই ক্লাবঘরে বসে ভেজিটেবিল চপ ও রসগোল্লা দিয়ে বিজয় উৎসব পালন করছ। টুনা এক কামড় চপ মুখে দিয়ে বলল,” এতে হবে না মনীশদা,প্র্যাকটিসের সময় কি খাটান খাটিয়েছ এবার কিন্তু মাংস ভাত খাওয়াতে হবে”। সকলের একসঙ্গে চিৎকার “ঠিক কথা ঠিক কথা” মনীশ একগাল হেসে বলল “আচ্ছা বাবা ,ঠিক আছে তাই হবে। পাড়ার মুখ রেখেছিস, এটুকু তো করতেই হবে”। আকাশ বলল,” মনীশদা, গত বছরের মতো এবারও পিকনিক হবে তো ? আগের বছর পিকনিকটা তুমি দারুন অ্যারেঞ্জ করেছিলে।” মনীশ বলল,” আরে বাবা ,এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? সব হবে। আমি যখন আছি ,তোদের কোনো চিন্তা নেই।”
      শোনা যায় মনীশ কোথাও একটা চাকরি করে খুব বড় কিছু নয়, কিন্তু তার হাবেভাবে সবসময় একটা প্রচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠে। এবার মনীশ ছুটোছুটি করে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে পাড়ার বড় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অ্যাসেম্বলি হলে খুব বড় করে ড্রয়িং কম্পিটিশনের আয়োজন করেছে ।এখানে শুধু এপাড়ার নয় ,সারা কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছেলেমেয়েরা অংশ নিতে পারবে। তার নিজের দিকে তাকাবার সময় নেই। দিনরাত এক করে খাটছে। কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় পোস্টার লাগিয়েছে ,কিছুটা সাড়াও মিলেছে । অনেক ছেলেমেয়ে নাম দিয়েছে । ক্লাবের টাকা ছাড়াও মনীশ ভালো ভালো প্রাইজের ব্যবস্থা করার জন্য মোটা টাকা দিয়েছে। আঁকা নাচ-গান ক্রিকেট এগুলোর ব্যাপারে মনীশের যেন উৎসাহের অন্ত নেই।     সেদিন মনীশ ক্লাবঘরে মুড়ি- তেলেভাজা নিয়ে ঢুকল। মনীশ ক্লাবঘরে চায়েরও ব্যবস্থা করেছে, চা পাতা, গুঁড়ো দুধ ,চিনি সব মজবুত রাখে আর রাজু হিটারে দারুন চা বানায়। মুড়ি তেলেভাজা খেতে খেতে মনীশ একটার পর একটা জোকস বলছিল আর সকলের দমফাটা হাসিতে ক্লাবঘর যেন কাঁপছিল। এমন সময় নরেন বাবু ক্লাব ঘরে ঢুকে খুব বিশ্রী ভাবে মনীশকে অপমান করলেন,” মশাই ,শিং ভেঙ্গে বাছুরের দলে ঢুকেছেন, ন্যাংটার নেই বাটপারের ভয়। আপনার না আছে ঘর-সংসার না আছে আত্মীয়-স্বজন না কোনো দায়দায়িত্ব!  সারাদিন কি একটা টুকটাক চাকরি করেন আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ান ।পাড়ার অল্পবয়সী ছেলেগুলোকেও খেপিয়ে বেড়াচ্ছেন আর ছোট ছোট ছেলের পড়াশোনা মাথায় উঠেছে । সারাবছরই ফাংশন ,খেলাধুলো, পিকনিক নিয়ে মেতে রয়েছে। সংসারের দায়িত্ব পালন করতে হলে আপনার এই ফূর্তি হাসি গান সব বেরিয়ে যেত! আপনি এ পাড়ায় আসার পর থেকেই পাড়াটা একেবারে গোল্লায় গেছে। ক্লাবঘরে মনীশের সঙ্গে রনি টুনা অনি ও আরো অনেকে বসেছিল। ওরা শান্ত গলায় বলল,কাকু, কিছু মনে করবেন না। আপনি কোন কারণে বিরক্ত বা উত্তেজিত হয়ে আছেন। মনীশদার সঙ্গে আপনার এভাবে কথা বলা অন্যায়। মনীশদা এ পাড়ায় আসার পর থেকে পাড়াটা অনেক সুশৃংখল হয়েছে। খেলাধুলো নাচ-গান আঁকার মধ্যে দিয়ে পাড়ার ছেলেমেয়েরা সবদিক থেকে উন্নত হয়েছে। সকলকে পড়াশোনার ব্যাপারেও মনীশদা অনেক উৎসাহ দেয়, সেগুলো তো কই দেখতে পাচ্ছেন না? নরেন বাবু ঢোক গিলে বাধ্য হয়ে বললেন , “মাফ করবেন।সেটা তো ঠিকই আছে। তবে একটা কথা মনীশ বাবু ,পাড়ার সকলে কিন্তু আপনার এই অল্প বয়সী চামচাদের মত নয়। পাড়ার অনেকেই আপনার ওপর বিরক্ত ।আমি ঠোঁট কাটা মানুষ তাই মুখের উপর স্পষ্ট কথাটা বলে গেলাম। সেদিন ক্লাবঘরের আড্ডাটা আর ঠিক মতো জমল না।
  বেশ কদিন পর ক্লাবে স্পিড পোস্টে ড্রয়িং কম্পিটিশনের রেজাল্ট এল ।টুনা, রনি, জয় তখন ক্লাবে ছিল ।ওরা হই হই করে উঠলো । রনি বলল,”দাঁড়া দাঁড়া খামটা খুলিস না, মনীশদা খুলবে। রুনা বললো,”মনীশদা আজকে আসেনি। কাল পরশু আসবে কিনা ঠিক নেই। কে জানে কি হল! জয় বলল,” চল আমরা মনীশদার ফ্ল্যাটে গিয়ে খামটা দিয়ে আসি।” ওরা তিনজনে মনীশের ফ্লাটে গেল । কলিংবেল টেপার পর মনীশের চাকর রতনদা দরজা খুলে দিতেই ওরা হুড়মুড় করে ঢুকে চিৎকার করে উঠল,”মনীশদা মনীশদা”। রতন গম্ভীর মুখে বলল,”দাদাবাবু তো বাড়ি নেই। দাদা আজ সকাল বেলা বেলুড় মঠ চলে গেছে, রাতে ফিরবে বলেছে। সিটিং রুমের কোণে একটা টেবিলে সাদা টেবিল ক্লথ পাতা তার ওপর একটা ছবি রাখা । ছবিতে একজন ভদ্রমহিলা হাসছেন তার দুপাশে দুটো ছেলেমেয়ে,তারাও হাসছে। ছবিটা খুব প্রাণবন্ত। ছবিটায় মালা পরানো, দুপাশে দুটো ফুলদানি, তাতে গোলাপ ফুলের গোছা, সামনে ধুপ জ্বলছে। ওরা হতভম্ব হয়ে তিনজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। রতন দা বলল,”তোমরা বস আমি তোমাদের জন্য চা করি।” ওরা বলল,”আমাদের চা দরকার নেই, তুমি বরং মনীশদার কথা বল” ওরা সোফায় বসে পড়ল। রতনদা চোখ মুছে বলল,”কি বলি বলতো, তোমরা কেউ আমার দাদাবাবুকে সম্পূর্ণ চেননা। দাদাবাবুর যে হাসি খুশি ভরা রূপটা তোমরা দেখো ওটা আসলে দাদাবাবুর একটা আবরণ। আমি ১৮/১৯ বছর দাদা বাবুর কাছে আছি তাই আমি জানি এই আনন্দময় মানুষটার আড়ালে লুকোনো আসল দুঃখী মানুষটাকে। দাদাবাবু চোখের জল হাসি দিয়ে ঢেকে রাখে। নিজের দুঃখ কাউকে বুঝতে দেয় না। অত দুঃখেও কারো সামনে কাঁদতে দেখিনি অথচ নিজের মধ্যে গুমরে মরে। দুঃখী মানুষটা আসলে হাসির আবরণে মোড়া।
          দাদাবাবুর আসল বাড়ি মানিকতলায়,খুব বড় বংশের ছেলে ও খুব শিক্ষিত। অনেক বড় চাকরি করতো একটা কোম্পানির ডিরেক্টর ছিল। বৌদিমণি ছিল খুব সুন্দর। খুব সুন্দর ছবি আঁকতো। ওই দেখো না,সব দেয়ালে বৌদিমণির আঁকা ছবি। দাদাবাবুর একটা ছেলে একটা মেয়ে ছিল। তারা যেমন সুন্দর দেখতে তেমনি সভ্য-ভদ্র। দুজনে ইংরেজি স্কুলে পড়তো। দাদাবাবু খুব ভালো গান গাইত। বাড়িটা সব সময় হাসি গান-নাচ আনন্দে জমজমাট হয়ে থাকতো। মনে হত পৃথিবীতে যেন কোন দুঃখ নেই, আছে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। মনীশদার ছোট্ট ফ্ল্যাটটার চারিদিকে ছেলে মেয়ে দুটোর প্রাণবন্ত সব ছবি। কোনটায় ছেলেটা ক্রিকেট খেলছে, মেয়েটা নাচছে, কোথাও মনীশদা বৌদির দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে একটা সুখী পরিবারের ছবি। সে যেন এক আনন্দময় স্বপ্ন জগতের ছবি। তারপর এল সেই অভিশপ্ত দিন। বৌদিমণির বাপের বাড়ি ছিল কালিম্পং। বাচ্চাদের গরমের ছুটিতে ছেলেমেয়েকে নিয়ে বৌদিমণি বাপের বাড়ি যাচ্ছিল। কথা ছিল এক মাস পর এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে দাদাবাবু ওদের কালিম্পং থেকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনবে, কিন্তু ওদের যাবার পথেই ঘটে গেল সেই অঘটন। পাহাড়ি সরু রাস্তার ধারে গভীর খাদে গাড়িটা তলিয়ে গেল। অনেক কষ্টে পুলিশ ড্রাইভার সমেত চার জনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছিল। একটা প্রাণবন্ত ভরাভর্তি সংসার নিমেষে নিঃস্ব হয়ে গেল। আমার দাদাবাবুর জীবনে নাচ-গান আনন্দ কেড়ে নিয়ে ভগবান মানুষটাকে যেন জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিলেন। দাদাবাবু অত বড় চাকরিটা ছেড়ে দিল। দিন রাত ওদের ছবির সামনে বসে কাঁদত, ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করত না। অত হাসিখুশি মানুষটা নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়ে গৃহবন্দী করে ফেলল। সময় আবার মানুষের মনকে শান্ত করে। দাদাবাবু স্বাভাবিক হতে লাগলো। একটা ছোটখাটো চাকরি জোগাড় করল। অত বড় পৈতৃক বাড়িখানা বিক্রি করে ওই তল্লাট,পরিচিত পরিবেশ সবকিছু ছেড়ে এই ছোট্ট ফ্ল্যাটটা কিনে এখানে এসে উঠলো। বাইরে থেকে এমন হাসিখুশি গানে ভরা মানুষটাকে দেখে কেউ তার ভিতরের আসল মানুষটাকে চিনতেও পারবেনা। আজ ৫ বছর পূর্ণ হল দাদাবাবুর সবচেয়ে কাছের মানুষগুলো দাদাবাবুকে ছেড়ে চলে গেছে। দাদাবাবু আজ ভোর রাতে উঠে স্নান সেরে ছবিতে মালা পরিয়ে ফুল দিয়ে সাজিয়ে ছবির সামনে অনেকক্ষণ বসে ছিল। দুচোখ বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল। ফ্ল্যাটের পরিবেশ থমথম করছে। কলিংবেল বেজে উঠলো। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে রনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত নটা বেজে গেছে। তারা এসেছিল সন্ধে সাতটা নাগাদ। রতনদা দরজা খুলল। সামনে মনীশদা দাঁড়িয়ে, চুল গুলো উস্কোখুস্কো, চোখদুটো টকটকে লাল। সকলকে দেখে মনীশদা কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে ঘরে ঢুকে গেল। রনি টুনা জয় মাথা নিচু করে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলো।
***************************************
রমা চ্যাটার্জি পরিচিতি – গল্প লেখা এঁনার নেশা। বাস্তব ঘটনা অবলম্বন করে নিজের খেয়ালে নিজের আনন্দে লিখে যান ।

 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!